পুঁজি ও বিনিয়োগ -না জেনে শেয়ার কিনতে নেই by আবু আহমেদ
আমাকে অনেকে শেয়ারবাজার নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কোন শেয়ার কিনলে লাভ হবে। আবার অনেকে জিজ্ঞেস করেন, ওই শেয়ারটা ভালো কি না। তাঁদের জিজ্ঞাসা শুনে মনে হয়, তাঁরা নিজেরা কিছু জানেন না, জানলেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানেন না। তবে এ কথাও সত্য, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বহু দিন ধরে শেয়ারবাজারে আছেন এমন লোকদের বিনিয়োগ নিয়ে আচরণ দেখলে আমাকে হতাশই হতে হয়। আবার অনেকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফাঁকফোকরগুলো ঠিকই বুঝে উঠতে সক্ষম হন। আমার এক সহকর্মী আছেন, যিনি পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছেন, তিনি শেয়ার বেচাকেনার কিছু চার্ট তৈরি করে বললেন, এই অবস্থায় এই শেয়ারের মূল্য বাড়ার কথা। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, এটা মূল্য-ট্রেন্ড বোঝার জন্য অবশ্যই একটা ভালো পদ্ধতি, তবে এর সঙ্গে আরও অনেক উপাদানকে হিসাবে নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার আরেকজন পরিচিত বড় বিনিয়োগকারী আছেন, যিনি শুধু মার্কেট-ট্রেন্ডকে আমলে নিয়ে বেচাকেনার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কথা হলো, বাজারের সঙ্গে থাকা ভালো। এর অন্য অর্থ হলো, জুয়াড়িরা যদি মার্কেট ট্রেন্ড ঠিক করে দেয়, তাহলে তিনি ওইটার পেছনে দৌড়াতেও প্রস্তুত। আমার পদার্থবিজ্ঞানের সহকর্মীর শেয়ারবাজারে আগমন বেশি দিনের নয়। তবে বাজারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তিনি বোঝার আগেই এমন কিছু শেয়ার কিনেছেন, যেগুলো থেকে ইতিমধ্যে পুঁজির এক-তৃতীয়াংশ হারিয়েছেন। তাঁর অন্য অসুবিধা হলো, শেয়ারবাজার বোঝার পর নতুন করে পুঁজি জোগানোর ক্ষমতা আর নেই। এভাবে অনেকেই আছেন যাঁরা বোঝার আগেই পুঁজির বৃহদাংশ হারিয়েছেন। তাঁরা কিন্তু শেয়ারবাজারের ওপর বেজায় রাগ। এ ব্যাপারটা বেশি ঘটছে কথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা শেয়ারের মূল্যের ব্যাপারে কোনো ভালো বই, ভালো ব্যাখ্যামূলক রিপোর্ট তো পড়েননি, বরং ভালো বোঝেন এমন লোকদের কাছ থেকেও এই নিয়ে কিছু শুনেননি।
তাঁরা বিনিয়োগকারী হয়েছেন বন্ধুর কথায় অথবা খবরের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে। শেয়ারবাজার যখন তুঙ্গে থাকে, তখন ক্লাব-সোসাইটি, বিশেষ বিশেষ দোকান এই নিয়ে সরগরম থাকে। আর তখনই নতুনেরা এই বাজারে দলে দলে ভর্তি হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ধারণা জন্মেছে যে শেয়ারকে ধরে রাখতে নেই, চার দিনের মাথায় অথবা আরও একটু সবুর করে ঝটপট বিক্রি করে দিলেই লাভ বেশি হয়। তাঁরা তাঁদের এই কাজের নাম দিয়েছেন ‘শেয়ার ব্যবসা’। আমি কক্সবাজারে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের একটা সমাবেশে বলেছিলাম, ‘আপনারা আপনাদের এই বিনিয়োগকে শেয়ার ব্যবসা বলছেন কেন, এটা তো একটা বিনিয়োগ।’
বিনিয়োগ একটা সম্মানিত কাজ, আর শেয়ার ব্যবসা তো একটা হালকা কাজ। কিন্তু তাতে যে আমি তাঁদের মন জয় করতে পেরেছি, তা নয়। তাঁরা এবং অন্যত্র অন্যরাও একটা ভাবনায় ভুগছেন যে চট-জলদি লাভকে ঘরে তুলতে না পারলে লাভ হারিয়ে যাবে। চার দিনের ট্রেডাররা এ জন্যই হন্যে হয়ে ছুটছেন কোন শেয়ারে লাভ করা যাবে তার সন্ধানে। আর তাঁদের জন্য ওই ট্রেন্ডটা সেট করে দিচ্ছে একঝাঁক জুয়াড়ি। জুয়াড়িরা যে দলবদ্ধভাবে চলে, তা নয়। তারাও বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকে, আবার বিচ্ছিন্নও থাকে। তাদের প্রথম কাজ হলো মূল্যকে উসকে দেওয়া, উসকাতে গিয়ে তারা গুজব, মিথ্যা তথ্য ইত্যাদি ছড়ায়। কখনো কখনো তাদের এই কাজের সঙ্গে কোম্পানির মালিকেরাও থাকেন। তাই অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর বদ্ধমূল ধারণা হলো, শেয়ারের মৌলভিত্তি তথা আয় ও সম্ভাবনা—এসব অর্থহীন, বরং কোন শেয়ারের মূল্য বাড়বে সেটা জানতে পারলেই কাজ হবে। এক হাউজিং কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেড়ে গেল মাত্র দুই মাসে ৩০০ শতাংশ। চারদিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এল, ওই কোম্পানির বিরাট ল্যান্ড ব্যাংক আছে এবং পুনর্মূল্যায়ন করলে নেট অ্যাসেট ভ্যালু অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হলো, নেট অ্যাসেট ভ্যালু বাড়লে কি শেয়ারের আয় এবং মুনাফা দেওয়ার ক্ষমতা বাড়বে? তখন আর কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া গেল না। যাঁরা শেয়ারবাজারে আছেন, তাঁরাই শুধু প্রশ্ন জিজ্ঞাস করেন না, বাইরের কিছু লোকও এই নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমার বক্তৃতা শুনে দু-চারজন দাঁড়িয়ে বলেন, এটা তো জিরো-সাম গেইম, অর্থাত্ একজনের লাভ অন্যজনের ক্ষতি। যতই আমি বোঝাতে চেষ্টা করি না কেন যে এটা যোগফলের শূন্যের অঙ্ক নয়, এটাতেও সবাই একসঙ্গে জিততে পারে, তবুও আমি তাঁদের বিশ্বস্তভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে হয় না। অন্য কিছু লোকে প্রশ্ন করে, শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানির কী লাভ হয়। এতে তো কোম্পানি নতুন করে পুঁজি পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রেও আমি বোঝাতে চেষ্টা করি যে এতে কোম্পানির লাভ হয়, কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে। শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানির যে লাভ হয় না, এ ধারণাটা অনেক শিক্ষিত লোকের মধ্যেও আছে। একবার আমি রেভিনিউ রিফর্ম কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলাম। সেখানে আরও চারজন গণ্যমান্য এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিও কাজ করছিলেন। আমি যখন বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে আমাদের ছোট পুঁজিবাজারে কিছু ট্যাক্স-সুবিধা দেওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি দিচ্ছিলাম, তখন একজন সদস্য বলে উঠলেন, ট্যাক্স কমিয়ে কেন পুঁজিবাজারকে উত্সাহ দিতে হবে? আর শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানিগুলোরই বা কী লাভ হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি যদিও ট্যাক্স প্রশাসনে কাজ করেছেন, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের জগত্ সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা নেই। উত্সাহ দিয়ে পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধি করায় তিনি বিশ্বাসী নন। পরে অবশ্য আমার চাপাচাপিতে এবং চেয়ারম্যান মহোদয়ের সমর্থনে ফাইনাল রিপোর্টে শেয়ারবাজারে কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়ার পক্ষে বলা হয়েছিল। শেয়ারবাজার এগিয়েছে বটে, তবে বেশি এগিয়েছে আমাদের বিনিয়োগকারীরা, অন্তত সংখ্যায়। তাদের শেয়ার চাহিদা-ক্ষুধাকে মিটাতেই আমার মতো লোক বারবার সরকারি শেয়ারগুলো বেচার পক্ষে বলতে থাকে। অবশ্য এই বেচার পক্ষে অন্য যুক্তিও আছে। আমাদের সমাজে অনেক বুঝের লোক আছেন, আবার শিক্ষিত অবুঝ লোকও আছেন। সবার মন রক্ষা করে সরকার শেয়ার বেচার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, পারলেও বাস্তবায়ন করতে পারবে না। একটা স্বার্থ এক পক্ষকে বলবে ‘না’, অন্য বৃহত্ স্বার্থ সরকারকে বলবে, হ্যাঁ। তবে ‘হ্যাঁ’ এখনো জয়যুক্ত হয়নি। ছোট্ট কোটারি যারা ‘না’-এর পক্ষে, তারা আজও জয়ী হয়ে চলেছে। শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাঁচা প্রশ্ন হলো, কোন শেয়ার ভালো। এটাও শিক্ষিত লোকদের প্রশ্ন। তবে সহজ উত্তর হলো, সব শেয়ারই ভালো, যদি বিনিয়োগকারী লাভ করতে পারে। একদিন আমার শিক্ষকতুল্য এক বিনিয়োগকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি না ওই শেয়ারকে ভালো বলেছিলে, এখন আবার ‘না’ বলছ কেন।’ আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওটাই তো বলেছিলাম একটা মূল্যে, এখন মূল্য বেড়ে গেছে, তাই শেয়ার ভালো হলেও সেটা উপযুক্ত মনে করছি না। ওই ঘটনা থেকে আমি তাঁর সামনে পারতপক্ষে আর পড়তে চাই না। পড়লেও অন্য কথায় চলে যাই। যা হোক, শেয়ারবাজার নিয়ে জানা লোকেরাই বেশি জানার চেষ্টা করে। এটা এ জন্যই, একে তো তারা তাতে মজা পায়; অন্য কথা হলো, একেকজনের জ্ঞান একেক রকম। কেউ অনেক উঁচুস্তরের শেয়ার-সাহিত্য পড়ে, কেউ শুধু দেখা থেকে শিখে, কেউ আগেই ভেতরের খবর জানে। তাই বন্ধুরা ক্লাবে আড্ডা দেয়, ফোনে কথা বলে, কিন্তু বিষয় একটাই—নতুন করে কিছু জানা। আমি বিনিয়োগকারীদের সমাবেশে অনেক বক্তৃতা দিয়েছি। আমার বৈশিষ্ট্য হলো, কথা বলতে বলতে ব্ল্যাকবোর্ড বা সাদা বোর্ডে কিছু লেখা, অধিকাংশ সময় অতি সাধারণ সমীকরণ বা উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক। আমার কাছে বোর্ডে লিখতে ভালো লাগে এ জন্য যে, আমি শ্রোতার বা দর্শকের প্রশ্নের উত্তর সহজ একটা অঙ্ক বা সমীকরণ লিখে তাত্ক্ষণিকভাবে দিতে পারি। এতে উপস্থিত বিনিয়োগকারীরা বেশি উপকৃত হয় বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু অনেক জানেন এমন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে আমার অধিক ভালো লাগে এই অর্থে যে আমি তাঁদের থেকে অনেক জানতে পারি। আমার অনেক ছাত্রও এখন বিনিয়োগ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান। তারা আমাকে দেখলে অনেক সম্মান করে এবং আমিও ভাবি সেই অনেক আগে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নের সময় ওদেরকে ভ্যালুয়েশন, আয় হিসাব, পুঁজি আহরণ নিয়ে যেসব কথা বলেছি, আজ তারা ওই সব বিষয়কে আরও শাণিত করে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজে লাগাচ্ছে। শেয়ার এবং কোম্পানি, অর্থনীতি নিয়ে জানার কোনো বিকল্প নেই। জানার জন্য বাংলাদেশে অনেক উত্স নেই। সনাতনী উত্স থেকেই আমাদের যা জানার, জানতে হবে। একেবারেই না জেনে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে নেই। বই-পুস্তক মোটামুটি একটা জ্ঞান দেয়। তবে ওই জ্ঞানের সঙ্গে চলতি জ্ঞানের সংযোগ ঘটাতে পারলে জানার ব্যাপারটা উঁচুতে পৌঁছে। অনেকে আমাকেও অনুরোধ করেছে তাদের জন্য কিছু লিখতে। তাদের ইচ্ছায় সাড়া দিতে গিয়ে আমি নিজেও ছোট্ট একটি বই লিখেছি, যা এখন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে পাওয়া যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে শিক্ষিত হয়ে ভালো আচরণ করবে—সেই লক্ষ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং রেগুলেটরও কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যকে অনেকে বিশ্লেষণ করে নিজের কাজে লাগাতে অপারগ হন। এটাও সহজ হয়ে যাবে যদি মৌলিক বিষয়গুলোকে একবার জানা যায়। বিভিন্ন হাউজ তাদের গবেষণা রিপোর্টও বের করছে। ওইগুলোও দেখা যেতে পারে। অনেক উদ্যোগী লোক এই বাজার নিয়ে সাপ্তাহিক-পাক্ষিক সাময়িকীও বের করেছেন। ওইগুলোও দেখা যেতে পারে। অডিট রিপোর্ট বা বার্ষিক প্রতিবেদনকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে একটু সময় নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিন। উপকার পাবেন। অভিজ্ঞতা থেকে হোক, পড়ে হোক, এই দুইয়ের সম্মিলন ঘটিয়ে হোক, কিছু জেনে শেয়ারে বিনিয়োগ করুন, দেখবেন আপনি হারবেন না।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢা.বি.।
তাঁরা বিনিয়োগকারী হয়েছেন বন্ধুর কথায় অথবা খবরের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে। শেয়ারবাজার যখন তুঙ্গে থাকে, তখন ক্লাব-সোসাইটি, বিশেষ বিশেষ দোকান এই নিয়ে সরগরম থাকে। আর তখনই নতুনেরা এই বাজারে দলে দলে ভর্তি হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ধারণা জন্মেছে যে শেয়ারকে ধরে রাখতে নেই, চার দিনের মাথায় অথবা আরও একটু সবুর করে ঝটপট বিক্রি করে দিলেই লাভ বেশি হয়। তাঁরা তাঁদের এই কাজের নাম দিয়েছেন ‘শেয়ার ব্যবসা’। আমি কক্সবাজারে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের একটা সমাবেশে বলেছিলাম, ‘আপনারা আপনাদের এই বিনিয়োগকে শেয়ার ব্যবসা বলছেন কেন, এটা তো একটা বিনিয়োগ।’
বিনিয়োগ একটা সম্মানিত কাজ, আর শেয়ার ব্যবসা তো একটা হালকা কাজ। কিন্তু তাতে যে আমি তাঁদের মন জয় করতে পেরেছি, তা নয়। তাঁরা এবং অন্যত্র অন্যরাও একটা ভাবনায় ভুগছেন যে চট-জলদি লাভকে ঘরে তুলতে না পারলে লাভ হারিয়ে যাবে। চার দিনের ট্রেডাররা এ জন্যই হন্যে হয়ে ছুটছেন কোন শেয়ারে লাভ করা যাবে তার সন্ধানে। আর তাঁদের জন্য ওই ট্রেন্ডটা সেট করে দিচ্ছে একঝাঁক জুয়াড়ি। জুয়াড়িরা যে দলবদ্ধভাবে চলে, তা নয়। তারাও বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকে, আবার বিচ্ছিন্নও থাকে। তাদের প্রথম কাজ হলো মূল্যকে উসকে দেওয়া, উসকাতে গিয়ে তারা গুজব, মিথ্যা তথ্য ইত্যাদি ছড়ায়। কখনো কখনো তাদের এই কাজের সঙ্গে কোম্পানির মালিকেরাও থাকেন। তাই অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর বদ্ধমূল ধারণা হলো, শেয়ারের মৌলভিত্তি তথা আয় ও সম্ভাবনা—এসব অর্থহীন, বরং কোন শেয়ারের মূল্য বাড়বে সেটা জানতে পারলেই কাজ হবে। এক হাউজিং কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বেড়ে গেল মাত্র দুই মাসে ৩০০ শতাংশ। চারদিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এল, ওই কোম্পানির বিরাট ল্যান্ড ব্যাংক আছে এবং পুনর্মূল্যায়ন করলে নেট অ্যাসেট ভ্যালু অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হলো, নেট অ্যাসেট ভ্যালু বাড়লে কি শেয়ারের আয় এবং মুনাফা দেওয়ার ক্ষমতা বাড়বে? তখন আর কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া গেল না। যাঁরা শেয়ারবাজারে আছেন, তাঁরাই শুধু প্রশ্ন জিজ্ঞাস করেন না, বাইরের কিছু লোকও এই নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমার বক্তৃতা শুনে দু-চারজন দাঁড়িয়ে বলেন, এটা তো জিরো-সাম গেইম, অর্থাত্ একজনের লাভ অন্যজনের ক্ষতি। যতই আমি বোঝাতে চেষ্টা করি না কেন যে এটা যোগফলের শূন্যের অঙ্ক নয়, এটাতেও সবাই একসঙ্গে জিততে পারে, তবুও আমি তাঁদের বিশ্বস্তভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে হয় না। অন্য কিছু লোকে প্রশ্ন করে, শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানির কী লাভ হয়। এতে তো কোম্পানি নতুন করে পুঁজি পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রেও আমি বোঝাতে চেষ্টা করি যে এতে কোম্পানির লাভ হয়, কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে। শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানির যে লাভ হয় না, এ ধারণাটা অনেক শিক্ষিত লোকের মধ্যেও আছে। একবার আমি রেভিনিউ রিফর্ম কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করছিলাম। সেখানে আরও চারজন গণ্যমান্য এবং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিও কাজ করছিলেন। আমি যখন বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে আমাদের ছোট পুঁজিবাজারে কিছু ট্যাক্স-সুবিধা দেওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি দিচ্ছিলাম, তখন একজন সদস্য বলে উঠলেন, ট্যাক্স কমিয়ে কেন পুঁজিবাজারকে উত্সাহ দিতে হবে? আর শেয়ারের মূল্য বাড়লে কোম্পানিগুলোরই বা কী লাভ হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি যদিও ট্যাক্স প্রশাসনে কাজ করেছেন, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের জগত্ সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা নেই। উত্সাহ দিয়ে পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধি করায় তিনি বিশ্বাসী নন। পরে অবশ্য আমার চাপাচাপিতে এবং চেয়ারম্যান মহোদয়ের সমর্থনে ফাইনাল রিপোর্টে শেয়ারবাজারে কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়ার পক্ষে বলা হয়েছিল। শেয়ারবাজার এগিয়েছে বটে, তবে বেশি এগিয়েছে আমাদের বিনিয়োগকারীরা, অন্তত সংখ্যায়। তাদের শেয়ার চাহিদা-ক্ষুধাকে মিটাতেই আমার মতো লোক বারবার সরকারি শেয়ারগুলো বেচার পক্ষে বলতে থাকে। অবশ্য এই বেচার পক্ষে অন্য যুক্তিও আছে। আমাদের সমাজে অনেক বুঝের লোক আছেন, আবার শিক্ষিত অবুঝ লোকও আছেন। সবার মন রক্ষা করে সরকার শেয়ার বেচার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, পারলেও বাস্তবায়ন করতে পারবে না। একটা স্বার্থ এক পক্ষকে বলবে ‘না’, অন্য বৃহত্ স্বার্থ সরকারকে বলবে, হ্যাঁ। তবে ‘হ্যাঁ’ এখনো জয়যুক্ত হয়নি। ছোট্ট কোটারি যারা ‘না’-এর পক্ষে, তারা আজও জয়ী হয়ে চলেছে। শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাঁচা প্রশ্ন হলো, কোন শেয়ার ভালো। এটাও শিক্ষিত লোকদের প্রশ্ন। তবে সহজ উত্তর হলো, সব শেয়ারই ভালো, যদি বিনিয়োগকারী লাভ করতে পারে। একদিন আমার শিক্ষকতুল্য এক বিনিয়োগকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি না ওই শেয়ারকে ভালো বলেছিলে, এখন আবার ‘না’ বলছ কেন।’ আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওটাই তো বলেছিলাম একটা মূল্যে, এখন মূল্য বেড়ে গেছে, তাই শেয়ার ভালো হলেও সেটা উপযুক্ত মনে করছি না। ওই ঘটনা থেকে আমি তাঁর সামনে পারতপক্ষে আর পড়তে চাই না। পড়লেও অন্য কথায় চলে যাই। যা হোক, শেয়ারবাজার নিয়ে জানা লোকেরাই বেশি জানার চেষ্টা করে। এটা এ জন্যই, একে তো তারা তাতে মজা পায়; অন্য কথা হলো, একেকজনের জ্ঞান একেক রকম। কেউ অনেক উঁচুস্তরের শেয়ার-সাহিত্য পড়ে, কেউ শুধু দেখা থেকে শিখে, কেউ আগেই ভেতরের খবর জানে। তাই বন্ধুরা ক্লাবে আড্ডা দেয়, ফোনে কথা বলে, কিন্তু বিষয় একটাই—নতুন করে কিছু জানা। আমি বিনিয়োগকারীদের সমাবেশে অনেক বক্তৃতা দিয়েছি। আমার বৈশিষ্ট্য হলো, কথা বলতে বলতে ব্ল্যাকবোর্ড বা সাদা বোর্ডে কিছু লেখা, অধিকাংশ সময় অতি সাধারণ সমীকরণ বা উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক। আমার কাছে বোর্ডে লিখতে ভালো লাগে এ জন্য যে, আমি শ্রোতার বা দর্শকের প্রশ্নের উত্তর সহজ একটা অঙ্ক বা সমীকরণ লিখে তাত্ক্ষণিকভাবে দিতে পারি। এতে উপস্থিত বিনিয়োগকারীরা বেশি উপকৃত হয় বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু অনেক জানেন এমন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে আমার অধিক ভালো লাগে এই অর্থে যে আমি তাঁদের থেকে অনেক জানতে পারি। আমার অনেক ছাত্রও এখন বিনিয়োগ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান। তারা আমাকে দেখলে অনেক সম্মান করে এবং আমিও ভাবি সেই অনেক আগে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নের সময় ওদেরকে ভ্যালুয়েশন, আয় হিসাব, পুঁজি আহরণ নিয়ে যেসব কথা বলেছি, আজ তারা ওই সব বিষয়কে আরও শাণিত করে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজে লাগাচ্ছে। শেয়ার এবং কোম্পানি, অর্থনীতি নিয়ে জানার কোনো বিকল্প নেই। জানার জন্য বাংলাদেশে অনেক উত্স নেই। সনাতনী উত্স থেকেই আমাদের যা জানার, জানতে হবে। একেবারেই না জেনে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে নেই। বই-পুস্তক মোটামুটি একটা জ্ঞান দেয়। তবে ওই জ্ঞানের সঙ্গে চলতি জ্ঞানের সংযোগ ঘটাতে পারলে জানার ব্যাপারটা উঁচুতে পৌঁছে। অনেকে আমাকেও অনুরোধ করেছে তাদের জন্য কিছু লিখতে। তাদের ইচ্ছায় সাড়া দিতে গিয়ে আমি নিজেও ছোট্ট একটি বই লিখেছি, যা এখন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে পাওয়া যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে শিক্ষিত হয়ে ভালো আচরণ করবে—সেই লক্ষ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং রেগুলেটরও কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যকে অনেকে বিশ্লেষণ করে নিজের কাজে লাগাতে অপারগ হন। এটাও সহজ হয়ে যাবে যদি মৌলিক বিষয়গুলোকে একবার জানা যায়। বিভিন্ন হাউজ তাদের গবেষণা রিপোর্টও বের করছে। ওইগুলোও দেখা যেতে পারে। অনেক উদ্যোগী লোক এই বাজার নিয়ে সাপ্তাহিক-পাক্ষিক সাময়িকীও বের করেছেন। ওইগুলোও দেখা যেতে পারে। অডিট রিপোর্ট বা বার্ষিক প্রতিবেদনকে ছুড়ে ফেলে না দিয়ে একটু সময় নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিন। উপকার পাবেন। অভিজ্ঞতা থেকে হোক, পড়ে হোক, এই দুইয়ের সম্মিলন ঘটিয়ে হোক, কিছু জেনে শেয়ারে বিনিয়োগ করুন, দেখবেন আপনি হারবেন না।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢা.বি.।
No comments