ইউরোপ -২০ বছরের হিসাব-নিকাশ-স্লাভো জিজেক
২০ বছর আগে ৯ নভেম্বর বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটে। ঐতিহাসিক সেই দিনের ওপর জোর দিতে গিয়েবলা হয়: সেদিন যেন স্বপ্ন সত্যি হলো, তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল কমিউনিস্ট শাসন, হঠাত্ দুনিয়ার গতিপথে এমন পরিবর্তন ঘটে গেল, যা মাত্র কয়েক মাস আগেও ছিল ধারণার বাইরে। পোল্যান্ডে বসে কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, নির্বাচন হবে অবাধ আর তাতে জিতে প্রেসিডেন্ট হবেন লেস ওয়ালেসা?
অবশ্য নতুন গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বাস্তবতায় মখমল বিপ্লবের মহিমা মলিন হতে সময় লাগেনি। প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণ অনিবার্য হতাশাকে আশ্রয় করে পথ হাতড়ানোর চেষ্টা করে। ‘পুরোনো মহান’ কমিউনিস্ট সময়ের প্রতি স্মৃতিবিধুরতা; দক্ষিণপন্থী, জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয়তামুখিতা; এবং নতুন কমিউনিস্টবিরোধী বিকারের মাধ্যমে পালাক্রমে এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।
প্রথম দুটি প্রক্রিয়া সহজে অনুধাবনযোগ্য। কয়েক দশক আগেও যেসব ডানপন্থী ‘কমিউনিজমের থেকে মৃত্যু শ্রেয়’ বলে গলা ফাটাত, তাদেরই আজ অস্ফুট স্বরে মাঝেমধ্যে বলতে শোনা যায়, ‘হ্যামবার্গার খাওয়ার চেয়ে কমিউনিজম শ্রেয়।’ কিন্তু কমিউনিস্ট স্মৃতিবিধুরতাকে খুব গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত হবে না: এ স্মৃতিবিধুরতায় সমাজতান্ত্রিক ধূসর বাস্তবতায় ফিরে যাওয়ার কোনো প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা নেই, এটি আসলে শোক পালন, অতীত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটি আচার। অন্যদিকে জনপ্রিয়তামুখী ডানপন্থীদের উত্থান কেবল পূর্ব ইউরোপেই ঘটেনি, বিশ্বায়নের আবর্তে আটকে পড়া সব দেশেই এর দেখা মেলে।
হাঙ্গেরি থেকে স্লোভেনিয়া পর্যন্ত কমিউনিজম-বিরোধিতার সাম্প্রতিক পুনরুত্থান বরং অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। ২০০৬ সালের হেমন্তে হাঙ্গেরির ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীরা দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে আগের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের যোগসূত্রকে দায়ী করে। কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী এই ক্ষমতাসীন দল, তাই এই সংকট, এমন কথা ওঠে। বিক্ষোভকারীরা সরকারের বৈধতাকেই প্রত্যাখ্যান করে, যদিও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সোভিয়েত ফৌজ যেভাবে ১৯৫৬ সালের কমিউনিস্টবিরোধী বিদ্রোহ দমন করেছিল, তার সঙ্গে তুলনা করা হতে থাকে নাগরিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পুলিশের ভূমিকার।
এই নব্য কমিউনিস্টবিরোধী আতঙ্ক এমনকি প্রতীকের পিছু নিতেও ছাড়েনি। ২০০৮ সালের জুন মাসে লিথুয়ানিয়া আইন করে কাস্তে-হাতুড়ির মতো কমিউনিস্ট প্রতীকের প্রদর্শনী এবং সোভিয়েত জাতীয় সংগীত বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে পোলিশ সরকার টোটালিটেরিয়ান প্রপাগান্ডার ওপর নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়িয়ে তাতে কমিউনিস্ট বই, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসার প্রস্তাব করে: তাহলে হয়তো চে গুয়েভারার ছবিসংবলিত কোনো টি-শার্ট পরার কারণেও কেউ গ্রেপ্তারের শিকার হতে পারত। স্লোভেনিয়ায় বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের প্রধান সমালোচনা, তারা পুরোনো কমিউনিস্ট শাসনেরই জের।
কমিউনিস্টবিরোধিতার পুনরুজ্জীবনের এই শক্তির উত্স কী? যেসব দেশের তরুণেরা কমিউনিস্ট যুগ দেখেনি, তাদের আবার কমিউনিজমের ভয় ধরানো কেন? এসব প্রশ্নের একটি সরল উত্তর মিলবে নতুন কমিউনিস্টবিরোধিতার মধ্যেই, ‘পুঁজিবাদ সত্যিই যদি সমাজতন্ত্র থেকে এত ভালোই হবে, তবে কেন আমাদের এখনো এত করুণ জীবন যাপন করতে হয়?’
অনেকে মনে করে, এর কারণ আমরা সত্যিকারের পুঁজিবাদের মধ্যে বাস করছি না: সত্যিকারের গণতন্ত্রের দেখা আমরা এখনো পাইনি, শুধু গণতন্ত্রের মুখোশে আমাদের নিরন্তর ভাওতা দেওয়া হচ্ছে; পুরোনো অশুভ শক্তি এখনো ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছে, সাবেক কমিউনিস্টদের এক অংশ নতুন মালিক ও ম্যানেজাররূপে আবির্ভূত হয়েছে। সত্যিকারে কিছুই বদলায়নি। তাই আবারও বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে...অথচ পুঁজিবাদের এমন চিত্রকেই গতানুগতিক বামপন্থীরা সবচেয়ে বেশি গালি দেয়। এ সমাজের আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র শুধু সংখ্যালঘু সম্পদশালীদের শাসনকে আড়াল করে রাখে। অন্যভাবে বলা যায়, আজকের কমিউনিস্টবিরোধীরা বুঝতে পারে না, যে ব্যবস্থাকে তারা বিপথগামী ছদ্ম পুঁজিবাদী হিসেবে প্রকাশ্যে নিন্দা জানাচ্ছে, তা আসলে পুঁজিবাদী।
এ জন্যই এখন চীনে এত অস্থিরতা। সব সময় পুঁজিবাদকে মনে হয় গণতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য গাঁটছড়া বাঁধা। পুঁজিবাদের বিস্ফোরণের পটভূমিতে অনেক বিশ্লেষক এখনো মনে করেন, চীনে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অনিবার্যভাবে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করবে।
কিন্তু এই কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদ যদি উদারনৈতিক পুঁজিবাদের চেয়ে অধিকতর কার্যকর, অধিকতর লাভজনক বলে প্রমাণিত হয় তবে? গণতন্ত্র যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ও স্বাভাবিক পরিণতি না হয়ে বরং প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে তাহলে কী হবে? এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট-উত্তর দেশগুলোতে পুঁজিবাদের প্রতি আশাভঙ্গকে পুঁজিবাদের স্বরূপ না চেনা জনগণের ‘অপরিণত’ প্রত্যাশার চিহ্ন হিসেবে খারিজ করে দেওয়া উচিত নয়।
পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মানুষের বিরাট অংশ পুঁজিবাদ চায়নি। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা চেয়েছেন, নিজের ইচ্ছামতো একত্র হওয়ার ও কথা বলার স্বাধীনতা চেয়েছেন। যে জীবন সরলতা ও আন্তরিকতার, সেকেলে মতাদর্শিক অনুশাসন ও প্রচলিত নৈরাশ্যবাদী ভণ্ডামি থেকে মুক্ত, সে জীবন তারা চেয়েছেন। যেসব আদর্শকে সামনে রেখে বিক্ষোভকারীরা মাঠে নেমেছিল, সেগুলো অনেকাংশে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ থেকেই নেওয়া। জনগণের সেসব আকাঙ্ক্ষাকে বলা যেতে পারে ‘সমাজতন্ত্রের মানবিক রূপ।’
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ভিক্টর ক্রেভচেঙ্কোর কথা। এই সোভিয়েত প্রকৌশলী ১৯৪৪ সালে ওয়াশিংটনে এক বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের হয়ে সফরের সময় পক্ষত্যাগ করেন এবং কিছুদিনের ভেতর আই চুজ ফ্রিডম নামের একটি স্মৃতিকথা লেখেন। এ বইয়ে তিনি স্টালিনবাদের বিভীষিকা তুলে ধরেন। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকের উইক্রেনে দুর্ভিক্ষের সময়কার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এ বইয়ে। ব্যবস্থার প্রতি তখন তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। সেখানে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি সহায়তা করেন।
১৯৪৯ সালের পর ক্রেভচেঙ্কোর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে কথা বেশি লোকে জানে না। আমেরিকায় ম্যাককার্থির আমলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে জঘন্য নিপীড়নমূলক এক অভিযানের বিরুদ্ধে আবেগঘন বক্তব্য দেওয়ার সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, কমিউনিস্ট ও তাদের সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কমিউনিস্টদের পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করতে পারি না, করা উচিতও নয়।’ আমেরিকাবাসীর জন্য তাঁর সতর্কবাণী: এভাবে স্টালিনবাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে।
পশ্চিমা দুনিয়ার বৈষম্য তাঁকে দিনে দিনে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। তিনি আই চুজ ফ্রিডম-এর সিক্যুয়েল হিসেবে আই চুজ জাস্টিস নামের আরেকটি বই লেখেন। এই নামটা বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি একসময় যৌথ মালিকানার কম শোষণমূলক ধরনের খোঁজে নিজেকে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত করেন। বলিভিয়ার গরিব কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টায় তাঁর সব অর্থ ঢালেন। ব্যর্থ হয়ে মনোবল ভেঙে পড়ায় সামাজিক পরিসর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন।
আজকের এ অবস্থানে আমরা কেমন করে এলাম? বিংশ শতকের কমিউনিজমের আশাভঙ্গ আর একবিংশ শতকের পুঁজিবাদের ঘোর কাটার পর আমরা শুধু নতুন ক্রেভচেঙ্কোদের আশা করতে পারি। তাঁদের শেষটা শুভ হোক, এতটুকুই আশা। ন্যায়বিচারের খোঁজে তাঁদের শুরু করতে হবে ছন্নছাড়া জায়গা থেকেই। তাঁদের মতাদর্শ নিজেদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। বিপজ্জনক স্বপ্নবাজ বলে তাঁদের দোষানো হবে, কিন্তু আমরা যে ঘোরের মধ্যে বশীভূত, তা থেকে সবার আগে জেগে উঠবেন তাঁরাই।
নিউ ইয়র্কটাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
স্লাভো জিজেক: স্লাভোনিয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
অবশ্য নতুন গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বাস্তবতায় মখমল বিপ্লবের মহিমা মলিন হতে সময় লাগেনি। প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণ অনিবার্য হতাশাকে আশ্রয় করে পথ হাতড়ানোর চেষ্টা করে। ‘পুরোনো মহান’ কমিউনিস্ট সময়ের প্রতি স্মৃতিবিধুরতা; দক্ষিণপন্থী, জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয়তামুখিতা; এবং নতুন কমিউনিস্টবিরোধী বিকারের মাধ্যমে পালাক্রমে এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।
প্রথম দুটি প্রক্রিয়া সহজে অনুধাবনযোগ্য। কয়েক দশক আগেও যেসব ডানপন্থী ‘কমিউনিজমের থেকে মৃত্যু শ্রেয়’ বলে গলা ফাটাত, তাদেরই আজ অস্ফুট স্বরে মাঝেমধ্যে বলতে শোনা যায়, ‘হ্যামবার্গার খাওয়ার চেয়ে কমিউনিজম শ্রেয়।’ কিন্তু কমিউনিস্ট স্মৃতিবিধুরতাকে খুব গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত হবে না: এ স্মৃতিবিধুরতায় সমাজতান্ত্রিক ধূসর বাস্তবতায় ফিরে যাওয়ার কোনো প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা নেই, এটি আসলে শোক পালন, অতীত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটি আচার। অন্যদিকে জনপ্রিয়তামুখী ডানপন্থীদের উত্থান কেবল পূর্ব ইউরোপেই ঘটেনি, বিশ্বায়নের আবর্তে আটকে পড়া সব দেশেই এর দেখা মেলে।
হাঙ্গেরি থেকে স্লোভেনিয়া পর্যন্ত কমিউনিজম-বিরোধিতার সাম্প্রতিক পুনরুত্থান বরং অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। ২০০৬ সালের হেমন্তে হাঙ্গেরির ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীরা দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে আগের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের যোগসূত্রকে দায়ী করে। কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী এই ক্ষমতাসীন দল, তাই এই সংকট, এমন কথা ওঠে। বিক্ষোভকারীরা সরকারের বৈধতাকেই প্রত্যাখ্যান করে, যদিও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সোভিয়েত ফৌজ যেভাবে ১৯৫৬ সালের কমিউনিস্টবিরোধী বিদ্রোহ দমন করেছিল, তার সঙ্গে তুলনা করা হতে থাকে নাগরিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পুলিশের ভূমিকার।
এই নব্য কমিউনিস্টবিরোধী আতঙ্ক এমনকি প্রতীকের পিছু নিতেও ছাড়েনি। ২০০৮ সালের জুন মাসে লিথুয়ানিয়া আইন করে কাস্তে-হাতুড়ির মতো কমিউনিস্ট প্রতীকের প্রদর্শনী এবং সোভিয়েত জাতীয় সংগীত বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে পোলিশ সরকার টোটালিটেরিয়ান প্রপাগান্ডার ওপর নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়িয়ে তাতে কমিউনিস্ট বই, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসার প্রস্তাব করে: তাহলে হয়তো চে গুয়েভারার ছবিসংবলিত কোনো টি-শার্ট পরার কারণেও কেউ গ্রেপ্তারের শিকার হতে পারত। স্লোভেনিয়ায় বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের প্রধান সমালোচনা, তারা পুরোনো কমিউনিস্ট শাসনেরই জের।
কমিউনিস্টবিরোধিতার পুনরুজ্জীবনের এই শক্তির উত্স কী? যেসব দেশের তরুণেরা কমিউনিস্ট যুগ দেখেনি, তাদের আবার কমিউনিজমের ভয় ধরানো কেন? এসব প্রশ্নের একটি সরল উত্তর মিলবে নতুন কমিউনিস্টবিরোধিতার মধ্যেই, ‘পুঁজিবাদ সত্যিই যদি সমাজতন্ত্র থেকে এত ভালোই হবে, তবে কেন আমাদের এখনো এত করুণ জীবন যাপন করতে হয়?’
অনেকে মনে করে, এর কারণ আমরা সত্যিকারের পুঁজিবাদের মধ্যে বাস করছি না: সত্যিকারের গণতন্ত্রের দেখা আমরা এখনো পাইনি, শুধু গণতন্ত্রের মুখোশে আমাদের নিরন্তর ভাওতা দেওয়া হচ্ছে; পুরোনো অশুভ শক্তি এখনো ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছে, সাবেক কমিউনিস্টদের এক অংশ নতুন মালিক ও ম্যানেজাররূপে আবির্ভূত হয়েছে। সত্যিকারে কিছুই বদলায়নি। তাই আবারও বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে...অথচ পুঁজিবাদের এমন চিত্রকেই গতানুগতিক বামপন্থীরা সবচেয়ে বেশি গালি দেয়। এ সমাজের আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র শুধু সংখ্যালঘু সম্পদশালীদের শাসনকে আড়াল করে রাখে। অন্যভাবে বলা যায়, আজকের কমিউনিস্টবিরোধীরা বুঝতে পারে না, যে ব্যবস্থাকে তারা বিপথগামী ছদ্ম পুঁজিবাদী হিসেবে প্রকাশ্যে নিন্দা জানাচ্ছে, তা আসলে পুঁজিবাদী।
এ জন্যই এখন চীনে এত অস্থিরতা। সব সময় পুঁজিবাদকে মনে হয় গণতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য গাঁটছড়া বাঁধা। পুঁজিবাদের বিস্ফোরণের পটভূমিতে অনেক বিশ্লেষক এখনো মনে করেন, চীনে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অনিবার্যভাবে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করবে।
কিন্তু এই কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদ যদি উদারনৈতিক পুঁজিবাদের চেয়ে অধিকতর কার্যকর, অধিকতর লাভজনক বলে প্রমাণিত হয় তবে? গণতন্ত্র যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ও স্বাভাবিক পরিণতি না হয়ে বরং প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে তাহলে কী হবে? এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট-উত্তর দেশগুলোতে পুঁজিবাদের প্রতি আশাভঙ্গকে পুঁজিবাদের স্বরূপ না চেনা জনগণের ‘অপরিণত’ প্রত্যাশার চিহ্ন হিসেবে খারিজ করে দেওয়া উচিত নয়।
পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মানুষের বিরাট অংশ পুঁজিবাদ চায়নি। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা চেয়েছেন, নিজের ইচ্ছামতো একত্র হওয়ার ও কথা বলার স্বাধীনতা চেয়েছেন। যে জীবন সরলতা ও আন্তরিকতার, সেকেলে মতাদর্শিক অনুশাসন ও প্রচলিত নৈরাশ্যবাদী ভণ্ডামি থেকে মুক্ত, সে জীবন তারা চেয়েছেন। যেসব আদর্শকে সামনে রেখে বিক্ষোভকারীরা মাঠে নেমেছিল, সেগুলো অনেকাংশে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ থেকেই নেওয়া। জনগণের সেসব আকাঙ্ক্ষাকে বলা যেতে পারে ‘সমাজতন্ত্রের মানবিক রূপ।’
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ভিক্টর ক্রেভচেঙ্কোর কথা। এই সোভিয়েত প্রকৌশলী ১৯৪৪ সালে ওয়াশিংটনে এক বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের হয়ে সফরের সময় পক্ষত্যাগ করেন এবং কিছুদিনের ভেতর আই চুজ ফ্রিডম নামের একটি স্মৃতিকথা লেখেন। এ বইয়ে তিনি স্টালিনবাদের বিভীষিকা তুলে ধরেন। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকের উইক্রেনে দুর্ভিক্ষের সময়কার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এ বইয়ে। ব্যবস্থার প্রতি তখন তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। সেখানে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি সহায়তা করেন।
১৯৪৯ সালের পর ক্রেভচেঙ্কোর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে কথা বেশি লোকে জানে না। আমেরিকায় ম্যাককার্থির আমলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে জঘন্য নিপীড়নমূলক এক অভিযানের বিরুদ্ধে আবেগঘন বক্তব্য দেওয়ার সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, কমিউনিস্ট ও তাদের সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কমিউনিস্টদের পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করতে পারি না, করা উচিতও নয়।’ আমেরিকাবাসীর জন্য তাঁর সতর্কবাণী: এভাবে স্টালিনবাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে।
পশ্চিমা দুনিয়ার বৈষম্য তাঁকে দিনে দিনে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। তিনি আই চুজ ফ্রিডম-এর সিক্যুয়েল হিসেবে আই চুজ জাস্টিস নামের আরেকটি বই লেখেন। এই নামটা বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি একসময় যৌথ মালিকানার কম শোষণমূলক ধরনের খোঁজে নিজেকে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত করেন। বলিভিয়ার গরিব কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টায় তাঁর সব অর্থ ঢালেন। ব্যর্থ হয়ে মনোবল ভেঙে পড়ায় সামাজিক পরিসর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন।
আজকের এ অবস্থানে আমরা কেমন করে এলাম? বিংশ শতকের কমিউনিজমের আশাভঙ্গ আর একবিংশ শতকের পুঁজিবাদের ঘোর কাটার পর আমরা শুধু নতুন ক্রেভচেঙ্কোদের আশা করতে পারি। তাঁদের শেষটা শুভ হোক, এতটুকুই আশা। ন্যায়বিচারের খোঁজে তাঁদের শুরু করতে হবে ছন্নছাড়া জায়গা থেকেই। তাঁদের মতাদর্শ নিজেদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। বিপজ্জনক স্বপ্নবাজ বলে তাঁদের দোষানো হবে, কিন্তু আমরা যে ঘোরের মধ্যে বশীভূত, তা থেকে সবার আগে জেগে উঠবেন তাঁরাই।
নিউ ইয়র্কটাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
স্লাভো জিজেক: স্লাভোনিয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
No comments