ডারউইন - চিরকুট by শাহাদুজ্জামান

মানুষের ভাবনাচিন্তার একেবারে গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছেন যে কয়জন, ডারউইন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর জন্মের ২০০ বছর পালিত হচ্ছে এ বছর। এ মাসে পালিত হচ্ছে তাঁর যুগান্তকারী বই ‘অরিজিন অব স্পেসিস’-এর দেড় শ বছর পূর্তি। কেঁচো, গিরগিটি, বাদুর, বানর, মানুষ—সব একই সূত্রে বাঁধা। কে আর তাঁর মতো ভেবেছিল এমন করে। মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘বিগল’ নামের জাহাজে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি। বছর পাঁচ ধরে পৃথিবীর এ বন্দর থেকে ও বন্দরে ঘুরেছেন। যেখানে গেছেন, মানুষ ছাপিয়ে তাঁর চোখ পড়েছে সে এলাকার জন্তু, জানোয়ার, পোকামাকড়ের দিকে। কেন ভৌগোলিক এলাকার তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গে জন্তু-জানোয়ারের আকার, প্রকৃতি বদলে যায় তার সূত্র খুঁজেছেন তিনি। প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজন-প্রক্রিয়ায় যোগ্যতমের টিকে থাকার মধ্য দিয়ে কী করে বিকশিত হয়েছে প্রাণিজগত্, তার তথ্য আর যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি। জানিয়েছেন, একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে জগতের সকল প্রাণী। তাঁর ভাবনা প্রকৃতিবিজ্ঞানকে ছাপিয়ে প্রভাবিত করেছে সমাজবিজ্ঞানকেও, জনপ্রিয় হয়েছে সামাজিক বিবর্তনের ধারণাও। এই বিবর্তনের ভাবনার সূত্র ধরে সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, কোনো দৈববলে মানুষ কেউ রাজা বা কেউ দাস নয়, বরং একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দাস, সামন্ত, পুঁজিবাদী ইত্যাকার স্তরের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে সমাজ এবং মানুষ বন্দী হয়েছে এক এক শ্রেণীতে। জগত্-সংসারের নানা জট খুলতে সহায়ক হয়েছে ডারউইনের ভাবনা।
বলা বাহুল্য, তাঁর ভাবনার তীব্র বিরোধিতাও হয়েছে বরাবর। প্রধান আক্রমণটি এসেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। সব ধর্মেই মানব সৃষ্টির যে বিবরণ আছে, এ ভাবনা তার একেবারে বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে বানরের বংশধর হিসেবে দেখানোটা রীতিমতো অপমানকর হিসেবেই বিবেচিত হয়। তাকে ঘিরে তৈরি হয় নানা ঠাট্টা-কৌতুক। এ বিরোধিতা এখনো অব্যাহত। কয়েক দিন আগে একটি ধর্মভিত্তিক টিভি চ্যানেলে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখছিলাম, যেখানে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছিল, আজকের পৃথিবীর যত অনাচার, ধ্বংস, অপকর্ম, তার পেছনে একজনমাত্র লোকই দায়ী, আর সে হচ্ছে চার্লস ডারউইন। তাঁরা দাবি করছেন, ডারউইন মানুষের চিন্তাকে বিভ্রান্ত করেছেন।
একটি মহল তাঁর বিরোধিতা করলেও, সাধারণভাবে সারা পৃথিবীতেই সম্মানের সঙ্গে পালিত হচ্ছে ডারউইনের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী। ব্রিটিশ ছিলেন বলে ইংল্যান্ডে ডারউইনকে ঘিরে খানিকটা বাড়তি আয়োজন। ডারউইনকে ঘিরে ভিন্নমাত্রার দুটি আয়োজনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে। একদল চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও চলচ্চিত্রশিল্পী মিলে ডারউইনকে নিবেদন করে একটি প্রদর্শনী করেছেন নিউক্যাসল শহরের বাল্টিক হলে। একটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে পুরো দলটি মাসখানেক কাটিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার গালাপাগোস দ্বীপে, বিগল জাহাজে ভ্রমণের সময় যে দ্বীপের প্রাণীবৈচিত্র্য বিস্মিত করেছিল ডারউইনকে। সেই প্রাণীগুলোকেই যাঁর যাঁর শিল্পমাধ্যমে নতুন করে প্রকাশ করেছেন শিল্পীরা। ওই দ্বীপের প্রাণীদের নিয়ে বিমূর্ত এবং পরাবাস্তব ধরনের চমত্কার কিছু ছবি একেঁছেন চিত্রশিল্পীরা। এক চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন গালাপাগোস দ্বীপের অতিকায় কাছিমগুলোকে নিয়ে, যার কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন ডারউইন তাঁর লেখায়। তাঁর প্রমাণ্যচিত্রের মূল বিষয় ওই প্রকাণ্ড কাছিমগুলোর সঙ্গম। যে যৌনতার মাধ্যমে এই কাছিমগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের বংশবিস্তার করে চলেছে তার বিচিত্র প্রক্রিয়াটিকে মজাদার করে চিত্রায়িত করেছেন নির্মাতা। শত বছরের আয়ুসম্পন্ন এই কাছিমগুলোর কারও কারও সঙ্গে হয়তো ডারউইনের দেখা হয়েও থাকতে পারে। মনোযোগ আকর্ষণ করেছে একটি বিশেষ ভাস্কর্য। ভাস্কর দেয়ালে টানিয়ে দিয়েছেন বিশাল আকারের একটি কাচের ফ্রেম। কাছে গিয়ে দেখি স্বচ্ছ কাঁচের ওই ফ্রেমের ভেতর ঠাসা মাটি এবং তার ভেতর অসংখ্য জ্যান্ত কেঁচো। কেঁচোকে ডারউইন পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি কেঁচোর নাম দিয়েছিলেন ‘আদিম লাঙল’। মানুষ যখন লাঙল আবিষ্কার করেনি, হাজার বছর আগে কেঁচোই মাটিতে লাঙলের কাজ করেছে। অবিরাম নিচের মাটি ওপরে করে ভৃপৃষ্ঠের রাসায়নিক ভারসাম্য রক্ষা করেছে তারা। সেই অসংখ্য আদিম লাঙলকে স্বচ্ছ কাচের ফ্রেমে ঢুকিয়ে চারদিক অন্ধকার করে শিল্পী স্পট লাইট ফেলেছেন ফ্রেমের ওপর। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম স্পট লাইটের আলোয় অবিরাম মাটি খুঁড়ে চলেছে কেঁচোগুলো। মনে হচ্ছিল, কোনো একটি মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কতিপয় দর্শক এই প্রাচীন অথচ উপেক্ষিত প্রাণীটির পারফর্মেন্স দেখছি।
দ্বিতীয় যে অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থেকেছি সেখানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জিলিয়ান বিয়ার ডারউইনের জীবন এবং ভাবনায় শিল্প-সাহিত্যের প্রভাববিষয়ক তাঁর গবেষণাটি উপস্থাপন করেন। ডারউইনের আত্মজীবনীতে দেখা যায়, তরুণ বয়সে সাহিত্য, চিত্রকলা এবং সংগীতের ব্যাপারে গভীর অনুরাগ ছিল ডারউইনের। বিগল জাহাজে ভ্রমণের সময় তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল মিল্টন, শেলি ও বায়রনের কবিতা। প্রকৃতির নানা জট খুলতে কবিতা তাঁকে সহায়তা করেছে লিখেছেন। ডারউইন পাডোভানিনোর ‘স্লিপিং ভেনাস’ চিত্রকর্মটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। তাঁর বন্ধু চিত্রশিল্পী জন রাসকিনের আঁকা ময়ূরের পেখমের ছবি নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য আছে ডারউইনের। ময়ূরের পেখমের বর্ণাঢ্যতা তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মূল কিছু প্রতিপাদ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ডারউইন। আবার পশুপাখির ডাক যেমন যৌনতার অনুষঙ্গ তেমনি তা সংগীতেরও আদি অনুপ্রেরণা, এ তিনের সম্পর্ক নিয়েও লেখা আছে ডারউইনের। ২০০ বছর পরেও নানাভাবে প্রাসঙ্গিক এই যুগান্তকারী চিন্তাবিদকে স্মরণ করা যাক নতুন করে।
নিউক্যাসল, যুক্তরাজ্য
>>>শাহাদুজ্জামান: কথাসহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.