জলবায়ু সম্মেলন-ভারত ও চীন অভিন্ন কৌশল নিতে আগ্রহী by মুশফিকুর রহমান
অসময়ের বরফ পড়া বেইজিং থেকে চির বসন্তের কুনমিং পৌঁছে রোদ ঝলমল পরিবেশে চমত্কৃত হতে হলো। সিল্ক রুটের প্রবেশপথ কুনমিং থেকে ৮৮ কিলোমিটার দূরে পর্যটন আকর্ষণ ‘স্টোন ফরেস্ট’-এ যেতে পাহাড় ও সমতলের চীনের ইউনান প্রদেশের অনেকটুকু দেখার সুযোগ মেলে। সে দেখায় দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের প্রায় দুই হাজার ৫০০ বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সামান্য দেখা মিললেও নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি ও বৈচিত্র্যময় জীবিকার উন্নয়ন স্পষ্ট বোঝা যায়। কুনমিং থেকে ‘স্টোন ফরেস্টের’ ছোট্ট পথ যাত্রায় আমি অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে দুটো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র দেখেছি।
বেইজিংয়ের আলো ঝলমল আধুনিক জীবনের সমৃদ্ধির সঙ্গে প্রাদেশিক রাজধানী কুনমিংয়ের তুলনা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু চীন তার অর্থনীতির অতি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত—নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহের বিষয়ে আপসহীন। প্রকৃতি যেহেতু জ্বালানি কয়লার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার চীনকে দিয়েছে, স্বভাবতই তা কাজে লাগাতে কার্পণ্য করেনি সে দেশ। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়লা উত্পাদন ও ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে চীন পরিচিতি পেয়েছে। সেই সঙ্গে সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান ইন্ধন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান হওয়ার খেতাবও চীনের গলায়। তবে তা নিয়ে চীনের ভাবনা তার নিজ দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বের।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগর বেইজিংয়ের ট্রাফিক শৃঙ্খলাসহ শহরের প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের উপস্থিতিতে দূষণে দম আটকে আসার মতো পরিস্থিতি কখনোই মনে হয়নি। শহরের গাছপালার সবুজ আচ্ছাদনের পরিপাটি বরং চমত্কৃত করে আমাদের মতো সুস্থ পরিবেশের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ ঢাকাবাসীকে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে চীন প্রায় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র তৈরি করছে। বেইজিং, কুনমিং বা অন্যান্য বড় নগর ও উন্নয়নকেন্দ্রের আশপাশে গড়ে ওঠা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো ধোঁয়া কম ছড়াচ্ছে না। তবে এ জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে চীনকে দোষারোপ করার যে প্রকট প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়, চীন তাকে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ শিল্পোন্নত বিশ্ব বৈশিক উষ্ণায়নে নিজেদের ঘরের দূষণের দিকে যত তাকায়, তার চেয়ে বেশি নজর দেয় চীন ও ভারতের শিল্পায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রবণতায়।
তবে পশ্চিমের সবাই বিষয়টি এক দৃষ্টে দেখে তাও ঠিক নয়। বরং চীন ও ভারতের মতো দ্রুত বিকাশমান বৃহত্ অর্থনীতির যে উন্নত হওয়ার সহজাত অধিকার রয়েছে, সেটি বোঝার মানুষও রয়েছে। কারণ তাঁরা জানেন যে বিশ্বে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আবহাওয়ামণ্ডলে যত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরিত হয়েছে, তার সিংহভাগ দায় শিল্পোন্নত দেশসমূহের। মাথাপ্রতি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার বিবেচনায় এখনো চীনের গড়, শিল্পোন্নত ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ ও যুক্তরাষ্ট্রের এক-ষষ্ঠাংশ। চীন তার বিদ্যুতের চাহিদার ৮০ শতাংশ কয়লা পুড়িয়ে পায়। চীন এখনো উত্পাদন ও অর্থনীতির উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হচ্ছে কেবল এ জন্য নয় যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে তার মাথাব্যথা নেই। বরং দূষণমুক্ত ও শূন্যদূষণের প্রযুক্তি তার পর্যাপ্ত নেই বা তার ব্যয়ভার বহন তার অর্থনীতির জন্য এখনো অপরিপক্ব। সে কারণে চীনকে এখনো তার প্রয়োজনীয় কয়লা উত্তোলনে প্রায় অর্ধকোটি খনি শ্রমিকের জীবন বাজি রাখা উত্পাদননির্ভর থাকতে হয় এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জন খনি শ্রমিকের জীবনের মূল্যে সারা দেশ আলোকিত রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়।
এদিকে ডিসেম্বরের বহুল আলোচিত কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে আমরা যখন বিশ্ব উষ্ণায়নে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়া দেশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের জন্য দাবি তুলতে চেষ্টা করছি; ভারত ও চীন তখন সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে এগোতে চাইছে কোপেনহেগেন সম্মেলনে তাদের কৌশল নির্ধারণে। গত ২১ অক্টোবর ভারত ও চীন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় কোপেনহেগেনের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতার স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
বিশ্বজুড়ে বেশ জোরেশোরে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে যে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০১২ সালে ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারিত হবে কোপেনহেগেনে। বিশেষত, বিশ্বের উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করার নতুন টার্গেট নির্ধারণ ও তা অর্জনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেওয়া; ইতিমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে হুমকির মুখে পড়া দেশগুলোর সংকট মোকাবিলার পথ নির্ধারণ করা এ সম্মেলনের অন্যতম আলোচনার বিষয়। এ আলোচনার অংশ হিসেবেই শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে সুনির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ ও চীন-ভারতের দূষণ হ্রাস করার মাত্রা নির্ধারণে সম্মত হওয়ার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নমুখী দেশগুলো কীভাবে তাদের দূষণ হ্রাস ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে তাও আলোচনার বিষয় হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে সুনির্দিষ্ট কী অর্থনৈতিক প্যাকেজ তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনে ব্যয় করতে প্রস্তুত।
বলাই বাহুল্য, আলোচনার উপাদানগুলো মোটেই সহজ নয়। বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো তাদের অর্থনীতির উন্নয়নের সহজাত অধিকার দাবি ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দায় প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর বর্তায় বলে দাবি করে।
পক্ষান্তরে, শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের দায় ঠেলে দিতে চায় চীন-ভারতসহ অধিকতর জনবহুল উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দূষণপ্রবণতার দিকে। অনেক ক্ষেত্রে বরং কিয়োটো প্রটোকলের মতো অনেক নমনীয় টার্গেটের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের চুক্তিকেও সরাসরি অবজ্ঞার প্রবণতা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ শিল্পোন্নত অনেক দেশ।
এই পটভূমিতে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও কোপেনহেগেন সম্মেলনকে সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে চীনের যৌথ অবস্থান নেওয়ার সমঝোতা চুক্তি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। এক অর্থে আমাদের অঞ্চলের জন্য যৌথ কৌশল নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কোপেনহেগেন বিশ্ব সম্মেলনে যেতে পারলে তা শিল্পোন্নত বিশ্বের ওপর চাপ সৃষ্টি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি আদায়ে সহায়ক হতে পারে।
নিশ্চিতভাবে চীন, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো সীমানাহীন বৈশ্বিক আবহাওয়ামণ্ডলীর সুস্থতা নিশ্চিত করার দায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। বরং কার্যকরভাবে দেশগুলো নিজ দেশের উন্নয়ন, জনগণের জীবনমান সমৃদ্ধ করার অগ্রাধিকারকে চ্যালেঞ্জ না করে, বৈশ্বিক পরিবেশ সুস্থতার চ্যালেঞ্জে শামিল হতে চায়। এ জন্য প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু উন্নয়নশীল, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একক সামর্থ্যের সীমায় তা নেই। তা ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়ভার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বিশ্ব পরিবেশ বিপন্ন করায় যেহেতু মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, সে কারণে সামর্থ্যের নিরিখ ও নৈতিক দায় থেকেও শিল্পোন্নত বিশ্বকে তাই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের সংযমী হওয়ার অনুকরণীয় উদাহরণ দিয়ে এবং অন্যদের সহায়তা করার বাস্তবানুগ অবস্থান নিশ্চিত করে।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিষয়ক লেখক।
বেইজিংয়ের আলো ঝলমল আধুনিক জীবনের সমৃদ্ধির সঙ্গে প্রাদেশিক রাজধানী কুনমিংয়ের তুলনা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু চীন তার অর্থনীতির অতি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত—নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহের বিষয়ে আপসহীন। প্রকৃতি যেহেতু জ্বালানি কয়লার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার চীনকে দিয়েছে, স্বভাবতই তা কাজে লাগাতে কার্পণ্য করেনি সে দেশ। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়লা উত্পাদন ও ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে চীন পরিচিতি পেয়েছে। সেই সঙ্গে সবাইকে ছাড়িয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান ইন্ধন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান হওয়ার খেতাবও চীনের গলায়। তবে তা নিয়ে চীনের ভাবনা তার নিজ দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বের।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগর বেইজিংয়ের ট্রাফিক শৃঙ্খলাসহ শহরের প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের উপস্থিতিতে দূষণে দম আটকে আসার মতো পরিস্থিতি কখনোই মনে হয়নি। শহরের গাছপালার সবুজ আচ্ছাদনের পরিপাটি বরং চমত্কৃত করে আমাদের মতো সুস্থ পরিবেশের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ ঢাকাবাসীকে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে চীন প্রায় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র তৈরি করছে। বেইজিং, কুনমিং বা অন্যান্য বড় নগর ও উন্নয়নকেন্দ্রের আশপাশে গড়ে ওঠা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো ধোঁয়া কম ছড়াচ্ছে না। তবে এ জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে চীনকে দোষারোপ করার যে প্রকট প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়, চীন তাকে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ শিল্পোন্নত বিশ্ব বৈশিক উষ্ণায়নে নিজেদের ঘরের দূষণের দিকে যত তাকায়, তার চেয়ে বেশি নজর দেয় চীন ও ভারতের শিল্পায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রবণতায়।
তবে পশ্চিমের সবাই বিষয়টি এক দৃষ্টে দেখে তাও ঠিক নয়। বরং চীন ও ভারতের মতো দ্রুত বিকাশমান বৃহত্ অর্থনীতির যে উন্নত হওয়ার সহজাত অধিকার রয়েছে, সেটি বোঝার মানুষও রয়েছে। কারণ তাঁরা জানেন যে বিশ্বে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আবহাওয়ামণ্ডলে যত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরিত হয়েছে, তার সিংহভাগ দায় শিল্পোন্নত দেশসমূহের। মাথাপ্রতি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার বিবেচনায় এখনো চীনের গড়, শিল্পোন্নত ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ ও যুক্তরাষ্ট্রের এক-ষষ্ঠাংশ। চীন তার বিদ্যুতের চাহিদার ৮০ শতাংশ কয়লা পুড়িয়ে পায়। চীন এখনো উত্পাদন ও অর্থনীতির উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হচ্ছে কেবল এ জন্য নয় যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে তার মাথাব্যথা নেই। বরং দূষণমুক্ত ও শূন্যদূষণের প্রযুক্তি তার পর্যাপ্ত নেই বা তার ব্যয়ভার বহন তার অর্থনীতির জন্য এখনো অপরিপক্ব। সে কারণে চীনকে এখনো তার প্রয়োজনীয় কয়লা উত্তোলনে প্রায় অর্ধকোটি খনি শ্রমিকের জীবন বাজি রাখা উত্পাদননির্ভর থাকতে হয় এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জন খনি শ্রমিকের জীবনের মূল্যে সারা দেশ আলোকিত রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়।
এদিকে ডিসেম্বরের বহুল আলোচিত কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে আমরা যখন বিশ্ব উষ্ণায়নে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়া দেশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের জন্য দাবি তুলতে চেষ্টা করছি; ভারত ও চীন তখন সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে এগোতে চাইছে কোপেনহেগেন সম্মেলনে তাদের কৌশল নির্ধারণে। গত ২১ অক্টোবর ভারত ও চীন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় কোপেনহেগেনের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতার স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
বিশ্বজুড়ে বেশ জোরেশোরে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে যে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০১২ সালে ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারিত হবে কোপেনহেগেনে। বিশেষত, বিশ্বের উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করার নতুন টার্গেট নির্ধারণ ও তা অর্জনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেওয়া; ইতিমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে হুমকির মুখে পড়া দেশগুলোর সংকট মোকাবিলার পথ নির্ধারণ করা এ সম্মেলনের অন্যতম আলোচনার বিষয়। এ আলোচনার অংশ হিসেবেই শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে সুনির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ ও চীন-ভারতের দূষণ হ্রাস করার মাত্রা নির্ধারণে সম্মত হওয়ার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নমুখী দেশগুলো কীভাবে তাদের দূষণ হ্রাস ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে তাও আলোচনার বিষয় হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে সুনির্দিষ্ট কী অর্থনৈতিক প্যাকেজ তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনে ব্যয় করতে প্রস্তুত।
বলাই বাহুল্য, আলোচনার উপাদানগুলো মোটেই সহজ নয়। বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো তাদের অর্থনীতির উন্নয়নের সহজাত অধিকার দাবি ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দায় প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর বর্তায় বলে দাবি করে।
পক্ষান্তরে, শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের দায় ঠেলে দিতে চায় চীন-ভারতসহ অধিকতর জনবহুল উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দূষণপ্রবণতার দিকে। অনেক ক্ষেত্রে বরং কিয়োটো প্রটোকলের মতো অনেক নমনীয় টার্গেটের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের চুক্তিকেও সরাসরি অবজ্ঞার প্রবণতা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ শিল্পোন্নত অনেক দেশ।
এই পটভূমিতে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও কোপেনহেগেন সম্মেলনকে সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে চীনের যৌথ অবস্থান নেওয়ার সমঝোতা চুক্তি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। এক অর্থে আমাদের অঞ্চলের জন্য যৌথ কৌশল নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কোপেনহেগেন বিশ্ব সম্মেলনে যেতে পারলে তা শিল্পোন্নত বিশ্বের ওপর চাপ সৃষ্টি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি আদায়ে সহায়ক হতে পারে।
নিশ্চিতভাবে চীন, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো সীমানাহীন বৈশ্বিক আবহাওয়ামণ্ডলীর সুস্থতা নিশ্চিত করার দায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। বরং কার্যকরভাবে দেশগুলো নিজ দেশের উন্নয়ন, জনগণের জীবনমান সমৃদ্ধ করার অগ্রাধিকারকে চ্যালেঞ্জ না করে, বৈশ্বিক পরিবেশ সুস্থতার চ্যালেঞ্জে শামিল হতে চায়। এ জন্য প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু উন্নয়নশীল, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একক সামর্থ্যের সীমায় তা নেই। তা ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়ভার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বিশ্ব পরিবেশ বিপন্ন করায় যেহেতু মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, সে কারণে সামর্থ্যের নিরিখ ও নৈতিক দায় থেকেও শিল্পোন্নত বিশ্বকে তাই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের সংযমী হওয়ার অনুকরণীয় উদাহরণ দিয়ে এবং অন্যদের সহায়তা করার বাস্তবানুগ অবস্থান নিশ্চিত করে।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments