বাবা তোমায় ভীষণ মনে পড়ে by শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাঁড়ে
(আমি সাত বছরের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাঁড়ে। আমার বাবা ঘাতকের বোমায় নিহত বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে। আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে, ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে জেএমবি নামের জঙ্গিদের বোমায় আমার বাবা ও তার সহকর্মী সোহেল আহমদ নৃশংসভাবে নিহত হন। তখন আমার বয়স মাত্র পৌনে তিন বছর। বাবার আদর তখন আমি একটু একটু বুঝতে শুরু করেছিলাম।)
বাবা, কী ভীষণ আদরই না করতে তুমি আমাকে। মাথায় তুলে নাচতে। বড় হয়ে আমি কী হব, কার মতো হব, তা নিয়ে মায়ের সঙ্গে বসে কত না স্বপ্ন বুনতে দুজনে। ঝালকাঠিতে আমাদের বাসায় প্রতিদিন যখন তোমাকে অফিসে নেওয়ার জন্য গাড়ি আসত, আমি বায়না ধরতাম, অফিসে যাব। তুমি বলতে, আমি যখন জেলা জজ হব, আমার নিজের দারুণ একটা গাড়ি থাকবে, তখন তোকে রোজ অফিসে নিয়ে যাব। মায়েরও খুউব ইচ্ছে ছিল, জজ বাংলোয় ঘর করার। বাবা, ওরা আমাকে-তোমাকে-মাকে কাউকে কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। আজ বেঁচে থাকলে তুমি হয়তো জেলা জজ হতে। এ কারণেই বাড়িতে কোনো গাড়ি এলে আজও আমি ছুটে যাই—হয়তো তুমি এলে!
বাবা, তোমার মৃত্যুর পর থেকে আমি বরিশালে দাদুবাড়ি থাকি। দাদু-দিদা তাঁদের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে আমাকে ভরিয়ে রেখেছেন। আমাকে মানুষ করতে মা সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেন। সেই কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর খাটুনি। এর পরও ক্লান্ত দেহে শ্রান্ত মনে যখন তিনি বাড়ি ফেরেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তাঁর সব ব্যথা। কিন্তু বাবা, দুপুর বেলা সবাই যখন ঘুমোয়, মা অফিসে ব্যস্ত থাকেন, খটখটে রোদ্দুর পশ্চিমের জানালা দিয়ে আমার ঘরে ঢোকে আর বাইরে বড় বড় গাছের ওপর বসে কোনো কানাকুয়া অলস ডেকে ওঠে, তখন তোমাকে আমার ভীষণ মনে পড়ে বাবা। আমি একা একা বিছানা থেকে উঠে সামনের ঘরে তোমার ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি, আর বাবা বাবা বলে তোমাকে ডাকি। তুমি কি কিছুই শুনতে পাও না বাবা? তুমি কি কিছুতেই ফিরবে না আর? আমাদের স্কুলে বন্ধুদের বাবারা যখন এসে টিফিনের সময় বা ছুটির সময় তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যায়, তখন আমার খুউব ইচ্ছে করে, তুমি এসে একবার, মাত্র একবার আমাকে যদি নিয়ে যেতে, তাহলে মা কী খুশিই না হতেন বলো! পুজোর সময় সবাই বাবাকে নিয়ে কত আনন্দ করল। আমি আর মা ঘরে দরজা দিয়ে শুধু কাঁদলাম। আমার মা আর বিজয়া দশমীতে দুর্গা মায়ের কপালে সিঁদুর দিতে পারেন না। হঠাত্ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, মা তোমার ছবি বুকে জড়িয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন। বাবা, আমার মায়ের চোখের জল কি কোনো দিন মুছবে না? আমাদের ঘরে তুমি, আমি, মা, দাদু-দিদা-মামা—সবাই মিলে একটা ছবি আছে। ওই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। সেই আনন্দের ছবিটা থেকে ওরা কেন তোমাকে কেড়ে নিল বাবা, আমার কী দোষ ছিল?
মা বলেন, তুই বড় হয়ে ঠিক তোর বাবার মতো জজ হবি। আমি হব, বাবা। তোমার মতো। তোমার সেই কোট, জুতো—সবকিছু আমি গোপনে গোপনে পরে দেখি, আমাকে জজের মতো লাগে কি না। কিন্তু বাবা, আমার ভয়ও করে। যারা তোমাকে মেরেছিল, ওদের লোকজন এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কাকু তোমার মামলা লড়েছিল, তাকেও ওরা মেরে ফেলেছে। ওরা সবকিছু দখল করে নিতে চায়। খুনিরা যদি সবকিছু দখল করে, ওদের যদি নির্মূল করা না যায়, তবে আমি বড় হব কোন দেশে বাবা! আমি মায়ের দুঃখ ঘোচাব কী করে বলো? আমার মা আর বাংলা মায়ের দুঃখ আজ একাকার মনে হয়। আমি ছোট বলে ভেব না, কিছু বুঝি না। আমি সব বুঝি বাবা। কে ভালো, কে মন্দ, আমি বুঝি বাবা। বুঝি বলেই আমি ঠিক করেছি, আমি তোমার মতো বিচারক হব। যত দিন আমি তোমার মতো হতে না পারছি, তত দিন যে আমার তোমার জন্য প্রতীক্ষার অবসান হবে না। যেদিন বিচারক হব, তোমার মতো পোশাক পরে, মায়ের হাত ধরে তোমার সমাধির পাশে গিয়ে তোমাকে ডাকব। সেদিন কি তুমি আসবে তোমার ছোট্ট শ্রেষ্ঠর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে?
বাবা, কী ভীষণ আদরই না করতে তুমি আমাকে। মাথায় তুলে নাচতে। বড় হয়ে আমি কী হব, কার মতো হব, তা নিয়ে মায়ের সঙ্গে বসে কত না স্বপ্ন বুনতে দুজনে। ঝালকাঠিতে আমাদের বাসায় প্রতিদিন যখন তোমাকে অফিসে নেওয়ার জন্য গাড়ি আসত, আমি বায়না ধরতাম, অফিসে যাব। তুমি বলতে, আমি যখন জেলা জজ হব, আমার নিজের দারুণ একটা গাড়ি থাকবে, তখন তোকে রোজ অফিসে নিয়ে যাব। মায়েরও খুউব ইচ্ছে ছিল, জজ বাংলোয় ঘর করার। বাবা, ওরা আমাকে-তোমাকে-মাকে কাউকে কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। আজ বেঁচে থাকলে তুমি হয়তো জেলা জজ হতে। এ কারণেই বাড়িতে কোনো গাড়ি এলে আজও আমি ছুটে যাই—হয়তো তুমি এলে!
বাবা, তোমার মৃত্যুর পর থেকে আমি বরিশালে দাদুবাড়ি থাকি। দাদু-দিদা তাঁদের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে আমাকে ভরিয়ে রেখেছেন। আমাকে মানুষ করতে মা সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেন। সেই কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর খাটুনি। এর পরও ক্লান্ত দেহে শ্রান্ত মনে যখন তিনি বাড়ি ফেরেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তাঁর সব ব্যথা। কিন্তু বাবা, দুপুর বেলা সবাই যখন ঘুমোয়, মা অফিসে ব্যস্ত থাকেন, খটখটে রোদ্দুর পশ্চিমের জানালা দিয়ে আমার ঘরে ঢোকে আর বাইরে বড় বড় গাছের ওপর বসে কোনো কানাকুয়া অলস ডেকে ওঠে, তখন তোমাকে আমার ভীষণ মনে পড়ে বাবা। আমি একা একা বিছানা থেকে উঠে সামনের ঘরে তোমার ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি, আর বাবা বাবা বলে তোমাকে ডাকি। তুমি কি কিছুই শুনতে পাও না বাবা? তুমি কি কিছুতেই ফিরবে না আর? আমাদের স্কুলে বন্ধুদের বাবারা যখন এসে টিফিনের সময় বা ছুটির সময় তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যায়, তখন আমার খুউব ইচ্ছে করে, তুমি এসে একবার, মাত্র একবার আমাকে যদি নিয়ে যেতে, তাহলে মা কী খুশিই না হতেন বলো! পুজোর সময় সবাই বাবাকে নিয়ে কত আনন্দ করল। আমি আর মা ঘরে দরজা দিয়ে শুধু কাঁদলাম। আমার মা আর বিজয়া দশমীতে দুর্গা মায়ের কপালে সিঁদুর দিতে পারেন না। হঠাত্ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, মা তোমার ছবি বুকে জড়িয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন। বাবা, আমার মায়ের চোখের জল কি কোনো দিন মুছবে না? আমাদের ঘরে তুমি, আমি, মা, দাদু-দিদা-মামা—সবাই মিলে একটা ছবি আছে। ওই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। সেই আনন্দের ছবিটা থেকে ওরা কেন তোমাকে কেড়ে নিল বাবা, আমার কী দোষ ছিল?
মা বলেন, তুই বড় হয়ে ঠিক তোর বাবার মতো জজ হবি। আমি হব, বাবা। তোমার মতো। তোমার সেই কোট, জুতো—সবকিছু আমি গোপনে গোপনে পরে দেখি, আমাকে জজের মতো লাগে কি না। কিন্তু বাবা, আমার ভয়ও করে। যারা তোমাকে মেরেছিল, ওদের লোকজন এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে কাকু তোমার মামলা লড়েছিল, তাকেও ওরা মেরে ফেলেছে। ওরা সবকিছু দখল করে নিতে চায়। খুনিরা যদি সবকিছু দখল করে, ওদের যদি নির্মূল করা না যায়, তবে আমি বড় হব কোন দেশে বাবা! আমি মায়ের দুঃখ ঘোচাব কী করে বলো? আমার মা আর বাংলা মায়ের দুঃখ আজ একাকার মনে হয়। আমি ছোট বলে ভেব না, কিছু বুঝি না। আমি সব বুঝি বাবা। কে ভালো, কে মন্দ, আমি বুঝি বাবা। বুঝি বলেই আমি ঠিক করেছি, আমি তোমার মতো বিচারক হব। যত দিন আমি তোমার মতো হতে না পারছি, তত দিন যে আমার তোমার জন্য প্রতীক্ষার অবসান হবে না। যেদিন বিচারক হব, তোমার মতো পোশাক পরে, মায়ের হাত ধরে তোমার সমাধির পাশে গিয়ে তোমাকে ডাকব। সেদিন কি তুমি আসবে তোমার ছোট্ট শ্রেষ্ঠর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে?
No comments