মানবজীবনে ট্র্যাজেডি by মোজাফফর হোসেন
মৃত্যুর
আগ পর্যন্তু মানুষের বেঁচে থাকাকে বলা হয় মানবজীবন। জগতের শ্রেষ্ঠ জীবন
মানবজীবন। অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষ এ জন্য আলাদা যে, তাদের সুখ ও দুঃখ
ভোগ করার একটা ভিন্নরকমের অনুভূতি রয়েছে। চরম সুখে মানুষ পুলকিত হতে পারে
আবার কঠিন দুঃখে মানুষ মুষরে পড়তে পারে। যার যার মতো করে মানুষ সুখী হয়
আবার এই মানুষই যার যার মতো করে দুঃখ ভোগ করে। এই বৈশিষ্ট্যই মানবজীবনকে
অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছে। কিছু মানুষ রয়েছে যারা সারা জীবনই
সুখ ভোগ করতে পারে আর কিছু মানুষ রয়েছে সারা জীবনই দুঃখ-কষ্টে বেঁচে থাকেন।
কোনো মানুষের জীবনে কোনো একসময় সুখ ধরা দিতে পারে আবার দুঃখও তেমনি করে
হঠাৎ জীবনের দরজায় কড়া নাড়তে পারে। সুখ ও দুঃখ এভাবেই নিজ নিজ গন্তব্য ঠিক
করে নিয়ে আবর্তিত হতে থাকে। সুখ কী আর দুঃখইবা কাকে বলে এ নিয়েও বিস্তর
মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ছোট ছোট সুখ এবং ছোট ছোট দুঃখের কোনো সংজ্ঞা দেয়া
যায় না। এগুলো আপেক্ষিক। বড় বড় দুঃখের সংজ্ঞা না হলেও সেসব দুঃখকে দেখা
যায়। ছোট ছোট সুখ; ছোট ছোট দুঃখ প্রায় সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি অবস্থান
করে। কিন্তু বড় বড় সুখ ও বড় বড় দুঃখ বাসা বাঁধতে পারে বড় বড় মানুষের জীবনে।
মহৎ ব্যক্তিত্বের সুখ ও দুঃখ আস্বাদনের মাত্রা সাধারণ মানুষের তুলনায়
ভিন্নতর হয়ে থাকে। জীবনবোধের অনুভূতি যত গভীর হয় সুখ ও দুঃখ বোধের পরিমাণও
ততই গভীর হতে পারে। পাহাড়কে নিশ্চিহ্ন করতে বড় শক্তির প্রয়োজন পড়ে। সেরকম
বীর ও মহৎপ্রাণ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতে বড় দুঃখ লাগে। অর্থাৎ বড় দুঃখের
জন্য বড় মানুষ এবং বড় সুখের জন্যও বড় মানুষের দরকার পড়ে। যেমন বড় সুখ ধরা
দিতে পারে রাজা-বাদশাদের জীবনে এবং বড় দুঃখগুলো তাদের জীবনে প্রবেশ করার পথ
খুঁজতে থাকে। বড় মানুষের জীবনে যখন বড় সুখ ধরা দেয় তখন সেই সুখকে বলা হয়
সাফল্য। আবার এই সফল জীবনে যখন ধরা পড়ে বড় দুঃখ তখন সেই দুঃখভোগকে বলা হয়
ট্র্যাজেডি।
দুঃখ কমবেশি অধিকাংশ মানুষের জীবনেই ঘটে থাকে। সেই দুঃখ যখন ভয়াবহ রূপে মানব জীবনে অনুপ্রবেশ করে তখন মানুষ শিউরে ওঠেন; বিহবল হয়ে পড়েন দুঃখ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। নানান কৌশল অবলম্বন করেও যখন দুঃখকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন তখন মানবজীবনকে ভোগ করতে হয় দুঃখের করুণ পরিণতি। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকেন; ধীরে ধীরে দুঃখ সাগরের অতলগহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েন। দুঃখের শুরু থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্তু যে অসহ্য যন্ত্রণা ও নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট তিলে তিলে ভোগ করতে গিয়ে মানব মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয় সেই অপ্রত্যাশিত অনুভূতিই হলো ট্র্যাজেডি। এরিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডি হলো অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বে পরাভূত মানবজীবনের করুণ কাহিনী। অর্থাৎ মানুষের দুঃখময় জীবনের করুণ পরিণতি বা ইতিবৃত্তকেই বলা হয় ট্র্যাজেডি। মানবজীবনে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয় তখনই যখন কোনো শক্তিমান এবং প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ অন্তর্ঘাত ও বহির্ঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করে। এই আঘাত যেকোনো স্থান থেকে আসতে পারে। হতে পারে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা কিংবা আপনজন অথবা প্রিয়জনের কাছ থেকে। হতে পারে নিজের কোনো ভুলের কারণে অথবা পারিপার্শ্বিক কোনো ঘটনার জন্য কিংবা অদৃষ্টের প্রভাবেও মানবজীবন তিলে তিলে বিনষ্ট হতে পারে।
দুঃখ মানবজীবনে কীভাবে বাসা বাঁধতে পারে এবং সেই দুঃখে মানুষ কীভাবে ট্র্যাজিক চরিত্রে উপনীত হতে থাকে তার দৃষ্টান্ত সাহিত্যের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। বলা হয় সাহিত্য হলো মানবজীবনের আয়না। সাহিত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের ট্র্যাজেডিকে অবলোকন করতে হলে নাট্যসাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। একমাত্র নাটকই পারে ট্র্যাজিক চরিত্রকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করতে। ট্র্যাজেডি নাটকের রূপরেখা দিতে গিয়ে এরিস্টটল বলেন, Tragedy, then, is an imitation of an action that is serious, complete, and of a certain magnitude;in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play; in the form of action, not of narrative; through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions. তাই ট্র্যাজেডিকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে নাটক। মানবজীবনে ট্র্যাজিডি কিভাবে ঘনীভূত হতে থাকে সেটা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পরিবেশন করতে হলে নাটকের বিকল্প আশা করা যায় না। সেজন্যে ট্যাজেডিকে বুঝতে ও বুঝাতে নাটকের শরণাপন্ন হতে হয়। ট্র্যাজিডির স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস (খ্রি.পূ ৪৯৬-৪০৬) রচনা করেছিলেন ‘দি কিং ইডিপাস’ নাটক। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬ খ্রি.) রচনা করেছিলেন ‘হ্যামলেট; ম্যাকবেথ’ এবং নরওয়েতে জন্ম নেয়া হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬) রচনা করেছিলেন ‘আ ডলস্ হাউজ’।
মানুষ নানাভাবে ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারেন। সফোক্লিসের ধারণা মতে, মানুষ নিয়তির ক্রীড়নক। দৈবশক্তির প্রভাবে মানবজীবনে দুঃখের প্রবেশ ঘটতে পারে। তিনি তার নাটক দি কিং ইডিপাসে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মানুষ নিয়তির বাইরে একধাপও এগোতে পারেন না। মানুষের অদৃষ্টে যা লেখা রয়েছে তা যেকোনোভাবে ঘটবেই। ‘ইডিপাস’ নাটকের কাহিনীও সেদিকেই অগ্রসর হয়েছে। ইডিপাস রাজা হয়েছেন ঠিকই কিন্তু যখন তিনি জানতে পেরেছেন; যে রাজাকে হত্যা করে তিনি রাজ্যের অধিপতি হয়েছেন সেই রাজা ছিলেন তারই জন্মদাতা পিতা আর যে রানী তার সংসার করছেন তিনিই হলেন ইডিপাসের মা। এই সত্য জানার কারণে ইডিপাসের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা, দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ ও হতাশার উদ্রেগ ঘটে। ধীরে ধীরে ইডিপাসের জীবনে নেমে আসে কঠিন দুর্যোগ। রাজ্যসিংহাসনচ্যুত হয়ে ইডিপাস নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে থাকেন এবং আত্মগ্লানিতে ভুগতে ভুগতে ইডিপাস একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। নিয়তিকে উপেক্ষা করার লক্ষ্যে ইডিপাসের জন্মের পরপরই তার বাবা ইডিপাসকে হত্যার উদ্দেশ্যে মেষপালক ভৃত্যের হাতে তুলে দেন; কিন্তু মেষপালক ইডিপাসকে হত্যা না করে ভিন্ন রাজ্যের শিকারিদের কাছে হস্তান্তর করেন। ইডিপাসের বেঁচে যাওয়ার কারণে দৈববাণীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়নি আর নিয়তিও ইডিপাসের পিছু ছাড়েনি।
শেক্সপিয়রের ধারণা মতে, মানবজীবনে ট্র্যাজেডি শুধু গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো নিয়তির প্রভাবে ঘটে না; অন্যভাবেও ঘটতে পারে। মানুষ তার নিজের কোনো একটি ভুল বা চারিত্রিক দুর্বলতা সৃষ্টিকরত ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারেন। এই মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে শেক্সপিয়র তার নাটকের চরিত্র ও ঘটনা গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস থেকে। ইতিহাসের বিখ্যাত চরিত্রগুলোর দুর্বল কোনো বৈশিষ্ট্যের কোটর গলিয়ে ছোট্ট একটি ভুল ঢুকে পড়লে তা ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হতে থাকে। সেই ছোট্ট ভুল চরিত্রটিকে পরে ভেতর ও বাহির থেকে তছনছ করে তোলে। নৌকার ক্ষুদ্র একটি ছিদ্র বেয়ে পানি উঠতে উঠতে একসময় সমগ্র নৌকাটিকে যেভাবে নিমজ্জিত করে ফেলে ঠিক তেমনিভাবে একটি ভুল একটি চরিত্রের অনায়াসে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। শেক্সপিয়র তার ওথেলো ও ম্যাকবেথ নাটকে সে অবস্থার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। ম্যাকবেথ নাটকে দেখা গেছে রাজা ডানকানের রাজ্যে জাতীয় বীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ম্যাকবেথ। তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র প্রধান সেনাপতি বীর ম্যাকবেথ। দেশ রক্ষা করার সব কৃতিত্বই তার। কিন্তু রাজ্যের যাবতীয় সুনাম ও সুবিধা ভোগ করেন রাজা ডানকান। এটি লেডি ম্যাকবেথের ভালো ঠেকল না। লেডি ম্যাকবেথ ভাবল তার স্বামী রাজ্যের প্রধান সেনাপতি এবং জাতীয় বীর। রাজা ডানকানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া তার পক্ষে ক্ষণিকের ব্যাপার। লেডি ম্যাকবেথ আরো ভাবল যদি রাজা ডানকানকে রাজ্যক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে খুব সহজেই ম্যাকবেথ রাজা হতে পারবেন আর তিনি হবেন রানী। রানী হওয়ার স্বপ্ন লেডি ম্যাকবেথকে পেয়ে বসল। ডানকানকে হত্যা করতে সে প্রতিনিয়ত স্বামী ম্যাকবেথকে প্ররোচিত করতে লাগলেন। স্ত্রী অনুরক্ত ম্যাকবেথ স্ত্রীর রানী হওয়ার সাধ পূরণ করতে নিরস্ত্র রাজা ডানকানকে হত্যা করে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। কিন্তু বিবেকের কাছে পরাজিত হলেন ম্যাকবেথ। প্রতি রাতে ডানকানের প্রেতাত্মা ম্যাকবেথকে ধিক্কার জানাতে লাগলেন। বিবেকের দংশনে ম্যাকবেথ রাজ্যক্ষমতা ত্যাগ করলেন। ভাবলেন স্ত্রীর কথা শুনে যে ভুল তিনি করলেন তা ক্ষমার অযোগ্য; এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় না। ম্যাকবেথ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। একসময় আত্মহত্যা করে মুক্তি খুঁজলেন। নাটকে লেডি ম্যাকবেথের অবৈধভাবে গ্রণী হওয়ার বাসনা সেনাপতি ম্যাকবেথকে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে ফেলে ধ্বংস করেছে।
গ্রিক নিয়তি ও শেক্সপিয়রের চারিত্রিক দুর্বলতা ব্যতিরেকেও মানবজীবন যে ট্র্যাজেডি আক্রান্ত হতে পারে তার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন ইবসেন। নরওয়ে নাট্যকার হেনরিক ইবসেন তার ‘আ ডল হাউজ’ নাটকে সফোক্লিস ও শেক্সপিয়রের ধারণা ছাড়াও ট্র্যাজেডি সঙ্ঘটিত হওয়ার উপায় দেখিয়েছেন। হেনরিক ইবসেন ছিলেন সমকালীন সমাজ ও সমসাময়িক মানবজীবনের বিশ্লেষক। তিনি দেখালেন পারিপার্শ্বিক একটি ঘটনা কীভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ট্র্যাজেডিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তার ‘আ ডল হাউজ’ নাটকের নোরা চরিত্রটি সে ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছে। দ্বন্দ্ব আর সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে সংসার বেশি দিন টেকে না। নোরার জীবনেও তাই ঘটেছিল। স্বামী, সন্তান ত্যাগ করে পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নোরা মুক্তির আশায় বেরিয়ে পড়েছিল। এতে সমাজের তির্যক দৃষ্টি এসে পড়েছে তার ওপর। তাকে কটাক্ষ্য সহ্য করতে হয়েছে। উপর্যুপরি কটাক্ষ্যের কারণে নোরা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে উঠেছেন। এতে যে দুঃখ তিনি পেয়েছেন তা ট্র্যাজেডির কোনো অংশে কম নয়। সমাজ তাকে পাগল বলেছে।
স্বামী সন্তান সংসারের মায়া ত্যাগ করে একজন নারী যখন অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে সংসার ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হন তখন কতটা ক্ষত তাকে বিচলিত করে তুলতে পারে তা অনুধাবনের বিষয়। এরকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলাকে হেনরিক ইবসেন ট্র্যাজেডির কোনো অংশে কম বলে মনে করেন না।
দুঃখ কমবেশি অধিকাংশ মানুষের জীবনেই ঘটে থাকে। সেই দুঃখ যখন ভয়াবহ রূপে মানব জীবনে অনুপ্রবেশ করে তখন মানুষ শিউরে ওঠেন; বিহবল হয়ে পড়েন দুঃখ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। নানান কৌশল অবলম্বন করেও যখন দুঃখকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন তখন মানবজীবনকে ভোগ করতে হয় দুঃখের করুণ পরিণতি। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকেন; ধীরে ধীরে দুঃখ সাগরের অতলগহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েন। দুঃখের শুরু থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্তু যে অসহ্য যন্ত্রণা ও নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট তিলে তিলে ভোগ করতে গিয়ে মানব মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয় সেই অপ্রত্যাশিত অনুভূতিই হলো ট্র্যাজেডি। এরিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডি হলো অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বে পরাভূত মানবজীবনের করুণ কাহিনী। অর্থাৎ মানুষের দুঃখময় জীবনের করুণ পরিণতি বা ইতিবৃত্তকেই বলা হয় ট্র্যাজেডি। মানবজীবনে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয় তখনই যখন কোনো শক্তিমান এবং প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ অন্তর্ঘাত ও বহির্ঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে করুণ পরিণতি ভোগ করে। এই আঘাত যেকোনো স্থান থেকে আসতে পারে। হতে পারে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা কিংবা আপনজন অথবা প্রিয়জনের কাছ থেকে। হতে পারে নিজের কোনো ভুলের কারণে অথবা পারিপার্শ্বিক কোনো ঘটনার জন্য কিংবা অদৃষ্টের প্রভাবেও মানবজীবন তিলে তিলে বিনষ্ট হতে পারে।
দুঃখ মানবজীবনে কীভাবে বাসা বাঁধতে পারে এবং সেই দুঃখে মানুষ কীভাবে ট্র্যাজিক চরিত্রে উপনীত হতে থাকে তার দৃষ্টান্ত সাহিত্যের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। বলা হয় সাহিত্য হলো মানবজীবনের আয়না। সাহিত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের ট্র্যাজেডিকে অবলোকন করতে হলে নাট্যসাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। একমাত্র নাটকই পারে ট্র্যাজিক চরিত্রকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করতে। ট্র্যাজেডি নাটকের রূপরেখা দিতে গিয়ে এরিস্টটল বলেন, Tragedy, then, is an imitation of an action that is serious, complete, and of a certain magnitude;in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play; in the form of action, not of narrative; through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions. তাই ট্র্যাজেডিকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে নাটক। মানবজীবনে ট্র্যাজিডি কিভাবে ঘনীভূত হতে থাকে সেটা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পরিবেশন করতে হলে নাটকের বিকল্প আশা করা যায় না। সেজন্যে ট্যাজেডিকে বুঝতে ও বুঝাতে নাটকের শরণাপন্ন হতে হয়। ট্র্যাজিডির স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস (খ্রি.পূ ৪৯৬-৪০৬) রচনা করেছিলেন ‘দি কিং ইডিপাস’ নাটক। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬ খ্রি.) রচনা করেছিলেন ‘হ্যামলেট; ম্যাকবেথ’ এবং নরওয়েতে জন্ম নেয়া হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬) রচনা করেছিলেন ‘আ ডলস্ হাউজ’।
মানুষ নানাভাবে ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারেন। সফোক্লিসের ধারণা মতে, মানুষ নিয়তির ক্রীড়নক। দৈবশক্তির প্রভাবে মানবজীবনে দুঃখের প্রবেশ ঘটতে পারে। তিনি তার নাটক দি কিং ইডিপাসে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মানুষ নিয়তির বাইরে একধাপও এগোতে পারেন না। মানুষের অদৃষ্টে যা লেখা রয়েছে তা যেকোনোভাবে ঘটবেই। ‘ইডিপাস’ নাটকের কাহিনীও সেদিকেই অগ্রসর হয়েছে। ইডিপাস রাজা হয়েছেন ঠিকই কিন্তু যখন তিনি জানতে পেরেছেন; যে রাজাকে হত্যা করে তিনি রাজ্যের অধিপতি হয়েছেন সেই রাজা ছিলেন তারই জন্মদাতা পিতা আর যে রানী তার সংসার করছেন তিনিই হলেন ইডিপাসের মা। এই সত্য জানার কারণে ইডিপাসের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা, দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ ও হতাশার উদ্রেগ ঘটে। ধীরে ধীরে ইডিপাসের জীবনে নেমে আসে কঠিন দুর্যোগ। রাজ্যসিংহাসনচ্যুত হয়ে ইডিপাস নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে থাকেন এবং আত্মগ্লানিতে ভুগতে ভুগতে ইডিপাস একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। নিয়তিকে উপেক্ষা করার লক্ষ্যে ইডিপাসের জন্মের পরপরই তার বাবা ইডিপাসকে হত্যার উদ্দেশ্যে মেষপালক ভৃত্যের হাতে তুলে দেন; কিন্তু মেষপালক ইডিপাসকে হত্যা না করে ভিন্ন রাজ্যের শিকারিদের কাছে হস্তান্তর করেন। ইডিপাসের বেঁচে যাওয়ার কারণে দৈববাণীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়নি আর নিয়তিও ইডিপাসের পিছু ছাড়েনি।
শেক্সপিয়রের ধারণা মতে, মানবজীবনে ট্র্যাজেডি শুধু গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো নিয়তির প্রভাবে ঘটে না; অন্যভাবেও ঘটতে পারে। মানুষ তার নিজের কোনো একটি ভুল বা চারিত্রিক দুর্বলতা সৃষ্টিকরত ট্র্যাজেডির শিকার হতে পারেন। এই মন্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে শেক্সপিয়র তার নাটকের চরিত্র ও ঘটনা গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস থেকে। ইতিহাসের বিখ্যাত চরিত্রগুলোর দুর্বল কোনো বৈশিষ্ট্যের কোটর গলিয়ে ছোট্ট একটি ভুল ঢুকে পড়লে তা ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হতে থাকে। সেই ছোট্ট ভুল চরিত্রটিকে পরে ভেতর ও বাহির থেকে তছনছ করে তোলে। নৌকার ক্ষুদ্র একটি ছিদ্র বেয়ে পানি উঠতে উঠতে একসময় সমগ্র নৌকাটিকে যেভাবে নিমজ্জিত করে ফেলে ঠিক তেমনিভাবে একটি ভুল একটি চরিত্রের অনায়াসে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। শেক্সপিয়র তার ওথেলো ও ম্যাকবেথ নাটকে সে অবস্থার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। ম্যাকবেথ নাটকে দেখা গেছে রাজা ডানকানের রাজ্যে জাতীয় বীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ম্যাকবেথ। তিনি ছিলেন প্রধান সেনাপতি। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র প্রধান সেনাপতি বীর ম্যাকবেথ। দেশ রক্ষা করার সব কৃতিত্বই তার। কিন্তু রাজ্যের যাবতীয় সুনাম ও সুবিধা ভোগ করেন রাজা ডানকান। এটি লেডি ম্যাকবেথের ভালো ঠেকল না। লেডি ম্যাকবেথ ভাবল তার স্বামী রাজ্যের প্রধান সেনাপতি এবং জাতীয় বীর। রাজা ডানকানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া তার পক্ষে ক্ষণিকের ব্যাপার। লেডি ম্যাকবেথ আরো ভাবল যদি রাজা ডানকানকে রাজ্যক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে খুব সহজেই ম্যাকবেথ রাজা হতে পারবেন আর তিনি হবেন রানী। রানী হওয়ার স্বপ্ন লেডি ম্যাকবেথকে পেয়ে বসল। ডানকানকে হত্যা করতে সে প্রতিনিয়ত স্বামী ম্যাকবেথকে প্ররোচিত করতে লাগলেন। স্ত্রী অনুরক্ত ম্যাকবেথ স্ত্রীর রানী হওয়ার সাধ পূরণ করতে নিরস্ত্র রাজা ডানকানকে হত্যা করে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। কিন্তু বিবেকের কাছে পরাজিত হলেন ম্যাকবেথ। প্রতি রাতে ডানকানের প্রেতাত্মা ম্যাকবেথকে ধিক্কার জানাতে লাগলেন। বিবেকের দংশনে ম্যাকবেথ রাজ্যক্ষমতা ত্যাগ করলেন। ভাবলেন স্ত্রীর কথা শুনে যে ভুল তিনি করলেন তা ক্ষমার অযোগ্য; এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় না। ম্যাকবেথ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। একসময় আত্মহত্যা করে মুক্তি খুঁজলেন। নাটকে লেডি ম্যাকবেথের অবৈধভাবে গ্রণী হওয়ার বাসনা সেনাপতি ম্যাকবেথকে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে ফেলে ধ্বংস করেছে।
গ্রিক নিয়তি ও শেক্সপিয়রের চারিত্রিক দুর্বলতা ব্যতিরেকেও মানবজীবন যে ট্র্যাজেডি আক্রান্ত হতে পারে তার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন ইবসেন। নরওয়ে নাট্যকার হেনরিক ইবসেন তার ‘আ ডল হাউজ’ নাটকে সফোক্লিস ও শেক্সপিয়রের ধারণা ছাড়াও ট্র্যাজেডি সঙ্ঘটিত হওয়ার উপায় দেখিয়েছেন। হেনরিক ইবসেন ছিলেন সমকালীন সমাজ ও সমসাময়িক মানবজীবনের বিশ্লেষক। তিনি দেখালেন পারিপার্শ্বিক একটি ঘটনা কীভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ট্র্যাজেডিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তার ‘আ ডল হাউজ’ নাটকের নোরা চরিত্রটি সে ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছে। দ্বন্দ্ব আর সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে সংসার বেশি দিন টেকে না। নোরার জীবনেও তাই ঘটেছিল। স্বামী, সন্তান ত্যাগ করে পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নোরা মুক্তির আশায় বেরিয়ে পড়েছিল। এতে সমাজের তির্যক দৃষ্টি এসে পড়েছে তার ওপর। তাকে কটাক্ষ্য সহ্য করতে হয়েছে। উপর্যুপরি কটাক্ষ্যের কারণে নোরা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে উঠেছেন। এতে যে দুঃখ তিনি পেয়েছেন তা ট্র্যাজেডির কোনো অংশে কম নয়। সমাজ তাকে পাগল বলেছে।
স্বামী সন্তান সংসারের মায়া ত্যাগ করে একজন নারী যখন অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে সংসার ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হন তখন কতটা ক্ষত তাকে বিচলিত করে তুলতে পারে তা অনুধাবনের বিষয়। এরকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলাকে হেনরিক ইবসেন ট্র্যাজেডির কোনো অংশে কম বলে মনে করেন না।
No comments