স্মরণে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর by অমিয় পি সেন
বলা
হয় স্মৃতি হয় বাছাইপটু। এর সঙ্গে আরো বলতে হয় যে, এটা হতে পারে
সংক্ষিপ্তভাবে বাছাই করা। এটা অনেকটাই পরিহাসের বিষয় যে বহু বাঙ্গালী
যাদেরকে ২০১৯ সালের ১৫ মে গুন্ডাদের হাতে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি
ভাঙ্গা নিয়ে বিচলিত মনে হচ্ছে তারা সেই ১৯৭০-এর দশকের ঘটনাবলী উপেক্ষা
করতে চাচ্ছেন। তখন চরম বাম বাঙ্গালী আদর্শবাদী এবং তাদের সংগঠন দেশভারতী
‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবে’র নামে প্রকাশে বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা ভেঙ্গেছিলো।
এই ভাঙ্গচুরকে ক্ষুদ্ধ বাঙ্গালীরা বলছেন- বাঙ্গালীর সংস্কৃতির উপর
অবাঙ্গালীদের বড় আকারের সুপরিকল্পিত হামলা। এরপরও অনেকে বলছেন যে এ জন্য
বাঙ্গারীরা নিজেরাই দায়ি কারণ তারা বিদ্যাসাগরকে তাদের ‘পবিত্র গরু’ হিসেবে
তুলে ধরেছেন।
বিদ্যাসাগরকে স্মরণের জন্য উপযুক্ত উপলক্ষ হতে পারতো ২০২০ সালে তার ২০০তম জন্মদিন উযযাপন। কিন্তু সাম্প্রতি যে দু:খজনক ঘটনা ঘটেছে তা তার জন্মভূমি পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়েও বেশি আত্মদর্শন ও স্বপ্রতিক্রিয়শীলতার দিকে ডাকছে।
বিদ্যাসাগর ও তার কাজ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো রচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বিদ্যাসাগর চরিত্র’, যা চরিত্রপূজায় (১৯০৭) সংকলিত হয়। তীব্র আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী কবি দেখিয়েছেন, বিদ্যাসাগরের ‘শিক্ষাবিদ থেকে সংস্কারক’ চরিত্র সমসাময়িক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কতটা অমীল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গড়ে বাঙ্গালীরা বিশ্বাস স্থাপন করে কিন্তু সেগুলো কাজে পরিণত করার ইচ্ছা তাদের নেই। গড়ে বাঙ্গালীরা তার ইংলিশ সুপিরিয়রদের অনুসরণ করে গর্ববোধ করেন, তাদের দ্বারা প্রশংসিত হয়ে পুলকিত বোধ করেন, মোটের উপর সবাই ফাঁকাবুলি আওড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব চতুরতার জন্য তৃপ্ত হন।
বিদ্যাসাগরের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি হলো তিনি ছিলেন এসব বৈশিষ্ট্যের জীবন্ত এনটনিম বা বিপরীতার্থক শব্দ। নিদারুণ অধ্যাবসায় ও দৃঢ়সংকল্পের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একজন আত্মকৃত মানুষ, যাতনা ও উন্নতি ছিলো যার আপ্তবাক্য এবং যা তার নৈতিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট রীতিগুলো বিনির্মাণ করেছে, এবং আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যার কারণে আত্ম-সম্মান ও আত্ম-সংকল্প মানবজীবনকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ দিয়েছে। সমসাময়িক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে এটা ছিলো একটি দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গী এবং বিচ্ছিন্নতাজনিত অজ্ঞতা, ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং পশ্চিমা অনুপ্রাণিত সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
দৃশ্যত, এটা খুব অসাধারণ মনে হয়। তা নাহলে বিদ্যাসাগর ঐতিহ্যগত হিন্দু শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বিরোধিতা করতেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে পশ্চিম থেকে আসা নতুন শিক্ষার গ্রহণ করে হিন্দু শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞজনদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রয়োজন।
বিদ্যাসাগর মূলত বাঙ্গালী অজ্ঞরজ্ঞান বা বর্ণপরিচয় শিক্ষায় অবদানের জন্য স্মরণীয়। হিন্দু নারী ও স্ত্রীদের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি ব্যাপক ও নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ধর্মের ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিলো না, মনযোগ কেন্দ্রিভূত ছিলো সামাজিক ইস্যুগুলোতে। তার অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান না জানানো কোন মানুষের চত্রিত্রের সঙ্গে মেলে না । সম্ভবত এর সঙ্গে কিছু সত্যতাও জড়িত কারণ তিনি দক্ষিণেশ্বর থেকে আসা শ্রী রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পাল্টা সফরে যাননি, যিনি একসময় এই লোকটির সঙ্গে পরিচিত হতে, তার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন যাকে তারা জ্ঞানের সাগর (বিদ্যাসাগর) উপাধি দিয়েছিলেন।
সম্ভবত এ কারণেই ঈশ্বরের উপর বিদ্যাসাগরের তেমন কোন বিশ্বাস ছিলো না, যে ঈশ্বর দুর্বলের উপর সবলের অবাধ অন্যায় ও নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে পারে না। তার বন্ধু ও সমসাময়িক বাঙ্গালী চিন্তাবিদ অক্ষয় কুমার দত্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেন। দুই বন্ধুই মূলত ছিলেন যুক্তিবাদি এবং তারা বেকনিয়ান চিন্তুাধারাকে উৎসাহিত করতেন। দত্ত চাইতেন ধর্মের জায়গায় নীতিশাস্ত্রকে স্থান দিতে। যা স্পষ্টতই সমসাময়িক ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া চিন্তুাধারাকে রূপদান করছিলো। যা স্কটিশ লেখক স্যামুয়েল স্মাইলসের বই সেল্ফ হেল্প (১৮৫৯), ক্যারেক্টার (১৮৭১) ও থ্রিফট (১৮৭৫)-এ ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বিদ্যাসাগর বাঙ্গালী প্রাথমিক শিক্ষার বই লিখলেও বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে তেমন কিছু করেননি। বামদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হওয়ার আংশিক কারণও তাই। সামাজিক বিধি প্র্রণয়নের জন্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থকে আশ্রয় করার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপধ্যায়ের মতো সমসাময়িক ঔপন্যাসিকেরাও তার সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিম ও অন্যরা মনে করতেন এটা লোকটির সঙ্গে মানানসই নয় এমন একটি অধ:পতনশীল পদক্ষেপ।
বিদ্যাসাগরকে স্মরণের জন্য উপযুক্ত উপলক্ষ হতে পারতো ২০২০ সালে তার ২০০তম জন্মদিন উযযাপন। কিন্তু সাম্প্রতি যে দু:খজনক ঘটনা ঘটেছে তা তার জন্মভূমি পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়েও বেশি আত্মদর্শন ও স্বপ্রতিক্রিয়শীলতার দিকে ডাকছে।
বিদ্যাসাগর ও তার কাজ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো রচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বিদ্যাসাগর চরিত্র’, যা চরিত্রপূজায় (১৯০৭) সংকলিত হয়। তীব্র আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী কবি দেখিয়েছেন, বিদ্যাসাগরের ‘শিক্ষাবিদ থেকে সংস্কারক’ চরিত্র সমসাময়িক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কতটা অমীল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গড়ে বাঙ্গালীরা বিশ্বাস স্থাপন করে কিন্তু সেগুলো কাজে পরিণত করার ইচ্ছা তাদের নেই। গড়ে বাঙ্গালীরা তার ইংলিশ সুপিরিয়রদের অনুসরণ করে গর্ববোধ করেন, তাদের দ্বারা প্রশংসিত হয়ে পুলকিত বোধ করেন, মোটের উপর সবাই ফাঁকাবুলি আওড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব চতুরতার জন্য তৃপ্ত হন।
বিদ্যাসাগরের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি হলো তিনি ছিলেন এসব বৈশিষ্ট্যের জীবন্ত এনটনিম বা বিপরীতার্থক শব্দ। নিদারুণ অধ্যাবসায় ও দৃঢ়সংকল্পের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একজন আত্মকৃত মানুষ, যাতনা ও উন্নতি ছিলো যার আপ্তবাক্য এবং যা তার নৈতিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট রীতিগুলো বিনির্মাণ করেছে, এবং আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যার কারণে আত্ম-সম্মান ও আত্ম-সংকল্প মানবজীবনকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ দিয়েছে। সমসাময়িক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে এটা ছিলো একটি দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গী এবং বিচ্ছিন্নতাজনিত অজ্ঞতা, ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং পশ্চিমা অনুপ্রাণিত সংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
দৃশ্যত, এটা খুব অসাধারণ মনে হয়। তা নাহলে বিদ্যাসাগর ঐতিহ্যগত হিন্দু শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বিরোধিতা করতেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে পশ্চিম থেকে আসা নতুন শিক্ষার গ্রহণ করে হিন্দু শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞজনদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রয়োজন।
বিদ্যাসাগর মূলত বাঙ্গালী অজ্ঞরজ্ঞান বা বর্ণপরিচয় শিক্ষায় অবদানের জন্য স্মরণীয়। হিন্দু নারী ও স্ত্রীদের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি ব্যাপক ও নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ধর্মের ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিলো না, মনযোগ কেন্দ্রিভূত ছিলো সামাজিক ইস্যুগুলোতে। তার অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান না জানানো কোন মানুষের চত্রিত্রের সঙ্গে মেলে না । সম্ভবত এর সঙ্গে কিছু সত্যতাও জড়িত কারণ তিনি দক্ষিণেশ্বর থেকে আসা শ্রী রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পাল্টা সফরে যাননি, যিনি একসময় এই লোকটির সঙ্গে পরিচিত হতে, তার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন যাকে তারা জ্ঞানের সাগর (বিদ্যাসাগর) উপাধি দিয়েছিলেন।
সম্ভবত এ কারণেই ঈশ্বরের উপর বিদ্যাসাগরের তেমন কোন বিশ্বাস ছিলো না, যে ঈশ্বর দুর্বলের উপর সবলের অবাধ অন্যায় ও নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে পারে না। তার বন্ধু ও সমসাময়িক বাঙ্গালী চিন্তাবিদ অক্ষয় কুমার দত্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেন। দুই বন্ধুই মূলত ছিলেন যুক্তিবাদি এবং তারা বেকনিয়ান চিন্তুাধারাকে উৎসাহিত করতেন। দত্ত চাইতেন ধর্মের জায়গায় নীতিশাস্ত্রকে স্থান দিতে। যা স্পষ্টতই সমসাময়িক ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া চিন্তুাধারাকে রূপদান করছিলো। যা স্কটিশ লেখক স্যামুয়েল স্মাইলসের বই সেল্ফ হেল্প (১৮৫৯), ক্যারেক্টার (১৮৭১) ও থ্রিফট (১৮৭৫)-এ ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বিদ্যাসাগর বাঙ্গালী প্রাথমিক শিক্ষার বই লিখলেও বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে তেমন কিছু করেননি। বামদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হওয়ার আংশিক কারণও তাই। সামাজিক বিধি প্র্রণয়নের জন্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থকে আশ্রয় করার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপধ্যায়ের মতো সমসাময়িক ঔপন্যাসিকেরাও তার সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিম ও অন্যরা মনে করতেন এটা লোকটির সঙ্গে মানানসই নয় এমন একটি অধ:পতনশীল পদক্ষেপ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০-২৯ জুলাই ১৯৮১) |
No comments