ঢাবিতে হলে হলে আতঙ্ক, ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার by ফররুখ মাহমুদ ও মুনির হোসাইন
নানা
চাপ। হুমকি। আতঙ্কে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে হল ছেড়েছেন। এই যখন অবস্থা তখন
কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রী নির্যাতনে অভিযুক্ত হল শাখা ছাত্রলীগের
সভাপতি ইফফাত জাহান ইশাকে স্বপদে ফিরিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল সংগঠনটির
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম
জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এরপর
দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ছাত্রলীগ নেত্রী
ইশাকে ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে একাধিকবার ভিসির মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও
প্রতিবারই তার প্রটোকল অফিসার ধরে জানিয়েছেন ‘ভিসি স্যার ব্যস্ত আছেন।’ এর
আগে বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগ নেত্রী ইশা হলে ফিরছেন এমন আতঙ্কে রাতেই হল
ছেড়েছেন প্রায় দেড় ডজন সাধারণ ছাত্রী। গতকালও সকাল থেকে বেশ কিছু ছাত্রী হল
ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলেও কোটা সংস্কার
আন্দোলনে যাওয়া শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন ধরনের হুমকি, হয়রানি ও ব্লেমগেইম চলছে আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রীয়
কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধেও। অন্যদিকে আন্দোলনকারী কোনো শিক্ষার্থী বা
কেন্দ্রীয় কমিটির কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি হলে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার
হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। হয়রানি না করতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা কথা
বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ও আওয়ামী লীগ
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরর সঙ্গে।
ইশার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে ওই টেলিভিশন চ্যানেলকে ভিসি বলেন, ‘শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না, বরং সম্মানিত হবে এবং সেটি উচিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সেটি হবে। কারণ আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। ওই মেয়েটির কাছ থেকে আমরা যেটি শুনেছি যে ওই মেয়ে একটি দরজায় পা দিয়ে আঘাত হানার কারণে তার পা কেটে গেছে।’ এদিকে ইশাকে ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে ভিসির দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আমি জানি না। ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। আমি জানিও না। তবে ভিসি স্যার যদি বলে থাকেন, তাহলে তো তিনি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কথা বলবেন।’
এদিকে ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে ছাত্রলীগের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সংগঠটির চার সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন ইশা। তাই তাকে স্বপদে বহাল করা হলো। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করার পর থেকেই ছাত্রলীগের একটি অংশ ইশাকে নির্দোষ প্রমাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। যাদের অনেকে ওইদিনের সংঘটিত ঘটনার পর ইশার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইশার বাসায় গিয়ে তাকে ফুলের মালা পরিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রীরা। অন্যদিকে ইশা হলে ফিরছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই হল ছেড়েছেন সুফিয়া কামাল হলের প্রায় দেড় ডজন ছাত্রী। আতঙ্ক বিরাজ করছে হলটির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। হলটির একাধিক ছাত্রী জানান, ইশা হলটির নেতৃত্বে আসার পর থেকে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন করে থাকেন। বিভিন্ন সময় মারধরও করা হয়েছে অনেককে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা সক্রিয় তাদের নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এত দিন কেউ ভয়ে মুখ খুলেননি। সর্বশেষ গত সোমবারের ঘটনার পর অনেকে ইশার নানা ধরনের অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাই এখন ইশা হলে ফিরলে আগের চেয়েও বেশি নির্যাতন শুরু হবে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর। তাই আমরা হলে এখন অনিরাপদ বোধ করছি। গতকাল সন্ধ্যায় হল ছাড়ার সময় এক ছাত্রী বলেন, ‘হলের সভাপতি হলে আসছেন শুনে আমরা হল ছাড়ছি। তিনি আমাদের মারধর করেন। সেদিন এক ছাত্রীর পা কেটে দেয়ায় আমরা তার প্রতিবাদ করি। তিনি হলে আসলে আমরা আবারো নির্যাতিত হবো। তাই চলে যাচ্ছি।’ অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তিনি আমাকে মারধর করেছেন। গেস্টরুমে নির্যাতন করতেন। তিনি হলে আসলে আবারো এই কাজ করবেন বলে আমি হল ছাড়ছি।’ তবে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান বলেন, ‘সে বহিষ্কৃত। তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত হলে উঠতে পারবে না। আর যেসব মেয়েরা হল ছাড়ছে তাদের বিষয়ে আমি অবগত নই।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা রহমান হলের ছাত্রীদের নিয়ে এক সাধারণ সভার আয়োজন করেন। যেখানে শিক্ষার্থীরা ইশার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে। সাধারণ সভায় হলটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ম্যাম আমরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হল চাই। সেখানে কেন সিট বাণিজ্য থাকবে? কেন পলিটিক্যাল ফ্লোর এবং নন পলিটিক্যাল ফ্লোর থাকবে। আমরা এখানে সিটের আশায় উঠেছি, রাজনীতি করার জন্য উঠি নাই। একজন পদত্যাগ করেছে। আরো একজন হলে আছে। তারা আমাদের সমস্যা করবে। আমাদের দায়ভার কে নেবে।’ আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা রাজনীতি মুক্ত হল চাই। মেয়েরা যেটার জন্য এত ভয় পায় সেটা হলো নোংরা সিট পলিটিক্স। যার হুমকি দিয়ে মেয়েদের নির্যাতন করা হয়। পলিটিক্যাল মেয়েদের দায়িত্বও প্রশাসন নিক। অন্য কেউ অভিভাবক নয়।’
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অন্যান্য হলের ছাত্রছাত্রীদেরও নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ‘অপপ্রচার’। ইতিমধ্যে হল ছেড়েছে অনেকে। গতকাল দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর প্রতিবাদ ও হয়রানি অভিযোগ করে আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফেসবুক গ্রুপ থেকে লাইভে বক্তব্য রাখেন। এসময় রাশেদ তার বক্তব্যে নিজের ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভাইয়েরা আমাকে এখন বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও ভিসি স্যারের বাসায় হামলা করেছি বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমি এসবের কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। যদি সম্পৃক্ত থাকতাম তাহলে গত দুই মাস যাবৎ গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমার পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পায়নি কেন? আপনারা কী গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও বেশি এক্সপার্ট ও আইটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন? এসময় রাশেদ বলেন, যারা এখন অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তারা চাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে বানচাল করতে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যের পক্ষে ছিলাম। এখনো আছি। আর আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও আন্দোলনকারীদের ওপর যদি কোনো ধরনের হয়রানি না হয় সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকবেন। রাশেদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান ওই গ্রুপে লেখেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি এক আছি। আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। যে কোনো অন্যায়ের দাঁত ভাঙা জবাব দেয়া হবে।’ আর যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, ‘নতুন নাটক তৈরি করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বোকা বানাতে চেষ্টা করবেন না। শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথে নামলে কিন্তু পালাবার পথ পাবেন না।’
এদিকে আন্দোলকারীদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা ভিসির বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছেন। দাবি করেছেন হলে যেন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থাকতে পারে। কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়। ভিসি তখন তাদের কোনো সংগঠন কর্তৃক কাউকে হয়রানি যেন না করা হয় সে বিষয়ে প্রশাসনের সজাগ থাকার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। এছাড়াও আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও অবহিত করেছেন যেন কাউকে সারা দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়। মন্ত্রীও তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যেন কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে আমরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আমাদের ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘এরপরও যদি কাউকে হয়রানি করা হয়, তাহলে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যবস্থা নিবো।’ অন্যদিক ছাত্রলীগ নেত্রীর ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এই ইস্যুতে এখনো আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো বক্তব্য নেই। যদি কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত থাকে তাহলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
সে রাতে ঢাবির ছাত্রী হলে যা ঘটেছে
রাত সাড়ে ৯টায় হলে আসি। এ সময় অনেকে সর্তক করছিল, তোমাদের ওপর হামলা হতে পারে। যারা আন্দোলনে গেছো তাদের ওপর গোপন হামলা হতে পারে। সবাই সাবধানে থেকো। পরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে দরজা আটকে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ করে শুনি চিৎকার। অনেক জোরে চিৎকার। একটা আপু দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো হলের নিচে নামো। কাউকে মারছে মনে হয়। আমরা দৌড়ে নিচে নামলাম। পরে কয়েকজন ইশার রুমের সামনে গেলাম। সেখান থেকেই চিৎকার এসেছিল। রুমের সামনে গিয়ে দেখি কয়েকটা পলিটিক্যাল মেয়ে দাঁড়ানো। তারা নিজেদের মধ্যে ফান করছে। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম এত জোরে চিৎকার করলো কে? তখন তারা বললো গায়ের ওপর একটা পোকা পড়েছিল তাই চিৎকার দিচ্ছে। এ কথা শুনে আমরা চলে আসছিলাম। পরে বড় আপুরা বলতেছে, পোকার কারণে এত জোরে চিৎকার করবে কেন? এসময় আমরা ইশার রুম থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখি। কয়েকজন বললো বেসিনেও দাগ দেখেছে তারা। এরপর মেয়েরা একত্রিত হয়ে ইশার রুমের সামনে যায় এবং দরজা খোলার জন্য বলে। একপর্যায়ে ইশা দরজা খুলে। একসঙ্গে এত মেয়েকে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। কান্না করে দেয়। তাকে মারধর যাতে না করে সেজন্য অনুরোধ করতে থাকে। মেয়েরা জানতে পারে ৫-৬ জনকে মারধর করেছে ইশা। এর মধ্যে দুজনের পা কেটে যায়। ছাত্রীরা ইশাকে নিচে নামিয়ে আনতে চাইলে সে দৌঁড় দেয়। একপর্যায় উত্তেজিত হয়ে কিছু মেয়ে তার গায়ে হাত তুলে। মারধর করে। নিচে নামিয়ে আনে। খবর পেয়ে প্রক্টর ও হল কর্তৃপক্ষ আসে। তাদের সামনে ইশা নিজের দোষ স্বীকার করে। সবার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু মেয়েরা তাকে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারের দাবি জানায়। জুতোর মালা পরিয়ে দেয়। টেলিভিশনে দেখি তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারপর রুমে চলে আসি। গত ১০ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বর্ণনারত ওই ছাত্রী বলেন, হলের মেয়েরা ইশার ওপর আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, ইশা মেয়েদের নানাভাবে কষ্ট দিতো। তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতো। আগে থেকেই মেয়েরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। কিছু হলেই মেয়েদের মারধর করতো। হুমকি দিতো।
ওই রাতে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান ইশা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে মারধর করে। এদের মধ্যে একজন ছাত্রীর পায়ের গোড়ালির ওপরের অংশ কেটে যায়। খবরটি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। মেয়েরা হলের ভেতরে অবস্থান করে। ছাত্রীরা দাবি জানায়, ইশাকে হল, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারও করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ইশাকে বহিষ্কার করেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এই বহিষ্কারাদেশকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই আবার ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলনে নামেন। গতকাল রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন। আগের দিন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বিবৃতিতে দেন এবং রাতে ইশাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। ছাত্রলীগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে ইশা সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। যার ওপর ভিত্তি করে ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রলীগ। এদিকে ওই দিন রাতে ইশার রুমের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে আন্দোলনে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে ইশার কথোপকথন শোনা যায়। সেখানে ইশা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, “এত কুরকুরানি না। যারা যারা প্রোগ্রামে গেছে কাল এবং আজ তারা ছাড়া সবাই চলে যা। অথবা পেছন থেকে সামনে আয়। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা বলেন, এই তুই সামনে আয়। মোবাইল দে। আমি কি বলছি। নাটক... (প্রকাশের অযোগ্য)। হুম। ওরা কি খুব সংস্কার করে দিছে। হলের মধ্যে তোমার ভাইয়েরা এসে ঠেকাবে না। বুজছো। ওই পাওয়ারগিরি দেখাতে আসবা না। পিছনে কে আছে দেখা যাচ্ছে না, সর। আরেক মেয়েকে বলে, তুইও গেছিলি। আমি তোকে নিজে নিষেধ করছিলাম। পাশের জনকে উদ্দেশ্য করে ইশা বলেন, জিজ্ঞেস কর। আমি নিজে নিষেধ করেছি। কেন গেছিলি? আমি নিষেধ করার পরও কেন গেছিলি? মুন আপু (খালেদা হোসাইন মুন, ওই হলের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি) তোকে গালি দিসিলো না। বেয়াদব বলেছিল না। তুই আসলেই একটা বেয়াদব। সোজা হয়ে দাঁড়া। তোদের চেহারাগুলো দেখি। তোদের মধ্যে গডফাদার পল? এই তুই, তুই। তুই তো যাবি। তুই তো হাড়েহাড়ে শয়তান। মিনমিনে শয়তান। চেহারাটা দেখ কি সুন্দর করে রাখে। মনে হয় পৃথিবীর একটা ইনোসেন্ট। আর ভিতরে ভিতরে এত রস। তুই গণরুমে চলে যাবি। রুমে থাকতে পারবি না। সব গোছাইছিস। গোছাইসনি কেন? আমি এখন চারটা মেয়ে পাঠাবো। তোরা গণরুমে চলে যাবি। তিনজনের জন্য এই শাস্তি। তোরা সবাইরে নিয়ে গেছিলি। তোদের পদে পদে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলিসনি কেন? এখন থেকে হলে থাকতে হলে প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা বলবি। তুই, তুই আর তুই। এই তিনজন। আর কেউ না। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা আরো বলেন, এই তুই তোর আব্বুকে কল দে। মেয়েটি দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইশা বলে না হলে আমি কল দিবো। তখন অনেক খারাপ হবে। তুই কল দে। আমি যেটা বলি সেটা করেই ছাড়ি। হলের গেট ভেঙে তোরা আন্দোলনে যাস। এটা তোর আব্বুকে বলে দিবো। তখন তোর পরিবারের সবাই বিষয়টি জানবে। কাল থেকে কেউ আমাকে না বলে কোথাও বের হবি না।’ এদিকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারাদাশে প্রত্যাহার করায় হলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ১২ই এপ্রিল রাতেই হল থেকে ১৫/২০ জন ছাত্রী বাড়ি চলে যায়। হলে অবস্থানরতদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে ইশার ওপর থেকে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভিসি ড. আখতারুজ্জামান বলেন, শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না। বরং সম্মানিত হবে। সেটি উচিত হবে। কারণ, আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। যদিও ঘটনার দিন রাতেই ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। ওই দিন তিনি বলেন, তাকে শারীরিকভাবে আহত করেছে। এটা জানার পর আমি দুই দিক থেকে ভেরিফাই করলাম। প্রক্টর এবং হল প্রশাসন বললো। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু ওই মেয়ে আরেকজনকে আঘাত করেছে তাই তাকে বহিষ্কার করলাম।”
ইশার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে ওই টেলিভিশন চ্যানেলকে ভিসি বলেন, ‘শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না, বরং সম্মানিত হবে এবং সেটি উচিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সেটি হবে। কারণ আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। ওই মেয়েটির কাছ থেকে আমরা যেটি শুনেছি যে ওই মেয়ে একটি দরজায় পা দিয়ে আঘাত হানার কারণে তার পা কেটে গেছে।’ এদিকে ইশাকে ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে ভিসির দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আমি জানি না। ছাত্রত্ব ফিরে দেয়ার বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। আমি জানিও না। তবে ভিসি স্যার যদি বলে থাকেন, তাহলে তো তিনি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কথা বলবেন।’
এদিকে ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে ছাত্রলীগের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সংগঠটির চার সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন ইশা। তাই তাকে স্বপদে বহাল করা হলো। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করার পর থেকেই ছাত্রলীগের একটি অংশ ইশাকে নির্দোষ প্রমাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন। যাদের অনেকে ওইদিনের সংঘটিত ঘটনার পর ইশার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইশার বাসায় গিয়ে তাকে ফুলের মালা পরিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-নেত্রীরা। অন্যদিকে ইশা হলে ফিরছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই হল ছেড়েছেন সুফিয়া কামাল হলের প্রায় দেড় ডজন ছাত্রী। আতঙ্ক বিরাজ করছে হলটির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। হলটির একাধিক ছাত্রী জানান, ইশা হলটির নেতৃত্বে আসার পর থেকে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন করে থাকেন। বিভিন্ন সময় মারধরও করা হয়েছে অনেককে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা সক্রিয় তাদের নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এত দিন কেউ ভয়ে মুখ খুলেননি। সর্বশেষ গত সোমবারের ঘটনার পর অনেকে ইশার নানা ধরনের অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাই এখন ইশা হলে ফিরলে আগের চেয়েও বেশি নির্যাতন শুরু হবে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর। তাই আমরা হলে এখন অনিরাপদ বোধ করছি। গতকাল সন্ধ্যায় হল ছাড়ার সময় এক ছাত্রী বলেন, ‘হলের সভাপতি হলে আসছেন শুনে আমরা হল ছাড়ছি। তিনি আমাদের মারধর করেন। সেদিন এক ছাত্রীর পা কেটে দেয়ায় আমরা তার প্রতিবাদ করি। তিনি হলে আসলে আমরা আবারো নির্যাতিত হবো। তাই চলে যাচ্ছি।’ অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তিনি আমাকে মারধর করেছেন। গেস্টরুমে নির্যাতন করতেন। তিনি হলে আসলে আবারো এই কাজ করবেন বলে আমি হল ছাড়ছি।’ তবে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান বলেন, ‘সে বহিষ্কৃত। তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত হলে উঠতে পারবে না। আর যেসব মেয়েরা হল ছাড়ছে তাদের বিষয়ে আমি অবগত নই।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা রহমান হলের ছাত্রীদের নিয়ে এক সাধারণ সভার আয়োজন করেন। যেখানে শিক্ষার্থীরা ইশার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে। সাধারণ সভায় হলটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ম্যাম আমরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হল চাই। সেখানে কেন সিট বাণিজ্য থাকবে? কেন পলিটিক্যাল ফ্লোর এবং নন পলিটিক্যাল ফ্লোর থাকবে। আমরা এখানে সিটের আশায় উঠেছি, রাজনীতি করার জন্য উঠি নাই। একজন পদত্যাগ করেছে। আরো একজন হলে আছে। তারা আমাদের সমস্যা করবে। আমাদের দায়ভার কে নেবে।’ আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা রাজনীতি মুক্ত হল চাই। মেয়েরা যেটার জন্য এত ভয় পায় সেটা হলো নোংরা সিট পলিটিক্স। যার হুমকি দিয়ে মেয়েদের নির্যাতন করা হয়। পলিটিক্যাল মেয়েদের দায়িত্বও প্রশাসন নিক। অন্য কেউ অভিভাবক নয়।’
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অন্যান্য হলের ছাত্রছাত্রীদেরও নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ‘অপপ্রচার’। ইতিমধ্যে হল ছেড়েছে অনেকে। গতকাল দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানোর প্রতিবাদ ও হয়রানি অভিযোগ করে আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফেসবুক গ্রুপ থেকে লাইভে বক্তব্য রাখেন। এসময় রাশেদ তার বক্তব্যে নিজের ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভাইয়েরা আমাকে এখন বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও ভিসি স্যারের বাসায় হামলা করেছি বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমি এসবের কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। যদি সম্পৃক্ত থাকতাম তাহলে গত দুই মাস যাবৎ গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমার পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পায়নি কেন? আপনারা কী গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও বেশি এক্সপার্ট ও আইটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন? এসময় রাশেদ বলেন, যারা এখন অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তারা চাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে বানচাল করতে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যের পক্ষে ছিলাম। এখনো আছি। আর আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও আন্দোলনকারীদের ওপর যদি কোনো ধরনের হয়রানি না হয় সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকবেন। রাশেদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান ওই গ্রুপে লেখেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি এক আছি। আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। যে কোনো অন্যায়ের দাঁত ভাঙা জবাব দেয়া হবে।’ আর যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, ‘নতুন নাটক তৈরি করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বোকা বানাতে চেষ্টা করবেন না। শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথে নামলে কিন্তু পালাবার পথ পাবেন না।’
এদিকে আন্দোলকারীদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা ভিসির বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছেন। দাবি করেছেন হলে যেন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থাকতে পারে। কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়। ভিসি তখন তাদের কোনো সংগঠন কর্তৃক কাউকে হয়রানি যেন না করা হয় সে বিষয়ে প্রশাসনের সজাগ থাকার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। এছাড়াও আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও অবহিত করেছেন যেন কাউকে সারা দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়। মন্ত্রীও তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যেন কোনো ধরনের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে আমরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আমাদের ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘এরপরও যদি কাউকে হয়রানি করা হয়, তাহলে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যবস্থা নিবো।’ অন্যদিক ছাত্রলীগ নেত্রীর ইশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এই ইস্যুতে এখনো আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো বক্তব্য নেই। যদি কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত থাকে তাহলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
সে রাতে ঢাবির ছাত্রী হলে যা ঘটেছে
রাত সাড়ে ৯টায় হলে আসি। এ সময় অনেকে সর্তক করছিল, তোমাদের ওপর হামলা হতে পারে। যারা আন্দোলনে গেছো তাদের ওপর গোপন হামলা হতে পারে। সবাই সাবধানে থেকো। পরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে দরজা আটকে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ করে শুনি চিৎকার। অনেক জোরে চিৎকার। একটা আপু দরজা ধাক্কা দিয়ে বললো হলের নিচে নামো। কাউকে মারছে মনে হয়। আমরা দৌড়ে নিচে নামলাম। পরে কয়েকজন ইশার রুমের সামনে গেলাম। সেখান থেকেই চিৎকার এসেছিল। রুমের সামনে গিয়ে দেখি কয়েকটা পলিটিক্যাল মেয়ে দাঁড়ানো। তারা নিজেদের মধ্যে ফান করছে। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করলাম এত জোরে চিৎকার করলো কে? তখন তারা বললো গায়ের ওপর একটা পোকা পড়েছিল তাই চিৎকার দিচ্ছে। এ কথা শুনে আমরা চলে আসছিলাম। পরে বড় আপুরা বলতেছে, পোকার কারণে এত জোরে চিৎকার করবে কেন? এসময় আমরা ইশার রুম থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখি। কয়েকজন বললো বেসিনেও দাগ দেখেছে তারা। এরপর মেয়েরা একত্রিত হয়ে ইশার রুমের সামনে যায় এবং দরজা খোলার জন্য বলে। একপর্যায়ে ইশা দরজা খুলে। একসঙ্গে এত মেয়েকে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। কান্না করে দেয়। তাকে মারধর যাতে না করে সেজন্য অনুরোধ করতে থাকে। মেয়েরা জানতে পারে ৫-৬ জনকে মারধর করেছে ইশা। এর মধ্যে দুজনের পা কেটে যায়। ছাত্রীরা ইশাকে নিচে নামিয়ে আনতে চাইলে সে দৌঁড় দেয়। একপর্যায় উত্তেজিত হয়ে কিছু মেয়ে তার গায়ে হাত তুলে। মারধর করে। নিচে নামিয়ে আনে। খবর পেয়ে প্রক্টর ও হল কর্তৃপক্ষ আসে। তাদের সামনে ইশা নিজের দোষ স্বীকার করে। সবার কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু মেয়েরা তাকে গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারের দাবি জানায়। জুতোর মালা পরিয়ে দেয়। টেলিভিশনে দেখি তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারপর রুমে চলে আসি। গত ১০ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বর্ণনারত ওই ছাত্রী বলেন, হলের মেয়েরা ইশার ওপর আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, ইশা মেয়েদের নানাভাবে কষ্ট দিতো। তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতো। আগে থেকেই মেয়েরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। কিছু হলেই মেয়েদের মারধর করতো। হুমকি দিতো।
ওই রাতে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান ইশা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে মারধর করে। এদের মধ্যে একজন ছাত্রীর পায়ের গোড়ালির ওপরের অংশ কেটে যায়। খবরটি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। মেয়েরা হলের ভেতরে অবস্থান করে। ছাত্রীরা দাবি জানায়, ইশাকে হল, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারও করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ইশাকে বহিষ্কার করেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এই বহিষ্কারাদেশকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই আবার ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলনে নামেন। গতকাল রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন। আগের দিন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বিবৃতিতে দেন এবং রাতে ইশাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। ছাত্রলীগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে ইশা সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। যার ওপর ভিত্তি করে ইশার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রলীগ। এদিকে ওই দিন রাতে ইশার রুমের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে আন্দোলনে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে ইশার কথোপকথন শোনা যায়। সেখানে ইশা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, “এত কুরকুরানি না। যারা যারা প্রোগ্রামে গেছে কাল এবং আজ তারা ছাড়া সবাই চলে যা। অথবা পেছন থেকে সামনে আয়। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা বলেন, এই তুই সামনে আয়। মোবাইল দে। আমি কি বলছি। নাটক... (প্রকাশের অযোগ্য)। হুম। ওরা কি খুব সংস্কার করে দিছে। হলের মধ্যে তোমার ভাইয়েরা এসে ঠেকাবে না। বুজছো। ওই পাওয়ারগিরি দেখাতে আসবা না। পিছনে কে আছে দেখা যাচ্ছে না, সর। আরেক মেয়েকে বলে, তুইও গেছিলি। আমি তোকে নিজে নিষেধ করছিলাম। পাশের জনকে উদ্দেশ্য করে ইশা বলেন, জিজ্ঞেস কর। আমি নিজে নিষেধ করেছি। কেন গেছিলি? আমি নিষেধ করার পরও কেন গেছিলি? মুন আপু (খালেদা হোসাইন মুন, ওই হলের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি) তোকে গালি দিসিলো না। বেয়াদব বলেছিল না। তুই আসলেই একটা বেয়াদব। সোজা হয়ে দাঁড়া। তোদের চেহারাগুলো দেখি। তোদের মধ্যে গডফাদার পল? এই তুই, তুই। তুই তো যাবি। তুই তো হাড়েহাড়ে শয়তান। মিনমিনে শয়তান। চেহারাটা দেখ কি সুন্দর করে রাখে। মনে হয় পৃথিবীর একটা ইনোসেন্ট। আর ভিতরে ভিতরে এত রস। তুই গণরুমে চলে যাবি। রুমে থাকতে পারবি না। সব গোছাইছিস। গোছাইসনি কেন? আমি এখন চারটা মেয়ে পাঠাবো। তোরা গণরুমে চলে যাবি। তিনজনের জন্য এই শাস্তি। তোরা সবাইরে নিয়ে গেছিলি। তোদের পদে পদে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলিসনি কেন? এখন থেকে হলে থাকতে হলে প্রতিদিন আমার সঙ্গে কথা বলবি। তুই, তুই আর তুই। এই তিনজন। আর কেউ না। এক মেয়েকে ইঙ্গিত করে ইশা আরো বলেন, এই তুই তোর আব্বুকে কল দে। মেয়েটি দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইশা বলে না হলে আমি কল দিবো। তখন অনেক খারাপ হবে। তুই কল দে। আমি যেটা বলি সেটা করেই ছাড়ি। হলের গেট ভেঙে তোরা আন্দোলনে যাস। এটা তোর আব্বুকে বলে দিবো। তখন তোর পরিবারের সবাই বিষয়টি জানবে। কাল থেকে কেউ আমাকে না বলে কোথাও বের হবি না।’ এদিকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারাদাশে প্রত্যাহার করায় হলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ১২ই এপ্রিল রাতেই হল থেকে ১৫/২০ জন ছাত্রী বাড়ি চলে যায়। হলে অবস্থানরতদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে ইশার ওপর থেকে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভিসি ড. আখতারুজ্জামান বলেন, শুধু ছাত্রত্ব ফিরে পাবে না। বরং সম্মানিত হবে। সেটি উচিত হবে। কারণ, আমরা তো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করতে পারি না। যদিও ঘটনার দিন রাতেই ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। ওই দিন তিনি বলেন, তাকে শারীরিকভাবে আহত করেছে। এটা জানার পর আমি দুই দিক থেকে ভেরিফাই করলাম। প্রক্টর এবং হল প্রশাসন বললো। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু ওই মেয়ে আরেকজনকে আঘাত করেছে তাই তাকে বহিষ্কার করলাম।”
No comments