দুই ভাইকে দেখবে কে: রাজীব আমরা কাঁদছি
রাজীবের
লড়াই শেষ হয়েছে। টগবগে এক তরুণের দীর্ঘ লড়াই। যে লড়াইয়ে সে হার মানতে
চায়নি। শেষ পর্যন্ত অভিমান হয়েছিল তার। তীব্র, তীক্ষ্ণ অভিমান। আমাদের সবার
প্রতি। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি। যে ব্যবস্থা রাজীবদের বাঁচতে দেয়
না।
এতো শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়। এক তরুণের দুর্দান্ত লড়াইয়েরও মৃত্যু। যে লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল খুব ছোট বেলায়। যখন তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে যান। এখানেই অবশ্য শেষ হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর সবহারা এক ছেলের আশ্রয় জোটে খালার বাসায়। সেখান থেকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। এত কষ্ট, আর যন্ত্রণা নিয়েও সব কিছু গুছিয়ে আনছিল ছেলেটি। যেন শপথ নিয়েছিল হার না মানার। তিতুমীর কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে চালিয়ে নিচ্ছিল জীবন। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাতো। স্বপ্ন দেখতো দুই ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। মনের ভেতরে হয়তো আরো অনেক স্বপ্ন ছিল তার। এদেশের প্রতিটি গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের মতো। বৃত্ত ভাঙতে চেয়েছিল সে। যেন আপসহীন এক যোদ্ধা। হঠাৎই দুই বাসের মাঝখানে আটকা পড়ে যায় তার জীবন, স্বপ্ন। শুরুতে কাটা পড়ে হাত। এরপর তীব্র অভিমান খেলে গেছে তার বুকে, হৃদয়ে। স্বজনদের কোনো কথার জবাব দিতো না। যেন আহত এক যোদ্ধার বুকে অভিমানের ঘাসফুল জন্মেছিল। শেষ ক’টা দিন ছিল লাইফ সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের চেষ্টা আর মানুষের প্রার্থনা পরাজিত হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাওয়া যায় করুণ, মর্মান্তিক আর মর্মন্তুদ সেই খবর। যে খবর আমাদের ঘুমাতে দেয় না। বিষণ্ন করে। চোখ ভিজে ওঠে।
রাজীবের মৃত্যুর পর কান্না চলছে। এক অসহায় আর দরিদ্র যুবকের জন্য আমরা সবাই কাঁদছি। যারা হয়তো প্রায় কেউই রাজীবকে চিনতাম না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জন্য চলছে মাতম। কিন্তু কিছুই কী বদলাবে। এ এক গভীর হতাশার সময়। চারদিকে ভয় আর ভয়। এখানে মানুষ স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। এটা সম্ভবত সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়া সময়। কারণ, যে চালকরা রাজীবদের হত্যা করে চলছে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত তাদের কিছুই হয় না। এই মানসিক বিকারগ্রস্ত চালকদের জীবনের মূল্য বুঝানোর মতো কেউ এখানে নেই। কেউ যদি তাদের বুঝাতে যান, বিপদ নিশ্চিত। কারণ, তাদের ওপর ক্ষমতার ছায়া আছে। বিরোধীদের কর্মসূচির দিন গাড়ি বন্ধ করে দিতে তাদের প্রয়োজন আছে। তাদের নেতারা মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই পান। তারা বলে দেবেন কী করলে চালক হওয়া যাবে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে বেশি বুঝি না। আমাদের বুদ্ধিও তাদের মতো প্রখর নয়। তারা ঠিক করে দেবেন আমাদের হাত থাকবে কি থাকবে না? আমরা বেঁচে থাকতে পারবো কি পারবো না?
রাজীব আমরা তোমার জন্য কাঁদছি। এছাড়া আমাদের আর কীই বা করার আছে বলো ভাই।
‘এখন তো আর ভাইয়া নেই, কী হবে জানি না’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুই কিশোর মেহেদী হাসান ও হৃদয় আবদুল্লাহ। তাদের চোখে-মুখে রাজ্যের অনিশ্চয়তা। শিশু বয়সেই মা-বাবা হারানো এ দুই কিশোরের মাথার ওপর ছাতা হয়ে আগলে রেখেছিলেন বড় ভাই রাজীব হোসেন। রাজধানীর পান্থপথে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় এক হাত হারানো রাজীব চলে গেছেন না ফেরার দেশে। নিজেদের শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে দুই কিশোর যেন কান্নার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। অল্প কথায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেহেদী হাসান বললো, ‘এখন তো আর ভাইয়া নেই। আমাদের কী হবে জানি না।’ বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই ও খালা-মামাদের সহায়তায় পড়াশোনা করছে মেহেদী ও হৃদয়। পরীক্ষার মার্কসিট, ক্লাস লেকচার নোটের প্রিন্ট আউটসহ যাবতীয় কম্পিউটারের কাজ করে দিতেন ভাই রাজীব। দুর্ঘটনার পরদিন একটি জাতীয় দৈনিকে ভাইয়ের কাটা হাতের ছবি দেখে খালাকে বলেছিলো, ভাইয়ার তো ডান হাতই নেই এখন আমাদের কম্পিউটারের কাজ কে করে দেবেন। টিউশনির পাশাপাশি কম্পোজের কাজ করে নিজের মেস ভাড়া ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন রাজীব। এত কষ্টের মাঝেও দুই কিশোরের আশা, কেউ হয়তো তাদের দায়িত্ব নেবেন। অপসোনিন কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে বরিশালেই থাকতেন রাজীব। ২০০৬ সালে হৃদরোগে মা মারা যাওয়ার পর ২০১০ সালে একইভাবে মারা যান রাজীবের বাবা। শুরু হয় বাবা-মা হারানো রাজীবের বেঁচে থাকার লড়াই। তিন খালা ও মামাদের সহোযোগিতায় দুই ভাইকে নিয়ে ২০১২ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান রাজীব। তিতুমীর কলেজে ম্যানেজমেন্টে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন রাজীব। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ছেলে রাজীব পড়ালেখার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার টাইপ করে নিজের এবং ছোট দু’ভাইয়ের খরচ চালাতেন। এইচএসসি পাস করার পরপরই সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করতেন। পড়াশোনা শেষে একটি সরকারি চাকরি আর এলএলবি শেষ করে একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ছোট দুইভাইকে মানুষ করাই ছিল তার স্বপ্ন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নেরও ইতি ঘটলো। লেখাপড়া শিখে যখন দুই ভাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলেন বাবা-মা হারানো রাজীব। তখন দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এমন সংগ্রামী তরুণের প্রাণ থামিয়ে দিলো। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজীব মা আকলিমা খানমকে হারান। বাবা সেই শোকে ছিলেন নিরুদ্দেশ। পরে ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনি মারা যান। এর আগের তিন বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন বলে জানান, রাজীবের দূরসম্পর্কের এক চাচা। রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানার বাড়িতে ছিল। পরে ঢাকায় এসে পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি হয়। খালার বাড়ি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর মেসে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। ছাত্র পড়াতেন। ২২ বছর বয়সী রাজীবের লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নেয়া। দুই সপ্তাহ আগেও প্রাণবন্ত স্বপ্ন জ্বলজ্বল করা রাজীব সদ্যই যেন স্মৃতি হয়ে গেলেন। দুর্ঘটনার পর অনেক অভিমান করে হাসপাতালে একবার বলেছিলেন, ‘রাজীব কে? সে মারা গেছে!’ স্বভাবজাতভাবে গম্ভীর প্রকৃতির হওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলতেন না রাজীব। কার সঙ্গে অভিমান করেছিলেন রাজীব, সেটা আর কখনো জানা হবে না। দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব হোসেনের মরদেহ পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায় তার নানা বাড়িতে দাফন করা হবে। রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম জানান, জোহরের নামাজের পর ঢাকার হাইকোর্ট সংলগ্ন মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
এদিকে রাজীবের ঘটনাটি যেন গোটা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। রাস্তায় যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। এক নজর দেখতে হাসপাতালে ভিড় করেন অনেকে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব বলেন, রাজীব আমার একজন ভালো বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন। রাজীবের দুর্ঘটনার পরপরই ফেসবুকে রাজীবের সাহায্যার্থে ও দায়ী বাসচালকদের শাস্তির দাবি করে প্রচারণা চালিয়েও বন্ধু রাজীবকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা দায়ী বাসচালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। রাজীবকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে ছুটে যান সিএমএম কোর্টের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে ফেসবুকে রাজীবের মৃত্যুর খরব শুনে খুবই শোকাহত হয়েছি। বেপরোয়া বাসচালকদের অসাবধানতার কারণে আর যেন কোনো রাজীবের প্রাণ ঝরে না যায় সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসিরউদ্দীন বলেন, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থেকে মৃত্যু হয়েছে রাজীবের। ওই রক্তক্ষরণের জন্য তার শরীরে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ে। ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ কুমার বিশ্বাস ময়নাতদন্ত শেষে জানান, মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া তার মাথার একটি হাড় ভাঙা ছিল।
এতো শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়। এক তরুণের দুর্দান্ত লড়াইয়েরও মৃত্যু। যে লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল খুব ছোট বেলায়। যখন তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে যান। এখানেই অবশ্য শেষ হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর সবহারা এক ছেলের আশ্রয় জোটে খালার বাসায়। সেখান থেকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। এত কষ্ট, আর যন্ত্রণা নিয়েও সব কিছু গুছিয়ে আনছিল ছেলেটি। যেন শপথ নিয়েছিল হার না মানার। তিতুমীর কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে চালিয়ে নিচ্ছিল জীবন। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাতো। স্বপ্ন দেখতো দুই ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। মনের ভেতরে হয়তো আরো অনেক স্বপ্ন ছিল তার। এদেশের প্রতিটি গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের মতো। বৃত্ত ভাঙতে চেয়েছিল সে। যেন আপসহীন এক যোদ্ধা। হঠাৎই দুই বাসের মাঝখানে আটকা পড়ে যায় তার জীবন, স্বপ্ন। শুরুতে কাটা পড়ে হাত। এরপর তীব্র অভিমান খেলে গেছে তার বুকে, হৃদয়ে। স্বজনদের কোনো কথার জবাব দিতো না। যেন আহত এক যোদ্ধার বুকে অভিমানের ঘাসফুল জন্মেছিল। শেষ ক’টা দিন ছিল লাইফ সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের চেষ্টা আর মানুষের প্রার্থনা পরাজিত হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাওয়া যায় করুণ, মর্মান্তিক আর মর্মন্তুদ সেই খবর। যে খবর আমাদের ঘুমাতে দেয় না। বিষণ্ন করে। চোখ ভিজে ওঠে।
রাজীবের মৃত্যুর পর কান্না চলছে। এক অসহায় আর দরিদ্র যুবকের জন্য আমরা সবাই কাঁদছি। যারা হয়তো প্রায় কেউই রাজীবকে চিনতাম না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জন্য চলছে মাতম। কিন্তু কিছুই কী বদলাবে। এ এক গভীর হতাশার সময়। চারদিকে ভয় আর ভয়। এখানে মানুষ স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। এটা সম্ভবত সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়া সময়। কারণ, যে চালকরা রাজীবদের হত্যা করে চলছে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত তাদের কিছুই হয় না। এই মানসিক বিকারগ্রস্ত চালকদের জীবনের মূল্য বুঝানোর মতো কেউ এখানে নেই। কেউ যদি তাদের বুঝাতে যান, বিপদ নিশ্চিত। কারণ, তাদের ওপর ক্ষমতার ছায়া আছে। বিরোধীদের কর্মসূচির দিন গাড়ি বন্ধ করে দিতে তাদের প্রয়োজন আছে। তাদের নেতারা মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই পান। তারা বলে দেবেন কী করলে চালক হওয়া যাবে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে বেশি বুঝি না। আমাদের বুদ্ধিও তাদের মতো প্রখর নয়। তারা ঠিক করে দেবেন আমাদের হাত থাকবে কি থাকবে না? আমরা বেঁচে থাকতে পারবো কি পারবো না?
রাজীব আমরা তোমার জন্য কাঁদছি। এছাড়া আমাদের আর কীই বা করার আছে বলো ভাই।
‘এখন তো আর ভাইয়া নেই, কী হবে জানি না’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুই কিশোর মেহেদী হাসান ও হৃদয় আবদুল্লাহ। তাদের চোখে-মুখে রাজ্যের অনিশ্চয়তা। শিশু বয়সেই মা-বাবা হারানো এ দুই কিশোরের মাথার ওপর ছাতা হয়ে আগলে রেখেছিলেন বড় ভাই রাজীব হোসেন। রাজধানীর পান্থপথে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় এক হাত হারানো রাজীব চলে গেছেন না ফেরার দেশে। নিজেদের শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে দুই কিশোর যেন কান্নার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। অল্প কথায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেহেদী হাসান বললো, ‘এখন তো আর ভাইয়া নেই। আমাদের কী হবে জানি না।’ বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই ও খালা-মামাদের সহায়তায় পড়াশোনা করছে মেহেদী ও হৃদয়। পরীক্ষার মার্কসিট, ক্লাস লেকচার নোটের প্রিন্ট আউটসহ যাবতীয় কম্পিউটারের কাজ করে দিতেন ভাই রাজীব। দুর্ঘটনার পরদিন একটি জাতীয় দৈনিকে ভাইয়ের কাটা হাতের ছবি দেখে খালাকে বলেছিলো, ভাইয়ার তো ডান হাতই নেই এখন আমাদের কম্পিউটারের কাজ কে করে দেবেন। টিউশনির পাশাপাশি কম্পোজের কাজ করে নিজের মেস ভাড়া ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন রাজীব। এত কষ্টের মাঝেও দুই কিশোরের আশা, কেউ হয়তো তাদের দায়িত্ব নেবেন। অপসোনিন কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে বরিশালেই থাকতেন রাজীব। ২০০৬ সালে হৃদরোগে মা মারা যাওয়ার পর ২০১০ সালে একইভাবে মারা যান রাজীবের বাবা। শুরু হয় বাবা-মা হারানো রাজীবের বেঁচে থাকার লড়াই। তিন খালা ও মামাদের সহোযোগিতায় দুই ভাইকে নিয়ে ২০১২ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান রাজীব। তিতুমীর কলেজে ম্যানেজমেন্টে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন রাজীব। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ছেলে রাজীব পড়ালেখার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার টাইপ করে নিজের এবং ছোট দু’ভাইয়ের খরচ চালাতেন। এইচএসসি পাস করার পরপরই সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করতেন। পড়াশোনা শেষে একটি সরকারি চাকরি আর এলএলবি শেষ করে একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ছোট দুইভাইকে মানুষ করাই ছিল তার স্বপ্ন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নেরও ইতি ঘটলো। লেখাপড়া শিখে যখন দুই ভাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলেন বাবা-মা হারানো রাজীব। তখন দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এমন সংগ্রামী তরুণের প্রাণ থামিয়ে দিলো। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজীব মা আকলিমা খানমকে হারান। বাবা সেই শোকে ছিলেন নিরুদ্দেশ। পরে ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনি মারা যান। এর আগের তিন বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন বলে জানান, রাজীবের দূরসম্পর্কের এক চাচা। রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানার বাড়িতে ছিল। পরে ঢাকায় এসে পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি হয়। খালার বাড়ি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর মেসে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। ছাত্র পড়াতেন। ২২ বছর বয়সী রাজীবের লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নেয়া। দুই সপ্তাহ আগেও প্রাণবন্ত স্বপ্ন জ্বলজ্বল করা রাজীব সদ্যই যেন স্মৃতি হয়ে গেলেন। দুর্ঘটনার পর অনেক অভিমান করে হাসপাতালে একবার বলেছিলেন, ‘রাজীব কে? সে মারা গেছে!’ স্বভাবজাতভাবে গম্ভীর প্রকৃতির হওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলতেন না রাজীব। কার সঙ্গে অভিমান করেছিলেন রাজীব, সেটা আর কখনো জানা হবে না। দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব হোসেনের মরদেহ পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায় তার নানা বাড়িতে দাফন করা হবে। রাজীবের মামা জাহিদুল ইসলাম জানান, জোহরের নামাজের পর ঢাকার হাইকোর্ট সংলগ্ন মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
এদিকে রাজীবের ঘটনাটি যেন গোটা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। রাস্তায় যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। এক নজর দেখতে হাসপাতালে ভিড় করেন অনেকে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব বলেন, রাজীব আমার একজন ভালো বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন। রাজীবের দুর্ঘটনার পরপরই ফেসবুকে রাজীবের সাহায্যার্থে ও দায়ী বাসচালকদের শাস্তির দাবি করে প্রচারণা চালিয়েও বন্ধু রাজীবকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা দায়ী বাসচালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। রাজীবকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে ছুটে যান সিএমএম কোর্টের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে ফেসবুকে রাজীবের মৃত্যুর খরব শুনে খুবই শোকাহত হয়েছি। বেপরোয়া বাসচালকদের অসাবধানতার কারণে আর যেন কোনো রাজীবের প্রাণ ঝরে না যায় সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসিরউদ্দীন বলেন, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থেকে মৃত্যু হয়েছে রাজীবের। ওই রক্তক্ষরণের জন্য তার শরীরে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ে। ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ কুমার বিশ্বাস ময়নাতদন্ত শেষে জানান, মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া তার মাথার একটি হাড় ভাঙা ছিল।
No comments