ব্যাংকিং খাত এতিমে পরিণত হয়েছে: সিপিডি
বেসরকারি
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয়
ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশে একটি বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং ব্যবস্থা সৃষ্টি করা
হয়েছে। ২০১৭ সাল ছিল ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির বছর। আর ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাত
এতিমে পরিণত হয়েছে। আর সেই এতিমের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তিনি বলেন,
বর্তমানে ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ ১৮ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি
বাড়ছে অভূতপূর্বভাবে। ব্যক্তিখাতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা
যাচ্ছে। কিন্ু এ খাতে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাহলে এই টাকাটা গেল কোথায়?
অন্যদিকে আয়হীন কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়।
গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯ সিডিপি’র সুপারিশমালা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতের রক্ষকরাই তাদের দায়িত্ব পালন না করে বিভিন্ন ফাঁকফোকরে খাতটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি না মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই মুদ্রানীতি করছে। মুদ্রানীতি ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ পর নিজেরাই তারল্যের ঘাটতির কথা বলে সিআরআর কমিয়ে মুদ্রাপ্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তারল্যের ঘাটতি রোগের উপসর্গ মাত্র, কোনো রোগ নয়। অথচ একটি বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং ব্যবস্থা সৃষ্টি করে রোগ বানিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। তিনি বলেন, এবার মনে হচ্ছে ব্যাংকিং খাত নিতান্তই এতিমে পরিণত হয়েছে। এর রক্ষকরাই এখন এই শিশু, এতিমের ওপর অত্যাচার করছেন। যাদের এটা রক্ষা করার কথা ছিল, তারাই বিভিন্ন চাপের মুখে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মুদ্রানীতিতে ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ ১৬.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হয়েছে। অথচ আগে কখনো এটা ১২, ১৩, ১৪ শতাংশের বেশি হতো না। বর্তমানে ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে। অথচ দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবির। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে না। তাহলে এই টাকাটা গেল কোথায়? অন্যদিকে আমদানি বাড়ছে অভূতপূর্বভাবে। তিনি জানান, সিপিডি বারবার বলছে- ঝুঁকিপূর্ণ আমদানির ভেতর দিয়ে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে কিনা তা মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আমদানি হচ্ছে, ব্যক্তিখাতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা যাচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তিখাতে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? তাহলে টাকাটা যাচ্ছে কোথায়?
আয়হীন কর্মসংস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পুঁজিপণ্য আমদানিও বাড়ছে। ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তি বিনিয়োগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। এটা কেমন ধরনের কথা। আগামী বাজেটকে সামনে রেখে সংযত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বজায় রাখার পরামর্শ দেন তিনি। প্রবৃদ্ধির হার, আয়ের হার, কর্মসংস্থানের হার এবং উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লেও এগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। যদি সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে বলেন, প্রবৃদ্ধি ৬, ৭, ৮ যাই বলেন, তার ফলাফলটা আমরা কোথায় পাবো। ফল তো প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে হবে না। ফলাফল নির্ধারিত হবে জনমানুষের জীবনে কর্মসংস্থান হলো কি-না, আয় হলো কি-না তার ওপর। সরকারি প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখছি, কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রকৃত আয় কমে গেছে।
আয় কমার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যাদের আয় কমেছে তাদের মধ্যে নারীদের আয় বেশি কমেছে। একই সঙ্গে শহরের মানুষের থেকে গ্রামের মানুষের আয় বেশি কমেছে। এর সঙ্গে আমরা নতুন বিষয় দেখছি যারা পড়াশোনা করে তারা বেকার বেশি। আর শেষ যেটা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে।
তিনি আরো বলেন, এতদিন আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়েছি। এই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আজকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শোভন কর্মসংস্থান। কারণ যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে আয় কম, সেখানে কোনো ধরনের শ্রমের অধিকার বা পরিবেশ নেই।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সিপিডি’র বক্তব্য হলো, প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে আমরা তর্ক-বিতর্ক করতে পারি। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো তার ফলাফলটা। ফলাফলটা হলো আমরা এখন আয়হীন কর্মসংস্থানে আছি। কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির বিপরীত। এই যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার পুরোটাই হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের কারণে। গত তিন বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রায়ই একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। উৎপাদনের পরিসংখ্যান, মুদ্রানীতির পরিসংখ্যান এবং আমদানির যে পরিসংখ্যান এটা মিলানো যাচ্ছে না। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তিখাতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে না এর ফলে আয়হীন কর্মসংস্থানের একটা বড় কারণ বলে আমাদের কাছে মনে হয়। তিনি বলেন, দেশে আয়হীন কর্মসংস্থান হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্মসংস্থান আরো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগে ছিল কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, এখন হয়ে গেছে আয়হীন কর্মসংস্থান।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি বাংলাদেশে নির্বাচন আসলে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে অনেকে রেমিটেন্সের টাকা পাঠায় নির্বাচনের অর্থায়নের জন্য, অপরদিকে তার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে চলে যায়। অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা থাকলে এটি আরো বেশি যায়। টাকা এই ধরনের তছরুপ, অপব্যবহার ও বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা রয়েছে। এর প্রথমটি ব্যাংকিং খাত, দুই নম্বর পুঁজিবাজার এবং তৃতীয়টি আমদানি। আগামী বাজেটের বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরো বেশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.১ শতাংশের উপরে নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ কোন খাতে কতো খরচ করা হচ্ছে তা স্বচ্ছ হতে হবে, এর তথ্য আমাদের কাছে আসতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে গড় আয় বাড়লেও অধিকাংশ মানুষের বিশেষ করে শ্রমজীবীদের আয় কমছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বিবিএস-এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এটাকে কমিশনে পরিণত করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে হবে।
মূল প্রতিবেদনে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, আগামী বাজেটে দেশীয় সম্পদ আহরণের ওপর জোর দিতে হবে। সেজন্য কর আহরণের আওতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১০৫টি কর আহরণকারী দেশের মধ্যে ১০২তম স্থানে রয়েছে। প্রবন্ধে আরো বলা হয়, আগামী বাজেটে কর্পোরেট করা কমানো উচিত হবে না। সেই সঙ্গে বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাজেটে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য তুলে ধরে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, গত অর্থবছরে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি। যেখানে অশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ১.৫ শতাংশ, সেখানে উচ্চমাধ্যমিক পাস করাদের বেকারত্বের হার ১৪.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে বলে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীল দুর্বল জায়গায় রয়েছে-মন্তব্য করে তৌফিক ইসলাম আগামী বাজেটের জন্য বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা, মানুষের করের টাকা ব্যাংকগুলোকে না দেয়া, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা আরো ভালো করা, বকেয়া রজস্ব আদায়ে সরকার ও এনবিআরের আরো মনোযোগী হওয়া, করপোরেট কর হার কমানোর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করা এবং নতুন প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। পাশাপাশি এখন যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।
গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯ সিডিপি’র সুপারিশমালা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতের রক্ষকরাই তাদের দায়িত্ব পালন না করে বিভিন্ন ফাঁকফোকরে খাতটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি না মেনে ব্যাংকগুলো নিজেরাই মুদ্রানীতি করছে। মুদ্রানীতি ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ পর নিজেরাই তারল্যের ঘাটতির কথা বলে সিআরআর কমিয়ে মুদ্রাপ্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তারল্যের ঘাটতি রোগের উপসর্গ মাত্র, কোনো রোগ নয়। অথচ একটি বিকলাঙ্গ ব্যাংকিং ব্যবস্থা সৃষ্টি করে রোগ বানিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। তিনি বলেন, এবার মনে হচ্ছে ব্যাংকিং খাত নিতান্তই এতিমে পরিণত হয়েছে। এর রক্ষকরাই এখন এই শিশু, এতিমের ওপর অত্যাচার করছেন। যাদের এটা রক্ষা করার কথা ছিল, তারাই বিভিন্ন চাপের মুখে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মুদ্রানীতিতে ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ ১৬.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হয়েছে। অথচ আগে কখনো এটা ১২, ১৩, ১৪ শতাংশের বেশি হতো না। বর্তমানে ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশেরও বেশি হচ্ছে। অথচ দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবির। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে না। তাহলে এই টাকাটা গেল কোথায়? অন্যদিকে আমদানি বাড়ছে অভূতপূর্বভাবে। তিনি জানান, সিপিডি বারবার বলছে- ঝুঁকিপূর্ণ আমদানির ভেতর দিয়ে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে কিনা তা মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আমদানি হচ্ছে, ব্যক্তিখাতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা যাচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তিখাতে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? তাহলে টাকাটা যাচ্ছে কোথায়?
আয়হীন কর্মসংস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পুঁজিপণ্য আমদানিও বাড়ছে। ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তি বিনিয়োগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। এটা কেমন ধরনের কথা। আগামী বাজেটকে সামনে রেখে সংযত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বজায় রাখার পরামর্শ দেন তিনি। প্রবৃদ্ধির হার, আয়ের হার, কর্মসংস্থানের হার এবং উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লেও এগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। যদি সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে বলেন, প্রবৃদ্ধি ৬, ৭, ৮ যাই বলেন, তার ফলাফলটা আমরা কোথায় পাবো। ফল তো প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে হবে না। ফলাফল নির্ধারিত হবে জনমানুষের জীবনে কর্মসংস্থান হলো কি-না, আয় হলো কি-না তার ওপর। সরকারি প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখছি, কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রকৃত আয় কমে গেছে।
আয় কমার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যাদের আয় কমেছে তাদের মধ্যে নারীদের আয় বেশি কমেছে। একই সঙ্গে শহরের মানুষের থেকে গ্রামের মানুষের আয় বেশি কমেছে। এর সঙ্গে আমরা নতুন বিষয় দেখছি যারা পড়াশোনা করে তারা বেকার বেশি। আর শেষ যেটা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে।
তিনি আরো বলেন, এতদিন আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়েছি। এই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আজকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শোভন কর্মসংস্থান। কারণ যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে আয় কম, সেখানে কোনো ধরনের শ্রমের অধিকার বা পরিবেশ নেই।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সিপিডি’র বক্তব্য হলো, প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে আমরা তর্ক-বিতর্ক করতে পারি। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো তার ফলাফলটা। ফলাফলটা হলো আমরা এখন আয়হীন কর্মসংস্থানে আছি। কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির বিপরীত। এই যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার পুরোটাই হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের কারণে। গত তিন বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রায়ই একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। উৎপাদনের পরিসংখ্যান, মুদ্রানীতির পরিসংখ্যান এবং আমদানির যে পরিসংখ্যান এটা মিলানো যাচ্ছে না। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তিখাতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে না এর ফলে আয়হীন কর্মসংস্থানের একটা বড় কারণ বলে আমাদের কাছে মনে হয়। তিনি বলেন, দেশে আয়হীন কর্মসংস্থান হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্মসংস্থান আরো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগে ছিল কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, এখন হয়ে গেছে আয়হীন কর্মসংস্থান।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি বাংলাদেশে নির্বাচন আসলে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে অনেকে রেমিটেন্সের টাকা পাঠায় নির্বাচনের অর্থায়নের জন্য, অপরদিকে তার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে চলে যায়। অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা থাকলে এটি আরো বেশি যায়। টাকা এই ধরনের তছরুপ, অপব্যবহার ও বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রে তিনটি জায়গা রয়েছে। এর প্রথমটি ব্যাংকিং খাত, দুই নম্বর পুঁজিবাজার এবং তৃতীয়টি আমদানি। আগামী বাজেটের বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরো বেশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.১ শতাংশের উপরে নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ কোন খাতে কতো খরচ করা হচ্ছে তা স্বচ্ছ হতে হবে, এর তথ্য আমাদের কাছে আসতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে গড় আয় বাড়লেও অধিকাংশ মানুষের বিশেষ করে শ্রমজীবীদের আয় কমছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে বিবিএস-এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এটাকে কমিশনে পরিণত করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে হবে।
মূল প্রতিবেদনে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, আগামী বাজেটে দেশীয় সম্পদ আহরণের ওপর জোর দিতে হবে। সেজন্য কর আহরণের আওতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ১০৫টি কর আহরণকারী দেশের মধ্যে ১০২তম স্থানে রয়েছে। প্রবন্ধে আরো বলা হয়, আগামী বাজেটে কর্পোরেট করা কমানো উচিত হবে না। সেই সঙ্গে বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাজেটে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য তুলে ধরে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, গত অর্থবছরে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি। যেখানে অশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ১.৫ শতাংশ, সেখানে উচ্চমাধ্যমিক পাস করাদের বেকারত্বের হার ১৪.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে বলে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীল দুর্বল জায়গায় রয়েছে-মন্তব্য করে তৌফিক ইসলাম আগামী বাজেটের জন্য বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা, মানুষের করের টাকা ব্যাংকগুলোকে না দেয়া, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা আরো ভালো করা, বকেয়া রজস্ব আদায়ে সরকার ও এনবিআরের আরো মনোযোগী হওয়া, করপোরেট কর হার কমানোর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করা এবং নতুন প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। পাশাপাশি এখন যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে।
No comments