উদ্বেগ, আতঙ্কে কোটা আন্দোলনের নেতারা by ফররুখ মাহমুদ
নানা
হুমকি ও চাপের মুখে আতঙ্কে সময় পার করছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন
করা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের শীর্ষ নেতারা। সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমেও একটি পক্ষ তাদের ছবি ব্যবহার করে প্রচারণা চালাচ্ছে। যেখানে
পাওয়া যাবে সেখানেই হামলা চালানোর হুমকিও দিচ্ছে তারা। নেতারা সরকারবিরোধী
রাজনৈতিক পক্ষ এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে জোরেশোরে। এরই মধ্যে হুমকির মুখে
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে বাসায় উঠেছেন কয়েকজন। আবার যারা হলে থাকেন তারাও
রুমের বাইরে বের হতে পারছেন না নিরাপত্তার অভাবে। অনবরত হুমকির মুখে জীবন
নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তারা। নিরাপত্তা চেয়েছেন রাষ্ট্রের কাছে। এদিকে শুধু
শীর্ষ নেতারা নন যারা আন্দোলনে ছিলেন তাদেরও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে
হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষে স্ট্যাটাস
দিয়েছিলেন তাদের আইডি বন্ধ করে দেয়ার জন্য রিপোর্ট করা হচ্ছে। তাদের আইডিতে
গিয়ে পূর্বের স্ট্যাটাসের নিচে গালাগাল করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের
পরিবারের সদস্যদেরও হেনস্তা করা হচ্ছে বলে জানান নেতারা।
আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, আতঙ্ক কাজ করছে সবার মধ্যেই। সোমবারের পর থেকে আতঙ্কটা বেশি কাজ করছে। আমি হল থেকে বের হচ্ছি না। ডিবি যখন ওদের ধরে নিয়ে যায় তখন আমি সেখানে ছিলাম। আমি ওদেরকে চিনি। এজন্য কোথাও বের হচ্ছি না। তিনি বলেন, রাশেদ খানের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একটা একাউন্ট খুলে পরে সেখানে নাম এবং ছবি পরিবর্তন করে নানা কিছু প্রচার করা যায়। যেটা রাশেদের ক্ষেত্রে হচ্ছে। ভয়ের কারণে হল থেকে কোথাও বের হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতায় আছি। ফেসবুকে ‘গুজবে কান দেবেন না’ নামে একটা গ্রুপ থেকে হুমকি দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ওই গ্রুপ কাদের একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। আমি বলতে চাচ্ছি না। তিনি আরো বলেন, গতকাল পুলিশ সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা বলেছে, ভিডিও দেখাবে। কিন্তু ভিডিও দেখায়নি। পরে বলেছে, আমাদের ওপর হামলা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কার্যালয় থেকে আমাদের কোনো নিরাপত্তা না দিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়। নুরুল হক সরকারের কাছে নিরাপত্তার আশা করেন। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হাসানও নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেন। এদিকে হুমকির কারণে হল ছেড়ে দিয়েছেন যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খান। তিনি বলেন, হলে ছিলাম। কিন্তু আন্দোলন শুরুর পর থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের ছবি দিয়ে যেখানে দেখবে সেখানে হামলা হবে লিখা হচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে। যার কারণে হলে এখন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্রদের দাবি ঠিক নয়। তাদের চোখ বেঁধে আনা হয় নি। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ খান ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পথে জরুরি বিভাগের সামনে আমাদের টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামানো হয়। নূরকে মোটরসাইকেলে ওঠানো হয়। আমাকে একটা সিএনজি অটোরিকশায় ওঠাতে চায়। কিন্তু অটোরিকশার ভেতর একজন রোগী থাকায় সেখানে ওঠাতে পারেনি। আমি বলেছিলাম, ভাই আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পরিচয় দেন? আপনারা কারা? তারা বলে, শালা, চুপ থাক। পরে আমাদের তিনজনকেই মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। চোখ বেঁধে দেয়া হয়। হুমকি দেয়। পুলিশ বলে, দুই দিন আন্দোলন করে নেতা হতে আসছিস। সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিস। আমরা বললাম, অন্যায় তো করছি না। ন্যায়ের প্রতিবাদ করছি। কেন চোখ বেঁধে নিয়ে যাবেন। কোথায় যেতে হবে বলেন- আমরা যাবো। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন, প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও হুমকি দিতে থাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে লোহার হ্যান্ডক্যাফ পরানো হয়। এখনো হাতে ব্যথা আছে। নূর অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপরও তাকে হ্যান্ডক্যাফ পরানো হয়। আমরা বলি, চোখ খুলে দেন। আমরা ওর সঙ্গে কথা বলি। পরে আমাদের মাটিতে বসতে বলে। পেছনে হ্যান্ডক্যাফ দিয়ে হাত বাঁধা, চোখও বাঁধা। আমরা বলি এভাবে কি বসা যায়। তখন ওরা বলে মাটিতেই তোদের বসতে হবে। আমাদের যখন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমাদেরই একজন সেটা ভিডিও করে, সংবাদ মাধ্যমকে জানায়। টেলিভিশনগুলোতে নিউজ হয়। পরে পুলিশের কাছে উপর থেকে কল আসে। নিউজ শুরু হয়ে গেছে। ওদের ছেড়ে দাও। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাকে কিছু লোক অনুসরণ করে বলে জানিয়ে রাশেদ আরো বলেন, আমরা নিরাপদ নই। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। সকালে একটু বের হয়েছিলাম। কিন্তু পেছন থেকে কিছু লোক অনুসরণ করা শুরু করে। পরে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পালিয়ে বাসায় আসি। তিনি বলেন, প্রক্টর স্যারের কাছে গিয়ে আমরা নিরাপত্তা চাই। কিন্তু তিনি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন নি। কয়েকটা মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছেন কোনো সমস্যা হলে কল দিতে। কিন্তু সমস্যা তো এক মিনিটের মধ্যে হয়ে যায় কীভাবে কল দেবো। আমিসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা আছে তারা সবাই অনিরাপত্তায় আছে। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করছি। সেসময় আমাদের বাড়ি, হল থেকে ঠিকানা নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। তখন কোনো কিছু পায় নি। এদিকে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে কিছু স্ট্যাটাস এডিট করে স্ক্রীনশট নিয়ে তা ছড়ানো হচ্ছে। আমাকে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইডি নতুন করে খুলে নাম ও ছবি পরিবর্তন করে পেছনের তারিখে স্ট্যাটাসও দেয়া যায়। সেটা আমরা পরীক্ষামূলক একজনের ছবি ও নাম ব্যবহার করে দেখিয়েছি। টকশোতে আমাকে নাজেহাল করা হয়েছে। আমাকে ঠিকভাবে কথা বলতে দেয়া হয় নি। বারবার বলা হচ্ছে স্ট্যাটাস আমার কিনা তা হ্যাঁ অথবা না উত্তর দিতে। আমি অনেকবার বলেছি আইডি হ্যাক হয়েছে, স্ট্যাটাসগুলো এডিট করা তাও ওনারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই প্রশ্ন করে নাজেহাল করে। তিনি আরো বলেন, একটি পত্রিকাও আমাদের নামে ভুয়া তথ্য দিয়ে নিউজ করেছিলো। পরে আমরা চ্যালেঞ্জ করলে পত্রিকাটি নিউজ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চায়। শুধু নেতারা নন আন্দোলনে অংশ নেয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। আন্দোলন শুরুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন অন্তত ১৫ জন। পরের দিন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হল থেকে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে ২০/২৫ জন ছাত্রী বের হয়ে বাড়ি চলে যান। এছাড়া বিভিন্ন হলে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফেসবুকে ‘গুজবে কান দেবেন না’ নামে একটি গ্রুপ খোলে। সেখানে আন্দোলনকারীদের আইডির লিংক দিয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয় এবং ওই আইডিতে গিয়ে গালাগাল করা হয়। কোটা সংস্কারের পক্ষে থাকায় এক আইনজীবীকে হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই আইনজীবী রমনা থানায় ছাত্রলীগের আট থেকে দশজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। ওই নারী আইনজীবী বলেন, কোটা সংস্কারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নামেন। এতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ক্ষেপে ওঠেন। তিনি প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছেন, সেটা জানতে চান। ফেসবুকের লেখা মুছে না ফেললে দেখে নেয়ার হুমকি দেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। আন্দোলন চলাকালে কবি সুফিয়া কামাল হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনায় জড়িত হল ছাত্রলীগ সভাপতির পক্ষে সংগঠনের হল শাখার নেত্রীদের বহিষ্কারের ঘটনার পর হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এখন আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আকতারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতারা। তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. একেএম গোলাম রব্বানী জানান, শিক্ষার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয় তা আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ৮ই এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে টানা চার দিন চলা আন্দোলনের মাথায় সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ৫টি শর্ত দিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। শর্তের মধ্যে গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি ও দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি ছিল। এ দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে দুই দিনের আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। একই দিন দুপুরের পর তাদের তিন নেতাকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা তাদের ছেড়ে দেয়ার দাবি জানায়। আটকের পর চোখ বেঁধে তাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়েছিল। যদিও ডিবি তা অস্বীকার করেছে।
চোখ বাঁধা হয়নি: ডিবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন নেতাকে তুলে আনার ঘটনা সত্য। তবে তাদের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে তুলে আনার যে বিষয়টি ছড়ানো হচ্ছে সেটা ভুল বুঝাবুঝি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন। বলেছেন, চোখ বাঁধা হয়নি। বিভ্রান্তির জন্য হয়তো এরকমভাবে ছড়ানো হচ্ছে। মূলত ভিসির বাসায় হামলায় শাহবাগ থানায় করা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে একাধিক ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আন্দোলনকারী শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। তাই তাদের আনা হয়েছিল আবার ছেড়েও দেয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আব্দুল বাতেন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাও ভিসির বাসায় হামলার সুষ্ঠু তদন্ত চাইছে। তারা একাধিকবার এ দাবি জানিয়েছে। আমাদের কাছে যে ভিডিও ফুটেজ রয়েছে সেখানে হামলাকারী কাউকে আমরা চিনতে পারছি না। হলের শিক্ষার্থী হিসাবে হামলাকারীদের শনাক্ত করার জন্য তাদের আনা হয়। এটা নতুন কিছু না। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিছিন্ন ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। তাদের এই আলটিমেটামের প্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহার করা হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ডিবির এই যুগ্ম কমিশনার বলেন, ওই দিনের ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। প্রত্যেক মামলার তদন্ত চলছে। আমাদের তদন্তে অনেক অগ্রগতি আছে। তবে ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নাই। তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মামলা চলবে। তিনি বলেন, মামলা নিয়ে তাদের এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নাই। তারাও ভিসির বাসায় হামলার বিচার চান। এসব মামলায় কাউকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই চার মামলার তদন্ত নিয়ে এখনি আমরা কিছু বলতে চাই না। আরো তদন্তের প্রয়োজন আছে। তবে তদন্ত শেষ হলে আমাদের সিনিয়ররা জানিয়ে দিবেন। সোমবার সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করেন। তখন তারা দুই দিনের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার না হলে ফের আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিছুক্ষণ পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক থেকে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর, মোহাম্মদ রাশেদ খান ও ফারুক হাসানকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেয়ার পর তারা ফের সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন তাদের গাড়িতে তোলে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়।
বুকে বুলেট বয়ে বেড়াতে হবে আশিকুরকে
বুকে বুলেট বয়ে বেড়াতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিকুর রহমানকে। তবে আপাতত তিনি ঝুঁকিমুক্ত বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, তার বুকের যে স্থানে বুলেট বিদ্ধ আছে সেটা আশিকুরকে তেমন কোনো ডিস্টার্ব করছে না, তাই আমরাও চাচ্ছি যে, বুলেটের স্থানে কোনো ডিস্টার্ব না করতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেখা গেছে এমন অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন শরীরে বুলেট বয়ে বেড়াচ্ছেন। আশিকুর স্বাভাবিকভাবেই রেগুলার জীবন যাপন করতে পারবেন। এখন যদি তার বুলেটের অপারেশন করা হয় তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ভবিষ্যতে যদি এটার কারণে সে কোনো সমস্যা অনুভব করে তাহলে তৎক্ষণাৎ অবস্থানুযায়ী ডাক্তাররা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আপাতত সে ঝুঁকিমুক্ত আছে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আশিকুর রহমানকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে কেবিনে স্থানান্তর করার পরপরই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে আন্দোলনের সময় আহত নাট্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মো. তানভীর হাসান সোমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। পুলিশের লাঠিপেটায় মাথা ফেটেছিল তানভীরের। তানভীর বলেন, বৃহস্পতিবার পরীক্ষা থাকায় সোমবার দুপুরে তিনি হলে ফিরেছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে। এদিকে রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. শাহরিয়ার হোসেন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আন্দোলনের প্রথম দিন পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি তার পিঠে লেগেছিল।
ওদিকে, আশিকুর রহমানের চিকিৎসায় গঠিত ঢাকা মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, যেহেতু বুলেটটি কোনো সমস্যা করছে না আর সেখানে অস্ত্রোপচার করতে গেলে বরং জটিলতা বাড়তে পারে, তাই এই মুহূর্তে কোনো অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না। বুলেটটি তাকে বুকে করেই বয়ে বেড়াতে হতে পারে দীর্ঘ সময়।
আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, আতঙ্ক কাজ করছে সবার মধ্যেই। সোমবারের পর থেকে আতঙ্কটা বেশি কাজ করছে। আমি হল থেকে বের হচ্ছি না। ডিবি যখন ওদের ধরে নিয়ে যায় তখন আমি সেখানে ছিলাম। আমি ওদেরকে চিনি। এজন্য কোথাও বের হচ্ছি না। তিনি বলেন, রাশেদ খানের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একটা একাউন্ট খুলে পরে সেখানে নাম এবং ছবি পরিবর্তন করে নানা কিছু প্রচার করা যায়। যেটা রাশেদের ক্ষেত্রে হচ্ছে। ভয়ের কারণে হল থেকে কোথাও বের হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতায় আছি। ফেসবুকে ‘গুজবে কান দেবেন না’ নামে একটা গ্রুপ থেকে হুমকি দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ওই গ্রুপ কাদের একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। আমি বলতে চাচ্ছি না। তিনি আরো বলেন, গতকাল পুলিশ সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা বলেছে, ভিডিও দেখাবে। কিন্তু ভিডিও দেখায়নি। পরে বলেছে, আমাদের ওপর হামলা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কার্যালয় থেকে আমাদের কোনো নিরাপত্তা না দিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়। নুরুল হক সরকারের কাছে নিরাপত্তার আশা করেন। আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হাসানও নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেন। এদিকে হুমকির কারণে হল ছেড়ে দিয়েছেন যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খান। তিনি বলেন, হলে ছিলাম। কিন্তু আন্দোলন শুরুর পর থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের ছবি দিয়ে যেখানে দেখবে সেখানে হামলা হবে লিখা হচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে। যার কারণে হলে এখন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্রদের দাবি ঠিক নয়। তাদের চোখ বেঁধে আনা হয় নি। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ খান ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পথে জরুরি বিভাগের সামনে আমাদের টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামানো হয়। নূরকে মোটরসাইকেলে ওঠানো হয়। আমাকে একটা সিএনজি অটোরিকশায় ওঠাতে চায়। কিন্তু অটোরিকশার ভেতর একজন রোগী থাকায় সেখানে ওঠাতে পারেনি। আমি বলেছিলাম, ভাই আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পরিচয় দেন? আপনারা কারা? তারা বলে, শালা, চুপ থাক। পরে আমাদের তিনজনকেই মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। চোখ বেঁধে দেয়া হয়। হুমকি দেয়। পুলিশ বলে, দুই দিন আন্দোলন করে নেতা হতে আসছিস। সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিস। আমরা বললাম, অন্যায় তো করছি না। ন্যায়ের প্রতিবাদ করছি। কেন চোখ বেঁধে নিয়ে যাবেন। কোথায় যেতে হবে বলেন- আমরা যাবো। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন, প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরও হুমকি দিতে থাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে লোহার হ্যান্ডক্যাফ পরানো হয়। এখনো হাতে ব্যথা আছে। নূর অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপরও তাকে হ্যান্ডক্যাফ পরানো হয়। আমরা বলি, চোখ খুলে দেন। আমরা ওর সঙ্গে কথা বলি। পরে আমাদের মাটিতে বসতে বলে। পেছনে হ্যান্ডক্যাফ দিয়ে হাত বাঁধা, চোখও বাঁধা। আমরা বলি এভাবে কি বসা যায়। তখন ওরা বলে মাটিতেই তোদের বসতে হবে। আমাদের যখন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমাদেরই একজন সেটা ভিডিও করে, সংবাদ মাধ্যমকে জানায়। টেলিভিশনগুলোতে নিউজ হয়। পরে পুলিশের কাছে উপর থেকে কল আসে। নিউজ শুরু হয়ে গেছে। ওদের ছেড়ে দাও। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাকে কিছু লোক অনুসরণ করে বলে জানিয়ে রাশেদ আরো বলেন, আমরা নিরাপদ নই। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। সকালে একটু বের হয়েছিলাম। কিন্তু পেছন থেকে কিছু লোক অনুসরণ করা শুরু করে। পরে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পালিয়ে বাসায় আসি। তিনি বলেন, প্রক্টর স্যারের কাছে গিয়ে আমরা নিরাপত্তা চাই। কিন্তু তিনি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন নি। কয়েকটা মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছেন কোনো সমস্যা হলে কল দিতে। কিন্তু সমস্যা তো এক মিনিটের মধ্যে হয়ে যায় কীভাবে কল দেবো। আমিসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা আছে তারা সবাই অনিরাপত্তায় আছে। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করছি। সেসময় আমাদের বাড়ি, হল থেকে ঠিকানা নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। তখন কোনো কিছু পায় নি। এদিকে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে কিছু স্ট্যাটাস এডিট করে স্ক্রীনশট নিয়ে তা ছড়ানো হচ্ছে। আমাকে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইডি নতুন করে খুলে নাম ও ছবি পরিবর্তন করে পেছনের তারিখে স্ট্যাটাসও দেয়া যায়। সেটা আমরা পরীক্ষামূলক একজনের ছবি ও নাম ব্যবহার করে দেখিয়েছি। টকশোতে আমাকে নাজেহাল করা হয়েছে। আমাকে ঠিকভাবে কথা বলতে দেয়া হয় নি। বারবার বলা হচ্ছে স্ট্যাটাস আমার কিনা তা হ্যাঁ অথবা না উত্তর দিতে। আমি অনেকবার বলেছি আইডি হ্যাক হয়েছে, স্ট্যাটাসগুলো এডিট করা তাও ওনারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই প্রশ্ন করে নাজেহাল করে। তিনি আরো বলেন, একটি পত্রিকাও আমাদের নামে ভুয়া তথ্য দিয়ে নিউজ করেছিলো। পরে আমরা চ্যালেঞ্জ করলে পত্রিকাটি নিউজ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চায়। শুধু নেতারা নন আন্দোলনে অংশ নেয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। আন্দোলন শুরুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন অন্তত ১৫ জন। পরের দিন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হল থেকে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে ২০/২৫ জন ছাত্রী বের হয়ে বাড়ি চলে যান। এছাড়া বিভিন্ন হলে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফেসবুকে ‘গুজবে কান দেবেন না’ নামে একটি গ্রুপ খোলে। সেখানে আন্দোলনকারীদের আইডির লিংক দিয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয় এবং ওই আইডিতে গিয়ে গালাগাল করা হয়। কোটা সংস্কারের পক্ষে থাকায় এক আইনজীবীকে হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই আইনজীবী রমনা থানায় ছাত্রলীগের আট থেকে দশজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। ওই নারী আইনজীবী বলেন, কোটা সংস্কারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নামেন। এতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ক্ষেপে ওঠেন। তিনি প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পরও কেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছেন, সেটা জানতে চান। ফেসবুকের লেখা মুছে না ফেললে দেখে নেয়ার হুমকি দেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। আন্দোলন চলাকালে কবি সুফিয়া কামাল হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনায় জড়িত হল ছাত্রলীগ সভাপতির পক্ষে সংগঠনের হল শাখার নেত্রীদের বহিষ্কারের ঘটনার পর হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এখন আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আকতারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতারা। তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. একেএম গোলাম রব্বানী জানান, শিক্ষার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয় তা আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ৮ই এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে টানা চার দিন চলা আন্দোলনের মাথায় সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ৫টি শর্ত দিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। শর্তের মধ্যে গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি ও দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি ছিল। এ দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে দুই দিনের আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। একই দিন দুপুরের পর তাদের তিন নেতাকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা তাদের ছেড়ে দেয়ার দাবি জানায়। আটকের পর চোখ বেঁধে তাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়েছিল। যদিও ডিবি তা অস্বীকার করেছে।
চোখ বাঁধা হয়নি: ডিবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন নেতাকে তুলে আনার ঘটনা সত্য। তবে তাদের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে তুলে আনার যে বিষয়টি ছড়ানো হচ্ছে সেটা ভুল বুঝাবুঝি বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন। বলেছেন, চোখ বাঁধা হয়নি। বিভ্রান্তির জন্য হয়তো এরকমভাবে ছড়ানো হচ্ছে। মূলত ভিসির বাসায় হামলায় শাহবাগ থানায় করা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে একাধিক ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আন্দোলনকারী শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। তাই তাদের আনা হয়েছিল আবার ছেড়েও দেয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আব্দুল বাতেন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাও ভিসির বাসায় হামলার সুষ্ঠু তদন্ত চাইছে। তারা একাধিকবার এ দাবি জানিয়েছে। আমাদের কাছে যে ভিডিও ফুটেজ রয়েছে সেখানে হামলাকারী কাউকে আমরা চিনতে পারছি না। হলের শিক্ষার্থী হিসাবে হামলাকারীদের শনাক্ত করার জন্য তাদের আনা হয়। এটা নতুন কিছু না। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিছিন্ন ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। তাদের এই আলটিমেটামের প্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহার করা হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ডিবির এই যুগ্ম কমিশনার বলেন, ওই দিনের ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। প্রত্যেক মামলার তদন্ত চলছে। আমাদের তদন্তে অনেক অগ্রগতি আছে। তবে ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নাই। তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মামলা চলবে। তিনি বলেন, মামলা নিয়ে তাদের এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নাই। তারাও ভিসির বাসায় হামলার বিচার চান। এসব মামলায় কাউকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই চার মামলার তদন্ত নিয়ে এখনি আমরা কিছু বলতে চাই না। আরো তদন্তের প্রয়োজন আছে। তবে তদন্ত শেষ হলে আমাদের সিনিয়ররা জানিয়ে দিবেন। সোমবার সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করেন। তখন তারা দুই দিনের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার না হলে ফের আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিছুক্ষণ পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক থেকে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়ক নুরুল হক নূর, মোহাম্মদ রাশেদ খান ও ফারুক হাসানকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেয়ার পর তারা ফের সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন তাদের গাড়িতে তোলে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়।
বুকে বুলেট বয়ে বেড়াতে হবে আশিকুরকে
বুকে বুলেট বয়ে বেড়াতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিকুর রহমানকে। তবে আপাতত তিনি ঝুঁকিমুক্ত বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, তার বুকের যে স্থানে বুলেট বিদ্ধ আছে সেটা আশিকুরকে তেমন কোনো ডিস্টার্ব করছে না, তাই আমরাও চাচ্ছি যে, বুলেটের স্থানে কোনো ডিস্টার্ব না করতে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেখা গেছে এমন অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন শরীরে বুলেট বয়ে বেড়াচ্ছেন। আশিকুর স্বাভাবিকভাবেই রেগুলার জীবন যাপন করতে পারবেন। এখন যদি তার বুলেটের অপারেশন করা হয় তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ভবিষ্যতে যদি এটার কারণে সে কোনো সমস্যা অনুভব করে তাহলে তৎক্ষণাৎ অবস্থানুযায়ী ডাক্তাররা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আপাতত সে ঝুঁকিমুক্ত আছে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আশিকুর রহমানকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে কেবিনে স্থানান্তর করার পরপরই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে আন্দোলনের সময় আহত নাট্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মো. তানভীর হাসান সোমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। পুলিশের লাঠিপেটায় মাথা ফেটেছিল তানভীরের। তানভীর বলেন, বৃহস্পতিবার পরীক্ষা থাকায় সোমবার দুপুরে তিনি হলে ফিরেছেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে। এদিকে রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. শাহরিয়ার হোসেন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আন্দোলনের প্রথম দিন পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি তার পিঠে লেগেছিল।
ওদিকে, আশিকুর রহমানের চিকিৎসায় গঠিত ঢাকা মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, যেহেতু বুলেটটি কোনো সমস্যা করছে না আর সেখানে অস্ত্রোপচার করতে গেলে বরং জটিলতা বাড়তে পারে, তাই এই মুহূর্তে কোনো অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না। বুলেটটি তাকে বুকে করেই বয়ে বেড়াতে হতে পারে দীর্ঘ সময়।
No comments