সিলেট শিক্ষা বোর্ডকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছেন কিবরিয়া
সিলেট শিক্ষা বোর্ডকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আরেক ‘খলিফা’ একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার। শিক্ষামন্ত্রীর আশীর্বাদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর বোর্ডকে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করছেন। টাকার বিনিময়ে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন, যত্রতত্র পরীক্ষা কেন্দ্র ও ব্যবহারিক পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমতি দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে তার ছত্রছায়ায়। তবে ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। কারণ তিনি শিক্ষামন্ত্রীর লোক। শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগধারী হয়েও বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন গোলাম কিবরিয়া তাপাদার। এক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম বিভাগ থাকা একাধিক প্রফেসরকে বাদ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বোর্ডের লোকজনের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ। কলেজ শিক্ষকরাও ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রী তৃতীয় বিভাগধারীকে শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষপদে বসিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের প্রতি অবিচার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে জাতিকে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, টাকা দিলেই বোর্ডের অধীনে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন, যত্রতত্র পরীক্ষা কেন্দ্র ও ব্যবহারিক পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমতি মেলে। এছাড়া জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসনের অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি, স্কুল ও কলেজ পরিদর্শন, ছাড়পত্র প্রদান, সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনেও চলে টাকার খেলা। স্কুল ও কলেজগুলোতে সঠিকভাবে পাঠদান হচ্ছে কিনা, সেই তদারকিও হয় না। সিলেটে অনুমোদন ছাড়া অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বোর্ড। এছাড়াও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত প্রেসকে টাকার বিনিময়ে বোর্ডের কাজ দেয়া হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ যখন কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন তখন বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ গ্রামের বাসিন্দা একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার ওই পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ওই পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। তখন থেকেই নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। এমএ পাস করে বিয়ানীবাজার কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন গোলাম কিবরিয়া। ১৯৮৮ সালে বিয়ানীবাজার কলেজ সরকারি হলে কলেজের সব শিক্ষক আত্তীকরণ হলেও আটকে যান তিনি। গোলাম কিবরিয়ার একজন সহপাঠী যুগান্তরকে জানান, চাকরি হারানোর ক্ষোভে ১৯৮৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নিজের ভাই গোলাম মর্তুজাসহ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি তৎকালীন অধ্যক্ষ মাহবুবুর রশীদ চৌধুরীর ওপর হামলা চালান। এ সময় অধ্যক্ষকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনার কথা স্বীকার করলেও গোলাম কিবরিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘সে হামলা হয়েছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে, তার চাকরি হারানোর ঘটনায় নয়।’ জানা যায়, আত্তীকরণ আটকে গেলে আদালতে রিট করেন গোলাম কিবরিয়া। এরপর তার চাকরি সরকারি হয়। এজন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ১২ বছর। সরকারিকরণ নিয়ে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি তিনি বিয়ানীবাজার কুড়ারবাজার কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আদালতের রায়ে ২০০০ সালে তিনি স্থায়ীভাবে সরকারি চাকরি ফিরে পান। প্রভাষক পদে যোগদান করলেও কয়েক বছরের মধ্যে ডাবল প্রমোশন পেয়ে যান তিনি। প্রভাষক থেকে সিনিয়রিটি চেয়েও আদালতে রিট করেন তিনি। আদালতের রায়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ না করেই প্রমোশন পেয়ে হয়ে যান সহযোগী অধ্যাপক। গোলাম কিবরিয়া যখন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তখন বিসিএস দিয়ে কলেজের শিক্ষকতায় যোগদানকারী অনেকেই ছিলেন সহকারী অধ্যাপক। তারা এখনও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে আছেন। কিন্তু গোলাম কিবরিয়া অধ্যাপক হিসেবে সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাকে চেয়ারম্যান করতে প্রায় আড়াই বছর ওই পদটি খালি রাখেন। ২০১৪ সালে সচিব হিসেবে যোগদান করেই মন্ত্রীর আশীর্বাদে তিনি পেয়ে যান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। মাঝে কিছুদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন অর্থমন্ত্রীর আত্মীয় অধ্যাপক মমতাজ শামীম। তিনি অবসরে চলে গেলে ফের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন কিবরিয়া। অবশেষে গত বছরের নভেম্বরে তিনি ভারমুক্ত হন। দায়িত্ব পান চেয়ারম্যানের। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ বছর ধরে তিনি এ দায়িত্বে আছেন। চেয়ারম্যান পদ খালি থাকাকালে একাধিক অধ্যাপক চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য চেষ্টা করলেও শিক্ষামন্ত্রী না চাওয়ায় কেউ সফল হতে পারেননি। চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম কিবরিয়ার এ সময়কালে বোর্ডে নানান দুর্নীতির পাশাপাশি প্রিন্টিং কাজ নিয়েও চলে ভয়াবহ কমিশন বাণিজ্য। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গত বছরের জুন মাসে নগরীর লালবাজার এলাকার ইলেকট্রো অফসেট প্রেস নামের একটি প্রেসকে সিলগালা করে দেয় পুলিশ। প্রেসটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে পোস্টার ছাপাচ্ছিল। কিন্তু সিলগালা করার মাত্র দুই মাস পর ওই ছাপাখানাকেই দেয়া হয় সিলেট শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন মুদ্রণ, বাঁধাই ও সেলাইয়ের কাজ। চলতি বছরের এসএসসি, এইচএসসি এবং গত বছরের শেষ হওয়া জেএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্রের কাভার পৃষ্ঠা মুদ্রণ, বাঁধাই ও সেলাইয়ের ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৯২০ টাকার কাজ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে বোর্ডের চেয়ারম্যান একেএম গোলাম কিবরিয়ার বক্তব্য হল- সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে বিধি অনুসারেই এ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। এতে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। সিলগালা করার বিষয়টি তার জানা ছিল না। তাছাড়া ছাপাখানাটিকে খুব গোপনীয় কোনো কাজ দেয়া হয়নি। উত্তরপত্রের মোড়কসহ কিছু ছোট কাজ ওই প্রেসকে দেয়া হয়েছিল। এদিকে বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া তাপাদারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের বিরক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে শিক্ষক থাকাকালে ছাত্রীদের বিভিন্ন রসাত্মক কথা বলে বিরক্ত করতেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে সময়ের এক শিক্ষক জানান, মেয়েরা (ছাত্রী) নানান সময় গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করলেও প্রভাবশালী এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলেনি। অনেক সময় দেখা গেছে ছেলেরা ক্লাসে না থাকলে গোলাম কিবরিয়ার ক্লাস মেয়েরা বর্জন করেছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেও ওই অভ্যাস পরিবর্তন হয়নি বলে জানা গেছে। এখনও তিনি বিভিন্ন সময় মোবাইলে মহিলাদের সঙ্গে আপত্তিকর কথাবার্তা বলে বিরক্ত করে থাকেন। ভুক্তভোগীরা জানান, মোবাইল কল চেক করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন গোলাম কিবরিয়া। শিক্ষাজীবনে একটি তৃতীয় বিভাগ থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বিধি মোতাবেক প্রমোশন পেয়ে অধ্যাপক হয়েছি। এখানে শিক্ষামন্ত্রীর কোনো হাত নেই।’ বোর্ডের বিভিন্ন কাজে অনিয়ম দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে বোর্ডে কোনো কাজ হয় না। সবকিছু চলে বিধি মোতাবেক। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ফরম পূরণের সময় কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হয়। গত বছর এমন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিয়েছি। তবে অনুমোদনহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বোর্ডের কিছু করার নেই। বিষয়টি দেখার দায়িত্ব শিক্ষা অধিদফতরের।’
No comments