প্রধান বিচারপতিকে সঠিক তথ্য দেননি বিচারক
প্রধান বিচারপতিকে সঠিক তথ্য দেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বিচারক বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইন। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে তাকে পাঠানো কারণ দর্শানোর চিঠির জবাবে সালমনের জামিন বাতিল করা হয়নি বলে তিনি দাবি করেছেন। তবে আদালতের হাজত রেজিস্টারসহ অন্যান্য তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, প্রথম শুনানিতেই তার জামিন বাতিল করেছিলেন বিচারক মো. আলী হোসাইন। এদিকে বরগুনা সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমনের ঘটনায় ‘নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন না করতে পারায়’ বরিশাল ও বরগুনার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সরিয়ে দিয়েছে সরকার। তাদের জায়গায় হাবিবুর রহমান ও মোখলেসুর রহমান নামে দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইউএনও তারিক সালমনের গ্রেফতারের ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এছাড়া এই বিচারকের বিরুদ্ধে উঠেছে মাসের পর মাস বিনা ভাড়ায় লঞ্চে ভ্রমণের অভিযোগ। পছন্দমতো বিনা ভাড়ার টিকিট না পাওয়ায় নৌযানের কর্মকর্তাকে পুলিশ দিয়ে ডেকে নেয়ার অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে তার বিরুদ্ধে। আরও জানা গেছে, জামিন বাতিলের দিন আদালত কক্ষে ইউএনও তারিক সালমনের বিরুদ্ধে একজন বর্তমান এবং একজন সাবেক এমপিসহ প্রায় ৬০-৭০ জন আওয়ামী লীগ নেতার (আইনজীবী) উপস্থিত থাকা নিয়েও শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্রসঙ্গত, তারিক সালমন বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও থাকাকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে ছাপিয়েছিলেন’ অভিযোগ করে ৭ জুন মামলা করেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ওবায়েদ উল্লাহ সাজু।
ওই মামলায় সমন জারির প্রেক্ষাপটে ১৯ জুলাই তারিক সালমন আদালতে হাজির হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. আলী হোসাইন। একই বিচারক দুই ঘণ্টা পর ইউএনও তারিকের জামিন মঞ্জুর করেন। আদালত প্রাঙ্গণে ইউএনও তারিককে পুলিশ ধরে নেয়ার ছবি প্রকাশ হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ওই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিস্মিত হয়েছেন জানিয়ে তার উপদেষ্টা এইচটি ইমাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ওই ছবিতে বিকৃত করার মতো কিছু তারা দেখেননি বরং এটি একটি ‘সুন্দর কাজ’। এই সমালোচনা আর ক্ষোভের মধ্যে শুক্রবার ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। তারিক সালমনকে নাজেহালের দিন বরিশালের আদালতে দায়িত্বরত পুলিশের ছয় সদস্যকে শনিবার সরিয়ে দেয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে রোববার মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবিটি যে শিশুর আঁকা- তা তার জানা ছিল না। এদিকে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগ ওঠার পর বরিশালের জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকেও তারিক সালমনকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সোমবার সাংবাদিকদের জানান, ইউএনওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো কিছু তারা পাননি। এ কারণে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতিকে সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি : ইউএনও তারিক সালমনের ঘটনা জানতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতর থেকে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয় বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইনকে। জবাবে বিচারক বলেছেন, ইউএনও’র জামিন বাতিল করা হয়নি। তবে তার এ দাবি মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ঘটনার দিন বরিশালের আদালতে দায়িত্ব পালনকারী কোর্ট পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নৃপেন্দ্র কুমারসহ সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ওইদিনের হাজত রেজিস্টারে ইউএনও তারিক সালমনকে যে হাজতে নেয়া হয়েছিল তার লিখিত প্রমাণও রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে ঘটনার ব্যাখ্যাসহ সংশ্লিষ্ট মামলার নথি চাওয়া হয়। তিনি রোববার সেটা অনলাইনে পাঠিয়েছেন।’ রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে বিচারক আলী হোসাইনের পাঠানো ২ পৃষ্ঠার ব্যাখ্যায় তিনি দাবি করেছেন, ঘটনার দিন ১৯ জুলাই তিনি ইউএনও তারিক সালমনের জামিন বাতিল করেননি। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আদালতের কার্যপ্রণালি শেষে এজলাস ত্যাগ করে খাস কামড়ায় এসে শুনি যে, ইউএনও সাহেবের জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউএনও সাহেবের জামিন একটিবারের জন্যও নামঞ্জুর করা হয়নি। ফলে জেলহাজতে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। শুনানি চলাকালে উৎসুক জনসাধারণের রোষানল থেকে ইউএনও সাহেবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমি শুনানি মুলতবি করি এবং ইউএনও সাহেবের কৌঁসুলির নিবেদন অনুসারে কাগজাত দাখিল করতে বলি এবং আরও মৌখিক আদেশ দিই যে, কাগজাত দাখিলের পরে পুনরায় শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আমি তখন ইউএনও সাহেবকে আদালত কক্ষে বসতে বলি।’ ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেন, ‘অতঃপর ইউএনও সাহেবের পক্ষে কাগজাত হলে এবং উত্তেজনার অবসান হলে জামিনের দরখাস্ত এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ ধারার দরখাস্ত আইনানুগ প্রক্রিয়া পালনপূর্বক মঞ্জুরক্রমে সসম্মানে জামিন প্রদান করা হয়।’ প্রথমে শুনানির পর জামিন মঞ্জুরের আদেশ না দেয়ার পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে আলী হোসাইন বলেন, ‘ইউএনও’র আদালত কক্ষ ত্যাগের পর তার নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয় এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে তিনি তা করেছিলেন।’ বিচারক আলী হোসাইন রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে এভাবে তার ব্যাখ্যা দিলেও তার কোনো সত্যতা মেলেনি। বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান জানান, ‘আদালতে প্রথম দফায় তারিক সালমনের জামিন বাতিল করে তাকে হাজতে পাঠানোর পর তারিক সালমন নিজেই আমাকে ফোন করে জানান, তার জামিন বাতিল হয়েছে এবং তাকে হাজতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়কে জানাই এবং তার জামিনের ব্যাপারে উদ্যোগী হই।’ তারিক সালমন নিজেও বিভিন্ন সময়ে যুগান্তরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রথমে তার জামিন নামঞ্জুরের ঘোষণা দেন বিচারক আলী হোসাইন। ওইদিন আদালতের কোর্ট হাজতে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নৃপেন্দ্র কুমার জানান, ‘আদালতে দায়িত্ব পালনরত সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর শচিন ইউএনও সাহেবকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। আদালতে বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করেছেন বলে জানান আমাকে। সে অনুযায়ী হাজত রেজিস্টারের ১নং সিরিয়ালে ইউএনও সাহেবের নাম হাজতি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে তাকে হাজতে না ঢুকিয়ে চেয়ারে বসতে দিই আমি। ঘণ্টা দুয়েক পরে শুনি যে তার জামিন হয়েছে। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।’ বিচার কক্ষ থেকে ইউএনও তারিক সালমনকে কোর্ট হাজতে নিয়ে যাওয়া পুলিশের সহকারী সাব ইন্সপেক্টর শচিন ঢালি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারক নিজে তাকে জামিন না দেয়ার ঘোষণা দেন। এটা আমি নিজ কানে শুনেছি। তাছাড়া আদালতের পেশকারও আমায় বলেন যে তার জামিন বাতিল হয়েছে। এরপর আমি তাকে নিয়মানুযায়ী হাজতে নিয়ে যাই। তবে আমি তার হাতে কোনো হাতকড়া পরাইনি।’ মামলার বাদী বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতা অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজু যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারক আলী হোসাইন প্রথম দফায় ইউএনও তারিক সালমনের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে তাকে জেলা হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শতাধিক মানুষের সামনে তিনি ওই নির্দেশ দেন।’ ঘটনার সময় আদালতে উপস্থিত একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘প্রথম দফায় বিচারক কর্তৃক জামিন বাতিলের আদেশ হওয়ার পর আদালতে হর্ষধ্বনি করে ইউএনও সালমন তারিকের বিরুদ্ধে কোর্টে দাঁড়ানো আইনজীবীরা। পরে বার লাইব্রেরির অফিস কক্ষে গিয়ে ভি চিহ্ন দেখিয়ে উল্লাসমুখর ছবি তোলেন তারা। সেই ছবি পরদিন বরিশালের স্থানীয় দৈনিকে ছাপা হয়।’
দুই ডিসি প্রত্যাহার : গাজী তারিক সালমনের বরিশালে নাজেহাল হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে ‘দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার’ কারণে দুই জেলার ডিসিকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান যুগান্তরকে বলেন, ‘বরিশালের জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান এবং বরগুনার জেলা প্রশাসক বশিরুল আলমকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফেরত আনা হয়েছে। তাদের জায়গায় নতুন দু’জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবের (পিএস) দায়িত্ব পালন করে আসা হাবিবুর রহমানকে জেলা প্রশাসক করে পাঠানো হয়েছে বরিশালে। আর বরগুনার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন পাবনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোখলেসুর রহমান। দুই ডিসিকে প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘তারা যে দায়িত্বে ছিলেন, তা পুরোপুরি পালন করতে পারেননি, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটি : গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা। গত ২২ জুলাই এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শফিউল আলম বলেন ‘কোনো ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে কিনা, আইনের অপব্যবহার বা আইনের বাইরে কিছু হয়েছে কি-না সেটা উনারা দেখবেন।’ ইউএনও নাজেহালের ঘটনা এ পর্যায়ে আসা পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের কোনো গাফিলতি আছে কি-না এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমরা কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করব। তবে ইনিশিয়ালি যাদেরকে আমরা দোষী মনে করছি বা সরকার মনে করবে, তাদের ব্যাপারে হয়তো অ্যাকশনে যেতে পারে। এটা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, জনপ্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’
বিনা ভাড়ায় লঞ্চ ভ্রমণ : একটানা ৭ মাস সার্কিট হাউসের ভাড়া প্রদানই কেবল নয়, বছরের পর বছরজুড়ে লঞ্চে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণেরও অভিযোগ উঠেছে ইউএনও তারিক সালমনের মামলার বিচারক বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইনের বিরুদ্ধে। গেল ঈদুল ফিতরে বিনা ভাড়ায় পছন্দসই সিট দিতে না পারায় ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী ওয়াটার বাস গ্রীন লাইনের কর্মকর্তা মো. লিপটনকে পুলিশ দিয়েও ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার শিকার লিপটন জানান, ‘প্রায় আড়াই বছর আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল শুরু করে গ্রীন লাইন। এই সার্ভিসে প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় ঢাকা যেতেন মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইন। সার্ভিস চালু হওয়ার ৪/৫ মাস পরে একদিন তার আদালতের পেশকার সুমন হাওলাদার আমাদের অফিসে এসে তার জন্যে প্রথম শ্রেণীর একটি সৌজন্য টিকিট চান। আমরা দিতে রাজি না হওয়ার বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়ে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান। পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টিকিট দিতে রাজি হলে সৌজন্য লিখে দেয়া বা সৌজন্য সিল দিতে নিষেধ করেন তিনি। এইবার আমরা কঠোরভাবে তা দিতে অস্বীকার করলে আবার শুরু হয় ভয়ভীতি প্রদর্শন। পরে ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তারা তা দিতে বলেন। সেই থেকে প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় নিজের পছন্দসই আসনে বিনা ভাড়ায় ঢাকায় যেতেন বিচারক আলী হোসাইন। গেল ঈদুল ফিতরে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে বিনা ভাড়ায় তার পছন্দের সিট দিতে ব্যর্থ হলে পুলিশ দিয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় ডেকে নেন তিনি। পুলিশ কর্মকর্তারা অবশ্য আমাদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেননি। পুরো ঘটনা শুনে সসম্মানে পাঠিয়ে দেন তারা।’ এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বিচারক আলী হোসাইনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ডায়াল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এমনকি তার পেশকার সুমন হাওলাদারও রাজি হননি মন্তব্য করতে। বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন বলেন, ‘বিচারক আলী হোসেন ফোনে আমাদেরকে গ্রীন লাইনের টিকিট দেয়া নিয়ে জটিলতার কথা বলে তাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী লিপটনকে থানায় আসার জন্য বলা হয়। কিন্তু পুরো ঘটনা শুনে আমরা এ ব্যাপারে আর কোনো ব্যবস্থা নেইনি। তাদেরকে থানা থেকেই বিদায় দেয়া হয়।’ বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একজন বিচারকের এমন আচরণ সত্যিকার অর্থেই হতাশাজনক। এটা পুরোপুরি নীতি নৈতিকতাবহির্ভূত। বিচারকের আসনে থাকা একজন মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কোনোক্রমেই আশা করা যায় না।’
আদালতে ছিলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা : ১/২ কিংবা ৮/১০ জন নয়, ইউএনও তারিক সালমনের জামিন আবেদন বাতিল করে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর পক্ষে সেদিন আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন ৭০/৮০ জন আইনজীবী। যারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ নেতা এদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য, আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক এবং প্রভাবশালী আইনজীবী নেতারা। এদের কারণে আদালতে ইউএনও তারিক সালমনের নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে বিচারক আলী হোসাইনের পাঠানো লিখিত ব্যাখ্যায়। দুই পৃষ্ঠার ওই ব্যাখ্যায় বেশ কয়েকবার তারিক সালমনের নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেছেন আলী হোসাইন। আদালত কক্ষে তার বিরুদ্ধে এবং মামলার বাদীর পক্ষে প্রভাবশালী আইনজীবী নেতাদের অবস্থান করার কথাও বলেছেন তিনি। ব্যাখ্যার শেষ পর্যায়ে আদালত কক্ষের পরিবেশ তুলে ধরে মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইন বলেন, ‘মামলার ফরিয়াদি বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়দুল্লাহ সাজু নিজে উপস্থিত ছিলেন আদালতে। এছাড়াও ছিলেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, সাবেক এমপি অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ খান, বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ আবদুল কাদের ও আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দিন শহীদসহ প্রায় ৫০ থেকে ৭০ আইনজীবী। অপরদিকে তারিক সালমনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন একমাত্র অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজু বলেন, ‘মামলার বাদী হিসেবে আমি আদালতে ছিলাম। এছাড়া আমার সঙ্গে আদালতে ছিলেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউনুস, অ্যাডভোকেট আ. রশিদ খান, অ্যাডভোকেট শেখ আবদুল কাদের এবং অ্যাডভোকেট আনিস উদ্দিন শহিদসহ ৬০-৭০ আইনজীবী। এরা সবাই সেদিন তারিক সালমনের জামিনের বিরুদ্ধে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ খান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
বরগুনার ডিসির বদলিতে ক্ষোভ : বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলমকে আকস্মিক বদলির প্রতিবাদে বরগুনার নাগরিকরা গণআন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা জেলা প্রশাসকের বদলির আদেশ বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। বরগুনার ডিসির বদলির সংবাদ টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরগুনার জনগণ সামাজিক যোগাযোগে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্বাস হোসেন মন্টু বলেন, বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলম একজন জনবান্ধব প্রশাসক। বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রশিদ বলেন, ড. মহা. বশিরুল আলমের মতো ভালো ডিসি বরগুনায় আসেননি।
প্রধান বিচারপতিকে সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি : ইউএনও তারিক সালমনের ঘটনা জানতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতর থেকে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয় বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইনকে। জবাবে বিচারক বলেছেন, ইউএনও’র জামিন বাতিল করা হয়নি। তবে তার এ দাবি মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ঘটনার দিন বরিশালের আদালতে দায়িত্ব পালনকারী কোর্ট পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নৃপেন্দ্র কুমারসহ সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ওইদিনের হাজত রেজিস্টারে ইউএনও তারিক সালমনকে যে হাজতে নেয়া হয়েছিল তার লিখিত প্রমাণও রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে ঘটনার ব্যাখ্যাসহ সংশ্লিষ্ট মামলার নথি চাওয়া হয়। তিনি রোববার সেটা অনলাইনে পাঠিয়েছেন।’ রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে বিচারক আলী হোসাইনের পাঠানো ২ পৃষ্ঠার ব্যাখ্যায় তিনি দাবি করেছেন, ঘটনার দিন ১৯ জুলাই তিনি ইউএনও তারিক সালমনের জামিন বাতিল করেননি। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আদালতের কার্যপ্রণালি শেষে এজলাস ত্যাগ করে খাস কামড়ায় এসে শুনি যে, ইউএনও সাহেবের জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউএনও সাহেবের জামিন একটিবারের জন্যও নামঞ্জুর করা হয়নি। ফলে জেলহাজতে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। শুনানি চলাকালে উৎসুক জনসাধারণের রোষানল থেকে ইউএনও সাহেবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমি শুনানি মুলতবি করি এবং ইউএনও সাহেবের কৌঁসুলির নিবেদন অনুসারে কাগজাত দাখিল করতে বলি এবং আরও মৌখিক আদেশ দিই যে, কাগজাত দাখিলের পরে পুনরায় শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আমি তখন ইউএনও সাহেবকে আদালত কক্ষে বসতে বলি।’ ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেন, ‘অতঃপর ইউএনও সাহেবের পক্ষে কাগজাত হলে এবং উত্তেজনার অবসান হলে জামিনের দরখাস্ত এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ ধারার দরখাস্ত আইনানুগ প্রক্রিয়া পালনপূর্বক মঞ্জুরক্রমে সসম্মানে জামিন প্রদান করা হয়।’ প্রথমে শুনানির পর জামিন মঞ্জুরের আদেশ না দেয়ার পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে আলী হোসাইন বলেন, ‘ইউএনও’র আদালত কক্ষ ত্যাগের পর তার নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয় এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে তিনি তা করেছিলেন।’ বিচারক আলী হোসাইন রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে এভাবে তার ব্যাখ্যা দিলেও তার কোনো সত্যতা মেলেনি। বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান জানান, ‘আদালতে প্রথম দফায় তারিক সালমনের জামিন বাতিল করে তাকে হাজতে পাঠানোর পর তারিক সালমন নিজেই আমাকে ফোন করে জানান, তার জামিন বাতিল হয়েছে এবং তাকে হাজতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়কে জানাই এবং তার জামিনের ব্যাপারে উদ্যোগী হই।’ তারিক সালমন নিজেও বিভিন্ন সময়ে যুগান্তরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রথমে তার জামিন নামঞ্জুরের ঘোষণা দেন বিচারক আলী হোসাইন। ওইদিন আদালতের কোর্ট হাজতে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নৃপেন্দ্র কুমার জানান, ‘আদালতে দায়িত্ব পালনরত সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর শচিন ইউএনও সাহেবকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। আদালতে বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করেছেন বলে জানান আমাকে। সে অনুযায়ী হাজত রেজিস্টারের ১নং সিরিয়ালে ইউএনও সাহেবের নাম হাজতি হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে তাকে হাজতে না ঢুকিয়ে চেয়ারে বসতে দিই আমি। ঘণ্টা দুয়েক পরে শুনি যে তার জামিন হয়েছে। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।’ বিচার কক্ষ থেকে ইউএনও তারিক সালমনকে কোর্ট হাজতে নিয়ে যাওয়া পুলিশের সহকারী সাব ইন্সপেক্টর শচিন ঢালি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারক নিজে তাকে জামিন না দেয়ার ঘোষণা দেন। এটা আমি নিজ কানে শুনেছি। তাছাড়া আদালতের পেশকারও আমায় বলেন যে তার জামিন বাতিল হয়েছে। এরপর আমি তাকে নিয়মানুযায়ী হাজতে নিয়ে যাই। তবে আমি তার হাতে কোনো হাতকড়া পরাইনি।’ মামলার বাদী বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতা অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজু যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারক আলী হোসাইন প্রথম দফায় ইউএনও তারিক সালমনের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে তাকে জেলা হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শতাধিক মানুষের সামনে তিনি ওই নির্দেশ দেন।’ ঘটনার সময় আদালতে উপস্থিত একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘প্রথম দফায় বিচারক কর্তৃক জামিন বাতিলের আদেশ হওয়ার পর আদালতে হর্ষধ্বনি করে ইউএনও সালমন তারিকের বিরুদ্ধে কোর্টে দাঁড়ানো আইনজীবীরা। পরে বার লাইব্রেরির অফিস কক্ষে গিয়ে ভি চিহ্ন দেখিয়ে উল্লাসমুখর ছবি তোলেন তারা। সেই ছবি পরদিন বরিশালের স্থানীয় দৈনিকে ছাপা হয়।’
দুই ডিসি প্রত্যাহার : গাজী তারিক সালমনের বরিশালে নাজেহাল হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে ‘দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার’ কারণে দুই জেলার ডিসিকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান যুগান্তরকে বলেন, ‘বরিশালের জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামান এবং বরগুনার জেলা প্রশাসক বশিরুল আলমকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফেরত আনা হয়েছে। তাদের জায়গায় নতুন দু’জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবের (পিএস) দায়িত্ব পালন করে আসা হাবিবুর রহমানকে জেলা প্রশাসক করে পাঠানো হয়েছে বরিশালে। আর বরগুনার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন পাবনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোখলেসুর রহমান। দুই ডিসিকে প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘তারা যে দায়িত্বে ছিলেন, তা পুরোপুরি পালন করতে পারেননি, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটি : গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা। গত ২২ জুলাই এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শফিউল আলম বলেন ‘কোনো ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে কিনা, আইনের অপব্যবহার বা আইনের বাইরে কিছু হয়েছে কি-না সেটা উনারা দেখবেন।’ ইউএনও নাজেহালের ঘটনা এ পর্যায়ে আসা পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের কোনো গাফিলতি আছে কি-না এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমরা কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করব। তবে ইনিশিয়ালি যাদেরকে আমরা দোষী মনে করছি বা সরকার মনে করবে, তাদের ব্যাপারে হয়তো অ্যাকশনে যেতে পারে। এটা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, জনপ্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’
বিনা ভাড়ায় লঞ্চ ভ্রমণ : একটানা ৭ মাস সার্কিট হাউসের ভাড়া প্রদানই কেবল নয়, বছরের পর বছরজুড়ে লঞ্চে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণেরও অভিযোগ উঠেছে ইউএনও তারিক সালমনের মামলার বিচারক বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইনের বিরুদ্ধে। গেল ঈদুল ফিতরে বিনা ভাড়ায় পছন্দসই সিট দিতে না পারায় ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী ওয়াটার বাস গ্রীন লাইনের কর্মকর্তা মো. লিপটনকে পুলিশ দিয়েও ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার শিকার লিপটন জানান, ‘প্রায় আড়াই বছর আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল শুরু করে গ্রীন লাইন। এই সার্ভিসে প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় ঢাকা যেতেন মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইন। সার্ভিস চালু হওয়ার ৪/৫ মাস পরে একদিন তার আদালতের পেশকার সুমন হাওলাদার আমাদের অফিসে এসে তার জন্যে প্রথম শ্রেণীর একটি সৌজন্য টিকিট চান। আমরা দিতে রাজি না হওয়ার বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়ে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান। পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে টিকিট দিতে রাজি হলে সৌজন্য লিখে দেয়া বা সৌজন্য সিল দিতে নিষেধ করেন তিনি। এইবার আমরা কঠোরভাবে তা দিতে অস্বীকার করলে আবার শুরু হয় ভয়ভীতি প্রদর্শন। পরে ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তারা তা দিতে বলেন। সেই থেকে প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় নিজের পছন্দসই আসনে বিনা ভাড়ায় ঢাকায় যেতেন বিচারক আলী হোসাইন। গেল ঈদুল ফিতরে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে বিনা ভাড়ায় তার পছন্দের সিট দিতে ব্যর্থ হলে পুলিশ দিয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় ডেকে নেন তিনি। পুলিশ কর্মকর্তারা অবশ্য আমাদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেননি। পুরো ঘটনা শুনে সসম্মানে পাঠিয়ে দেন তারা।’ এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বিচারক আলী হোসাইনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ডায়াল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এমনকি তার পেশকার সুমন হাওলাদারও রাজি হননি মন্তব্য করতে। বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন বলেন, ‘বিচারক আলী হোসেন ফোনে আমাদেরকে গ্রীন লাইনের টিকিট দেয়া নিয়ে জটিলতার কথা বলে তাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী লিপটনকে থানায় আসার জন্য বলা হয়। কিন্তু পুরো ঘটনা শুনে আমরা এ ব্যাপারে আর কোনো ব্যবস্থা নেইনি। তাদেরকে থানা থেকেই বিদায় দেয়া হয়।’ বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একজন বিচারকের এমন আচরণ সত্যিকার অর্থেই হতাশাজনক। এটা পুরোপুরি নীতি নৈতিকতাবহির্ভূত। বিচারকের আসনে থাকা একজন মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কোনোক্রমেই আশা করা যায় না।’
আদালতে ছিলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা : ১/২ কিংবা ৮/১০ জন নয়, ইউএনও তারিক সালমনের জামিন আবেদন বাতিল করে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর পক্ষে সেদিন আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন ৭০/৮০ জন আইনজীবী। যারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ নেতা এদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য, আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক এবং প্রভাবশালী আইনজীবী নেতারা। এদের কারণে আদালতে ইউএনও তারিক সালমনের নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে বিচারক আলী হোসাইনের পাঠানো লিখিত ব্যাখ্যায়। দুই পৃষ্ঠার ওই ব্যাখ্যায় বেশ কয়েকবার তারিক সালমনের নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেছেন আলী হোসাইন। আদালত কক্ষে তার বিরুদ্ধে এবং মামলার বাদীর পক্ষে প্রভাবশালী আইনজীবী নেতাদের অবস্থান করার কথাও বলেছেন তিনি। ব্যাখ্যার শেষ পর্যায়ে আদালত কক্ষের পরিবেশ তুলে ধরে মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আলী হোসাইন বলেন, ‘মামলার ফরিয়াদি বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়দুল্লাহ সাজু নিজে উপস্থিত ছিলেন আদালতে। এছাড়াও ছিলেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, সাবেক এমপি অধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ খান, বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ আবদুল কাদের ও আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসউদ্দিন শহীদসহ প্রায় ৫০ থেকে ৭০ আইনজীবী। অপরদিকে তারিক সালমনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন একমাত্র অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজু বলেন, ‘মামলার বাদী হিসেবে আমি আদালতে ছিলাম। এছাড়া আমার সঙ্গে আদালতে ছিলেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউনুস, অ্যাডভোকেট আ. রশিদ খান, অ্যাডভোকেট শেখ আবদুল কাদের এবং অ্যাডভোকেট আনিস উদ্দিন শহিদসহ ৬০-৭০ আইনজীবী। এরা সবাই সেদিন তারিক সালমনের জামিনের বিরুদ্ধে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ খান বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
বরগুনার ডিসির বদলিতে ক্ষোভ : বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলমকে আকস্মিক বদলির প্রতিবাদে বরগুনার নাগরিকরা গণআন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা জেলা প্রশাসকের বদলির আদেশ বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। বরগুনার ডিসির বদলির সংবাদ টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরগুনার জনগণ সামাজিক যোগাযোগে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্বাস হোসেন মন্টু বলেন, বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলম একজন জনবান্ধব প্রশাসক। বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রশিদ বলেন, ড. মহা. বশিরুল আলমের মতো ভালো ডিসি বরগুনায় আসেননি।
No comments