তারিশির কাছে ভাইয়ের মর্মস্পর্শী চিঠি
হলি
আর্টিজান বেকারিতে মর্মান্তিক জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারানো একজন ছিলেন
তারিশি জৈন। ১৮ বছরের এই তরুণী গেল বছর ১লা জুলাই সেখানে গিয়েছিলেন বন্ধু
ফারাজ আইয়াজ হোসাইন ও অবিন্তা কবিরের সঙ্গে দেখা করতে। যুক্তরাষ্ট্রের
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্রী ছিলেন।
জুনের প্রথমদিকে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে
অবস্থানরত পিতা-মাতার সঙ্গে অবকাশ যাপনের পাশাপাশি বেসরকারি একটি ব্যাংকে
ইন্টার্নশিপ সমপন্ন করা।
কানাডাপ্রবাসী ভাই সঞ্চিত জৈনেরও ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা জটিলতায় তার আসা হয়নি। তারিশির মৃত্যুবার্ষিকীতে সঞ্চিত ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে আবেগভরা এক চিঠি লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ইংরেজিতে লেখা সঞ্চিতের লেখা সেই চিঠির অনুবাদ মানবজমিনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
প্রিয় তারিশি,
তোকে ছাড়া পেরিয়ে গেছে একটি বছর। যখন ভাবি কি বলবো- তখন কত কিছু যে মনে আসে। এতো কিছু যে সেগুলোর জট ছাড়াতে হয় একটা একটা করে। তুই জানিস আমি কেমন হয়ে যাই। আমি এখানে এটা লিখছি- কেননা, আমি ফের এটা পড়তে চাই- তুই মানুষটা যেমন ছিলি, তোর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হতে। হয়তো নিজেকে ও আমার চারপাশের মানুষদের পরিবর্তন করার জন্য অনুপ্রাণিত হতেও লিখছি। তেমন একটা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে পরিবর্তন হওয়া, যেমনটা তোর আর তোর বন্ধুদের প্রাপ্য।
আমি যদি বলি, তুই আমার কাছে আমার পুরো দুনিয়া; তাহলে সেটা সত্যি হবে। তবে, আমি ভাবি যদি তুই দেখতে পেতি তুই গোটা বিশ্বের কাছে কি। তুই যেখানেই গেছিস, তোকে নিয়ে কারো না কারো একটা বা দশটা গল্প আছে বলার। আর তারা সেগুলো বলেও, মুখে হাসি নিয়েই বলে। তোর এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল, ‘তারিশির সঙ্গে থাকা নিজের বাড়িতে থাকার মতো।’ অন্য আরেকজনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তুই নিজের সেরাটা ঢেলে দিতিস- হোক সেটা স্কুলে যোগ দেয়া নতুন কেউ, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কোনো শিক্ষার্থী। পুরো সময়টা নীরবে একই সঙ্গে অস্বস্তিটা নিজে বয়ে বেড়িয়েছিস। আরেকজনকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়ার অসামান্য সামর্থ্য ছিল তোর। সেটা শুধু বাহ্যিকভাবেই নয়, বরং আবেগিক ও আত্মিকভাবেও।
তোর কাছ থেকে আমি প্রথম যে শিক্ষাটা নেই সেটা সহমর্মিতার। স্বপ্নের যেই জগৎটা তোর প্রাপ্য সেটা সহমর্মিতায় পূর্ণ। আমি লক্ষ্য করেছি যে, তোর নিজের অবস্থা যেমনই হোক না কেন তোর হৃদয়ে সবসময় অন্যকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়ার জায়গা ছিল। অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবে যে সহমর্মিতা আত্মগত আর বোকামির মতো কোনো বিষয়। হতাশাবাদী কেউ হয়তো বলবে, সহমর্মিতা আর স্বার্থপরতা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবে, তুই তোর জীবনে দেখিয়েছিস যে, গোপন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সহমর্মিতা অনুভব করা যায়। আবার আমাদের জগতে কাপুরুষেরাও আছে যারা সকল ধরনের নৃশংসতা চালানোর অজুহাত হিসেবে অন্যের হতাশার পেছনে লুকায়। তুই আমাকে দ্বিতীয় যেটা শিখিয়েছিস তা হলো প্রতিকূলতার মুখেও নিঃস্বার্থপরতা।
তোর দৃঢ়চিত্ততা আর উদ্যমী দৃষ্টিভঙ্গির কথা না বললেই নয়। তোর শেষ বছরটা ছিল অসম্ভব কঠিন। বার্কলির মতো স্কুলে প্রথম বছর, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া, এরপর অস্ত্রোপচার, নতুন বন্ধু বানানো, পুরনোদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, আর নিজের একটা ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। তুই সবই করেছিস। সকল প্রতিকূলতার মুখেও তুই সবকিছু উৎরে গেছিস সাবলীলভাবে। শেষে জয়টা তোরই হয়েছে।
আমার মনে আছে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন থাইল্যান্ডে পাহাড়ে চড়তে যেতাম। তুই বার বার পড়ে যেতিস আর পিছলে পড়তিস- কিন্তু পথ শেষ করার আগ পর্যন্ত থামতিস না। এই বিষয়টা কখনও তোর কাছে স্বীকার না করার আফসোস আমার সবসময় থাকবে। সেটা হলো তোর কাছ থেকে পাওয়া তৃতীয় শিক্ষা- অধ্যবসায়, আমার সবটুকু শ্রদ্ধাবোধ রইলো তোর প্রতি।
এতোদূর লেখার পর সত্যিই মনে হচ্ছে আমি তোকে একজন সাধু-সন্তুর মতো করে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। এটা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কে জানে! উপরে বলা তোর শিক্ষাগুলো তো ছিল অনেক বড়।
ছোটখাট বিষয়গুলো না বলাটা গাফিলতি হবে, যে বিষয়গুলো তোকে তোর মতো বানিয়েছে। নতুন কিছু খাওয়া বা নতুন কোনো গান শোনা নিয়ে তোর উদ্দীপনা। মা আর পাপা আমাদের জন্য যা কিছু করেন তার জন্য তুই যে অসামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ করতিস এবং প্রকাশ করতিস। এই গুণটা ছিল তোর ভেতরে প্রোথিত; এটাই তোর কাছ থেকে পাওয়া চতুর্থ শিক্ষা- কৃতজ্ঞতাবোধ।
জীবন আমাদের যা কিছু দিয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ আর জীবন আমাদের যা কিছু দিতে পারে তা নিশ্চিতভাবে মানবতার আধ্যাত্মিক বিবর্তনের এক মাইলফলক। কৃতজ্ঞতাবোধ, অধ্যবসায়, সহমর্মিতা আর নিঃস্বার্থপরতা। তোর সঙ্গে কাটানো ১৮টি বছরের দিকে ফিরে তাকালে এই চারটি বিষয় আমার দিকে প্রতিফলিত হয়। এই গুণগুলো কখনই ফুরিয়ে যাবার নয়। কেননা, আমি নিশ্চিত যে, এরপর যখন মা, পাপা আর আমি বসে আমাদের চার জনের কাটানো জীবনের দিকে ফিরে তাকাবো তখন আমরা আরো কিছু খুঁজে পাবো আর তোর বিশালত্ব অনুধাবন করার আরেকটু কাছে যাবো। আর তাই, আমি তোর গুণগুলো শেয়ার করতে চেয়েছি যা আমার ও বাকি বিশ্বের জন্য শিক্ষা। যেন, হয়তো কোনোদিন এমন এক ভবিষ্যৎ আসবে যেখানে তোর মতো মানুষ যাদের উষ্ণতাপূর্ণ ও সত্যিকারের উদারতার এক জীবন প্রাপ্য তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হবে না।
সেই লক্ষ্যে কাজ করার একটা অংশ হলো তোর মতো মানুষদের খোঁজা; যারা তোর মতোই একই গুণাবলী ধারণ করে। এবং প্রয়োজনে তাদের যেকোনোভাবে সাহায্য করা। এটাই ‘লিভ লাইভ লাইক তারিশি অ্যাওয়ার্ডের’ সারকথা। আর এটা সবে শুরু।
তোর শিক্ষাগুলোর জন্য ধন্যবাদ তারিশি। এটা জেনে রাখ যে, প্রতিবার যখন এগুলোর একটা আমি মেনে চলবো তোর একটি অংশ বেঁচে থাকবে। তারিশি, আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখবো।
ভালোবাসা,
ভাইয়া।
কানাডাপ্রবাসী ভাই সঞ্চিত জৈনেরও ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা জটিলতায় তার আসা হয়নি। তারিশির মৃত্যুবার্ষিকীতে সঞ্চিত ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে আবেগভরা এক চিঠি লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ইংরেজিতে লেখা সঞ্চিতের লেখা সেই চিঠির অনুবাদ মানবজমিনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
প্রিয় তারিশি,
তোকে ছাড়া পেরিয়ে গেছে একটি বছর। যখন ভাবি কি বলবো- তখন কত কিছু যে মনে আসে। এতো কিছু যে সেগুলোর জট ছাড়াতে হয় একটা একটা করে। তুই জানিস আমি কেমন হয়ে যাই। আমি এখানে এটা লিখছি- কেননা, আমি ফের এটা পড়তে চাই- তুই মানুষটা যেমন ছিলি, তোর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হতে। হয়তো নিজেকে ও আমার চারপাশের মানুষদের পরিবর্তন করার জন্য অনুপ্রাণিত হতেও লিখছি। তেমন একটা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে পরিবর্তন হওয়া, যেমনটা তোর আর তোর বন্ধুদের প্রাপ্য।
আমি যদি বলি, তুই আমার কাছে আমার পুরো দুনিয়া; তাহলে সেটা সত্যি হবে। তবে, আমি ভাবি যদি তুই দেখতে পেতি তুই গোটা বিশ্বের কাছে কি। তুই যেখানেই গেছিস, তোকে নিয়ে কারো না কারো একটা বা দশটা গল্প আছে বলার। আর তারা সেগুলো বলেও, মুখে হাসি নিয়েই বলে। তোর এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল, ‘তারিশির সঙ্গে থাকা নিজের বাড়িতে থাকার মতো।’ অন্য আরেকজনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তুই নিজের সেরাটা ঢেলে দিতিস- হোক সেটা স্কুলে যোগ দেয়া নতুন কেউ, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কোনো শিক্ষার্থী। পুরো সময়টা নীরবে একই সঙ্গে অস্বস্তিটা নিজে বয়ে বেড়িয়েছিস। আরেকজনকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়ার অসামান্য সামর্থ্য ছিল তোর। সেটা শুধু বাহ্যিকভাবেই নয়, বরং আবেগিক ও আত্মিকভাবেও।
তোর কাছ থেকে আমি প্রথম যে শিক্ষাটা নেই সেটা সহমর্মিতার। স্বপ্নের যেই জগৎটা তোর প্রাপ্য সেটা সহমর্মিতায় পূর্ণ। আমি লক্ষ্য করেছি যে, তোর নিজের অবস্থা যেমনই হোক না কেন তোর হৃদয়ে সবসময় অন্যকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়ার জায়গা ছিল। অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবে যে সহমর্মিতা আত্মগত আর বোকামির মতো কোনো বিষয়। হতাশাবাদী কেউ হয়তো বলবে, সহমর্মিতা আর স্বার্থপরতা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবে, তুই তোর জীবনে দেখিয়েছিস যে, গোপন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সহমর্মিতা অনুভব করা যায়। আবার আমাদের জগতে কাপুরুষেরাও আছে যারা সকল ধরনের নৃশংসতা চালানোর অজুহাত হিসেবে অন্যের হতাশার পেছনে লুকায়। তুই আমাকে দ্বিতীয় যেটা শিখিয়েছিস তা হলো প্রতিকূলতার মুখেও নিঃস্বার্থপরতা।
তোর দৃঢ়চিত্ততা আর উদ্যমী দৃষ্টিভঙ্গির কথা না বললেই নয়। তোর শেষ বছরটা ছিল অসম্ভব কঠিন। বার্কলির মতো স্কুলে প্রথম বছর, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া, এরপর অস্ত্রোপচার, নতুন বন্ধু বানানো, পুরনোদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, আর নিজের একটা ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। তুই সবই করেছিস। সকল প্রতিকূলতার মুখেও তুই সবকিছু উৎরে গেছিস সাবলীলভাবে। শেষে জয়টা তোরই হয়েছে।
আমার মনে আছে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন থাইল্যান্ডে পাহাড়ে চড়তে যেতাম। তুই বার বার পড়ে যেতিস আর পিছলে পড়তিস- কিন্তু পথ শেষ করার আগ পর্যন্ত থামতিস না। এই বিষয়টা কখনও তোর কাছে স্বীকার না করার আফসোস আমার সবসময় থাকবে। সেটা হলো তোর কাছ থেকে পাওয়া তৃতীয় শিক্ষা- অধ্যবসায়, আমার সবটুকু শ্রদ্ধাবোধ রইলো তোর প্রতি।
এতোদূর লেখার পর সত্যিই মনে হচ্ছে আমি তোকে একজন সাধু-সন্তুর মতো করে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। এটা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কে জানে! উপরে বলা তোর শিক্ষাগুলো তো ছিল অনেক বড়।
ছোটখাট বিষয়গুলো না বলাটা গাফিলতি হবে, যে বিষয়গুলো তোকে তোর মতো বানিয়েছে। নতুন কিছু খাওয়া বা নতুন কোনো গান শোনা নিয়ে তোর উদ্দীপনা। মা আর পাপা আমাদের জন্য যা কিছু করেন তার জন্য তুই যে অসামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ করতিস এবং প্রকাশ করতিস। এই গুণটা ছিল তোর ভেতরে প্রোথিত; এটাই তোর কাছ থেকে পাওয়া চতুর্থ শিক্ষা- কৃতজ্ঞতাবোধ।
জীবন আমাদের যা কিছু দিয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ আর জীবন আমাদের যা কিছু দিতে পারে তা নিশ্চিতভাবে মানবতার আধ্যাত্মিক বিবর্তনের এক মাইলফলক। কৃতজ্ঞতাবোধ, অধ্যবসায়, সহমর্মিতা আর নিঃস্বার্থপরতা। তোর সঙ্গে কাটানো ১৮টি বছরের দিকে ফিরে তাকালে এই চারটি বিষয় আমার দিকে প্রতিফলিত হয়। এই গুণগুলো কখনই ফুরিয়ে যাবার নয়। কেননা, আমি নিশ্চিত যে, এরপর যখন মা, পাপা আর আমি বসে আমাদের চার জনের কাটানো জীবনের দিকে ফিরে তাকাবো তখন আমরা আরো কিছু খুঁজে পাবো আর তোর বিশালত্ব অনুধাবন করার আরেকটু কাছে যাবো। আর তাই, আমি তোর গুণগুলো শেয়ার করতে চেয়েছি যা আমার ও বাকি বিশ্বের জন্য শিক্ষা। যেন, হয়তো কোনোদিন এমন এক ভবিষ্যৎ আসবে যেখানে তোর মতো মানুষ যাদের উষ্ণতাপূর্ণ ও সত্যিকারের উদারতার এক জীবন প্রাপ্য তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হবে না।
সেই লক্ষ্যে কাজ করার একটা অংশ হলো তোর মতো মানুষদের খোঁজা; যারা তোর মতোই একই গুণাবলী ধারণ করে। এবং প্রয়োজনে তাদের যেকোনোভাবে সাহায্য করা। এটাই ‘লিভ লাইভ লাইক তারিশি অ্যাওয়ার্ডের’ সারকথা। আর এটা সবে শুরু।
তোর শিক্ষাগুলোর জন্য ধন্যবাদ তারিশি। এটা জেনে রাখ যে, প্রতিবার যখন এগুলোর একটা আমি মেনে চলবো তোর একটি অংশ বেঁচে থাকবে। তারিশি, আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখবো।
ভালোবাসা,
ভাইয়া।
No comments