হনুজ দিল্লি দূর অস্ত by এম সাখাওয়াত হোসেন
বিগত
বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লি গিয়েছিলাম গবেষণার কাজে। আমার
এক সুহৃদের সহযোগিতায় দেখা হয়েছিল ভারতের রাষ্ট্রপতি মি. প্রণব মুখার্জির
সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর অফিসে। এটি ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎকার। তাঁর সঙ্গে
আমার পূর্ব পরিচিতি ছিল না। তথাপি তিনি আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন। ইতিপূর্বে
ভারতে কোনো বাংলা ভাষাভাষী রাষ্ট্রপতি হন নাই, তাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের
সময় সে কথা চেপে রাখতে পারিনি। তিনি আমার বক্তব্যে শুধু মুচকি হেসেছিলেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করায় সুযোগ হয়েছিল বিশ্বের সবচাইতে বড় এই ঐতিহাসিক সরকারি বাসভবনটির কিয়দাংশ দেখবার। রেইসিয়ানা পাহাড় কেটে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল বৃটিশ ভারতের শাসক বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির ধারক বাহক ভাইসরয় হাউস হিসেবে। হার্বাট বেকারের তত্ত্বাবধানে এবং যার নকশায় এই ভবনটি তৈরি হয়েছিল তার নাম এডউইন ল্যান্ডসির লুটিয়েন্স (Edwin Landseer Lutyens)। এই ব্যক্তিই বর্তমানের নতুন দিল্লিরও নকশা করেছিলেন। তার সহযোগী ছিলেন মি. হার্বাট বেকার (Herbert Baker)। এ কারণে ভারতের রাজধানী নতুন নতুন দিল্লিকে অনেক সময় লুটিয়েন্স দিল্লি বলা হয়। এই দিল্লিই ঐতিহাসিক ভারতের অষ্টম, জনান্তরে দশম দিল্লিস্থিত রাজধানী। যাই হোক দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের বিস্তারিত বিবরণে পরে আসবো।
ইতিপূর্বেই আমি দুবার দিল্লিতে এসেছিলাম এবং সপ্তাহখানেক সময় করে কাটিয়েছিলাম। জীবনে দিল্লিতে প্রথম এসেছিলাম ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশনে থাকাকালে ভারতের পনেরতম সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে। তারপর আরেকবার এসেছিলাম ২০১০ সালে যখন আমি নির্বাচন সংস্কার নিয়ে গবেষণা করি। আর তৃতীয়বার ২০১৬ সালে এসেছিলাম আরেক গবেষণার কাজে। যতবারই দিল্লিতে এসেছি ততবারই মনে হয়েছে দিল্লিকে তেমনভাবে দেখা হয়নি, যেমনভাবে আমি দেখতে চেয়েছি। আমি বহু দেশের রাজধানীতে গিয়েছি। যার মধ্যে রোম নগরীও রয়েছে। তথাপি আমার মনে হয় যে দিল্লির ইতিহাসের বৈচিত্র্যের ধারেকাছেও বিশ্বের আর কোনো রাজধানী নেই। প্রথমবার এসেই মনে হয়েছিল কত পরিচিত এই শহর। কারণ উপমহাদেশের ইতিহাস যেদিন আমার পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় এসেছিল সেদিন থেকেই আমি এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছি। সেই ইতিহাস পড়া আজও শেষ হয়নি।
দিল্লির বর্ণনা দিতে গিয়ে বোধকরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি মনে পড়ে। এর চাইতে ভালো বর্ণনা কেউ দিতে পারেনি বলে মনে হয়। অবশ্য তিনি তার কবিতায় ভারতবর্ষের কথা বললেও তা দিল্লির জন্যও প্রযোজ্য। তিনি লিখেছিলেন-
‘হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য
হেথা দ্রাবিড় চীন
শকহুনদল পাঠান মোগল
এক দেহে হলো লীন।’
রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই পঙক্তিতে যেন ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দিল্লির মসনদে বসে ভারতবর্ষ শাসন করেছে আর্য, অনার্য, মোগল, পাঠান, গোত্র না জানা ক্রীতদাস, ইংরেজ। এমন বিচিত্র সাম্রাজ্যের ইতিহাস অন্য কোনো শহরে পাওয়া কল্পনাই করা যায় না।
আধুনিক ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি পক্ষান্তরে দিল্লি যতই আধুনিক হোক না কেন- নতুন বা পুরাতন দিল্লি দেখেছে সাম্রাজ্য আর শাসকদের উত্থান আর পতন। এই উত্থান আর পতনের সঙ্গে জড়িত ছিল তৎকালীন উপমহাদেশের ভাগ্য। দিল্লি শহরটি যত আধুনিকই হোক না কেন এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের ধ্বংসস্তূপ। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের, গোত্রের শাসকদের উত্থান আর পতনের করুণ চিহ্ন। এই শহর গড়ে উঠেছে সাতটি রাজধানী শহরকে কেন্দ্র করে। অনেকের মতে দশ হতে বারোটি শহরও হতে পারে। এ শহরের এসব পুরাতন সমাধিস্থল আর শ্মশানঘাট মনে করিয়ে দেয় উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাস কারও পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই শহরে আসলেই জড়িয়ে পড়তে হয় ইতিহাসের সঙ্গে। নাটক, নভেল আর ভ্রমণ কাহিনীর উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে দিল্লির বৃহৎ উদ্যানগুলোতে আর রাজপথ, অলিগলি অথবা পুরাতন শহর জুড়ে। কত জাতির রক্ত ঝরেছে এই শহরে। কত সুখ-দুঃখের ইতিহাস আর অজানা গল্প রয়েছে দিল্লির প্রতিটি পাথরের নিচে। এমনই অনুভূতি হয়েছিল আমার প্রতিবারের দিল্লি সফরে।
প্রথমবার যখন দিল্লির দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাই চেষ্টা করেছিলাম কিছু অজানা ইতিহাস জানতে। কিছু পেয়েছি কিছু পাইনি। দিল্লির সাতটি রাজধানীর নাম এখনো তেমনই রয়েছে যেমন কিনা রাই পিলোথরা সবচাইতে পুরাতন শহর বলে নথিভুক্ত রয়েছে। এই শহরটি পৃত্থিরাজ চৌহান-এর তৈরি। এর ধ্বংসবিশেষ এখনো দৃশ্যমান। জায়গাটি কুতুব মিনারের কাছাকাছি। মেহেরুলী এখানেই কুতুব মিনারসহ বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রয়েছে ফিরোজ শাহ তুগলকের সমাধি ও তার তৈরি ওই সময়কার সবচাইতে বৃহৎ মুসলিম পাঠস্থান মাদরাসা, সূফী বখতিয়ার উদ্দিন কাকীর সমাধি আর সামসি তালাব, ‘শিরি’, খিলজিদের রাজধানী, ফিরোজাবাদ, গিয়াসউদ্দিন তুগলকের তৈরি শহর। যমুনা নদীর তীরে ফিরোজ শাহ কোটলা, বর্তমানে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম এই সুলতানের নাম ধারণ করে রয়েছে।
তুগলকাবাদ গিয়াসউদ্দিন তুগলকের শহর এখন শুধুমাত্র একটি পরিত্যক্ত বিশাল আয়তনের পাথরের তৈরি দুর্গ। ওই সময়কার অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সমসাময়িক ছিলেন দিল্লির অন্যতম সূফী সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়া। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন উপমহাদেশের সবচাইতে খ্যাত সূফী সাধক খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির শিষ্য এবং কুতুবউদ্দিন কাকীর শিক্ষানবিশ। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ক্রমেই বিখ্যাত হয়ে উঠেন এমন কি তিনি সূফী সাধক হিসেবে কুতুবউদ্দিন কাকীর চাইতে বেশি খ্যাত হন। ওই সময়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের নিকট নিজামউদ্দিন দারুণ একজন জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। নিজামউদ্দিনের এ খ্যাতি গিয়াসউদ্দিন তুগলককে দারুন ঈর্ষাপরায়ণ করে তোলে। আমি কথা বলছি ১৩ শতাব্দীর আশেপাশের দিনগুলোর কথা। গিয়াসউদ্দিন তুগলক যখন তার শহর তৈরি করছিলেন ওই সময়ই নিজামউদ্দিন তার দরবারে, যা এখন এই সাধকের মাজার, খনন করছিলেন বিশাল এক তালাব (পুকুর), যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে মাজারের পেছনে। ওই দীঘি খননের জন্য প্রয়োজন ছিল বহু কর্মীর। অপরদিকে দিল্লির সুলতানের শহর তৈরিতে কর্মীর অভাব হয়ে পড়লে নিজামউদ্দিনকে সুলতান তার কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে সুলতানের দরবারে ডেকে পাঠালে আওলিয়া সে ডাকে সাড়া দেননি।
গিয়াসউদ্দিন তুগলক তখন বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত। বাংলায় বিদ্রোহ থামাতে দিল্লি ছাড়লেন কিন্তু তার পূর্বেই তিনি মনঃস্থির করেছিলেন যে রাজদ্রোহের অপরাধে ফিরে এসে আউলিয়াকে চরম শাস্তি দেবেন। তুগলক বাংলার বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসবার পথে আবার তার সংকল্পের কথা প্রকাশ করলে আউলিয়ার শিষ্যরা আউলিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। নিজামউদ্দিনের তখন অনেক বয়স। তিনি তার অনুরাগীদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তুগলককে দিল্লি পর্যন্ত আসতে দাও’- বলে যে উক্তি করেছিলেন তা উপমহাদেশে আজও উচ্চারিত হয়। ধ্যানরত আউলিয়া বলেছিলেন ‘হুনুজ দিল্লি দূর অস্ত’ ‘দিল্লি এখনো বহু দূরে’। গিয়াসউদ্দিন তুগলক দিল্লি পর্যন্ত আসতে পারেননি। পথে তার পুত্র মোহাম্মদ বিন তুগলকের তৈরি অভ্যর্থনা মঞ্চ হতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মহাক্রমশালী গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সমাধি রয়েছে পরিত্যক্ত তুগলকাবাদের দুর্গের অদূরে জনমানবশূন্য নির্জন জায়গায় আর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার থাকে লোকে লোকারণ্য। নিজামউদ্দিন আউলিয়া আরো ভবিষ্যদ্বাণী করে তুগলকাবাদ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ইয়া রাসেগা গুজর ইয়া রহেগা উজার’ (এটা হয় থাকবে পরিত্যক্ত অথবা বসবাস করবে গুজারা। [যারা মহিষ চড়ায়]) এমনই রয়েছে তুগলকাবাদ। এখান থেকে যে শিক্ষা নেয়া উচিত আমাদের সময়কার নেতাদের, ক্ষমতার দাপট চিরস্থায়ী নয়। চিরস্থায়ী নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মতো নিঃস্বদের।
গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র মোহাম্মদ বিন তুগলক তৈরি করলেন মেহেরুলী এবং তুগলকাবাদের মাঝামাঝি নতুন শহর ‘জাহানপনা’। এখানে অনেক দিন ইবনে বতুতা অবস্থান করেছিলেন। পরে তুগলক রাজধানী দক্ষিণ ভারতে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন জাহানপনাতে। জাহানপনা এখন ধ্বংসস্তূপ।
মোহাম্মদ বিন তুগলক ছিলেন অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ এবং অনেকটা খেপাটে ধরনের। তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যার যৌক্তিকতা ওই সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন হঠাৎ দিল্লি হতে রাজধানী দক্ষিণে নিয়ে যেতে তিনি দিল্লিবাসীদের জোর করে নিয়ে যান। কথিত রয়েছে যে, একজন বিকলাঙ্গ ভিক্ষুককেও তিনি বাদ দেননি। আবার কয়েক বছর পর ফিরে আসেন দিল্লিতে। নিয়ে আসেন সব নাগরিকদের। এসবের জন্য তাকে উদাহরণ করেই ‘বাংলা ভাষায়’ যুক্ত হয়েছে প্রবাদবাক্য ‘তুগলকি কারবার’- যখন যা খুশি তাই করা। মোহাম্মদ বিন তুগলক ছিলেন ওই সময়কার প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরাচার। তুগলকরা এখনো একই রকম আছেন। অনেক তথাকথিত নির্বাচিত অনির্বাচিত শাসকরা ‘তুগলকি কারবারে অভ্যস্ত- আজ এক কথা কাল তার উল্টো। মোহাম্মদ বিন তুগলকের সমাধি কোথায় তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাস্ত করে শেরশাহ তৈরি করেছিলেন শেরগড়। শেরগড় লালকিল্লার কাছাকাছি জায়গায় আর পুরাতন কিল্লা ঘিরে। এখানেই এই পুরাতন কিল্লাতেই লাইব্রেরির সিঁড়ি হতে বাবরপুত্র হুমায়ুন পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
দিল্লির পুরাতন শহরের মধ্যে এখনো যা আবাদ রয়েছে- তা হলো শাহজাহানাবাদ যা বর্তমানে পুরাতন দিল্লি বলে পরিচিত। শাহজাহানাবাদ বা বর্তমানের পুরাতন দিল্লিই দিল্লির সপ্তম শহর। এই পুরাতন দিল্লিই ইতিহাসে ভরপুর। এখানেই শাহজাহানের বড় সন্তান জাহানারা তৈরি করেছিলেন ‘চাঁদনী চক’। এখানে বড় চওড়া রাস্তার মাঝে ছিল ছোট পানির তালাব আর ফোয়ারা। রাস্তার দু’ পাশে প্রবাহিত পানি যার উপরে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরিয়ে চকচক করতো। তাই জাহানারা নাম রেখেছিলেন চাঁদনীচক। এখন শুধুমাত্র চাঁদনী চক-এর নামটিই রয়েছে। প্রথমবার যখন পুরাতন দিল্লি তথা শাহজাহানাবাদে আসি তখন ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম এখনকার
অবস্থা দেখে। পুরাতন ঢাকার চাইতে বড় এ ঐতিহাসিক শহরটি এখন হতশ্রি, ঠেলাগাড়ি, রিকশা আর মানুষের ভিড়। পাইকারি বাজার। এক সময়ের ঝলমলে এই শহরের বিখ্যাত গলিগুলো গন্ধ আর পুতময় হয়ে রয়েছে।
এক সময়ের ‘চাঁদনীচক’ যখন প্রথমবার দেখি বেশ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে। মনে হয়েছিল শাহজাহানাবাদের অলিতে-গলিতে ইতিহাস। বড় বড় হাভেলী আর কুচাগুলোর প্রতিটির অতীতই একেকটি বড় ইতিহাস। সুখ-দুঃখ, জৌলুস, প্রেম, বঞ্চনা, জীবন-মৃত্যু- সবই ধারণ করে কয়েকশত বছরের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রত্যেকটি পুরাতন জরাজীর্ণ এক সময়ের সুরম্য হাভেলী আর কুচাগুলো। এখন এটি একটি সাধারণ চৌরাস্তা- এর এক পাশে ছিল একটি অতিথিশালা যা এখন নেই সেখানেই রয়েছে টাউন হল। শাহজাহানাবাদ বা বর্তমানের পুরাতন দিল্লির স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার ভারত বিখ্যাত। এখানে এখনো ঐতিহ্যবাহী মোগল খাবার পাওয়া যায়। এখানে পরের দিকের মোগলদের পাচকদের এক বংশধরের একটি রেস্তরাঁ রয়েছে যার নাম ‘করিমস্’, উপমহাদেশ খ্যাত এই রেস্তরাঁ। এখানে পরিবেশিত হয় সবধরনের কাবাব এবং মাংসের পরিবেশনা। মাৎস হিসেবে ব্যবহার হয় মুরগি এবং ছাগল বা বকরি। মোগলরা তাদের রাজত্বকালে তাদের হিন্দু প্রজাদের দিকে লক্ষ্য রেখেই গো-মাংস ভক্ষণকে নিরুসাহিত করেছিলেন। তাই এ অঞ্চলে কোরবানি ঈদ ‘বকরা ঈদ’ নামে পরিচিত।
শাহজাহানাবাদে অনেকগুলো বাজার ছিল। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পণ্যের বাজার। এখনো এই সব বাজার রয়েছে। তবে এগুলো এখন পাইকারি বাজার। তবে খুচরা বাজারও রয়েছে। শাহজাহানাবাদ গড়ে উঠেছিল দিল্লির মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর তীর ধরে। যমুনা তীর ধরেই গড়ে উঠেছিল ভারতের শত শত বছরের মুসলিম সাম্রাজ্য। লক্ষণীয় বিষয় যে, মোগল স্থাপন্যের সবচাইতে দর্শনীয় এবং বিশ্বের বিস্ময় আগ্রার তাজমহল এবং মোগলদের রাজধানী বলে কথিত আগ্রার দুর্গ গড়ে উঠে যমুনা নদীর তীরে।
যমুনা নদী তখন উন্মত্ত যৌবনা। দূর্গের পেছনে দেয়ালঘেঁষা। টলটল পরিস্কার পানির প্রবাহ। সূর্যের আলোতে চিকচিক করত। এ নদীর পানি সরবরাহ হত দূর্গ আর শাহজাহানাবাদে। এখন সেই যমুনা নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। দূর্গ হতে কয়েক কিলোমিটার পূর্বে সরে গিয়েছে। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে বস্তি আর পানি হয়েছে দূষিত। তবুও এই যমুনা নদী কালের সাক্ষী। অগণিত সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতনের সাক্ষী।
অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন ওই সময়কার মুসলিম শাসকরা গঙ্গার তীরে তেমন কোনো স্থাপনা তৈরি করেননি; কারণ ওই নদীটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র নদী। তবে অনেক শাসকদের উপর মন্দির বিনষ্ট করার ঐতিহাসিক অভিযোগ রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন মধ্যযুগে ধর্মস্থানের ওপর হামলা করার অন্যতম কারণ ছিল দুর্গের ভেতর হতে শত্রুসেনাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে আসার কৌশল। হয়তো ঠিক, হয়তো ঠিক নয়- এটি নিয়ে বিতর্কের অভিপ্রায় আমার নয়।
শাহজাহানাবাদ বা পুরাতন দিল্লির আকার অনেকটা পানের মতো ছিল। এ শহরের প্রান্তে রয়েছে লালকিল্লা। লালকিল্লার লাহোর গেট হতে সোজা পশ্চিম দিকে প্রধান সড়ক যার মাঝ প্রান্তে ছিল চাঁদনী চক। প্রায় শেষ মাথায় রয়েছে একটি বৃহৎ মসজিদ; এগুলো তৈরি করেছিলেন শাহজাহানের অন্য দুই পত্নী। এর মধ্যে একজন বেগম আকবরি মহল। অপরজন বেগম ফতেহপুরী যার নামে পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ফতেহপুরী মসজিদ। কথিত যে, তিনি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই দুই বেগমের সমাধি রয়েছে আগ্রার তাজমহলের প্রধান প্রবেশ পথের পাশে। আকবর মহলের তৈরি মসজিদটি ১৮৫৮ সালে কোম্পানির হুকুমে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় শাহজাহানাবাদের বহু মসজিদ আর মোগল স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। চাঁদনী চকের মূল সড়কে যুক্ত হয়েছে গলি, কুচা। আর শহরটি ছিল দেয়ালঘেরা যার নিয়ন্ত্রণ হতো বারটি গেটের মাধ্যমে। প্রতিটি গেটের বিভিন্ন নাম ছিল। এখনো কয়েকটি গেট দাঁড়িয়ে রয়েছে তবে দেয়াল প্রায় নেই বললেই চলে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের যুদ্ধে ধ্বংস হওয়ার পর বৃটিশ বাহিনী কয়েকটি গেট ছাড়া ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করেছিল শহরের দেয়াল। আজও পাঁচটি মূল গেট দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তার মধ্যে সবচাইতে ঘটনাবহুল এবং বহুভাবে আলোচিত ৫টি গেট বা দরওয়াজার অন্যতম বর্তমানে খুনি দরওয়াজা হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল শাহজাহানাবাদে প্রবেশের প্রথম দরওয়াজা। এই দরওয়াজাটি তৈরি করেছিলেন শেরশাহ সুর যিনি এটা শেরগড়ে প্রবেশের অন্যতম দরওয়াজা হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরে সম্রাট শাহজাহান তার প্রাচীর শহর শাহজাহানাবাদের প্রধান ফটকে উন্নীত করেন। এখানে হালেও বহু ঘটনার জন্ম হয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন ঐতিহাসিক কারণেই ‘এই দরওয়াজা, যা এখন রাস্তার ডিভাইডার-এর মাঝে, জায়গাটি অভিশপ্ত তাই বৃষ্টিতে রক্ত ঝরে। আমি প্রথমবার গাড়ি হতে নেমে এ দরওয়াজা বা গেট দেখতে। গেটটি তিনতলা উপরে সৈনিকদের বিশ্রামের জায়গা করা ছিল। এখন পরিত্যক্ত। এখানেই যুবরাজ জাহাঙ্গীর তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক সময়ে যুদ্ধে আকবরের অন্যতম রত্ন ও যোদ্ধা আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন। তার শিরশ্ছেদ করে মাথা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আরো পরে ১৮৫৭ সালে কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যখন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর মেজর হাডসনের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ওই সময়ে তার তিন পুত্রসহ আরো অনেককে এই দরওয়াজার প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্যা করে শিরশ্ছেদ করে লটকিয়ে রেখেছিল।
মেজর হাডসন যিনি নিজেও আরো পরে লক্ষ্ণৌতে সিপাহীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার দেহকেও লটকিয়ে রাখা হয়েছিল। লক্ষ্ণৌ-এর লা মার্টিনিয়ার কলেজের এক কোনায় রয়েছে মেজর হাডসন-এর সমাধি। মেজর হাডসন প্রথমে ছিলেন একজন ভাড়াটে সৈনিক। তার ক্যাভেলারি পরে বৃটিশ ভারত বাহিনীতে ‘হাডসন হর্স’ নামে আত্মীকরণ করা হয়েছিল। আমি ২০১৬ সালে ইয়াঙ্গুনে বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে গিয়েছিলাম। যাই হোক কিংবদন্তি রয়েছে যে, এই গেটের উপরে বৃষ্টির পানি পড়লে রক্তের রং ধারণ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে, এখানে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তাতে লোহার উপাদান বেশি বলে মরিচার রংয়ে পানির রং বদল হয়।
আর দুটি গেট যার মধ্যে একটি ১৮৫৭ সালের ক্ষত নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তার নাম কাশ্মিরী গেট। মূলত এই গেটের পতনের পরেই ১৮৫৭ সালের সিপাহীরা পরাজিত হন। আর দক্ষিণ প্রান্তে এখনো দাঁড়িয়ে তুর্কম্যান গেট।
বলছিলাম শাহজাহানাবাদের কথা। তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল এই শহর। লালকেল্লা হতে ‘চাঁদনীচক’ পর্যন্ত ছিল উচ্চবিত্তদের বাস আর উচ্চমার্গের বিপণী বিতান। চক কোতোয়ালি (পুলিশ থানা), হতে চাঁদনীচক স্কয়ার ছিল দ্বিতীয় ভাগ। এ জায়গাতেই ছিল উচ্চবিত্তদের বাজার। কবি-সাহিত্যিকদের বাস ও আড্ডাখানা। মীর্জা গালিবের বাসস্থানও এরই ধারেকাছে। শেষবার দিল্লি সফরকালে গিয়েছিলাম মীর্জা গালিবের বাসস্থান দেখতে। যার বেশি অংশই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল বহু আগে। তবে পরে ভারত সরকার একাংশ উদ্ধার করে গালিব ট্রাস্ট বানিয়েছেন। এখন সে অংশ গালিবের জাদুঘর।
শেষ অংশ ছিল চাঁদনীচক হতে ফতেহপুরী মসজিদ পর্যন্ত। এখানে এখন এশিয়ার সবচাইতে বড় মসলার পাইকারি আড়ত।
‘চাঁদনীচকের’ আবাসনগুলো ছিল তিন স্তরের। প্রথম স্তর হাভেলী। প্রাসাদের মতো বাড়িগুলো ছিল উঁচু দেয়ালঘেরা। মালিকরা ছিলেন আমীর, ওমরাহ বা নবাব এবং তৎকালীন সমাজের উচ্চ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এরা ছিলেন মোগল দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। একটি হাভেলী যা এখনো বিখ্যাত এবং সবচাইতে বড় নাম চুনীমল হাভেলী। আমি দেখতে গিয়েছিলাম ওই হাভেলীটি। দ্বিতীয় স্তর ছিল কুচা। এখানে একই পেশার মানুষরা থাকতেন। তৃতীয় স্তর কাটরা। এখানে পেশাদারদের কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান একই জায়গায় ছিল। এই দুই স্তরই ছিল মহল্লা।
চাঁদনীচকের দক্ষিণ পাশে ‘জোহরী বাজার’ এক সময় অলংকারের বড় বাজার ছিল। এখনো কিছু রয়েছে। তবে বর্তমানে এখানে শাড়ি, লেহেঙ্গা আর মহিলাদের অন্যান্য পরিধেয় জড়ির কাজ করা কাপড় ও তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার। সমগ্র ভারতে সরবরাহ করা হয় এখান থেকেই। এখানেই প্রথমবার আমার পরিচয় হয়েছিল একজন রিকশাচালক আহমেদ গিয়াসের সঙ্গে। যিনি ৮০ রুপির বিনিময়ে বহু গলি আর কুচা দেখিয়েছিলেন। তিনি এই জায়গারই বাসিন্দা। কথায় কথায় জেনেছিলাম যে, প্রায় দশ পুরুষ ধরে তারা মোরিগেটের বাসিন্দা। এখন তারা রিকশা আর ভ্যানগাড়ির ব্যবসা করেন। তিনি মাঝে মধ্যে মনমতো যাত্রী পেলে এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। আমাকে দেখেই তিনি ঠাওর করেছিলেন যে, এ জায়গা দেখতে এসেছি। বাংলাদেশি শুনে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, তার দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষিত করে তুলবার। তবে তার শঙ্কা ছিল সরকারি চাকরি না পাবার। তার তথ্য মোতাবেক এখানে একসময় সব বড় ব্যবসায়ীরাই ছিলেন মুসলমান। কিন্তু প্রথমবার ১৮৫৭ সালে পটপরিবর্তন হয় আর দ্বিতীয়বার ১৯৪৭ সালের দিল্লি রায়টের পরে মাত্র দশ ভাগে নেমে আসে মুসলমান ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। ১৯৪৭ সালের পাঞ্জাব বিভক্তির পর পশ্চিম পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে উদ্বাস্তু হওয়া শিখদের এখানে এবং ধারেকাছে ক্যারলবাগে পুনর্বাসন করা হয়। এখানে যে সব মুসলমানরা রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে একপ্রকার যুদ্ধ করেই থাকতে হয়েছে। তার পূর্ব-পুরুষরা এভাবেই রয়ে গিয়েছিলেন।
আহমেদ গিয়াস দুঃখ করে বলেছিলেন যে, এখানকার মুসলমান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী নয়। ফটকাবাজারি করা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। বয়স্করা আড্ডা আর কবুতর বাজি করে অতীতের প্রজন্মের স্বর্ণযুগের আলোচনায় তৃপ্ত হয়ে থাকেন। আহমেদ গিয়াস বলেছিলেন, এখানকার বহু বিত্তশালী যাদের হাভেলীগুলো এখনো দাঁড়িয়ে- তা তারা বিক্রি করে অনেকেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। আহমেদ গিয়াস দুঃখ করে বলেছিলেন যে, তার মুরুব্বিদের কাছ থেকে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা শুনেছেন। বললেন যে, তিনি শুনেছিলেন- মুসলমানদের পতন তাদের কারণেই হয়েছে। যেদিন বাহাদুর শাহ জাফরকে হাডসনের নেতৃত্বে শিখ পল্টন এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তখন এখানকার ধনাঢ্য মুসলমানরা টিকে থাকবার জন্য হাত মিলিয়েছিলেন ইংরেজদের সাথে। এমন কি মীর্জা গালিবও কোম্পানির সিপাহীদের সঙ্গে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের মোশাহেবার রত্ন। এসব কথা বিস্তারিতভাবে তার দাদার কাছে শুনেছিলেন। তিনি আমাকে অনেক গলি কুচাতে ঘুরিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাজিয়া সুলতানার সমাধিতে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। বলেছিলেন ওই জায়গা শাহজাহানাবাদেই। তবে গলির মধ্যে এ সময় যেতে বহু সময় লাগবে। তাই আর যাওয়া হয়নি। এরপরেও আর যাওয়া হয়নি। রাজিয়া সুলতানা ইলতুতমিশ-এর কন্যা ভারতবর্ষের প্রথম নারী সুলতান। আর মুসলমানদের শত শত বছরের শাসনকালের একমাত্র নারী শাসক। এর পরে আরেক নারী দিল্লি মসনদে সদর্পে ছিলেন তার নাম ইন্দিরা গান্ধী।
আহমেদ গিয়াস শিখদের গুরুদুয়ারা শিসগঞ্জ সাহেব, যেখানে আওরঙ্গজেব নবম শিখগুরুর শিরশ্ছেদ করিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম লালকুয়া বাজার হয়ে তুর্কম্যান গেটের দিকে। এই জায়গাটির বহু ঘটনা খুশবন্ত সিং-এর বইতে পড়েছিলাম। আহমেদ গিয়াস নিয়ে যেতে সাহস পায়নি। কারণ ওই এলাকায় দিল্লির বেশির ভাগ হিজড়াদের বাসস্থান। এদের এখানে আবাস মোগল সময় হতে। এদের মধ্য হতে মোগল হেরেমের রক্ষী নিয়োজিত হতো। অনেক ঘুরিয়ে গিয়াসউদ্দিন আমাকে দিল্লির তথা ভারতের সর্ববৃহৎ মসজিদ জামে মসজিদের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সামনেই চোর বাজার। জামা মসজিদ এখন ওয়াক্ফ সম্পত্তি। পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান। ১৮৫৭ সালের পর কোম্পানির সৈনিকরা ‘আস্তাবল’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল শাহজাহানের আরেক কীর্তি, এই মসজিদ কিন্তু ওই সময়ের ইংল্যান্ডের বৃটিশ সরকারের সায় না থাকায় রয়ে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে মোগলদের পতনের পর কোম্পানির শাসকরা পরবর্তী দুই বছর দিল্লিতে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার বন্ধ রেখেছিল। ভয় পেয়েছিল আরেক উত্থানের। অবশ্য সিপাহী বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা ছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ হতে ইংরেজদের বিতারিত করতে পলাশী যুদ্ধের ১০০ বছর পর। দিল্লির জামা মসজিদ তৈরি করেছিলেন রেড সেন্ড স্টোন দিয়ে। শাহজাহান পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব এর চাইতে কিছুটা বড় একই ধাঁচের লাল পাথরের মসজিদ তৈরি করেন লাহোরে। যার নাম বাদশাহী মসজিদ। মসজিদটি তৈরি করেন তার দাদার নির্মিত লাহোর দুর্গের সামনে।
প্রথম সফরে দুপুরে ইচ্ছা হয়েছিল পুরাতন দিল্লিতেই খাবার খেতে। পরাটাওয়ালি গলির অনেক নাম শুনেছি। সেখানে চল্লিশ রকমের পরাটা পাওয়া যায়- এমনটাই শোনা যায়। গিয়েছিলাম ওই গলিতে। রিকশা নিয়েছিলাম। কোন কোন গলি দিয়ে টাউন হলের সামনে অত্যধিক সরু গলির মুখে থামিয়ে রিকশাচালক দেখিয়ে দিলো ইতিহাসখ্যাত পরাটাওয়ালি গলি। গলির ভেতরে মাত্র চার পাঁচখানা দোকান এখনো অবশিষ্ট। সবগুলোই প্রায় দেড়শত বছরের পুরনো। এক দোকানে বসে পরিচয় হলো ইকবাল আলীর সঙ্গে। দুই ভাই বংশপরম্পরায় চালিয়ে আসছে এই ছোট পরিসরের দোকান। সামনে বড় কড়াইতে ঘি ফুটছে। একজন দ্রুত হস্তে পরাটা বানিয়ে ঘিয়ের মধ্যে ডুবিয়ে ভেজে নিয়ে তুলে দিচ্ছে খদ্দেরদের প্লেটে। তিন রকমের সবজি ফ্রি। চাইলে আরো পাওয়া যায়। এমন কোনো ধরনের পরাটা নেই যা চাইলে পাওয়া যায় না। অনেক পরাটার নাম শুনলেও চল্লিশ ধরনের পরাটা হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। এক প্লেটে দুটো পরাটা সঙ্গে সবজি চাটনি। অপূর্ব তার স্বাদ। ইকবাল আলীও তার সুখ-দুঃখের কথা জানালেন। বলেছিলেন, এ ব্যবসা ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাত্র চারটি দোকান রয়েছে। বাকিগুলো বিভিন্ন রকমারি শাড়ি-গহনার দোকানে রূপান্তরিত হয়েছে। বললেন, হয়তো এক দু’বছর পর আসলে এটাও বন্ধ পাবেন। নিজাম-এ (নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নামে স্থান ও রেলওয়ে স্টেশনের নাম) ছোট রেস্তরাঁ নিয়েছি সেখানেই চলে যাবো। এবার গিয়ে মাত্র তিনটি দোকান পেয়েছিলাম। ভাটিয়া নামক একজনের দোকানে নাস্তা করেছিলাম।
তিনি জানালেন, ‘এখন পরাটা লোকে তেমন খেতে চায় না। ঘিয়ে ডুবিয়ে এই পরাটা স্বাস্থ্য সচেতন লোকে তো একেবারেই খায় না। তার উপরে ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের ঝুঁকি। তেমন আড্ডাও হয় না। পেছনে পণ্ডিত নেহেরুর ছবি দেখিয়ে ভাটিয়া বললেন, আমার দাদা এলাকায় কংগ্রেস নেতা ছিলেন। তারই আমন্ত্রণে পণ্ডিত নেহেরু স্বাধীনতার আগে রাস্তার ওপারে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। এখান থেকে পরাটা নেয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইকবাল আলীর কথা। বললেন, নিজাম-এ খোঁজ করলে পাবেন।
আমি প্রথমবার যখন ইকবাল আলীর দোকান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হয়েছিলাম প্রায় একদিনের অভিজ্ঞতা আর মোগলদের তৈরি জৌলুসময় এই শহরের কথা চিন্তা করতে করতে ইহিাসে ডুবে গিয়েছিলাম। একদা প্রাচ্যের গর্ব এই শাহজাহানাবাদ, বর্তমানের পুরাতন দিল্লি, যে শহরের পতন হয়েছিল চারশ’ বছর আগে সেই শহর এখন মৃতনগরী। বাকি নেই কোনো জৌলুস। মানুষ আর ঠেলাগাড়ি, হট্টগোল, গালাগালি আর দোকানের বিশ্রি চেহারার পেছনের ইতিহাস ধুলোয় ডাকা পড়ছে। একদা মোগল বংশের উচ্চবিত্তদের বাসস্থানগুলো, গজল আর উর্দু শায়েরীর গুঞ্জনে মুখরিত হতো। আজ গোডাউনে পরিণত হয়েছে। বহু হাভেলী ধ্বংসপ্রায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ধ্বংসপ্রায় এক সময়ের ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের বংশধরদের হাভেলী আর কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আসকার হাভেলী যেখানে শত বছর পূর্বে জওহরলাল নেহেরু আর কমলা দেবীর জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এক সময়ের জৌলুসপূর্ণ শাহজাহানাবাদ, যে শহরকে নাদির শাহ তিনদিন ধরে লুট করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কোহিনূর হীরক খণ্ড। সেই শহর আজ অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোও মনে করিয়ে দেয়ার অবস্থায় নেই। আমি প্রথমবার পুরাতন দিল্লি বা শাহজাহানাবাদে গিয়ে যখন চারদিকে দেখছিলাম তখন যেন চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ইতিহাস উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। হয়তো যারা শাহজাহানাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জন্য এ জায়গা কেবলমাত্র ছোট ছোট কারখানা আর বৃহৎ সস্তা, খুচরা আর পাইকারি বাজারের ধূসর দালানকোঠাগুলো মাত্র। অনেকেই হয়তো আসতেও চাইবে না। কিন্তু যারা প্রকৃত ভ্রমণ পিপাসু, যারা ভ্রমণে ইতিহাস খোঁজ করেন, পুরাতন দিল্লি এখনও সেই ইতিহাসের জৌলশময় দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দেবে। এখনকার মূল বাসিন্দারা কঠিন জীবনযাপন করে আসছেন।
এই শাহজাহানাবাদ এক সময় সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। ছিল উর্দু ভাষার কবি-মহাকবিদের মিলনস্থল। ফার্সি ভাষা চর্চার কেন্দ্র যার নেতৃত্ব দিতেন মোগল দরবারের রাজকুমার বা রাজকুমারীরা। এখনো অনেক ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের সদস্যরা কিছু ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন। হয়তো কয়েকটি বিবর্ণ বাঁধানো ছবি আর পুরাতন গড়গড়াটা পরিষ্কার করে অতীত জীবনের স্মৃতি হাতরিয়ে বেড়াচ্ছেন। বেশির ভাগ উর্দু সংস্কৃতি আর গজল কবিতার ধারকরা পাকিস্তানে চলে গিয়েছেন। ইতিহাস হয়ে থাকা অনেক বড় বড় নামের কবিদের অস্তিত্বই নেই। জউখ এখন লক্ষ্ণৌয়ের রেললাইনের ধারের কোনো কবরে শুয়ে আর মীর্জা গালিব নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের প্রবেশমুখে উন্মুক্ত আকাশের নিচে অযত্নে অবহেলায় রয়েছেন।
এক সময় শাহজাহানাবাদে পড়ন্ত বিকেলে ছাদের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবুতরবাজরা কবুতরবাজি করতেন। এ খেলা ছিল বড় বড় হাভেলীর নবাবদের। মোগল সম্রাট আকবরের শখ ছিল কবুতরবাজি। যার নাম রেখেছিলেন ‘ইসকবাজি’। সে সময় হতেই উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পরে এ শখের খেলা। একজনের কবুতরের ঝাঁক অন্য কবুতরের সঙ্গে খেলা দেখাতে দেখাতে নিজের ঝাঁকের সঙ্গে নিয়ে আসা। ইতিহাসে বর্ণিত যে, সম্রাট আকবরের প্রায় বিশ হাজার কবুতর ছিল। এসব কবুতরের জন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল। ছিল পরিচর্যার জন্য বিভিন্ন পদবির কর্মকর্তাগণ। আকবরের এই শখ ছিল বাল্যকাল থেকেই। হবেই বা না কেন, মাত্র ১২ বছর বয়সকালে পিতৃবিয়োগ ঘটলে মাতা হামিদা বানুর হাত ধরে সিংহাসনে বসেছিলেন। কাজেই বাল্যকালের শখ রাজকীয় শখে পরিণত হয়েছিল। আকবরের কবুতরের ঝাঁকের মধ্যে পাঁচশত কবুতর ছিল বিশেষ ধরনের। এদের জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। তিনি নিজে তার প্রিয় কবুতরগুলোকে নাম দিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহান তার দাদার এই গুণটি পেয়েছিলেন। ওই সময়ে বিকেলে শাহজাহানাবাদের আকাশে কবুতরের পাখা ঝাপটা আর তাদের নিয়ন্ত্রকদের তীক্ষ্ণ শিসের বা অন্যান্য আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠতো শাহজাহানাবাদ।
এখনো শাহজাহানাবাদে বিকেলে চলে কবুতরবাজি। তবে এখন আর এ খেলা নবাব বা রাজকুমারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ খেলা চলে এসেছে সাধারণ মানুষের আঙ্গিনায়। এখনো উড়তে দেখা যায় সিরাজী, লাল খাল, আজাদী, গোলে, মাসাককলি এবং কাবুলী কবুতরের ঝাঁক। এখনো কবুতরের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিযোগিতা হয়। এখনো অন্য ঝাঁক হতে কবুতর ছিনিয়ে আনবার কৌশল শেখানো হয়। ছাদের উপর হতে ডাক শোনা যায় ‘আও আও’। তবে যা দেখা যায় না অতীতের সেই চাকচিক্য আর কবুতরবাজিতে শাহজাহানাবাদ মাতিয়ে রাখা। এখনো হুক্কার চলন থাকলেও নাকে আসে না বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি তামাকের ঘ্রাণ। নবাব আর সম্রাটদের হুক্কা এখন ‘সিসায়’ পরিণত হয়েছে। সুগন্ধি তামাকের জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে মাদক আর তৈরি হয়েছে ‘সিসা’ বার। এর ব্যাপ্তি আরেক মোগল শহর জাহাঙ্গীরনগর- এখনকার ঢাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কবুতরবাজি লক্ষ্ণৌ আর দিল্লি হয়ে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোতে পৌঁছেছে। মহাজিরদের কল্যাণে পাকিস্তানের শহর করাচিতেও পৌঁছেছিল। আমার কৈশোর কেটেছিল এই শহরে। আমারও শখ ছিল কবুতরবাজির। প্রায় দেড়শত কবুতর ছিল আমার সংগ্রহে। এগুলো সবই পুরাতন স্মৃতি।
শাহজাহানাবাদ আজ স্মৃতির গহ্বরে ঠিক যেমনি শাহজাহানের পিতার তৈরি ঢাকার ঐতিহ্য। পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্য এখন সেকেলে। আধুনিক হবার প্রতিযোগিতায় সমাজের অবক্ষয়, যার উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি।
শাহজাহানাবাদ আর চাঁদনীচক ক্রমশই ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আর কয়েক দশক পর ‘শাহজাহানাবাদ’-এর নাম ইতিহাসে খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। পুরাতন দিল্লি হয়তো থাকবে না। হয়তো পুরাতনের উপরেই গজিয়ে উঠতে পারে নতুন শহর। যে শহরের নিচে হারিয়ে যাবে মোগলদের ঐতিহ্য, জৌলুসভরা কাহিনী আর খণ্ড খণ্ড কাহিনী শোনাবার মতো আহমেদ গিয়াস আর ইকবাল আলীদের মতো ব্যক্তিরা। কতজনই বা জানেন যে ‘চাঁদনীচক’ নামটি যিনি দিয়েছিলেন সেই মোগল শাহজাদী ‘জাহানারা’, শাহজাহান কন্যা আজ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে উন্মুক্ত কবরে শায়িত। মাঝেমধ্যে দু’একজন দর্শনার্থী খুঁজে বের করেন জাহানারার সমাধি।
প্রথমবার দিল্লিতে এসেই গিয়েছিলাম দিল্লির সূফী সম্রাট হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। এক ঐতিহাসিক স্থান। প্রবেশপথে আমীর খসরুর মাজার যিনি উপমহাদেশে কাওয়ালীর প্রচলন করেছিলেন। তিনি নিজে কাওয়ালীর জন্য কবিতা, কাসিদা আর গজল লিখতেন। তিনি আওলিয়ার প্রধান শিষ্য ছিলেন। পরিচিত হন সূফী সাধক হিসেবে। বিখ্যাত হয়ে উঠেন সূফী সাধক হিসেবে। মাজার প্রাঙ্গণে রয়েছে মোগল বংশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধি যার মধ্যে অন্যতম জাহানারা।
নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগাতে সারা বছরব্যাপী প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। সমাগম হয় সকল ধর্মের মানুষের। ভাবতে অবাক হতে হয় কিভাবে পরাক্রমশীল সুলতানদের সময়ে একজন সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেন অতীব সাধারণ মানুষের ‘মসিহা’। উপমহাদেশের সূফীদের ভক্ত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের মানুষ। আওলিয়ার সঙ্গে সুলতানদের সম্পর্ক যে মধুর ছিল না তার বিবরণ আগেই দিয়েছি। হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া যখন সূফী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তখন জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লির মসনদে। তিনি কোনোদিন জালালউদ্দিনের ধারে কাছেও ঘেঁষেননি। বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম এই ঐতিহাসিক চত্বরে কেবলই মনে পড়ছিল তার উক্তি- ‘হনুজ দিল্লি দূর অস্ত’। ছোটবেলা হতেই শুনেছি এ বাক্য। তখন জানতাম না এর ইতিহাস।
নিজামউদ্দিন হতে কয়েক কিলোমিটার দূরেই দিল্লির অষ্টম শহর ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ বা নয়াদিল্লি। এ স্বাধীন ভারতের রাজধানী। প্রথমবারও দেখেছি। এবারও দেখলাম। লুটিয়েন্স একমাত্র তাজমহল ছাড়া তৎকালীন ভারতের কোনো স্থাপনাকেই শৈল্পিক মনে করেননি। তিনি বৃটিশ রাজের জন্য তৈরি করেছিলেন সর্বাধুনিক রাজধানী। তৈরি করেছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি আবাসস্থান যা আজ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। যার কথা প্রারম্ভে বলেছি। ইন্ডিয়া গেটে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অন্যতম প্রশস্ত রাজপথ যার এখনকার নাম জনপথ তার অপর প্রান্তে রেইসিয়ানা পাহাড়ের অপর প্রান্তের বিশাল প্রাসাদটি দেখা যায় না। ক্রমেই সামনের দিকে এগুলে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের উদয়ের মতো উপরে উঠতে থাকে এই প্রাসাদ। এবারই দেখবার সুযোগ হয়েছিল ভেতরের কিছু অংশ, বিশেষ করে দরবার হল আর অশোকা হল। ১৯১১ সালে কলকাতা হতে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করলেও ১৯৩১ সালের আগে শেষ করতে পারেনি নতুন দিল্লির কাজ। যখন নতুন দিল্লি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে ওই সময় হতেই ভারতবর্ষে বৃটিশরাজের সূর্য অস্তগামী এরপর মাত্র ১৬ বছর টিকে ছিল বৃটিশ রাজ। যখন নতুন রাজধানীর পরিকল্পনা করা হয় তখন বৃটিশ রাজ ৫০০ শ’ বছরের রাজত্বের পরিকল্পনায় বিভোর ছিল। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে ১৮৫৭-এর ঘটনা ভারতের জাতীয়তাবাদের নতুন রূপ দিবে। ওই বিদ্রোহের পর মাত্র ৯৯ বছরই টিকেছিল সমগ্র ভারতে বৃটিশ রাজ।
যাই হোক বর্তমানের রাষ্ট্রপতি ভবন, তৎকালীন ভাইসরয় প্রাসাদ, নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩১ সালে, ওই সময়ে খরচ হয়েছিল ৪,৭৭,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড। এই ভবনের মোট কক্ষ সংখ্যা ছিল ৩৫৫টি। বর্তমানে ১৯০০০ ঘন মিটার আয়তনের এই ভবনে রয়েছে ৩৪০টি কক্ষ। আমাকে যে কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তার এ ভবনে ৮ বছরের কর্মকালে পঞ্চাশটি রুমের বেশি দেখতে পারেননি। রাজকীয় ভবনই বটে।
এই ভবনটি তৈরিতে কোনো স্টিল ব্যবহার হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছিল ৭০০ মিলিয়ন ইট আর ৩.৫ মিলিয়ন ঘন মিটার পাথর। ওই সময় বাগানের পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত ছিল ৪১৮ জন মালী। এখন এ সংখ্যা অনেক কম।
এই ভবনের শেষ বৃটিশ ভাইসরয় ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। আর স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োজিত হয়েছিলেন সি রাজা গোপালচারি। তিনি সাধাসিধা জীবনযাপন করতেন। তিনি ভাইসরয়দের জন্য নির্দিষ্ট বিশাল শয়নকক্ষে থাকেননি। তিনি বেছে নেন ছোট একটি কক্ষ যা আজও রাষ্ট্রপতির বাসকক্ষ। ওই শয়নকক্ষটি এখন অতিথিশালা।
দিল্লি আমাকে সব সময়েই রোমাঞ্চিত করে। মনে হয় এত বিশাল ইতিহাস যার পরিমাপ সম্পূর্ণভাবে এক জীবনে করা সম্ভব নয়। বিচিত্র ইতিহাস এই নগরীর। দিল্লির ইতিহাস প্রভাবিত করে রেখেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। লাহোর-দিল্লি-ঢাকা প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। মাঝে মধ্যে ভাবতেও অবাক লাগে কিভাবে দিল্লি হতে ১২০০ মাইল অতিক্রম করে কুতুবউদ্দিন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি ১২০১ সাল হতে ১২০৪ সালের মধ্যে বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে বাংলার ভাগ্য দিল্লির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। সেই বন্ধন কি এখনো কেটেছে? মনে হয় না অন্তত ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে পিতা জাহাঙ্গীরের নামে তৈরি শহর জাহাঙ্গীরনগর আর পুত্র শাহজাহানের তৈরি শাহজাহানাবাদের সঙ্গে একটা বিশাল যোগসূত্র তো ইতিহাস স্বীকৃত। তবে পর্যায়ক্রমে সে যোগাযোগ যথেষ্ট শিথিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর এখন ঢাকা আর শাহজাহানাবাদ পুরাতন দিল্লি। অনেক স্মৃতি আর অনেক ইতিহাস এসব জায়গা দেখতে হলে যা প্রয়োজন তাহলো ঐতিহাসিক অনুভূতির।
(এই প্রবন্ধটি লেখকের অনবদ্য ভ্রমণ কাহিনী ‘কত জনপদ কত ইতিহাস’ হতে সংকলিত।)
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করায় সুযোগ হয়েছিল বিশ্বের সবচাইতে বড় এই ঐতিহাসিক সরকারি বাসভবনটির কিয়দাংশ দেখবার। রেইসিয়ানা পাহাড় কেটে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল বৃটিশ ভারতের শাসক বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির ধারক বাহক ভাইসরয় হাউস হিসেবে। হার্বাট বেকারের তত্ত্বাবধানে এবং যার নকশায় এই ভবনটি তৈরি হয়েছিল তার নাম এডউইন ল্যান্ডসির লুটিয়েন্স (Edwin Landseer Lutyens)। এই ব্যক্তিই বর্তমানের নতুন দিল্লিরও নকশা করেছিলেন। তার সহযোগী ছিলেন মি. হার্বাট বেকার (Herbert Baker)। এ কারণে ভারতের রাজধানী নতুন নতুন দিল্লিকে অনেক সময় লুটিয়েন্স দিল্লি বলা হয়। এই দিল্লিই ঐতিহাসিক ভারতের অষ্টম, জনান্তরে দশম দিল্লিস্থিত রাজধানী। যাই হোক দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের বিস্তারিত বিবরণে পরে আসবো।
ইতিপূর্বেই আমি দুবার দিল্লিতে এসেছিলাম এবং সপ্তাহখানেক সময় করে কাটিয়েছিলাম। জীবনে দিল্লিতে প্রথম এসেছিলাম ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশনে থাকাকালে ভারতের পনেরতম সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে। তারপর আরেকবার এসেছিলাম ২০১০ সালে যখন আমি নির্বাচন সংস্কার নিয়ে গবেষণা করি। আর তৃতীয়বার ২০১৬ সালে এসেছিলাম আরেক গবেষণার কাজে। যতবারই দিল্লিতে এসেছি ততবারই মনে হয়েছে দিল্লিকে তেমনভাবে দেখা হয়নি, যেমনভাবে আমি দেখতে চেয়েছি। আমি বহু দেশের রাজধানীতে গিয়েছি। যার মধ্যে রোম নগরীও রয়েছে। তথাপি আমার মনে হয় যে দিল্লির ইতিহাসের বৈচিত্র্যের ধারেকাছেও বিশ্বের আর কোনো রাজধানী নেই। প্রথমবার এসেই মনে হয়েছিল কত পরিচিত এই শহর। কারণ উপমহাদেশের ইতিহাস যেদিন আমার পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় এসেছিল সেদিন থেকেই আমি এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছি। সেই ইতিহাস পড়া আজও শেষ হয়নি।
দিল্লির বর্ণনা দিতে গিয়ে বোধকরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি মনে পড়ে। এর চাইতে ভালো বর্ণনা কেউ দিতে পারেনি বলে মনে হয়। অবশ্য তিনি তার কবিতায় ভারতবর্ষের কথা বললেও তা দিল্লির জন্যও প্রযোজ্য। তিনি লিখেছিলেন-
‘হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য
হেথা দ্রাবিড় চীন
শকহুনদল পাঠান মোগল
এক দেহে হলো লীন।’
রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই পঙক্তিতে যেন ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দিল্লির মসনদে বসে ভারতবর্ষ শাসন করেছে আর্য, অনার্য, মোগল, পাঠান, গোত্র না জানা ক্রীতদাস, ইংরেজ। এমন বিচিত্র সাম্রাজ্যের ইতিহাস অন্য কোনো শহরে পাওয়া কল্পনাই করা যায় না।
আধুনিক ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি পক্ষান্তরে দিল্লি যতই আধুনিক হোক না কেন- নতুন বা পুরাতন দিল্লি দেখেছে সাম্রাজ্য আর শাসকদের উত্থান আর পতন। এই উত্থান আর পতনের সঙ্গে জড়িত ছিল তৎকালীন উপমহাদেশের ভাগ্য। দিল্লি শহরটি যত আধুনিকই হোক না কেন এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের ধ্বংসস্তূপ। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের, গোত্রের শাসকদের উত্থান আর পতনের করুণ চিহ্ন। এই শহর গড়ে উঠেছে সাতটি রাজধানী শহরকে কেন্দ্র করে। অনেকের মতে দশ হতে বারোটি শহরও হতে পারে। এ শহরের এসব পুরাতন সমাধিস্থল আর শ্মশানঘাট মনে করিয়ে দেয় উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাস কারও পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই শহরে আসলেই জড়িয়ে পড়তে হয় ইতিহাসের সঙ্গে। নাটক, নভেল আর ভ্রমণ কাহিনীর উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে দিল্লির বৃহৎ উদ্যানগুলোতে আর রাজপথ, অলিগলি অথবা পুরাতন শহর জুড়ে। কত জাতির রক্ত ঝরেছে এই শহরে। কত সুখ-দুঃখের ইতিহাস আর অজানা গল্প রয়েছে দিল্লির প্রতিটি পাথরের নিচে। এমনই অনুভূতি হয়েছিল আমার প্রতিবারের দিল্লি সফরে।
প্রথমবার যখন দিল্লির দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাই চেষ্টা করেছিলাম কিছু অজানা ইতিহাস জানতে। কিছু পেয়েছি কিছু পাইনি। দিল্লির সাতটি রাজধানীর নাম এখনো তেমনই রয়েছে যেমন কিনা রাই পিলোথরা সবচাইতে পুরাতন শহর বলে নথিভুক্ত রয়েছে। এই শহরটি পৃত্থিরাজ চৌহান-এর তৈরি। এর ধ্বংসবিশেষ এখনো দৃশ্যমান। জায়গাটি কুতুব মিনারের কাছাকাছি। মেহেরুলী এখানেই কুতুব মিনারসহ বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রয়েছে ফিরোজ শাহ তুগলকের সমাধি ও তার তৈরি ওই সময়কার সবচাইতে বৃহৎ মুসলিম পাঠস্থান মাদরাসা, সূফী বখতিয়ার উদ্দিন কাকীর সমাধি আর সামসি তালাব, ‘শিরি’, খিলজিদের রাজধানী, ফিরোজাবাদ, গিয়াসউদ্দিন তুগলকের তৈরি শহর। যমুনা নদীর তীরে ফিরোজ শাহ কোটলা, বর্তমানে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম এই সুলতানের নাম ধারণ করে রয়েছে।
তুগলকাবাদ গিয়াসউদ্দিন তুগলকের শহর এখন শুধুমাত্র একটি পরিত্যক্ত বিশাল আয়তনের পাথরের তৈরি দুর্গ। ওই সময়কার অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সমসাময়িক ছিলেন দিল্লির অন্যতম সূফী সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়া। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন উপমহাদেশের সবচাইতে খ্যাত সূফী সাধক খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির শিষ্য এবং কুতুবউদ্দিন কাকীর শিক্ষানবিশ। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ক্রমেই বিখ্যাত হয়ে উঠেন এমন কি তিনি সূফী সাধক হিসেবে কুতুবউদ্দিন কাকীর চাইতে বেশি খ্যাত হন। ওই সময়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের নিকট নিজামউদ্দিন দারুণ একজন জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। নিজামউদ্দিনের এ খ্যাতি গিয়াসউদ্দিন তুগলককে দারুন ঈর্ষাপরায়ণ করে তোলে। আমি কথা বলছি ১৩ শতাব্দীর আশেপাশের দিনগুলোর কথা। গিয়াসউদ্দিন তুগলক যখন তার শহর তৈরি করছিলেন ওই সময়ই নিজামউদ্দিন তার দরবারে, যা এখন এই সাধকের মাজার, খনন করছিলেন বিশাল এক তালাব (পুকুর), যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে মাজারের পেছনে। ওই দীঘি খননের জন্য প্রয়োজন ছিল বহু কর্মীর। অপরদিকে দিল্লির সুলতানের শহর তৈরিতে কর্মীর অভাব হয়ে পড়লে নিজামউদ্দিনকে সুলতান তার কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে সুলতানের দরবারে ডেকে পাঠালে আওলিয়া সে ডাকে সাড়া দেননি।
গিয়াসউদ্দিন তুগলক তখন বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত। বাংলায় বিদ্রোহ থামাতে দিল্লি ছাড়লেন কিন্তু তার পূর্বেই তিনি মনঃস্থির করেছিলেন যে রাজদ্রোহের অপরাধে ফিরে এসে আউলিয়াকে চরম শাস্তি দেবেন। তুগলক বাংলার বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসবার পথে আবার তার সংকল্পের কথা প্রকাশ করলে আউলিয়ার শিষ্যরা আউলিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। নিজামউদ্দিনের তখন অনেক বয়স। তিনি তার অনুরাগীদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তুগলককে দিল্লি পর্যন্ত আসতে দাও’- বলে যে উক্তি করেছিলেন তা উপমহাদেশে আজও উচ্চারিত হয়। ধ্যানরত আউলিয়া বলেছিলেন ‘হুনুজ দিল্লি দূর অস্ত’ ‘দিল্লি এখনো বহু দূরে’। গিয়াসউদ্দিন তুগলক দিল্লি পর্যন্ত আসতে পারেননি। পথে তার পুত্র মোহাম্মদ বিন তুগলকের তৈরি অভ্যর্থনা মঞ্চ হতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মহাক্রমশালী গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সমাধি রয়েছে পরিত্যক্ত তুগলকাবাদের দুর্গের অদূরে জনমানবশূন্য নির্জন জায়গায় আর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার থাকে লোকে লোকারণ্য। নিজামউদ্দিন আউলিয়া আরো ভবিষ্যদ্বাণী করে তুগলকাবাদ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ইয়া রাসেগা গুজর ইয়া রহেগা উজার’ (এটা হয় থাকবে পরিত্যক্ত অথবা বসবাস করবে গুজারা। [যারা মহিষ চড়ায়]) এমনই রয়েছে তুগলকাবাদ। এখান থেকে যে শিক্ষা নেয়া উচিত আমাদের সময়কার নেতাদের, ক্ষমতার দাপট চিরস্থায়ী নয়। চিরস্থায়ী নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মতো নিঃস্বদের।
গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র মোহাম্মদ বিন তুগলক তৈরি করলেন মেহেরুলী এবং তুগলকাবাদের মাঝামাঝি নতুন শহর ‘জাহানপনা’। এখানে অনেক দিন ইবনে বতুতা অবস্থান করেছিলেন। পরে তুগলক রাজধানী দক্ষিণ ভারতে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন জাহানপনাতে। জাহানপনা এখন ধ্বংসস্তূপ।
মোহাম্মদ বিন তুগলক ছিলেন অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ এবং অনেকটা খেপাটে ধরনের। তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যার যৌক্তিকতা ওই সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন হঠাৎ দিল্লি হতে রাজধানী দক্ষিণে নিয়ে যেতে তিনি দিল্লিবাসীদের জোর করে নিয়ে যান। কথিত রয়েছে যে, একজন বিকলাঙ্গ ভিক্ষুককেও তিনি বাদ দেননি। আবার কয়েক বছর পর ফিরে আসেন দিল্লিতে। নিয়ে আসেন সব নাগরিকদের। এসবের জন্য তাকে উদাহরণ করেই ‘বাংলা ভাষায়’ যুক্ত হয়েছে প্রবাদবাক্য ‘তুগলকি কারবার’- যখন যা খুশি তাই করা। মোহাম্মদ বিন তুগলক ছিলেন ওই সময়কার প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরাচার। তুগলকরা এখনো একই রকম আছেন। অনেক তথাকথিত নির্বাচিত অনির্বাচিত শাসকরা ‘তুগলকি কারবারে অভ্যস্ত- আজ এক কথা কাল তার উল্টো। মোহাম্মদ বিন তুগলকের সমাধি কোথায় তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাস্ত করে শেরশাহ তৈরি করেছিলেন শেরগড়। শেরগড় লালকিল্লার কাছাকাছি জায়গায় আর পুরাতন কিল্লা ঘিরে। এখানেই এই পুরাতন কিল্লাতেই লাইব্রেরির সিঁড়ি হতে বাবরপুত্র হুমায়ুন পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
দিল্লির পুরাতন শহরের মধ্যে এখনো যা আবাদ রয়েছে- তা হলো শাহজাহানাবাদ যা বর্তমানে পুরাতন দিল্লি বলে পরিচিত। শাহজাহানাবাদ বা বর্তমানের পুরাতন দিল্লিই দিল্লির সপ্তম শহর। এই পুরাতন দিল্লিই ইতিহাসে ভরপুর। এখানেই শাহজাহানের বড় সন্তান জাহানারা তৈরি করেছিলেন ‘চাঁদনী চক’। এখানে বড় চওড়া রাস্তার মাঝে ছিল ছোট পানির তালাব আর ফোয়ারা। রাস্তার দু’ পাশে প্রবাহিত পানি যার উপরে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরিয়ে চকচক করতো। তাই জাহানারা নাম রেখেছিলেন চাঁদনীচক। এখন শুধুমাত্র চাঁদনী চক-এর নামটিই রয়েছে। প্রথমবার যখন পুরাতন দিল্লি তথা শাহজাহানাবাদে আসি তখন ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম এখনকার
অবস্থা দেখে। পুরাতন ঢাকার চাইতে বড় এ ঐতিহাসিক শহরটি এখন হতশ্রি, ঠেলাগাড়ি, রিকশা আর মানুষের ভিড়। পাইকারি বাজার। এক সময়ের ঝলমলে এই শহরের বিখ্যাত গলিগুলো গন্ধ আর পুতময় হয়ে রয়েছে।
এক সময়ের ‘চাঁদনীচক’ যখন প্রথমবার দেখি বেশ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে। মনে হয়েছিল শাহজাহানাবাদের অলিতে-গলিতে ইতিহাস। বড় বড় হাভেলী আর কুচাগুলোর প্রতিটির অতীতই একেকটি বড় ইতিহাস। সুখ-দুঃখ, জৌলুস, প্রেম, বঞ্চনা, জীবন-মৃত্যু- সবই ধারণ করে কয়েকশত বছরের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রত্যেকটি পুরাতন জরাজীর্ণ এক সময়ের সুরম্য হাভেলী আর কুচাগুলো। এখন এটি একটি সাধারণ চৌরাস্তা- এর এক পাশে ছিল একটি অতিথিশালা যা এখন নেই সেখানেই রয়েছে টাউন হল। শাহজাহানাবাদ বা বর্তমানের পুরাতন দিল্লির স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার ভারত বিখ্যাত। এখানে এখনো ঐতিহ্যবাহী মোগল খাবার পাওয়া যায়। এখানে পরের দিকের মোগলদের পাচকদের এক বংশধরের একটি রেস্তরাঁ রয়েছে যার নাম ‘করিমস্’, উপমহাদেশ খ্যাত এই রেস্তরাঁ। এখানে পরিবেশিত হয় সবধরনের কাবাব এবং মাংসের পরিবেশনা। মাৎস হিসেবে ব্যবহার হয় মুরগি এবং ছাগল বা বকরি। মোগলরা তাদের রাজত্বকালে তাদের হিন্দু প্রজাদের দিকে লক্ষ্য রেখেই গো-মাংস ভক্ষণকে নিরুসাহিত করেছিলেন। তাই এ অঞ্চলে কোরবানি ঈদ ‘বকরা ঈদ’ নামে পরিচিত।
শাহজাহানাবাদে অনেকগুলো বাজার ছিল। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পণ্যের বাজার। এখনো এই সব বাজার রয়েছে। তবে এগুলো এখন পাইকারি বাজার। তবে খুচরা বাজারও রয়েছে। শাহজাহানাবাদ গড়ে উঠেছিল দিল্লির মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর তীর ধরে। যমুনা তীর ধরেই গড়ে উঠেছিল ভারতের শত শত বছরের মুসলিম সাম্রাজ্য। লক্ষণীয় বিষয় যে, মোগল স্থাপন্যের সবচাইতে দর্শনীয় এবং বিশ্বের বিস্ময় আগ্রার তাজমহল এবং মোগলদের রাজধানী বলে কথিত আগ্রার দুর্গ গড়ে উঠে যমুনা নদীর তীরে।
যমুনা নদী তখন উন্মত্ত যৌবনা। দূর্গের পেছনে দেয়ালঘেঁষা। টলটল পরিস্কার পানির প্রবাহ। সূর্যের আলোতে চিকচিক করত। এ নদীর পানি সরবরাহ হত দূর্গ আর শাহজাহানাবাদে। এখন সেই যমুনা নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। দূর্গ হতে কয়েক কিলোমিটার পূর্বে সরে গিয়েছে। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে বস্তি আর পানি হয়েছে দূষিত। তবুও এই যমুনা নদী কালের সাক্ষী। অগণিত সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতনের সাক্ষী।
অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন ওই সময়কার মুসলিম শাসকরা গঙ্গার তীরে তেমন কোনো স্থাপনা তৈরি করেননি; কারণ ওই নদীটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র নদী। তবে অনেক শাসকদের উপর মন্দির বিনষ্ট করার ঐতিহাসিক অভিযোগ রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন মধ্যযুগে ধর্মস্থানের ওপর হামলা করার অন্যতম কারণ ছিল দুর্গের ভেতর হতে শত্রুসেনাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে আসার কৌশল। হয়তো ঠিক, হয়তো ঠিক নয়- এটি নিয়ে বিতর্কের অভিপ্রায় আমার নয়।
শাহজাহানাবাদ বা পুরাতন দিল্লির আকার অনেকটা পানের মতো ছিল। এ শহরের প্রান্তে রয়েছে লালকিল্লা। লালকিল্লার লাহোর গেট হতে সোজা পশ্চিম দিকে প্রধান সড়ক যার মাঝ প্রান্তে ছিল চাঁদনী চক। প্রায় শেষ মাথায় রয়েছে একটি বৃহৎ মসজিদ; এগুলো তৈরি করেছিলেন শাহজাহানের অন্য দুই পত্নী। এর মধ্যে একজন বেগম আকবরি মহল। অপরজন বেগম ফতেহপুরী যার নামে পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ফতেহপুরী মসজিদ। কথিত যে, তিনি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই দুই বেগমের সমাধি রয়েছে আগ্রার তাজমহলের প্রধান প্রবেশ পথের পাশে। আকবর মহলের তৈরি মসজিদটি ১৮৫৮ সালে কোম্পানির হুকুমে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় শাহজাহানাবাদের বহু মসজিদ আর মোগল স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। চাঁদনী চকের মূল সড়কে যুক্ত হয়েছে গলি, কুচা। আর শহরটি ছিল দেয়ালঘেরা যার নিয়ন্ত্রণ হতো বারটি গেটের মাধ্যমে। প্রতিটি গেটের বিভিন্ন নাম ছিল। এখনো কয়েকটি গেট দাঁড়িয়ে রয়েছে তবে দেয়াল প্রায় নেই বললেই চলে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের যুদ্ধে ধ্বংস হওয়ার পর বৃটিশ বাহিনী কয়েকটি গেট ছাড়া ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করেছিল শহরের দেয়াল। আজও পাঁচটি মূল গেট দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তার মধ্যে সবচাইতে ঘটনাবহুল এবং বহুভাবে আলোচিত ৫টি গেট বা দরওয়াজার অন্যতম বর্তমানে খুনি দরওয়াজা হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল শাহজাহানাবাদে প্রবেশের প্রথম দরওয়াজা। এই দরওয়াজাটি তৈরি করেছিলেন শেরশাহ সুর যিনি এটা শেরগড়ে প্রবেশের অন্যতম দরওয়াজা হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরে সম্রাট শাহজাহান তার প্রাচীর শহর শাহজাহানাবাদের প্রধান ফটকে উন্নীত করেন। এখানে হালেও বহু ঘটনার জন্ম হয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন ঐতিহাসিক কারণেই ‘এই দরওয়াজা, যা এখন রাস্তার ডিভাইডার-এর মাঝে, জায়গাটি অভিশপ্ত তাই বৃষ্টিতে রক্ত ঝরে। আমি প্রথমবার গাড়ি হতে নেমে এ দরওয়াজা বা গেট দেখতে। গেটটি তিনতলা উপরে সৈনিকদের বিশ্রামের জায়গা করা ছিল। এখন পরিত্যক্ত। এখানেই যুবরাজ জাহাঙ্গীর তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক সময়ে যুদ্ধে আকবরের অন্যতম রত্ন ও যোদ্ধা আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন। তার শিরশ্ছেদ করে মাথা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আরো পরে ১৮৫৭ সালে কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যখন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর মেজর হাডসনের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ওই সময়ে তার তিন পুত্রসহ আরো অনেককে এই দরওয়াজার প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্যা করে শিরশ্ছেদ করে লটকিয়ে রেখেছিল।
মেজর হাডসন যিনি নিজেও আরো পরে লক্ষ্ণৌতে সিপাহীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার দেহকেও লটকিয়ে রাখা হয়েছিল। লক্ষ্ণৌ-এর লা মার্টিনিয়ার কলেজের এক কোনায় রয়েছে মেজর হাডসন-এর সমাধি। মেজর হাডসন প্রথমে ছিলেন একজন ভাড়াটে সৈনিক। তার ক্যাভেলারি পরে বৃটিশ ভারত বাহিনীতে ‘হাডসন হর্স’ নামে আত্মীকরণ করা হয়েছিল। আমি ২০১৬ সালে ইয়াঙ্গুনে বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে গিয়েছিলাম। যাই হোক কিংবদন্তি রয়েছে যে, এই গেটের উপরে বৃষ্টির পানি পড়লে রক্তের রং ধারণ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে, এখানে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তাতে লোহার উপাদান বেশি বলে মরিচার রংয়ে পানির রং বদল হয়।
আর দুটি গেট যার মধ্যে একটি ১৮৫৭ সালের ক্ষত নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তার নাম কাশ্মিরী গেট। মূলত এই গেটের পতনের পরেই ১৮৫৭ সালের সিপাহীরা পরাজিত হন। আর দক্ষিণ প্রান্তে এখনো দাঁড়িয়ে তুর্কম্যান গেট।
বলছিলাম শাহজাহানাবাদের কথা। তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল এই শহর। লালকেল্লা হতে ‘চাঁদনীচক’ পর্যন্ত ছিল উচ্চবিত্তদের বাস আর উচ্চমার্গের বিপণী বিতান। চক কোতোয়ালি (পুলিশ থানা), হতে চাঁদনীচক স্কয়ার ছিল দ্বিতীয় ভাগ। এ জায়গাতেই ছিল উচ্চবিত্তদের বাজার। কবি-সাহিত্যিকদের বাস ও আড্ডাখানা। মীর্জা গালিবের বাসস্থানও এরই ধারেকাছে। শেষবার দিল্লি সফরকালে গিয়েছিলাম মীর্জা গালিবের বাসস্থান দেখতে। যার বেশি অংশই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল বহু আগে। তবে পরে ভারত সরকার একাংশ উদ্ধার করে গালিব ট্রাস্ট বানিয়েছেন। এখন সে অংশ গালিবের জাদুঘর।
শেষ অংশ ছিল চাঁদনীচক হতে ফতেহপুরী মসজিদ পর্যন্ত। এখানে এখন এশিয়ার সবচাইতে বড় মসলার পাইকারি আড়ত।
‘চাঁদনীচকের’ আবাসনগুলো ছিল তিন স্তরের। প্রথম স্তর হাভেলী। প্রাসাদের মতো বাড়িগুলো ছিল উঁচু দেয়ালঘেরা। মালিকরা ছিলেন আমীর, ওমরাহ বা নবাব এবং তৎকালীন সমাজের উচ্চ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এরা ছিলেন মোগল দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। একটি হাভেলী যা এখনো বিখ্যাত এবং সবচাইতে বড় নাম চুনীমল হাভেলী। আমি দেখতে গিয়েছিলাম ওই হাভেলীটি। দ্বিতীয় স্তর ছিল কুচা। এখানে একই পেশার মানুষরা থাকতেন। তৃতীয় স্তর কাটরা। এখানে পেশাদারদের কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান একই জায়গায় ছিল। এই দুই স্তরই ছিল মহল্লা।
চাঁদনীচকের দক্ষিণ পাশে ‘জোহরী বাজার’ এক সময় অলংকারের বড় বাজার ছিল। এখনো কিছু রয়েছে। তবে বর্তমানে এখানে শাড়ি, লেহেঙ্গা আর মহিলাদের অন্যান্য পরিধেয় জড়ির কাজ করা কাপড় ও তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার। সমগ্র ভারতে সরবরাহ করা হয় এখান থেকেই। এখানেই প্রথমবার আমার পরিচয় হয়েছিল একজন রিকশাচালক আহমেদ গিয়াসের সঙ্গে। যিনি ৮০ রুপির বিনিময়ে বহু গলি আর কুচা দেখিয়েছিলেন। তিনি এই জায়গারই বাসিন্দা। কথায় কথায় জেনেছিলাম যে, প্রায় দশ পুরুষ ধরে তারা মোরিগেটের বাসিন্দা। এখন তারা রিকশা আর ভ্যানগাড়ির ব্যবসা করেন। তিনি মাঝে মধ্যে মনমতো যাত্রী পেলে এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। আমাকে দেখেই তিনি ঠাওর করেছিলেন যে, এ জায়গা দেখতে এসেছি। বাংলাদেশি শুনে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, তার দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষিত করে তুলবার। তবে তার শঙ্কা ছিল সরকারি চাকরি না পাবার। তার তথ্য মোতাবেক এখানে একসময় সব বড় ব্যবসায়ীরাই ছিলেন মুসলমান। কিন্তু প্রথমবার ১৮৫৭ সালে পটপরিবর্তন হয় আর দ্বিতীয়বার ১৯৪৭ সালের দিল্লি রায়টের পরে মাত্র দশ ভাগে নেমে আসে মুসলমান ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। ১৯৪৭ সালের পাঞ্জাব বিভক্তির পর পশ্চিম পাঞ্জাবের ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে উদ্বাস্তু হওয়া শিখদের এখানে এবং ধারেকাছে ক্যারলবাগে পুনর্বাসন করা হয়। এখানে যে সব মুসলমানরা রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে একপ্রকার যুদ্ধ করেই থাকতে হয়েছে। তার পূর্ব-পুরুষরা এভাবেই রয়ে গিয়েছিলেন।
আহমেদ গিয়াস দুঃখ করে বলেছিলেন যে, এখানকার মুসলমান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী নয়। ফটকাবাজারি করা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। বয়স্করা আড্ডা আর কবুতর বাজি করে অতীতের প্রজন্মের স্বর্ণযুগের আলোচনায় তৃপ্ত হয়ে থাকেন। আহমেদ গিয়াস বলেছিলেন, এখানকার বহু বিত্তশালী যাদের হাভেলীগুলো এখনো দাঁড়িয়ে- তা তারা বিক্রি করে অনেকেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। আহমেদ গিয়াস দুঃখ করে বলেছিলেন যে, তার মুরুব্বিদের কাছ থেকে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা শুনেছেন। বললেন যে, তিনি শুনেছিলেন- মুসলমানদের পতন তাদের কারণেই হয়েছে। যেদিন বাহাদুর শাহ জাফরকে হাডসনের নেতৃত্বে শিখ পল্টন এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তখন এখানকার ধনাঢ্য মুসলমানরা টিকে থাকবার জন্য হাত মিলিয়েছিলেন ইংরেজদের সাথে। এমন কি মীর্জা গালিবও কোম্পানির সিপাহীদের সঙ্গে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের মোশাহেবার রত্ন। এসব কথা বিস্তারিতভাবে তার দাদার কাছে শুনেছিলেন। তিনি আমাকে অনেক গলি কুচাতে ঘুরিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাজিয়া সুলতানার সমাধিতে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। বলেছিলেন ওই জায়গা শাহজাহানাবাদেই। তবে গলির মধ্যে এ সময় যেতে বহু সময় লাগবে। তাই আর যাওয়া হয়নি। এরপরেও আর যাওয়া হয়নি। রাজিয়া সুলতানা ইলতুতমিশ-এর কন্যা ভারতবর্ষের প্রথম নারী সুলতান। আর মুসলমানদের শত শত বছরের শাসনকালের একমাত্র নারী শাসক। এর পরে আরেক নারী দিল্লি মসনদে সদর্পে ছিলেন তার নাম ইন্দিরা গান্ধী।
আহমেদ গিয়াস শিখদের গুরুদুয়ারা শিসগঞ্জ সাহেব, যেখানে আওরঙ্গজেব নবম শিখগুরুর শিরশ্ছেদ করিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম লালকুয়া বাজার হয়ে তুর্কম্যান গেটের দিকে। এই জায়গাটির বহু ঘটনা খুশবন্ত সিং-এর বইতে পড়েছিলাম। আহমেদ গিয়াস নিয়ে যেতে সাহস পায়নি। কারণ ওই এলাকায় দিল্লির বেশির ভাগ হিজড়াদের বাসস্থান। এদের এখানে আবাস মোগল সময় হতে। এদের মধ্য হতে মোগল হেরেমের রক্ষী নিয়োজিত হতো। অনেক ঘুরিয়ে গিয়াসউদ্দিন আমাকে দিল্লির তথা ভারতের সর্ববৃহৎ মসজিদ জামে মসজিদের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সামনেই চোর বাজার। জামা মসজিদ এখন ওয়াক্ফ সম্পত্তি। পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান। ১৮৫৭ সালের পর কোম্পানির সৈনিকরা ‘আস্তাবল’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল শাহজাহানের আরেক কীর্তি, এই মসজিদ কিন্তু ওই সময়ের ইংল্যান্ডের বৃটিশ সরকারের সায় না থাকায় রয়ে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে মোগলদের পতনের পর কোম্পানির শাসকরা পরবর্তী দুই বছর দিল্লিতে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার বন্ধ রেখেছিল। ভয় পেয়েছিল আরেক উত্থানের। অবশ্য সিপাহী বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা ছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ হতে ইংরেজদের বিতারিত করতে পলাশী যুদ্ধের ১০০ বছর পর। দিল্লির জামা মসজিদ তৈরি করেছিলেন রেড সেন্ড স্টোন দিয়ে। শাহজাহান পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব এর চাইতে কিছুটা বড় একই ধাঁচের লাল পাথরের মসজিদ তৈরি করেন লাহোরে। যার নাম বাদশাহী মসজিদ। মসজিদটি তৈরি করেন তার দাদার নির্মিত লাহোর দুর্গের সামনে।
প্রথম সফরে দুপুরে ইচ্ছা হয়েছিল পুরাতন দিল্লিতেই খাবার খেতে। পরাটাওয়ালি গলির অনেক নাম শুনেছি। সেখানে চল্লিশ রকমের পরাটা পাওয়া যায়- এমনটাই শোনা যায়। গিয়েছিলাম ওই গলিতে। রিকশা নিয়েছিলাম। কোন কোন গলি দিয়ে টাউন হলের সামনে অত্যধিক সরু গলির মুখে থামিয়ে রিকশাচালক দেখিয়ে দিলো ইতিহাসখ্যাত পরাটাওয়ালি গলি। গলির ভেতরে মাত্র চার পাঁচখানা দোকান এখনো অবশিষ্ট। সবগুলোই প্রায় দেড়শত বছরের পুরনো। এক দোকানে বসে পরিচয় হলো ইকবাল আলীর সঙ্গে। দুই ভাই বংশপরম্পরায় চালিয়ে আসছে এই ছোট পরিসরের দোকান। সামনে বড় কড়াইতে ঘি ফুটছে। একজন দ্রুত হস্তে পরাটা বানিয়ে ঘিয়ের মধ্যে ডুবিয়ে ভেজে নিয়ে তুলে দিচ্ছে খদ্দেরদের প্লেটে। তিন রকমের সবজি ফ্রি। চাইলে আরো পাওয়া যায়। এমন কোনো ধরনের পরাটা নেই যা চাইলে পাওয়া যায় না। অনেক পরাটার নাম শুনলেও চল্লিশ ধরনের পরাটা হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। এক প্লেটে দুটো পরাটা সঙ্গে সবজি চাটনি। অপূর্ব তার স্বাদ। ইকবাল আলীও তার সুখ-দুঃখের কথা জানালেন। বলেছিলেন, এ ব্যবসা ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাত্র চারটি দোকান রয়েছে। বাকিগুলো বিভিন্ন রকমারি শাড়ি-গহনার দোকানে রূপান্তরিত হয়েছে। বললেন, হয়তো এক দু’বছর পর আসলে এটাও বন্ধ পাবেন। নিজাম-এ (নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নামে স্থান ও রেলওয়ে স্টেশনের নাম) ছোট রেস্তরাঁ নিয়েছি সেখানেই চলে যাবো। এবার গিয়ে মাত্র তিনটি দোকান পেয়েছিলাম। ভাটিয়া নামক একজনের দোকানে নাস্তা করেছিলাম।
তিনি জানালেন, ‘এখন পরাটা লোকে তেমন খেতে চায় না। ঘিয়ে ডুবিয়ে এই পরাটা স্বাস্থ্য সচেতন লোকে তো একেবারেই খায় না। তার উপরে ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের ঝুঁকি। তেমন আড্ডাও হয় না। পেছনে পণ্ডিত নেহেরুর ছবি দেখিয়ে ভাটিয়া বললেন, আমার দাদা এলাকায় কংগ্রেস নেতা ছিলেন। তারই আমন্ত্রণে পণ্ডিত নেহেরু স্বাধীনতার আগে রাস্তার ওপারে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। এখান থেকে পরাটা নেয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইকবাল আলীর কথা। বললেন, নিজাম-এ খোঁজ করলে পাবেন।
আমি প্রথমবার যখন ইকবাল আলীর দোকান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হয়েছিলাম প্রায় একদিনের অভিজ্ঞতা আর মোগলদের তৈরি জৌলুসময় এই শহরের কথা চিন্তা করতে করতে ইহিাসে ডুবে গিয়েছিলাম। একদা প্রাচ্যের গর্ব এই শাহজাহানাবাদ, বর্তমানের পুরাতন দিল্লি, যে শহরের পতন হয়েছিল চারশ’ বছর আগে সেই শহর এখন মৃতনগরী। বাকি নেই কোনো জৌলুস। মানুষ আর ঠেলাগাড়ি, হট্টগোল, গালাগালি আর দোকানের বিশ্রি চেহারার পেছনের ইতিহাস ধুলোয় ডাকা পড়ছে। একদা মোগল বংশের উচ্চবিত্তদের বাসস্থানগুলো, গজল আর উর্দু শায়েরীর গুঞ্জনে মুখরিত হতো। আজ গোডাউনে পরিণত হয়েছে। বহু হাভেলী ধ্বংসপ্রায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ধ্বংসপ্রায় এক সময়ের ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের বংশধরদের হাভেলী আর কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আসকার হাভেলী যেখানে শত বছর পূর্বে জওহরলাল নেহেরু আর কমলা দেবীর জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এক সময়ের জৌলুসপূর্ণ শাহজাহানাবাদ, যে শহরকে নাদির শাহ তিনদিন ধরে লুট করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কোহিনূর হীরক খণ্ড। সেই শহর আজ অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোও মনে করিয়ে দেয়ার অবস্থায় নেই। আমি প্রথমবার পুরাতন দিল্লি বা শাহজাহানাবাদে গিয়ে যখন চারদিকে দেখছিলাম তখন যেন চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ইতিহাস উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। হয়তো যারা শাহজাহানাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জন্য এ জায়গা কেবলমাত্র ছোট ছোট কারখানা আর বৃহৎ সস্তা, খুচরা আর পাইকারি বাজারের ধূসর দালানকোঠাগুলো মাত্র। অনেকেই হয়তো আসতেও চাইবে না। কিন্তু যারা প্রকৃত ভ্রমণ পিপাসু, যারা ভ্রমণে ইতিহাস খোঁজ করেন, পুরাতন দিল্লি এখনও সেই ইতিহাসের জৌলশময় দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দেবে। এখনকার মূল বাসিন্দারা কঠিন জীবনযাপন করে আসছেন।
এই শাহজাহানাবাদ এক সময় সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। ছিল উর্দু ভাষার কবি-মহাকবিদের মিলনস্থল। ফার্সি ভাষা চর্চার কেন্দ্র যার নেতৃত্ব দিতেন মোগল দরবারের রাজকুমার বা রাজকুমারীরা। এখনো অনেক ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের সদস্যরা কিছু ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন। হয়তো কয়েকটি বিবর্ণ বাঁধানো ছবি আর পুরাতন গড়গড়াটা পরিষ্কার করে অতীত জীবনের স্মৃতি হাতরিয়ে বেড়াচ্ছেন। বেশির ভাগ উর্দু সংস্কৃতি আর গজল কবিতার ধারকরা পাকিস্তানে চলে গিয়েছেন। ইতিহাস হয়ে থাকা অনেক বড় বড় নামের কবিদের অস্তিত্বই নেই। জউখ এখন লক্ষ্ণৌয়ের রেললাইনের ধারের কোনো কবরে শুয়ে আর মীর্জা গালিব নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের প্রবেশমুখে উন্মুক্ত আকাশের নিচে অযত্নে অবহেলায় রয়েছেন।
এক সময় শাহজাহানাবাদে পড়ন্ত বিকেলে ছাদের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবুতরবাজরা কবুতরবাজি করতেন। এ খেলা ছিল বড় বড় হাভেলীর নবাবদের। মোগল সম্রাট আকবরের শখ ছিল কবুতরবাজি। যার নাম রেখেছিলেন ‘ইসকবাজি’। সে সময় হতেই উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পরে এ শখের খেলা। একজনের কবুতরের ঝাঁক অন্য কবুতরের সঙ্গে খেলা দেখাতে দেখাতে নিজের ঝাঁকের সঙ্গে নিয়ে আসা। ইতিহাসে বর্ণিত যে, সম্রাট আকবরের প্রায় বিশ হাজার কবুতর ছিল। এসব কবুতরের জন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল। ছিল পরিচর্যার জন্য বিভিন্ন পদবির কর্মকর্তাগণ। আকবরের এই শখ ছিল বাল্যকাল থেকেই। হবেই বা না কেন, মাত্র ১২ বছর বয়সকালে পিতৃবিয়োগ ঘটলে মাতা হামিদা বানুর হাত ধরে সিংহাসনে বসেছিলেন। কাজেই বাল্যকালের শখ রাজকীয় শখে পরিণত হয়েছিল। আকবরের কবুতরের ঝাঁকের মধ্যে পাঁচশত কবুতর ছিল বিশেষ ধরনের। এদের জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। তিনি নিজে তার প্রিয় কবুতরগুলোকে নাম দিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহান তার দাদার এই গুণটি পেয়েছিলেন। ওই সময়ে বিকেলে শাহজাহানাবাদের আকাশে কবুতরের পাখা ঝাপটা আর তাদের নিয়ন্ত্রকদের তীক্ষ্ণ শিসের বা অন্যান্য আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠতো শাহজাহানাবাদ।
এখনো শাহজাহানাবাদে বিকেলে চলে কবুতরবাজি। তবে এখন আর এ খেলা নবাব বা রাজকুমারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ খেলা চলে এসেছে সাধারণ মানুষের আঙ্গিনায়। এখনো উড়তে দেখা যায় সিরাজী, লাল খাল, আজাদী, গোলে, মাসাককলি এবং কাবুলী কবুতরের ঝাঁক। এখনো কবুতরের ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিযোগিতা হয়। এখনো অন্য ঝাঁক হতে কবুতর ছিনিয়ে আনবার কৌশল শেখানো হয়। ছাদের উপর হতে ডাক শোনা যায় ‘আও আও’। তবে যা দেখা যায় না অতীতের সেই চাকচিক্য আর কবুতরবাজিতে শাহজাহানাবাদ মাতিয়ে রাখা। এখনো হুক্কার চলন থাকলেও নাকে আসে না বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি তামাকের ঘ্রাণ। নবাব আর সম্রাটদের হুক্কা এখন ‘সিসায়’ পরিণত হয়েছে। সুগন্ধি তামাকের জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে মাদক আর তৈরি হয়েছে ‘সিসা’ বার। এর ব্যাপ্তি আরেক মোগল শহর জাহাঙ্গীরনগর- এখনকার ঢাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কবুতরবাজি লক্ষ্ণৌ আর দিল্লি হয়ে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোতে পৌঁছেছে। মহাজিরদের কল্যাণে পাকিস্তানের শহর করাচিতেও পৌঁছেছিল। আমার কৈশোর কেটেছিল এই শহরে। আমারও শখ ছিল কবুতরবাজির। প্রায় দেড়শত কবুতর ছিল আমার সংগ্রহে। এগুলো সবই পুরাতন স্মৃতি।
শাহজাহানাবাদ আজ স্মৃতির গহ্বরে ঠিক যেমনি শাহজাহানের পিতার তৈরি ঢাকার ঐতিহ্য। পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্য এখন সেকেলে। আধুনিক হবার প্রতিযোগিতায় সমাজের অবক্ষয়, যার উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি।
শাহজাহানাবাদ আর চাঁদনীচক ক্রমশই ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আর কয়েক দশক পর ‘শাহজাহানাবাদ’-এর নাম ইতিহাসে খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। পুরাতন দিল্লি হয়তো থাকবে না। হয়তো পুরাতনের উপরেই গজিয়ে উঠতে পারে নতুন শহর। যে শহরের নিচে হারিয়ে যাবে মোগলদের ঐতিহ্য, জৌলুসভরা কাহিনী আর খণ্ড খণ্ড কাহিনী শোনাবার মতো আহমেদ গিয়াস আর ইকবাল আলীদের মতো ব্যক্তিরা। কতজনই বা জানেন যে ‘চাঁদনীচক’ নামটি যিনি দিয়েছিলেন সেই মোগল শাহজাদী ‘জাহানারা’, শাহজাহান কন্যা আজ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে উন্মুক্ত কবরে শায়িত। মাঝেমধ্যে দু’একজন দর্শনার্থী খুঁজে বের করেন জাহানারার সমাধি।
প্রথমবার দিল্লিতে এসেই গিয়েছিলাম দিল্লির সূফী সম্রাট হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। এক ঐতিহাসিক স্থান। প্রবেশপথে আমীর খসরুর মাজার যিনি উপমহাদেশে কাওয়ালীর প্রচলন করেছিলেন। তিনি নিজে কাওয়ালীর জন্য কবিতা, কাসিদা আর গজল লিখতেন। তিনি আওলিয়ার প্রধান শিষ্য ছিলেন। পরিচিত হন সূফী সাধক হিসেবে। বিখ্যাত হয়ে উঠেন সূফী সাধক হিসেবে। মাজার প্রাঙ্গণে রয়েছে মোগল বংশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধি যার মধ্যে অন্যতম জাহানারা।
নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগাতে সারা বছরব্যাপী প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। সমাগম হয় সকল ধর্মের মানুষের। ভাবতে অবাক হতে হয় কিভাবে পরাক্রমশীল সুলতানদের সময়ে একজন সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেন অতীব সাধারণ মানুষের ‘মসিহা’। উপমহাদেশের সূফীদের ভক্ত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের মানুষ। আওলিয়ার সঙ্গে সুলতানদের সম্পর্ক যে মধুর ছিল না তার বিবরণ আগেই দিয়েছি। হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া যখন সূফী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তখন জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লির মসনদে। তিনি কোনোদিন জালালউদ্দিনের ধারে কাছেও ঘেঁষেননি। বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম এই ঐতিহাসিক চত্বরে কেবলই মনে পড়ছিল তার উক্তি- ‘হনুজ দিল্লি দূর অস্ত’। ছোটবেলা হতেই শুনেছি এ বাক্য। তখন জানতাম না এর ইতিহাস।
নিজামউদ্দিন হতে কয়েক কিলোমিটার দূরেই দিল্লির অষ্টম শহর ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ বা নয়াদিল্লি। এ স্বাধীন ভারতের রাজধানী। প্রথমবারও দেখেছি। এবারও দেখলাম। লুটিয়েন্স একমাত্র তাজমহল ছাড়া তৎকালীন ভারতের কোনো স্থাপনাকেই শৈল্পিক মনে করেননি। তিনি বৃটিশ রাজের জন্য তৈরি করেছিলেন সর্বাধুনিক রাজধানী। তৈরি করেছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি আবাসস্থান যা আজ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। যার কথা প্রারম্ভে বলেছি। ইন্ডিয়া গেটে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অন্যতম প্রশস্ত রাজপথ যার এখনকার নাম জনপথ তার অপর প্রান্তে রেইসিয়ানা পাহাড়ের অপর প্রান্তের বিশাল প্রাসাদটি দেখা যায় না। ক্রমেই সামনের দিকে এগুলে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের উদয়ের মতো উপরে উঠতে থাকে এই প্রাসাদ। এবারই দেখবার সুযোগ হয়েছিল ভেতরের কিছু অংশ, বিশেষ করে দরবার হল আর অশোকা হল। ১৯১১ সালে কলকাতা হতে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করলেও ১৯৩১ সালের আগে শেষ করতে পারেনি নতুন দিল্লির কাজ। যখন নতুন দিল্লি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে ওই সময় হতেই ভারতবর্ষে বৃটিশরাজের সূর্য অস্তগামী এরপর মাত্র ১৬ বছর টিকে ছিল বৃটিশ রাজ। যখন নতুন রাজধানীর পরিকল্পনা করা হয় তখন বৃটিশ রাজ ৫০০ শ’ বছরের রাজত্বের পরিকল্পনায় বিভোর ছিল। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে ১৮৫৭-এর ঘটনা ভারতের জাতীয়তাবাদের নতুন রূপ দিবে। ওই বিদ্রোহের পর মাত্র ৯৯ বছরই টিকেছিল সমগ্র ভারতে বৃটিশ রাজ।
যাই হোক বর্তমানের রাষ্ট্রপতি ভবন, তৎকালীন ভাইসরয় প্রাসাদ, নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩১ সালে, ওই সময়ে খরচ হয়েছিল ৪,৭৭,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড। এই ভবনের মোট কক্ষ সংখ্যা ছিল ৩৫৫টি। বর্তমানে ১৯০০০ ঘন মিটার আয়তনের এই ভবনে রয়েছে ৩৪০টি কক্ষ। আমাকে যে কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তার এ ভবনে ৮ বছরের কর্মকালে পঞ্চাশটি রুমের বেশি দেখতে পারেননি। রাজকীয় ভবনই বটে।
এই ভবনটি তৈরিতে কোনো স্টিল ব্যবহার হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছিল ৭০০ মিলিয়ন ইট আর ৩.৫ মিলিয়ন ঘন মিটার পাথর। ওই সময় বাগানের পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত ছিল ৪১৮ জন মালী। এখন এ সংখ্যা অনেক কম।
এই ভবনের শেষ বৃটিশ ভাইসরয় ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। আর স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োজিত হয়েছিলেন সি রাজা গোপালচারি। তিনি সাধাসিধা জীবনযাপন করতেন। তিনি ভাইসরয়দের জন্য নির্দিষ্ট বিশাল শয়নকক্ষে থাকেননি। তিনি বেছে নেন ছোট একটি কক্ষ যা আজও রাষ্ট্রপতির বাসকক্ষ। ওই শয়নকক্ষটি এখন অতিথিশালা।
দিল্লি আমাকে সব সময়েই রোমাঞ্চিত করে। মনে হয় এত বিশাল ইতিহাস যার পরিমাপ সম্পূর্ণভাবে এক জীবনে করা সম্ভব নয়। বিচিত্র ইতিহাস এই নগরীর। দিল্লির ইতিহাস প্রভাবিত করে রেখেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। লাহোর-দিল্লি-ঢাকা প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। মাঝে মধ্যে ভাবতেও অবাক লাগে কিভাবে দিল্লি হতে ১২০০ মাইল অতিক্রম করে কুতুবউদ্দিন আইবেকের সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি ১২০১ সাল হতে ১২০৪ সালের মধ্যে বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে বাংলার ভাগ্য দিল্লির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। সেই বন্ধন কি এখনো কেটেছে? মনে হয় না অন্তত ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে পিতা জাহাঙ্গীরের নামে তৈরি শহর জাহাঙ্গীরনগর আর পুত্র শাহজাহানের তৈরি শাহজাহানাবাদের সঙ্গে একটা বিশাল যোগসূত্র তো ইতিহাস স্বীকৃত। তবে পর্যায়ক্রমে সে যোগাযোগ যথেষ্ট শিথিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর এখন ঢাকা আর শাহজাহানাবাদ পুরাতন দিল্লি। অনেক স্মৃতি আর অনেক ইতিহাস এসব জায়গা দেখতে হলে যা প্রয়োজন তাহলো ঐতিহাসিক অনুভূতির।
(এই প্রবন্ধটি লেখকের অনবদ্য ভ্রমণ কাহিনী ‘কত জনপদ কত ইতিহাস’ হতে সংকলিত।)
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭
No comments