ওরা অসভ্যের মতো হামলে পড়েছিল by রুদ্র মিজান
ভিড় ঠেলে রিকশাটা এগুচ্ছিল। তখন অগণিত চোখের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে রিকশাযাত্রী দুই তরুণীর ওপর। রিকশায় দুই বোন তখন ভয়ে জড়সড়। ‘হুররে’ বলে রং ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে পথচারী, রিকশা আরোহী মেয়েদের ওপর। সুযোগ পেলেই হামলে পড়ছে তারা। হিংস্র ক্ষুধার্ত পশুদের মতো। মেয়েরা হাতজোড় করে মাফ চাচ্ছেন। ‘ভাই, আমাকে ছেড়ে দেন।’ চিৎকার করছেন। কাঁদছেন। রক্ষা পেতে দৌড়ে পালাচ্ছেন। কিন্তু রেহাই নেই। চারদিক ঘেরাও করে রাখা হচ্ছে। তারপর রং ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে পুরো শরীরে। জোর করেই জড়িয়ে ধরা হচ্ছে মেয়েদের। হাত দেয়া হচ্ছে তাদের শরীরে। একই কাণ্ড করছে একজনের পর আরেক জন বখাটে। প্রকাশ্যে। হাজার হাজার মানুষের সামনে রাস্তায় এভাবেই চলছিল আবির খেলার নামে নিপীড়ন। বাদ যাননি মধ্য বয়সী নারীরাও।
এমনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া ও তার ছোট বোন আনিকা (ছদ্মনাম)। গত সোমবার সূত্রাপুরের বাসা থেকে রিকশায় করে রায় সাহেব বাজার মোড়ের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাচ্ছিলেন তারা। সাদিয়া জানান, আবির খেলার নামে এরকম কিছু হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেননি তারা। রিকশাটি ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে পৌঁছলে ভয়ে কাঁপুনি শুরু হয়। প্রতিদিনের চেনা-জানা এই এলাকা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অসভ্যতায় মেতে উঠেছে কিছু তরুণ। যে কোনো বয়সের নারী দেখলেই তারা হামলে পড়ছে। সাদিয়ার ভাষায় ‘পশুরা যেভাবে শিকার পেলে উল্লাস করে ঠিক তেমনি ওরা নারী দেখলেই উল্লাস প্রকাশ করছিল। রং ছিটাচ্ছিলো। টেনে রিকশা থেকে নামাচ্ছিল।’ ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা পেরিয়ে রিকশাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতের পুরনো গেটের সামনে গেলে অন্তত আট থেকে ১০ জন বখাটে রিকশাকে ঘিরে ধরে। প্রথমে রং ছিটিয়ে দেয়া হয় তাদের ওপর। রিকশার মধ্যেই তাদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে নানাভাবে হাত বুলাতে থাকে। সাদিয়া ও আনিকা তখন কান্না করছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘ভাই আমাদের সঙ্গে এরকম করবেন না। আমাদের ছেড়ে দিন।’ কিন্তু তাদের কথা শুনছিল না কেউ। টেনে রিকশা থেকে নামানো হয় তাদের। যে যার মতো হামলে পড়ে। দুই বোনের চিৎকার ও বখাটেদের নগ্ন উল্লাস চলছিল। এরমধ্যেই জগন্নাথের দুই ছাত্র এগিয়ে যান। আপ্রাণ চেষ্টা করেন দুই তরুণীকে উদ্ধারের। একপর্যায়ে তাদের উদ্ধার করে আদালত সংলগ্ন পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে নিয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমানের কাছে যান দুই তরুণী। ঘটনার বর্ণনা দেন। এসপি শাহ মিজান শাফিউর রহমান কোতোয়ালি থানায় কল দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন। ততক্ষণে ফোনে খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন ওই দুই তরুণীর ভাই।
কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ ইসলাম জানান, নির্যাতিতা তরুণীরা তিন বখাটেকে শনাক্ত করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ বিষয়ে নির্যাতিতাদের ভাই বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন বলে জানান তিনি। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে, সিদ্দিকবাজার আলুবাজার এলাকার আকাশ, সিফাত ও শনির আখড়া এলাকার মামুন। গ্রেপ্তারকৃতরা ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত তা মঞ্জুর করেননি। বর্তমানে আসামিরা জেলহাজতে রয়েছে। এতে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
সোমবার সকাল থেকেই পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারী বাজার এবং লক্ষ্মীবাজার এলাকায় শুরু হয় আবির উৎসব। অফিসগামী এক তরুণী জানান, সকালে বাংলাবাজার এলাকা থেকে মতিঝিলের অফিসের উদ্দেশে বের হন তিনি। বাংলাবাজার পুস্তক ভবনের পাশে বখাটেরা ঘিরে ধরে তাকে। অনুনয় করেও রক্ষা পাননি এই তরুণী। তার পুরো শরীরে রং ছিটিয়ে দেয়া হয়। কান্নাকাটি করে অসহায়ের মতো বাসায় ফিরে যান তিনি। একইভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মধ্য বয়সী এক নারী। তিনি বলেন, তরুণরা প্রথমে তার রিকশা থামায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রং ছিটিয়ে দেয়া হয়। কয়েক বখাটে তার হাত টেনে ধরে নামানোর চেষ্টা করে। এসময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থান স্পর্শ করে বখাটেরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে বিভিন্ন বয়সের বহু নারী ওই দিন বখাটেদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সামাজিকতার কারণে থানা-পুলিশমুখো হননি তারা।
পুলিশের লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার মো. ইব্রাহিম খান বলেন, হলি উৎসবে পুলিশের যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো। এরমধ্যেই ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশ তৎপর ছিলো বলেই তিন বখাটে গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জানান তিনি।
No comments