ব্যবহারিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাকে যুক্ত করার পরামর্শ
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ও ভাষার বিকৃতি রুখতে কার্যকর সরকারি উদ্যোগ এবং এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া বক্তারা। একই সঙ্গে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ব্যবহারিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে শিক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগ’ শীর্ষক এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আলো ও এইচএসবিসি বাংলাদেশ যৌথভাবে এটি আয়োজন করে। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকের সঞ্চালক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ আলোচনার একটি রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি জানান, মার্চের প্রথম সপ্তাহে ১৩তম এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগ শুরু হবে। এ বৈঠকের ভেতর দিয়ে সেটার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো।
এটা এবারের ভাষা প্রতিযোগের উদ্বোধনী পর্ব। শুরুর আলোচনায় নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাষা সম্পর্কে সমাজ যদি সচেতন না হয়, তাহলে সরকার কিংবা রাষ্ট্র সচেতন হবে না। এখন আমাদের দেশে বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত, গায়েহলুদসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র লেখা হয় ইংরেজিতে। এর জন্য আমরা কাকে দোষ দেব?’ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাকিস্তান আমলেও রোমান হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করেছি। আর আজকাল ছেলেমেয়েরা রোমান হরফে বাংলা লিখছে। ভাষার এমন দুর্গতি কখনো দেখিনি। ভাষার আঞ্চলিক রূপ থাকবে, প্রমিত রূপও থাকবে। সমস্যাটা হচ্ছে মিশ্রণে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্মানিত ব্যক্তিরা যেসব ভাষা ব্যবহার করেন, সেখান থেকে সাধারণ মানুষ কী শিক্ষা নেবে?’ রফিকুল ইসলামের মতে, বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে এমন একটা হীনম্মন্যতাবোধ কাজ করছে, যেখানে মাতৃভাষার প্রতি যে শ্রদ্ধা থাকা উচিত, তা নেই। এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে এর থেকে উত্তরণের কোনো উপায় থাকবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম দানীউল হক বলেন, ‘ভাষা পরিকল্পনায় সাধারণত দুটি দিক থাকে। একটি হচ্ছে অবয়বগত পরিকল্পনা ও মর্যাদার পরিকল্পনা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে মর্যাদার দিকটা এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি।’
এ ক্ষেত্রে শিক্ষাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য অন্তত একটা নীতিমালা অথবা একটা নিয়ন্ত্রণ কমিটি তৈরির পরামর্শ দেন তিনি। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর ভাষ্য, বাংলা ভাষার এই দুরবস্থা আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে। এফ এম রেডিওগুলোতে বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে বিকৃত উচ্চারণে কথা বলা হচ্ছে। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে জগাখিচুড়ি হচ্ছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ কৃষক। অথচ সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের ব্যবহারবিধি বেশির ভাগই ইংরেজি অথবা কঠিন বাংলায় লেখা। সঠিক বাংলা শিক্ষার জন্য প্রথমেই নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি জানান তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষের (বাবাকো) অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা মো. মোস্তফা বলেন, ‘সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। গত বছরের মার্চ থেকে ফেসবুকে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ নামে একটি গ্রুপ খোলা আছে। সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের যেকোনো পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া দাপ্তরিক টেলিফোনেও অফিস সময়ে বাংলা ভাষা নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।’ এইচএসবিসি, বাংলাদেশের উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব-উর-রহমানের মতে, ভাষা কেবল শব্দচয়নের বিষয় নয়। এর ব্যাপ্তিটা আরও বড়। প্রথমেই জানার বিষয়টি পোক্ত করতে না পারলে এর যথার্থ প্রয়োগও সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলা না জানাটা কোনো স্মার্টনেস নয়, বরং বাংলা ভালো জানলে ইংরেজিটাও উন্নত হয়। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মনে করেন, বাংলা ভাষার ব্যবহারে সামাজিক সচেতনতার যে বিপর্যয়, তা কেবল আইন করে রক্ষা করা যাবে না। তিনি সাইনবোর্ডে নির্ভুল বানানের জন্য বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন। এ ক্ষেত্রে বানান ভুল হলে শাস্তির বিধান রাখার পরামর্শ দেন।
প্রথম আলোকে সারা বছর ভাষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করতে আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া সেলিনা হোসেন রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ উদ্ধৃত করেন। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনো দিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার কোনো স্থান নেই। কোনোভাবে ক্ষমতা আছে এমন একজনও বাংলায় পড়াশোনা করতে চায় না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজির দিকে ঠেলে দিয়েছি।’ উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলা ভাষার মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হবে না মন্তব্য করে মোহাম্মদ আজম আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যবহারিক দিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলা ভাষার ব্যবহার যুক্ত করতে হবে। বিষয়টির সঙ্গে সহমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, গত বছর ঈদে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ২২০টি নাটকের মধ্যে ১৭০টির নামই ছিল ইংরেজিতে। আর মুক্তিপ্রাপ্ত ১৭টি চলচ্চিত্রের মধ্যে এই সংখ্যা ১২। শাসকশ্রেণি বাংলাকে নিজের ভাষা মনে করে না। শিক্ষানীতির মতো সরকারের একটা ভাষানীতি থাকাও প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই এখন পর্যন্ত সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা যে শুধু সাম্রাজ্যবাদের শিকার তা নয়, যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁদেরও অবহেলার শিকার। ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে চিকিৎসাশাস্ত্র বাংলায় পড়ানো হয়েছে। ২০০ বছর আগে ইংরেজরা বাংলায় আইন তৈরি করেছে। তাহলে আমরা এখন কেন পারছি না?’ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলছি; সর্বস্তর বলতে প্রশাসন, শিক্ষাক্ষেত্র, আইন-আদালত, চিকিৎসাক্ষেত্র, কৃষিক্ষেত্র, সভা-সমিতি বোঝায়। যদি তা-ই হয়, তাহলে সরকারের এক মাসের সিদ্ধান্তে এটা হয়ে যেতে পারে, যদি কোনো সরকার সুস্পষ্টভাবে তা চায়।’ শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা ভাষা বিভিন্ন কালে বহু সময়ই আক্রমণের মুখে পড়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। সেসব সত্ত্বেও এ ভাষা টিকে আছে। নিজ ঐশ্বর্যের গুণেই বাংলা ভাষা টিকে থাকবে।
No comments