স্বর্ণালংকারের লোভেই শিশু দুটিকে হত্যা করেন লাকী!
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছোট্ট শিশু সুমাইয়া খাতুন (৭) ও মেহজাবিন আক্তারের (৬) কান ও গলায় থাকা সামান্য স্বর্ণালংকারের লোভে তাদের খুন করার কথা স্বীকার করেছেন লাকী আক্তার। তাদের হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা লাকী চাঁপাইনবাবগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে গতকাল বুধবার বিকেলে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এ কথা স্বীকার করেন। ওই ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে গত রোববার গ্রেপ্তার করা পাশের মহল্লা ঘোষপাড়ার গীতা রানি ঘোষের বাবা শম্ভু ঘোষের বাড়ির একটি ঘরে আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এ সময় আরেক ঘরের আসবাব ভাঙচুর করা হয়। ওই মহল্লাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় দুই শিশুর খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। আদালত সূত্র বলেছে, জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জুয়েল অধিকারীর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে লাকী আক্তার বলেন, শিশু দুটির কানে সোনার দুল এবং সুমাইয়ার গলায় সোনার চেইন ছিল। তাদের হত্যার পর তিনি সেগুলো ২১ হাজার টাকায় এলাকার এক স্বর্ণালংকারের দোকানে বিক্রি করেছেন। জবানবন্দি শেষে আদালত লাকীকে কারাগারে পাঠান। নিহত মেহজাবিনের দাদার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নামোশংকরবাটী ঝাপাইপাড়া মহল্লায়। গতকাল বিকেলে সেখানে ছিল অনেক নারী-পুরুষের ভিড়। কিছুক্ষণ আগে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ বাড়িতে আনা হয়েছে। তার মা তাজরিন বেগম বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘কেমন কইর্যাড় আমার দিন কাটবে। কোন প্রাণে হামার ধনকে (মেয়েকে) মারল, তার ফাঁসি না দেখা পর্যন্ত হামার কইলজ্যা ঠান্ডা হোইবে না।’ নামোশংকরবাটীর ভবানীপুর-ফতেপুর মহল্লায় নিহত সুমাইয়ার বাড়িতেও একই দৃশ্য। তার মা কুলসুম বেগমের (২৬) ভাবলেশহীন চেহারা, কথা বলছেন না। দাদি লুৎফন নেসা বললেন, কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। শোকে পাথর হয়ে গেছে। সুমাইয়া মিলন রানার মেয়ে ও পৌর এলাকার ছোটমণি বিদ্যানিকেতনের প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। সহপাঠী মেহজাবিন আবদুল মালেকের মেয়ে।
রোববার বেলা ১১টার দিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বাইরে খেলতে গিয়ে তারা দুজন নিখোঁজ হয়। ওই দিনই মেহজাবিনের বাবা সদর থানায় মামলা করেন। মঙ্গলবার প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজা শুরু করেন সুমাইয়ার স্বজনেরা। তাঁরা বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে প্রতিবেশী ভ্যানচালক মো. ইয়াসিনের বাড়িতে যান। ইয়াসিনের প্রবাসী ছেলে মো. ইব্রাহীমের স্ত্রী লাকী আক্তারের (২৪) অসংলগ্ন কথাবার্তায় সুমাইয়ার স্বজনদের সন্দেহ হয়। তাঁরা জোর করে লাকীর শোয়ার ঘরে ঢুকে খাটের নিচ থেকে সুমাইয়া ও মেহজাবিনের বস্তাবন্দী লাশ পান। খবর পেয়ে পুলিশ এসে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লাশ উদ্ধার করে। লাকীর মেয়ে ইমন ছিল সুমাইয়া ও মেহজাবিনের সহপাঠী, একসঙ্গে খেলত। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার লাকীর শ্বশুর ইয়াসিন (৬৫) ও শাশুড়ি তানজিলা খাতুন (৫০) পুলিশের হেফাজতে আছেন। শিশু দুটির লাশের ময়নাতদন্তের সঙ্গে যুক্ত সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, শিশু দুটিকে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। মেহজাবিনের লাশ গতকাল বিকেলে নামোশংকরবাটী ডিহিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। সুমাইয়ার বাবা দুবাইয়ে থাকায় তার লাশ সদর হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। দেশে ফেরার জন্য গতকাল দুপুরে তিনি রওনা দিয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার টি এম মোজাহিদুল ইসলাম সন্ধ্যায় তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, লাকী আক্তার ঋণগ্রস্ত ছিলেন। পাওনাদারেরা তাঁকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এ জন্য তিনি শিশু দুটিকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন এবং তাদের স্বর্ণালংকারগুলো খুলে নিয়ে বিক্রি করেন।সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলাম বলেন, লাকী শিশু দুটির স্বর্ণালংকার যে দোকানে বিক্রি করেছেন, তা শনাক্ত করা হয়েছে। দোকানিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আরেক শিশুর বস্তাবন্দী লাশ নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের বিলকরিল্যা গ্রাম থেকে গতকাল বিকেলে মুরাদ হোসেন (১২) নামের একটি শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে ওই গ্রামের আবদুর রাজ্জাক মোল্লার ছেলে। তাকে হত্যায় জড়িত অভিযোগে রাজ্জাকের দ্বিতীয় স্ত্রী অঞ্জনা বেগমকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় অঞ্জনাকে আসামি করে মান্দা থানায় হত্যা মামলা করেছেন শিশুটির চাচা আতাউর রহমান। মান্দা থানার ওসি আনিছুর রহমান বলেন, মনে হচ্ছে মুরাদকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে লাশ পাটের বস্তায় ভরে প্রতিবেশী এনামুলের বাড়ির পাশে এক গলিতে ফেলে রাখা হয়। অঞ্জনার ছয় বছর বয়সী ছেলে অনিকও পুলিশকে বলেছে, তার মা মুরাদকে গলা টিপে মেরেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নওগাঁ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। মুরাদের পারিবারিক সূত্র বলেছে, মুরাদ মঙ্গলবার সকালে উপজেলার গোয়ালমান্দা গ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে যায়। সেখান থেকে গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ি ফেরে। এরপর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। বেলা দুইটার পর গলিতে পড়ে থাকা একটি বস্তা খুলে স্থানীয় লোকজন মুরাদের লাশ দেখেন।
No comments