ইসরায়েলের জেরুজালেম গ্রাসের পাঁয়তারা
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়াতে উদ্বিগ্ন হয়নি এমন দেশ পৃথিবীজুড়ে দু–একটি আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসরায়েল। কিন্তু আমেরিকায় প্রচারণা আছে যে ট্রাম্প ইহুদিবিদ্বেষী। তিনি হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ হিসেবে যে ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছেন, সেই স্টিফেন ব্যানন শুধু শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীই নন, প্রচণ্ড ইহুদিবিদ্বেষীও বটেন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযান দলের নেতৃত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যানন ‘ব্রেইটবার্ট নিউজ’ নামে যে অনলাইন পোর্টাল পরিচালনা করতেন, সেখানে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে। তাই ট্রাম্প যখন তাঁকে হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ হিসেবে নিযুক্ত করেন, তখন আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো ইহুদি সংগঠনগুলোর অন্যতম অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ তার প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ফলে আমেরিকার ইহুদিবিরোধী সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলো ভীষণ উৎসাহিত হয়েছে—এমন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু একটা ধন্দ সৃষ্টি হয়েছে এ কারণে যে ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন। এই প্রতিশ্রুতির মানে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেম নগরকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মেনে নেবেন। এটা আসলে ইসরায়েলের সরকারের আকাঙ্ক্ষা; দেশটির ইহুদিবাদী দল, সংগঠন ও ব্যক্তিরাও এই স্বপ্ন দেখেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস, প্রাচীন ফিলিস্তিনের যে ভূখণ্ডে তাঁরা একটা রাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন, সেই ভূমি তাঁদের দান করেছেন স্বয়ং ঈশ্বর। জেরুজালেম তাঁদের পবিত্রতম নগর এবং ওই নগরটিই হবে তাঁদের রাষ্ট্রের ‘শাশ্বত ও অবিভক্ত রাজধানী’ (এটারনাল অ্যান্ড আনডিভাইডেড ক্যাপিটাল)। কিন্তু জেরুজালেম শুধু ইহুদিদের নয়, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদেরও। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস, জেরুজালেমেই যিশুর প্রয়াণ ও পুনরুত্থান ঘটেছিল।
ওই নগরের বিভিন্ন স্থানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেসব স্থান খ্রিষ্টানদের কাছে অতি পবিত্র বলে বিবেচিত। জেরুজালেমে খ্রিষ্টানরা অনেক গির্জা নির্মাণ করেছেন, সেগুলোর অন্যতম হলো দ্য চার্চ অব রেজারেকশন। মুসলমানদের কাছে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের স্থান পবিত্র কাবা শরিফের পরেই। আল-আকসাই ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। সংক্ষেপে, ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম—এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই জেরুজালেম নগরের পবিত্রতা ও গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। এই জেরুজালেমকে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চাওয়া হয়, তখন এর ওপর খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ধর্মবিশ্বাসগত অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। ইহুদি ধর্মবিশ্বাসের দাবিকেই একমাত্র সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এই চেষ্টা এ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, এর প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন নেই। পৃথিবীর বড় ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েল রাষ্ট্রের অনেক অন্যায়-অবিচার দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে বটে, কিন্তু জেরুজালেমকে রাজধানী করার মধ্য দিয়ে ওই নগরের ওপর ইসরায়েলের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যায্য আকাঙ্ক্ষার প্রতি তাদের সমর্থন নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশের দূতাবাস ইসরায়েলের আছে, সেগুলোর সবই রাজধানী তেল আবিবে অবস্থিত। ট্রাম্পের আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের কথা বলেননি। নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের এই প্রতিশ্রুতি উচ্চারণের পেছনে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের খুশি করার চেষ্টা। দেশটির ইহুদিবাদী সংগঠনগুলোর কোনো কোনো ভাষ্যকার লিখেছেন, ট্রাম্প আসলে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদিবিরোধী। কিন্তু এটা তিনি লুকাতে চান ইসরায়েল রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রতি সমর্থন জানানোর মধ্য দিয়ে।
এই ভাষ্যকারেরা মনে করেন, ইসরায়েলের রাজনীতির প্রতি সমর্থন জানালেই ট্রাম্পের ইহুদিবিদ্বেষ ক্ষমা পেতে পারে না। তাঁর নীতি ও পদক্ষেপগুলোর ইসরায়েলের পক্ষে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদিদের জন্য তিনি ক্ষতিকর। ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ইসরায়েলে দূতাবাস স্থানান্তরের প্রসঙ্গ তোলেননি। সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, বিষয়টা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের এক দিন পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানান। সে সময় নেতানিয়াহু ইসলামি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো ও ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে অনুরোধ করেন, কিন্তু দূতাবাস স্থানান্তরের বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে এ মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। টেলিফোনে ট্রাম্প দূতাবাস স্থানান্তরের বিষয়টি উত্থাপন করেননি বলে নেতানিয়াহু সম্ভবত হতাশ হয়েছেন। তারপর তিনি আগবাড়িয়ে একটা উসকানিমূলক কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের প্রসঙ্গটির প্রতি ইঙ্গিত করে নেতানিয়াহু টুইটারে লেখেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সঠিক। আমি ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে একটা প্রাচীর তুলেছি। তারপর সব অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। বিরাট সাফল্য। দারুণ ভাবনা।’
নেতানিয়াহু সম্ভবত ভেবেছিলেন, তাঁর এই উসকানিতে উৎসাহিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবেন, ‘আমরা শিগগিরই আমাদের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিচ্ছি।’ কিন্তু না। সে রকম কিছু ঘটেনি। বরং নেতানিয়াহু নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। মেক্সিকোর সরকার ভীষণ খেপে গিয়ে ইসরায়েলকে দুঃখ প্রকাশ করতে বললে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট দুঃখ প্রকাশ করেন। ট্রাম্পকে বলা হচ্ছে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ প্রেসিডেন্ট—কখন কী বলবেন বা করবেন, তার ঠিক নেই। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা আছে। কোনো কোনো পত্রিকা লিখেছে, জেরুজালেম থেকে দূতাবাস ওইখানে স্থানান্তর করার প্রস্তুতি চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডেভিড ফ্রিডম্যান নামের যে ব্যক্তিকে ইসরায়েলে নতুন রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছেন, তিনি একজন আমেরিকান ইহুদি, জেরুজালেম নগরে তাঁর বাসা আছে এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করার পর তিনি জেরুজালেমের ওই বাসাতেই বাস করবেন। শেষমেশ ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস যদি জেরুজালেমেই স্থানান্তর করা হয়, তাহলে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও মুসলিম জাহানের ‘শক্তিধর’ সরকারগুলো কী করবে? নেতানিয়াহু যেদিন ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন, সেদিনই জর্ডানের রাজধানী আম্মানে বাদশা আবদুল্লাহর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলছিলেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রসঙ্গই ছিল তাঁদের প্রধান আলোচ্য। বাদশা আবদুল্লাহ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং মাহমুদ আব্বাসকে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই জেরুজালেমে দূতাবাস সরিয়ে নেয়,
তাহলে জর্ডান সরকার কয়েকটা গুরুতর পদক্ষেপ নেবে। পদক্ষেপগুলো কী, সংবাদমাধ্যম তা জানতে পারেনি। তবে বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, জর্ডান ইসরায়েল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেবে, ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডানের যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেটা স্থগিত করে নিরাপত্তা-সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে। ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী বৃহৎ দেশ মিসরও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের পরিকল্পনার খবরে ভীষণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেদ শুকরি এটাকে ‘ভেরি ইনফ্লেইমেবল ইস্যু’ বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলে উঠতে পারে। উল্লেখ করা দরকার, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শুধু জর্ডান আর মিসরের সঙ্গেই ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি আছে। দুটি দেশের সঙ্গেই ইসরায়েলের সীমান্ত আছে এবং এ দুই দেশের সরকার, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্তসীমান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। জর্ডান ও মিসর যুক্তরাষ্ট্রেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র। আবার দুনিয়ায় যত সহিংসতাই ঘটুক না কেন, ইসরায়েলের ভেতরে যে মোটামুটি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় আছে, সেখানে যে আইএস, আল-কায়েদা ও অন্য সশস্ত্র মুসলিম গোষ্ঠীগুলো হামলা চালাতে পারে না, তার পেছনে জর্ডান ও মিসরের অবদান কম নয়।
এখন যদি ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে জর্ডান ও মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি ও নিরাপত্তা-সহযোগিতার ব্যবস্থাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে, তাহলে ওই অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়বে। কিন্তু তার চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হলে ওই নগরকে ইসরায়েলের রাজধানী করার ইসরায়েলি দাবির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে ‘প্রকাশ্য’ সমর্থন ব্যক্ত হবে, তার ফলে জেরুজালেমের ওপর ফিলিস্তিনিদের দাবি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন, এমনকি অসম্ভবও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটাই ফিলিস্তিনিদের শেষ দাবি এবং এটা ঐতিহাসিক কারণে অত্যন্ত ন্যায্য দাবি। তারা দশকের পর দশক ধরে জমি হারাচ্ছে। তাদের পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইসরায়েল সরকার ঘোষণা করেছে, পূর্ব জেরুজালেমে তারা আরও ৬০০ বসতি স্থাপন করবে। ইসরায়েলের জেরুজালেম গ্রাস করার এই পাঁয়তারা এবং তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের ইন্ধন প্রতিহত করা দরকার। কিন্তু কী উপায়ে তা করা যেতে পারে, জানি না। বিভক্ত ও পরস্পরের প্রতি শত্রুমনোভাবাপন্ন, ষড়যন্ত্রপ্রবণ আরব রাষ্ট্রগুলো কি এবার একজোট হবে? সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত কি ইরানকে সঙ্গে নিয়ে এককাট্টা হয়ে এবার প্রতিবাদে সোচ্চার হবে? রাশিয়া, চীন, ভারত—এই বৃহৎ শক্তিগুলোরও কি কোনো কর্তব্য নেই?
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
mashiul.alam@gmail.com
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments