যেভাবে ফ্লোরিডা জয়-পরাজয় গড়ে দিল
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডা আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গত চারটি নির্বাচনে ফ্লোরিডা যেদিকে গিয়েছে, হোয়াইট হাউস সেদিকেই ঝুঁকেছে। এবার অভিবাসীদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে আশা করা হয়েছিল, অভিবাসী-অধ্যুষিত এ অঙ্গরাজ্যটি বিপুল ভোটে ট্রাম্প-টিকিটকে প্রত্যাখ্যান করবে। ফ্লোরিডার মোট ভোটারের প্রায় ১৬ শতাংশ ল্যাটিনো, যাঁদের ভোট নির্বাচনের ফলাফলে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছিল। নির্বাচনের কয়েক দিন আগেও বিভিন্ন জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটন তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। বিশেষ করে হিস্পানিকদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে হিলারি ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে রেকর্ড ৩০ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, ততই জনমত জরিপগুলো এ অঙ্গরাজ্যে দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছিল। এর মূল কারণ ছিল, অভিবাসী ভোটাররা যতই হিলারি ক্লিনটনের দিকে ঝুঁকছিল, শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা ততই ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে জোট বাঁধছিল। এক অর্থে গণমাধ্যমে হিলারি ক্লিনটনের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতে থাকাই ডোনাল্ড ট্রাম্প-সমর্থকদের সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে।
এ প্রবণতাটি হিলারি শিবির আঁচ করতে পারেনি। আর গণমাধ্যমেও এর পূর্বাভাস আসেনি। এটি ছিল শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের অঘোষিত কিন্তু সংকল্পবদ্ধ প্রয়াস। আরেকটি বিষয় হলো আর্লি ভোটিংয়ে ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য প্রকাশ পাওয়ায় ভোটের দিন রিপাবলিকান, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা ব্যাপক হারে ভোটকেন্দ্রে জড়ো হন। ফলে যতই গ্রামাঞ্চলের ভোটের ফলাফল আসা শুরু করেছিল, ততই ডোনাল্ড ট্রাম্প আর্লি ভোটিংয়ে পিছিয়ে পড়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে জয়ী হওয়ার পথে এগিয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি এ অঙ্গরাজ্যের ২৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট বাগিয়ে নেন। ফ্লোরিডায় গত কয়েক দিনে যা দেখলাম, তা থেকে এ অঙ্গরাজ্যটিকে সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে স্বতন্ত্র মনে হয়েছে। নিরন্তর ছোট ছোট জাহাজের ভোঁ, মাথার ওপর দিয়ে যখন-তখন কপ্টারের শোঁ শোঁ, সবুজ পামগাছ—সব মিলিয়ে মনে হবে মার্কিন আদবকায়দার হুড়োহুড়ি থেকে এ বুঝি আলাদা৷ হবে না–ইবা কেন? ফ্লোরিডা সবার আদরের ‘সানশাইন স্টেট’ অর্থাৎ সূর্যালোকের রাজ্য, যেখানে তা কখনো চুরি যায় না৷ তাই শীত পড়লেই এ রাজ্যে ভিড় বাড়ে মার্কিনিদের। আর ভোটের সময় প্রার্থীদের। তাঁদের কাছেও এটা সানশাইন স্টেটই বটে৷ কারণ, এ রাজ্যের ভোট যাঁর ঝুলিতে যাবে, তাঁর মোটামুটি হোয়াইট হাউসে যাওয়া নিশ্চিতই। ঠিক যেভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলেন মার-আ-লাগো রিসোর্টের অধিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ফ্লোরিডার খেটে খাওয়া মানুষ ও অবসরপ্রাপ্ত শ্বেতাঙ্গের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে ভোট দিলেন এই ধনকুবেরকে। ভোটের মাত্র দুদিন আগে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বলেছিলেন,
হিলারি যদি ফ্লোরিডা জিততে পারেন, তাহলে তিনিই হবেন প্রেসিডেন্ট৷ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে সে কথা৷ ফসকে গেল ফ্লোরিডা, ফসকে গেলেন হিলারি৷ প্রমাণ হয়ে গেল, আমেরিকার ‘উত্তর প্রদেশ’ নিয়ে কেন রক্তচাপ ওঠা–নামা করে সব প্রার্থীর৷ ভারতে যেমন একটা কথা চালু আছে—উত্তর প্রদেশ যঁার, দেশ তঁার৷ তাই ভোটের প্রায় এক বছর আগে থেকে সেখানে রাজনীতিক নেতা-নেত্রীদের আনাগোনা বেড়ে যায়৷ কখনো কখনো মনে হতে পারে, সেখানে বুঝিবা উত্তর প্রদেশ ছাড়া কোনো রাজ্যই নেই৷ ফ্লোরিডাও তেমন৷ প্রাইমারি হোক বা মূল ভোট, প্রার্থীরা এখানে পড়ে থাকেন৷ যিনিই ভোটে দাঁড়ান, তঁার কাছেই এটা হয়ে ওঠে ‘সেকেন্ড হোম’৷ প্রচারপর্বে ট্রাম্প এই একটিমাত্র রাজ্যেই নিজের প্রফেশনাল ক্যাম্পেইন টিমকে কাজে না লাগিয়ে দলের সাহায্য নিয়েছিলেন৷ রিপাবলিকান পার্টির অন্যতম ভরসা সুজি ওয়াইলস দায়িত্ব নিয়েছিলেন ট্রাম্পের প্রচারের৷ তাঁর দলের অনেকে এতে আপত্তি করেছিলেন৷ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘এ রকম একটা লোকের জন্য কেন তিনি কাজ করছেন?’ ওয়াইলস বলেছিলেন, তাতে তাঁর কিছুই যায়-আসে না৷ তাঁর দল জিতল কি না, সেটাই বড়৷ ট্রাম্পের থেকে একেবারেই বিপরীত মেরুতে অবস্থান৷ তা–ও ৮ নভেম্বর রাত এগারোটা নাগাদ যখন ঘোষণা হলো, ‘ফ্লোরিডায় ট্রাম্প জিতে গিয়েছেন’, তখন সবচেয়ে উল্লসিত বোধ হয় ওয়াইলসই হয়েছিলেন। তাঁর তিন বছরের পরিশ্রম সফল হয়েছে। নহ্যাঁ, একেবারেই তাই৷ তিন বছর ধরে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ও আস্থা অর্জনের কাজটা করে গিয়েছেন রিপাবলিকানরা। ট্রাম্প যতই রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকুন,
তিনি বিলক্ষণ জানতেন—এই অদ্ভুত ‘দোল খাওয়া রাজ্য’ যদি ঝুলিতে না আসে, তাহলে আর টাকার জোরে ভোটে দাঁড়ালেও ওভাল অফিসে ঢোকা হবে না৷ ফলে এখানে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে কোনো ভুল করেননি৷ ব্যক্তিগত প্রচার কমিটিকে দূরে সরিয়ে এখানে দলের সাহায্য চান, পানও। অর্থাৎ উর্বর জমির ওপর ট্রাম্প বীজ পুঁততে থাকেন৷ যার নিট ফল, মায়ামি-দাদে ছাড়া আর কোথাও জিততে পারেননি ক্লিনটন। কোথাও বিশাল ব্যবধানে, কোথাও আবার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছেন ট্রাম্পই৷ মায়ামিতে যেমন ৫ লাখ ৭২ হাজার ভোট পেয়েছেন হিলারি, তেমনই ট্যাম্পায় ২ লাখ ২৩ হাজার ভোটে জিতেছেন ট্রাম্প৷ এবার প্রশ্ন হলো, কেন বারবার চরিত্র বদলায় ফ্লোরিডা? সে জন্য তাকাতে হবে এখানকার জনসংখ্যার দিকে৷ মূলত শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণি, অবসরপ্রাপ্ত শ্বেতাঙ্গ, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিকদের বসবাস এই রাজ্যে৷ অর্থাৎ বাসিন্দাদের প্রত্যেকেরই রোজগারের কথা ভাবতে হয়, দেশের অর্থনৈতিক ওঠা-নামা, কর্মসংস্থান বাড়া-কমা, শ্রমিক ছাঁটাই প্রভৃতি তাঁদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ ২০০৮ সালে লেহম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার পরে বিশ্বজুড়ে যে মন্দার সূচনা হয়েছিল, তার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিল এই ফ্লোরিডা৷ তা সত্ত্বেও ওবামার ওপর ভরসা রেখে ২০১২ সালে ফের তাঁকেই জেতান ফ্লোরিডাবাসী। কিন্তু হিলারির ওপর সে আস্থা তঁারা রাখতে পারলেন না। তাই এই রাজ্যে প্রচারের জন্য ৮১টি অফিস তৈরি করেও হিলারি থেকে গেলেন দ্বিতীয় স্থানে৷ এক-চতুর্থাংশ বা ১ লাখ ৩৪ হাজার বেশি ভোট পেয়ে জিতে গেলেন ট্রাম্প৷ ফ্লোরিডার ইলেকশন বোর্ডের হিসাব বলছে, এখানে ৬৪ শতাংশ রেজিস্টার্ড শ্বেতাঙ্গ ভোটার আছেন, যার সিংহভাগ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প, পুরুষ-মহিলানির্বিশেষে।
তাই হিস্পানিকদের ১৩ শতাংশ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ১৬ শতাংশ ভোটের বেশির ভাগটা হিলারি পেলেও কাজ হয়নি৷ এমনকি বহু হিস্পানিককে বলতে শোনা গেছে, ‘একবার সুযোগ দিয়ে দেখতে চাই!’ ভোট পণ্ডিতদের মত, হিলারি বুঝতেই পারেননি, তিনি যখন এই রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও একদা শরণার্থী হয়ে আসা মানুষের ভোট নিশ্চিত করতে ব্যস্ত, তখন শ্বেতাঙ্গদের নিজের পকেটে পুরে ফেলেছেন ট্রাম্প৷ সে জন্য তাঁর আলাদা অফিসেরও দরকার হয়নি। হিসাব বলছে, ট্রাম্প মোট ১৭ বার এ রাজ্যে প্রচারে এসেছেন৷ প্রতিবারই তিনি একটা কথা বলেছেন, ‘খেটে খাওয়া মানুষকে ভুলে রয়েছে এ সরকার৷ আপনাদের জন্য কিছু করবে না ডেমোক্র্যাটরা৷ আমাকে একটা সুযোগ দিন। দেখুন, কীভাবে বদলে দিই আপনাদের জীবন!’ দিনের শেষে তিনি একজন দুঁদে শিল্পপতি৷ বিশাল বিশাল হোটেল থেকে শুরু করে গলফ কোর্স—সবই রয়েছে তাঁর৷ তিনি মানুষের ‘পালস’ বুঝতে পারবেন না, তা কি হয়? ফলে সঠিক সময়ে তিনি সঠিক জায়গায় টোকা মেরেছেন৷ এমনকি নিউইয়র্কে তাঁর হোটেলে কাজ করা মেক্সিকানরা পর্যন্ত বলেছেন, ‘আমরা তাঁকেই ভোট দেব৷ কিন্তু উনি আমাদের তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ দেননি!’ এঁদের প্রত্যেকেই ফ্লোরিডার বাসিন্দা৷ সবাই প্রায় ‘আর্লি ভোটিং’ করেছিলেন৷ অর্থাৎ ই-মেইলে ব্যালটে নিজের ভোট আগেই দিয়ে এসেছিলেন। এ বছর ফ্লোরিডায় এই ভোটারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ভোট পোস্টাল ব্যালটে হয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,
আর্লি ভোটে সুবিধা করতে পারেননি হিলারি৷ এর প্রায় পুরোটাই পেয়েছেন ট্রাম্প৷ ২৯টি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট রয়েছে ফ্লোরিডায়৷ সেই ভোট অধিকাংশ সময়ই নির্ধারক হয়ে ওঠে৷ ৫৬ বছরের ইতিহাসে এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না৷ এ-ও এক ইতিহাস৷ ১৯৮০ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যান হেরে গিয়েছিলেন ফ্লোরিডায়৷ কিন্তু প্রবেশ করতে পেরেছিলেন হোয়াইট হাউসে। তারপর এ ঘটনা আর কখনো ঘটেনি৷ এমনকি ২০০৪ সালে বুশ-আল গোরের লড়াইয়ে বুশ ফ্লোরিডা জেতেন মাত্র ২ হাজার ভোটে৷ দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যান৷ এবারও ব্যতিক্রম হলো না৷ মানুষ দেখল, বিতর্কের শীর্ষে থাকা একজন শিল্পপতি কীভাবে পৌঁছে যেতে পারেন ওভাল অফিসে৷ রাজনীতিকদের কাছে ‘সংকেত’ হয়ে ওঠা ফ্লোরিডাবাসী কিন্তু নিজেদের এই চরিত্রে দারুণ খুশি। নইলে কি আর ভোটের পরের দিন একদল তরুণ হিলারি-সমর্থক চিত হয়ে শুয়ে রোদের আদর খেতে খেতে বলেন, ‘এটা তো সূর্যশিখার রাজ্য৷ সব সময়ই উজ্জ্বল! এবার রিপাবলিকানদের জন্য হয়েছে, পরেরবার আমাদের হবে! এখানে এভাবেই উদয়-অস্ত হয়৷’ নেই আফসোস, নেই দুঃখ, নেই হতাশা৷ মেক্সিকো উপসাগরের শাখা-উপশাখা দিয়ে ঘিরে থাকা এই জলাভূমি তাই যেন অবলীলায় বজায় রাখে অদ্ভুত এক নিরপেক্ষতা, যাকে ফি বছর আলেয়ার মতো ধাওয়া করতে হয় রাজনীতিকদের৷
রোজিনা ইসলাম: সাংবাদিক।
রোজিনা ইসলাম: সাংবাদিক।
No comments