আসিয়ান সম্মেলনে চীনের দাপট
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান সম্মেলনে নিজের শক্তিমত্তা দেখাল উদীয়মান পরাশক্তি চীন। চীনের কূটনীতির কারণে এ সম্মেলনে দক্ষিণ চীন সাগর বিতর্ক নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। অথচ আসিয়ানের সদস্য বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের তীব্র বিরোধ রয়েছে। এমনকি এ ইস্যুতে এ অঞ্চলে যুদ্ধের আশংকাও করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। বস্তুত বর্তমানে ভূ-রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত ইস্যু দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ামুখী কূটনীতি শুরুর পর এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। বেড়েছে উত্তেজনাও। চীন বিশ্বের অন্যতম এই ব্যস্ত সাগরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে হেগের সালিশি আদালতের রায়ে এই সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের একাধিপত্যকে বাতিল করে দেয়ায় উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আশা করে হয়েছিল যে আসিয়ান সম্মেলনে এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু। কিন্তু তা হয়নি। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কোনো উত্তেজনা আছে বলে আসিয়ান নেতাদের ভাষণে মনে হয়নি। লাওসের রাজধানী ভিয়েনতিয়েনে বৃহস্পতিবার সম্মেলনের ঘোষণাপত্রেও সচতুর শব্দ চয়নের মাধ্যমে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। শুধু বলা হয়, দক্ষিণ চীন সাগরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আসিয়ান নেতারা ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’।
সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে জুলাইয়ের হেগের আদালতের রায়কে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়। হেগের আন্তর্জাতিক সালিশ আদালত বলেছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কিছু কৃত্রিম দ্বীপ অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া এই সাগরে চীনের মালিকানার দাবিকে প্রায় পুরোপুরি নাকচ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথ দিয়ে বছরের ৫ লাখ কোটি ডলারের পণ্য পরিবাহিত হয়। এমন একটি বিষয়কে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর হলেও এজন্য চীনের দাপুটে কূটনীতিকে দায়ী করা হয়েছে। আসিয়ানের নিয়ম অনুসারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে সর্বসম্মতভাবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন লাওস ও কম্বোডিয়াকে ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে কোনো কড়া অবস্থান বা বিবৃতি দিতে দেয়নি। আসিয়ানের অন্যতম সদস্য তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের বিরোধ রয়েছে। তা সত্ত্বেও বুধবার আসিয়ান নেতাদের সঙ্গে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের বৈঠক মসৃণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে অবশ্য চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী চীন। এ ইস্যুকে যথাযথভাবে সামাল দিতে চায় চীন। এজন্য বাইরের হস্তক্ষেপ দরকার নেই।
বাইরের হস্তক্ষেপ বলতে স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছে। চীন এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধী। তবে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুকে ফের সামনে নিয়ে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি তার দেশের কূটনীতিতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এশিয়াকে। ওবামা বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের মালিকানা দাবির কোনো আইনি ভিত্তি নেই বলে হেগের আদালত যে রায় দিয়েছেন তা মেনে চলা অপরিহার্য। চীন বলছে, তারা ওই রায় মানে না। লাওসে আসিয়ান নেতাদের উদ্দেশে ভাষণে ওবামা বলেন, ‘জুলাইয়ের ঐতিহাসিক সালিশের রায় বাধ্যতামূলক। এটা এ অঞ্চলে সমুদ্রসীমা অধিকারকে ব্যাখ্যা করেছে। আমি স্বীকার করছি ওই রায় উত্তেজনা বাড়িয়েছে। কিন্তু কীভাবে উত্তেজনা কমিয়ে গঠনমূলকভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং কূটনীতি ও স্থিতিশীলতাকে বিকশিত করা যায় আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি।’ ওবামার ভাষণে চীন যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা স্পষ্ট। ওবামার ভাষণের আগেই ফিলিপাইন কিছু ছবি প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায় যে দক্ষিণ চীন সাগরের স্কারবোরো সোয়ালে নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু করেছে চীন। বেইজিং অবশ্য এ দাবি অস্বীকার করেছে। ওই এলাকাটি ফিলিপাইনের মূল ভূখণ্ড থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে। ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর সঙ্গে এক বিরোধের পর ২০১২ সালের সোয়াল দখল করে নেয় চীন।
No comments