ভালো লাগা কৌতুকগুলো by আনিসুল হক

আজ ঠিক করেছি, শুধুই হাসিঠাট্টা করব। শুধুই কৌতুক বলব। এবং সব আমার স্টক থেকে। মানে, স্মৃতি থেকে তুলে আনব আমার সবচেয়ে পছন্দের কৌতুকগুলো। আমার পছন্দের কৌতুকগুলোর মধ্যে আছে সোভিয়েত কৌতুক আর বুশ কৌতুক। একবার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ গেছেন ছাগলের খামার পরিদর্শনে। তিনি কয়েকটা ছাগলের সঙ্গে ফটো তুললেন। পরের দিনের প্রাভদা পত্রিকায় সেই ছবি বের হলো। নিচে ছবির পরিচিতি, ‘পাঁচটা ছাগলের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ। বাঁ থেকে তৃতীয়।’ ইদানীং কোরবানির পশুর সঙ্গে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তা দেখে হঠাৎ করে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, সেলফিটা কে তুলেছে? সেলফিটা আসলে কার?
আমি হয়তো একটা ছাগলের সঙ্গে ছবি তুলে ছবি–পরিচিতি দিতে পারি, ছাগলের সঙ্গে আমি, বাঁ থেকে দ্বিতীয়। সোভিয়েত কৌতুকের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো পুশকিনের ভাস্কর্যের কৌতুকটি, যে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন স্তালিন। প্রস্তাব করা হলো, পুশকিনের একটা ভাস্কর্য স্থাপিত হবে। শিল্পী মডেল বানালেন। পুশকিন বসে নিজের লেখা কবিতার বই পড়ছেন। তখন পর্যালোচনা করে বলা হলো, এটা বেশি ভাববাদী হয়ে যাবে। পুশকিন বরং স্তালিনের লেখা বই পড়ুক। সেই ভাস্কর্য নির্মাণ চলছে। তখন হঠাৎ মনে হলো, পুশকিনের আমলে স্তালিন ছিলেন না, স্তালিনের কোনো বইও ছিল না। এটা ইতিহাসের ব্যত্যয় হয়ে যায়। তাহলে কী করা যায়। ইতিহাসের ভুল সংশোধন করা হলো। এবার মূর্তিটা দাঁড়াল, স্তালিন পুশকিনের বই পড়ছেন। তখনো আবার সমালোচনা হলো।
স্তালিন কবিতা পড়ছেন, এটাও ভাববাদী হয়ে যাবে। ভুল বার্তা দেবে জনগণকে। চূড়ান্তভাবে মূর্তিটা বানানো হলো। স্তালিন স্তালিনের লেখা বই পড়ছেন। এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র বুশের কৌতুক। বুশ গেছেন ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে দেখা করতে। রানিকে তিনি বললেন, আপনারা রাজ্য চালান কী করে। রানি বললেন, বুদ্ধি দিয়ে।
কী রকম?
এই যে দেখো, আমার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছি, আচ্ছা টনি বলো তো, একটা ছেলে, সে তোমার বাবার ছেলে, সে তোমার মায়ের ছেলে, তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই, ছেলেটা কে?
টনি ব্লেয়ার বললেন, আমি। রানি বললেন, দেখলে বুশ। টনি কত বুদ্ধিমান। এই রকম বুদ্ধি দিয়েই আমরা দেশটা চালাই। বুশ দেশে ফিরে গেলেন। মন্ত্রীদের ডাকলেন। বললেন, বলো দেখি একটা ছেলে, সে তোমার বাবার ছেলে, সে তোমার মায়ের ছেলে, তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই, ছেলেটা কে?
পুরো মন্ত্রিসভা স্তব্ধ হয়ে গেল। এই কঠিন প্রশ্নের জবাব কারও জানা নেই। এই সময় কলিন পাওয়েল এলেন। তিনি বুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বুদ্ধিমান বলে গণ্য। বুশ তাঁকে বললেন, আচ্ছা পাওয়েল বলো তো, একটা ছেলে, সে তোমার বাবার ছেলে, সে তোমার মায়ের ছেলে, তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই, ছেলেটা কে?
কলিন পাওয়েল বললেন, আমি।
বুশ বললেন, হয় নাই। সঠিক উত্তর: টনি ব্লেয়ার।
বুশ গেছেন স্বর্গের দুয়ারে।
তাঁকে আটকে দিল স্বর্গের দ্বাররক্ষক। আপনার পরিচয় দিন।
বুশ বললেন, আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, আমি কেন পরিচয় দেব, সবাই চেনে আমাকে। দ্বাররক্ষক বলল, একটু আগে আইনস্টাইন এসেছিলেন। তাঁকে বললাম, আপনি যে আইনস্টাইন, তার প্রমাণ দিন। তিনি লিখলেন, ই ইজ ইকুয়াল টু এমসি স্কয়ার। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, বুঝেছি বুঝেছি, আপনি আইনস্টাইন, দয়া করে ভেতরে ঢুকুন। এরপর এলেন পাবলো পিকাসো। তিনি তাঁর বিখ্যাত কবুতরটা আঁকলেন। আর সাইন করে দিলেন। আমি বললাম, স্যার আমি আপনাকে চিনেছি। আপনি পিকাসো। ভেতরে ঢুকুন। আর আপনাকে আর পরিচয় দিতে হবে না।
বুশ বললেন, আইনস্টাইন, পিকাসো—এরা আবার কারা?
দ্বাররক্ষক বলল, বুঝেছি বুঝেছি, আপনিই প্রেসিডেন্ট বুশ। আপনি ভেতরে যেতে পারেন।
বুশের কৌতুক কি বেশি পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প জোকস শুনতে চান?
আচ্ছা, যদি রোনাল্ড রিগ্যানের মতো ট্রাম্পেরও আলঝেইমার রোগ হয়, তাহলে কী হবে? কী আর হবে, ট্রাম্প এখনকার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যাবেন।
এইবার একটা সত্য ঘটনা।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী।
একজন চাষির ছেলে এসেছে বরিশাল থেকে, চাকরির জন্য।
তুমি কী পারো?
জি?
লেখাপড়া করেছ?
জি না।
গাড়ি চালাতে পারো?
জি না।
রান্নাবান্না করতে পারো?
জি না।
ঘাস কাটতে পারো?
জি না।
কিছুই পারো না?
জি না। তাহলে তোমাকে আর কী চাকরি দেব? তোমাকে তো মন্ত্রী বানানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না। আর আব্রাহাম লিংকনেরসমস্যাটার কথাও আপনাদের আগে বলেছি। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সবাই তাঁকে ঘিরে ধরল, তারা মন্ত্রী হতে চায়। তখন আব্রাহাম লিংকন একটা গল্প বললেন। এক রাজা। তিনি যাচ্ছেন শিকারে। রাজাকে আবহাওয়ামন্ত্রী বলল, আবহাওয়া ভালো। ঝড়বৃষ্টি নাই। আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। রাজা যাচ্ছেন। এই সময় একটা চাষা বলল, সামনে যাবেন না। সামনে ঝড়বৃষ্টি হবে। এখানেই তাঁবু গেড়ে অপেক্ষা করুন। সত্যি সত্যি ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। তখন রাজা ওই চাষাকে আবহাওয়ামন্ত্রী বানালেন। তারপর শুধালেন, আপনি কী করে বুঝলেন, সামনে ঝড়বৃষ্টি আছে?
চাষা বলল, আমার গাধা যখন কান নাড়ে, তখন ঝড়বৃষ্টি হয়। সেভাবে বুঝেছি। রাজা বললেন, তাহলে আর আপনাকে মন্ত্রী রাখব কেন? গাধাটাকেই তো আমি মন্ত্রী বানাতে পারি। রাজনীতিবিদদের নিয়ে কৌতুক করা সোজা। কারণ, তাঁরা কৌতুক শুনলে রেগে যান না। অন্য পেশাজীবীদের নিয়ে কৌতুক করা মুশকিল। কারণ, তাঁরা প্রতিবাদ করেন। হ‌ুমায়ূন আহমেদ তাঁর বহুব্রীহি নাটকে একজন ডাক্তারকে বেশ বোকাসোকা দেখিয়েছিলেন। আফজাল হোসেন সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটক প্রচারের পর ডাক্তাররা নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া এক পেশাজীবী ঘুষ খান, এটা লেখার পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। পৃথিবী অনেক দূরদর্শী মহানুভব অগ্রসর চিন্তার নেতাও পেয়েছে। টমাস জেফারসন ১৮০১ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারবিহীন সংবাদপত্র আর সংবাদপত্রবিহীন সরকারের মধ্যে আমি প্রথমটা বেছে নেব। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়; অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.