তাঁর আলো, তাঁর ছায়া
তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু তার শিক্ষকতার আলো আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল। একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। এভাবেই তিনি বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষিতজনের মাঝে। আর আমরা যারা তার কাছাকাছি হতে পারিনি তারা দূর থেকেই জেনে গিয়েছিলাম তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষক। এমন নয় যে, কেউ নিয়ম করে এটি তৈরি করেছিল; এমন নয় যে, কেউ উদ্যোগ নিয়ে বলেছিল, চলো আমরা তাকে মহৎ বানাই। ব্যাপারটি ঘটেছিল আপনাআপনি, স্বাভাবিক নিয়মে। যেভাবে বেড়ে ওঠে বৃক্ষ কিংবা বয়ে যায় নদী, সেভাবে। যেন এটাই হওয়া উচিত ছিল, তাই সেটাই হয়েছে। শিক্ষকতার সাফল্য তাকে বয়ে নিয়ে গেছে সর্বত্র নদীর মতো, যে নদীর তীরে গড়ে ওঠে সভ্যতা। তাকে আমাদের নদীর মতোই মনে হতো। তার দু’পাশে গড়ে উঠেছিল শিক্ষার সভ্যতা। এমন অহংকার একজন মানুষের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। গ্রিক পুরাণে একটি নদী আছে। সে নদীর নাম স্টিক্স। এ নদীতে খেয়া পারাপার করতেন যে বৃদ্ধ মাঝি তার নাম ক্যারন। তিনি ছিলেন অন্ধকারের দেবতা এরিবাসের পুত্র, ক্যারনের কাজ ছিল মৃতের আত্মাকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যাওয়া। প্রাচীন গ্রিসে প্রচলিত নিয়ম ছিল, মৃতদেহের মুখে পয়সা গুঁজে রেখে দিতে হতো।
বিশ্বাস ছিল এমন যে, মৃতদেহের আত্মা যে প্রয়োজনমতো ক্যারনকে ঘুষ দিতে পারে। জীবিত কাউকে স্টিক্স নদী পার করে দেয়ার অনুমতি ছিল না ক্যারনের। কিন্তু কেউ কেউ গায়ের জোরে তাকে দিয়ে পারাপার নিত। যেমন বীর হারকিউলিস গায়ের জোরে ক্যারনকে বেঁধে রেখে স্টিক্স নদী পার হন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন শিক্ষক মোহাম্মদ নোমানের সুতিচারণ করতে গিয়ে আমার গ্রিক মিথের ক্যারন মাঝির কথা মনে হল। ক্যারন মাঝি ছিল শান্তির প্রতীক। মৃতের আত্মাকে পৌঁছে দিত আরেক জগতে। কিন্তু তার সঙ্গেও সন্ত্রাস করতে দ্বিধা করেনি বীর হারকিউলিস। প্রশ্নের উত্তর এখানে যে, ক্যারনরূপী শান্তির দূত মোহাম্মদ নোমানকে হারকিউলিসের মতো সন্ত্রাসীদের দেখতে হয়েছে তার শান্তিপূর্ণ শিক্ষাঙ্গনে। তিনি তো মাঝিই ছিলেন। নিরক্ষতার জগৎ থেকে শিক্ষার আলোর জগতে নিয়ে যেতেন শিক্ষার্থীদের। তাকে কেন সন্ত্রাসী দেখতে হবে? কেন তিনি সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের সামনে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? দেখলেন কী বীভৎসভাবে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে জ্ঞানের জগৎ। শিক্ষক মোহাম্মদ নোমানের এ তাণ্ডব দেখা আমার কাছে প্রচণ্ড দুঃখ ও বিষাদের। ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পদক পেয়েছিলেন তিনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য তিনি একুশে পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু এটাই একজন শিক্ষকের বড় পুরস্কার নয়। এটা কর্মজীবনের সফলতার এক ধরনের স্বীকৃতি,
তা শিক্ষকের হৃদয়কে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত করে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তবু ভাবি, শিক্ষকতার যে মান তিনি নির্ধারণ করেছিলেন সেটাই তার নিজের কাছে নিজের বিচার। এ আনন্দটুকু নিয়ে তিনি দু’চোখ বুজেছেন। আমার আনন্দ অন্যত্র। অল্প সময়ের জন্য হলেও আমি তাকে পেয়েছি আমার প্রতিষ্ঠানে। ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলা একাডেমিতে সচিব হিসেবে এসেছিলেন। বাংলা একাডেমির সচিব পদে বাইরে থেকে একজন শিক্ষাবিদকে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম প্রচলিত ছিল। কিন্তু সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলেও তিনি তথাকথিত আমলা হননি। তিনি শিক্ষকতার মূল্যবোধের ভিত্তিতে সবার সঙ্গে আচরণ করেছেন। স্নেহপ্রবণ দৃষ্টিতে দেখেছেন কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। আর শিক্ষকের মানসিকতায় দেখেছেন প্রশাসনকে। অন্য সচিবদের সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য। প্রশাসনিক আচরণের সঙ্গে তার মানবিক বোধের কোনো বিরোধ ছিল না। প্রশাসনের জটিলতা-কুটিলতার ঊর্ধ্বে, ক্ষুদ্রতা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন পূর্ণ মানুষ। বাংলা একাডেমিতে তার সময়ে আমি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত শান্ত, সৌম্য, স্নিগ্ধ কোনো মানুষের মুখের কথা মনে করতে হলে আমার মনে পড়ে মোহাম্মদ নোমানের কথা। কেউ কেউ এমনই হন। যারা পর্যাপ্ত আলো বিকীরণ করেন এবং তাদের ছায়ায় দাঁড়াতে পারলে ধন্য হয় অন্যরা।
সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক
সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক
No comments