পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের নিয়ে ভোটের রাজনীতি by রজত রায়
পশ্চিমবঙ্গে গরীব ও বঞ্চিতদের সিংহভাগই মুসলিম : অমর্ত্য সেন |
পশ্চিমবঙ্গের
জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলমান, তাই রাজ্য রাজনীতিতে মুসলমানদের
ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের দলে ভেড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর
মধ্যে টানাটানিও অব্যাহত। ভোটের রাজনীতির অঙ্ক সম্পর্কে যাঁরা মোটামুটি
ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন যে মুসলমানদের সমর্থন পেলে পশ্চিমবঙ্গে ভোটযুদ্ধে
জেতা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বামফ্রন্টের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের
একটা বড় অংশের সমর্থন তাদের দিকে ছিল। কিন্তু ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়
থেকে সংখ্যালঘুরা বামফ্রন্টের দিক থেকে যেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তূণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে পড়ল, মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ও পরপর জয় পেতে শুরু করলেন। এই অবস্থায় মুসলমানদের মন জয়
করতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাদের নিয়ে দড়ি-টানাটানির প্রতিযোগিতায় উগ্র
হিন্দুবাদী বিজেপি ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দলই যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে আশ্চর্য
কী!
সাধারণ হিসাবে, এতে যখন যে রাজনৈতিক দলই লাভবান হোক না কেন, সংখ্যালঘু মুসলমানদের লাভ হওয়া উচিত ছিল সর্বাধিক। শিক্ষায়, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে মুসলমানদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরের ব্যবধানে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের প্রতিবেদন ও অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্টের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের অবস্থার এতটুকু উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।
প্রতীচী প্রতিবেদনের চিত্রটা এ রকম: পশ্চিমবঙ্গে যেখানে গড়পড়তা প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ১০ দশমিক ৬টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, সেখানে মুসলমানপ্রধান তিন জেলা মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে এই হার যথাক্রমে মাত্র ৭ দশমিক ২, ৮ দশমিক ৫ ও ৬ দশমিক ২। ৬ থেকে ১৪ বছরের মুসলমান ছেলেমেয়েদের ১৫ শতাংশই স্কুলে যায় না। তাদের মধ্যে ৯ দশমিক ১ শতাংশ স্কুলে ভর্তিই হয়নি আর বাকিরা ভর্তি হলেও পরে ঝরে পড়েছে। তাদের এক-তৃতীয়াংশ মনে করে, স্কুলে গিয়ে তাদের আখেরে কোনো লাভ হবে না।
বড়দের অবস্থাও শোচনীয়। গ্রামবাংলার মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বেসরকারি ক্ষেত্রে নিয়মিত বেতনের চাকরি করছেন। সরকারি ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১ শতাংশ। অন্তত ১৩ দশমিক ২ শতাংশ মুসলমানের ভোট দেওয়ার জন্য আবশ্যিক পরিচয়পত্র নেই। ১২ দশমিক ২ শতাংশ মুসলমান পরিবারের বাড়ি পয়ঃপ্রণালির সঙ্গে যুক্ত নয়, যদিও রাজ্যে গড়ে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িতে তা আছে। আর্থিক উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার ক্ষেত্রেও মুসলমানরা পিছিয়ে। গোটা রাজ্যে যেখানে এই হার গড়ে ৩২ শতাংশ, সেই জায়গায় মুসলমানদের ক্ষেত্রে মাত্র ১৯ শতাংশ।
মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার ব্যাখ্যা কী? গণতন্ত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো তো সমাজের বিভিন্ন অংশের সমর্থন আদায় করতে তাদের উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবে, তাতে নাগরিকদেরই লাভ হবে। অমর্ত্য সেনসহ বহু গুণীজনই সংসদীয় গণতন্ত্রের এই ইতিবাচক দিকের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর কিছু সুফলও দেখা গিয়েছে। যেমন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অরণ্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বনাঞ্চল অধিকার আইন (ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট) করেছে। এ ছাড়া শিক্ষা, খাদ্য, কাজ ও তথ্যের অধিকারও তৈরি হয়েছে। একাধিক রাজ্য মেয়েদের (বিশেষ করে গরিব পরিবারের মেয়েদের) স্কুলে আসতে উৎসাহ দিতে নানা আর্থিক প্রকল্প চালু করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও ছাত্রীদের জন্য কন্যাশ্রী প্রকল্প বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। তাহলে মুসলমানদের উন্নতির দিকটি বারবার অবহেলিত হচ্ছে কেন? বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর মতো অনেকেই লক্ষ করেছেন, এর পেছনে মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর (দলমত-নির্বিশেষে) দীর্ঘদিনের লালিত কিছু ধারণা কাজ করছে। যেমন: এক. মুসলমান সমাজের মধ্যে কোনো স্তরভেদ বা বিভাজন নেই। তারা সবাই মোটামুটি একভাবে চিন্তা করে। দুই. মুসলমান সমাজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেন মৌলভিরা। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানরা তাঁদের মৌলভিদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন।
এই ধারণাগুলো যে ঠিক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, মুসলমান সমাজ কখনই একভাবে কোনো নির্দিষ্ট দিকে ভোট দেয়নি। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বেশি সংখ্যায় বামপন্থীদের ভোট দিলেও মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গের দুই মুসলমানপ্রধান জেলা মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে কংগ্রেসের পাশে থেকেছে। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বামপন্থীদের কাছ থেকে সরে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে সমর্থন করলেও ওই তিন জেলায় কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য থেকে সরে আসেনি। আবার উর্দুভাষী মুসলমান ও বাঙালি মুসলমানদের দুটি পৃথক সমাজ। বাংলাভাষী মুসলমানদের সিংহভাগই গ্রামবাসী, কৃষিজীবী বা নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। অবাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই শহরবাসী, শিল্পাঞ্চলে কাজ করেন। এঁরা ভোটও দেন নিজের মতো করে।
কিন্তু এসব হিসাব অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য তেমন কোনো কাজ না করে তাদের ‘মাথা’দের দলে টানার চেষ্টাই চালিয়ে গেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই মসজিদের ইমামদের মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা ও মুয়াজ্জিনদের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা বিশেষ সরকারি ভাতা চালু করেছেন। হাইকোর্ট এটাকে বৈষম্যমূলক কাজ বলে আপত্তি করলেও ঘুরিয়ে ওয়াক্ফ বোর্ডের হাত দিয়ে ভাতা দেওয়া চলছে। এ কাজের পেছনে সরকারের হিসাবটা স্পষ্ট, যেন ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিলেই গোটা মুসলমান সমাজের ভোট এসে যাবে। এ ছাড়া মমতা মুসলমানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে ফুরফুরা শরিফের পীর ত্বহা সিদ্দিকি বা কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতির মতো কিছু ধর্মগুরুর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করা, তাঁদের সঙ্গে এক মঞ্চ ব্যবহার করে জনসভা করা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঈদের আগে তিনি নিজেও রোজা রাখার কথা বলছেন, ইফতার পার্টি দিচ্ছেন, মুসলমানদের জনসভায় গেলে কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকছেন এবং জনতার উদ্দেশে কিছু প্রচলিত আরবি শব্দও ছুড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে লেখক ও সাবেক আইপিএস অফিসার নজরুল ইসলাম বিরক্ত হয়ে একাধিক বই লিখে প্রকাশ করেন। ওসব বইয়ে তিনি দাবি করেন, মমতা ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসলমানদের ভাঁওতা দিচ্ছেন। তা ছাড়া তিনি মুসলমানদের অনুকরণে যেসব কথা অর্থ না বুঝে বলছেন, তা হাস্যকর হয়ে উঠছে।
মমতা এখন মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয়দের। ইতিমধ্যে তিনি জমিয়াত উলেমা এ হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর হাত ধরে সংখ্যালঘুদের একটি দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেছেন। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর দলের দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় গ্রামাঞ্চলে কিছু প্রভাব থাকলেও এখনো একা লড়ে নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখেননি। ২০১৩ সালে সিদ্দিকুল্লা বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের কড়া সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন। তারও আগে বাম জামানার শেষ পর্যায়ে তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা শুরু করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইদ্রিস আলী, যিনি এখন বসিরহাট থেকে তূণমূল কংগ্রেসের হয়ে ভোটে জিতে লোকসভায় গিয়েছেন। মমতার দলের আরেক নেতা আহমেদ হাসান ইমরান রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোপনে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করেন। অতীতে নিষিদ্ধ সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার (সিমি) এই নেতা চিট ফান্ড সংস্থা সারদা থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গোপনে বাংলাদেশে জামায়াতিদের হাতে তুলে দিয়েছেন কি না, তা দেখতে তদন্ত চলছে।
সাধারণ হিসাবে, এতে যখন যে রাজনৈতিক দলই লাভবান হোক না কেন, সংখ্যালঘু মুসলমানদের লাভ হওয়া উচিত ছিল সর্বাধিক। শিক্ষায়, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে মুসলমানদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরের ব্যবধানে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের প্রতিবেদন ও অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্টের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের অবস্থার এতটুকু উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।
প্রতীচী প্রতিবেদনের চিত্রটা এ রকম: পশ্চিমবঙ্গে যেখানে গড়পড়তা প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ১০ দশমিক ৬টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, সেখানে মুসলমানপ্রধান তিন জেলা মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে এই হার যথাক্রমে মাত্র ৭ দশমিক ২, ৮ দশমিক ৫ ও ৬ দশমিক ২। ৬ থেকে ১৪ বছরের মুসলমান ছেলেমেয়েদের ১৫ শতাংশই স্কুলে যায় না। তাদের মধ্যে ৯ দশমিক ১ শতাংশ স্কুলে ভর্তিই হয়নি আর বাকিরা ভর্তি হলেও পরে ঝরে পড়েছে। তাদের এক-তৃতীয়াংশ মনে করে, স্কুলে গিয়ে তাদের আখেরে কোনো লাভ হবে না।
বড়দের অবস্থাও শোচনীয়। গ্রামবাংলার মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বেসরকারি ক্ষেত্রে নিয়মিত বেতনের চাকরি করছেন। সরকারি ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১ শতাংশ। অন্তত ১৩ দশমিক ২ শতাংশ মুসলমানের ভোট দেওয়ার জন্য আবশ্যিক পরিচয়পত্র নেই। ১২ দশমিক ২ শতাংশ মুসলমান পরিবারের বাড়ি পয়ঃপ্রণালির সঙ্গে যুক্ত নয়, যদিও রাজ্যে গড়ে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িতে তা আছে। আর্থিক উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার ক্ষেত্রেও মুসলমানরা পিছিয়ে। গোটা রাজ্যে যেখানে এই হার গড়ে ৩২ শতাংশ, সেই জায়গায় মুসলমানদের ক্ষেত্রে মাত্র ১৯ শতাংশ।
মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার ব্যাখ্যা কী? গণতন্ত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো তো সমাজের বিভিন্ন অংশের সমর্থন আদায় করতে তাদের উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবে, তাতে নাগরিকদেরই লাভ হবে। অমর্ত্য সেনসহ বহু গুণীজনই সংসদীয় গণতন্ত্রের এই ইতিবাচক দিকের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর কিছু সুফলও দেখা গিয়েছে। যেমন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অরণ্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বনাঞ্চল অধিকার আইন (ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট) করেছে। এ ছাড়া শিক্ষা, খাদ্য, কাজ ও তথ্যের অধিকারও তৈরি হয়েছে। একাধিক রাজ্য মেয়েদের (বিশেষ করে গরিব পরিবারের মেয়েদের) স্কুলে আসতে উৎসাহ দিতে নানা আর্থিক প্রকল্প চালু করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও ছাত্রীদের জন্য কন্যাশ্রী প্রকল্প বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। তাহলে মুসলমানদের উন্নতির দিকটি বারবার অবহেলিত হচ্ছে কেন? বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর মতো অনেকেই লক্ষ করেছেন, এর পেছনে মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর (দলমত-নির্বিশেষে) দীর্ঘদিনের লালিত কিছু ধারণা কাজ করছে। যেমন: এক. মুসলমান সমাজের মধ্যে কোনো স্তরভেদ বা বিভাজন নেই। তারা সবাই মোটামুটি একভাবে চিন্তা করে। দুই. মুসলমান সমাজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেন মৌলভিরা। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানরা তাঁদের মৌলভিদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন।
এই ধারণাগুলো যে ঠিক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, মুসলমান সমাজ কখনই একভাবে কোনো নির্দিষ্ট দিকে ভোট দেয়নি। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বেশি সংখ্যায় বামপন্থীদের ভোট দিলেও মুর্শিদাবাদ ও উত্তরবঙ্গের দুই মুসলমানপ্রধান জেলা মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে কংগ্রেসের পাশে থেকেছে। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে দক্ষিণবঙ্গে মুসলমানরা বামপন্থীদের কাছ থেকে সরে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে সমর্থন করলেও ওই তিন জেলায় কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য থেকে সরে আসেনি। আবার উর্দুভাষী মুসলমান ও বাঙালি মুসলমানদের দুটি পৃথক সমাজ। বাংলাভাষী মুসলমানদের সিংহভাগই গ্রামবাসী, কৃষিজীবী বা নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। অবাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই শহরবাসী, শিল্পাঞ্চলে কাজ করেন। এঁরা ভোটও দেন নিজের মতো করে।
কিন্তু এসব হিসাব অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য তেমন কোনো কাজ না করে তাদের ‘মাথা’দের দলে টানার চেষ্টাই চালিয়ে গেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই মসজিদের ইমামদের মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা ও মুয়াজ্জিনদের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা বিশেষ সরকারি ভাতা চালু করেছেন। হাইকোর্ট এটাকে বৈষম্যমূলক কাজ বলে আপত্তি করলেও ঘুরিয়ে ওয়াক্ফ বোর্ডের হাত দিয়ে ভাতা দেওয়া চলছে। এ কাজের পেছনে সরকারের হিসাবটা স্পষ্ট, যেন ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিলেই গোটা মুসলমান সমাজের ভোট এসে যাবে। এ ছাড়া মমতা মুসলমানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে ফুরফুরা শরিফের পীর ত্বহা সিদ্দিকি বা কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতির মতো কিছু ধর্মগুরুর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করা, তাঁদের সঙ্গে এক মঞ্চ ব্যবহার করে জনসভা করা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঈদের আগে তিনি নিজেও রোজা রাখার কথা বলছেন, ইফতার পার্টি দিচ্ছেন, মুসলমানদের জনসভায় গেলে কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকছেন এবং জনতার উদ্দেশে কিছু প্রচলিত আরবি শব্দও ছুড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে লেখক ও সাবেক আইপিএস অফিসার নজরুল ইসলাম বিরক্ত হয়ে একাধিক বই লিখে প্রকাশ করেন। ওসব বইয়ে তিনি দাবি করেন, মমতা ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসলমানদের ভাঁওতা দিচ্ছেন। তা ছাড়া তিনি মুসলমানদের অনুকরণে যেসব কথা অর্থ না বুঝে বলছেন, তা হাস্যকর হয়ে উঠছে।
মমতা এখন মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয়দের। ইতিমধ্যে তিনি জমিয়াত উলেমা এ হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর হাত ধরে সংখ্যালঘুদের একটি দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেছেন। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর দলের দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় গ্রামাঞ্চলে কিছু প্রভাব থাকলেও এখনো একা লড়ে নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখেননি। ২০১৩ সালে সিদ্দিকুল্লা বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের কড়া সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন। তারও আগে বাম জামানার শেষ পর্যায়ে তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা শুরু করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইদ্রিস আলী, যিনি এখন বসিরহাট থেকে তূণমূল কংগ্রেসের হয়ে ভোটে জিতে লোকসভায় গিয়েছেন। মমতার দলের আরেক নেতা আহমেদ হাসান ইমরান রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোপনে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করেন। অতীতে নিষিদ্ধ সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার (সিমি) এই নেতা চিট ফান্ড সংস্থা সারদা থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গোপনে বাংলাদেশে জামায়াতিদের হাতে তুলে দিয়েছেন কি না, তা দেখতে তদন্ত চলছে।
পশ্চিমবঙ্গে গরীব ও বঞ্চিতদের সিংহভাগই মুসলিম : অমর্ত্য সেন |
আসলে
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ সম্পর্কে সত্যিকারের ধারণা গড়ে তোলার বদলে সহজে
নিজেদের জন্য ভোট সংগ্রহকেই মূল উদ্দেশ্য করে তোলায় মুসলমান সমাজের কতিপয়
নেতাকে তুষ্ট রাখার মধ্যেই রাজনৈতিক দল ও সরকার নিজেদের ইতিকর্তব্য শেষ
করছে। ফলে সাচার কমিশনের প্রতিবেদনের ১০ বছর পরেও প্রতীচী ট্রাস্টের
প্রতিবেদন দেখে অমর্ত্য সেনকে বলতে হচ্ছে, এ রাজ্যে মুসলমানরা অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments