দয়া করে সার্টিফিকেট থেকে মুক্তি দিন! by মলয় ভৌমিক
মধ্যবয়সী
এক ভদ্রমহিলা আমার রবীন্দ্র কলাভবনের কক্ষে এলেন। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার
ছাপ। সঙ্গে তাঁর এইচএসসি পাস ছেলে। এসেছেন মেহেরপুর থেকে। সময়টা গেল বছরের
আগস্ট মাস। প্রথম বর্ষ সম্মান ভর্তি পরীক্ষার মাস দুই আগের ঘটনা। কথায় কথায়
জানতে পারি, ভদ্রমহিলা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠীর স্ত্রী। এসেছেন
সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে একটা সুপরামর্শ পেতে। আগের বছর
চেষ্টা করেও ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি। এসএসসি ও এইচএসসি
পরীক্ষায় যথেষ্ট ভালো ফল করেছে। নানা কোচিং সেন্টার, নামকরা সব প্রাইভেট
টিউটরের কাছ থেকে প্রশ্ন দাগিয়ে নেওয়া, ছেলেকে নিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে বেড়ানো, বিপুল অর্থ ব্যয়েও কোনো কার্পণ্য
করেননি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের
বছরের প্রার্থীর আবেদনের সুযোগ নেই। কাজেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ই শেষ
ভরসা।
আমি কী পরামর্শ দেব? আমার বন্ধুর সন্তানকে আরও ‘ভালো’ কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিতে বলব? অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। একপর্যায়ে হঠাৎ করেই আমি আমার সহপাঠীর স্ত্রীকে বলে ফেলি: ভর্তি পরীক্ষার এখনো কিছুদিন বাকি, আপনি দয়া করে আপনার ছেলেটিকে একা চলতে দিন! এরপর ছেলেটিকে জানাই, আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিনেও বাবা অথবা মায়ের সন্তানের সঙ্গে যাওয়ার চল ছিল না। অভিভাবক আর কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করে তুমি তো একবার ব্যর্থ হয়েছ, সবকিছু দূরে ঠেলে এবার অন্তত নিজের ওপর ভরসা রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে পার কি? আমার কথায় ছেলেটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেও মা খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেন না। বলা বাহুল্য, মা এবং সন্তান কেউই আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
মাস ছয়েক আগের ওই ঘটনাটি আমার নতুন করে মনে পড়ল গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবর দেখে। প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম ছিল ‘স্কুল-কলেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোচিং সেন্টার’। বগুড়া সদর উপজেলার খবর। সেখানে স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ১৯৮টি। আর কেবল লাইসেন্স পাওয়া কোচিং সেন্টারের সংখ্যাই ৩৬০। এ ছাড়া রয়েছে ‘প্রাইভেট হোম’ বা ব্যক্তি শিক্ষকের বাড়ি, যেখানে একসঙ্গে একদল (ব্যাচ) শিক্ষার্থী গিয়ে পড়তে পারে। সন্দেহ নেই, বগুড়া সদরের ওই খবরটি সারা দেশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ সব স্থানের চিত্র একই।
শিক্ষার্থীরা কেবল তাদের অভিভাবকদের ওপর নয়, নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে কোচিং সেন্টারগুলোর ওপরও। স্কুলের পাঠদান যথেষ্ট কি না অথবা স্কুলগুলোতে কী পড়ানো হয়—এসব নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তুলছেন না। কোচিং সেন্টারের অপরিহার্যতা এখন সমাজ স্বীকার করেই নিয়েছে। নির্ভরশীলতার শেষটা অবশ্য এখানেই নয়, এরপর রয়েছে বিষয়ভিত্তিক প্রাইভেট টিউটর, নোট বা গাইড বই এবং সর্বোপরি নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক লেখাপড়া। ক্রমাগত পরনির্ভর করে ফেলার এই মোক্ষম উপাদানগুলো একজন শিক্ষার্থীর ওপর কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করছে, তার বর্ণনাও পাওয়া যায় বগুড়ার ওই খবরটিতে।
আমার নিকট আত্মীয়ের এক সন্তানের কথা জানি। ওই সন্তানটিকে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে জাগানো হয়। একের পর এক শিক্ষকের বাড়ি ঘুরিয়ে তাকে পাঠানো হয় স্কুলে। সেখান থেকে কোচিং সেন্টার হয়ে অন্য শিক্ষকদের বাড়ি। দুপুরের পর থেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সন্তানটি। সন্ধ্যার আগে ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। আধা ঘুমের মধ্যে রাত ১১টা নাগাদ যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন স্কুল-পোশাক না খুলেই বিছানায় এলিয়ে পড়ে সে। তাকে খাওয়ানোও কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায়ও মা তাকে পরদিনের প্রস্তুতির কথা শুনিয়ে চলেন। পড়ার আতঙ্কে সন্তানটি ঘুমের ঘোরেও কোনো একজন শিক্ষকের দেওয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে শুরু করে। সূর্য ওঠার আগে ঘুম ভাঙলেও এই সন্তানটি সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পায় না। বিকেলে খেলার মাঠ তাকে ডাক দিয়ে যায়, কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই তার। এভাবে প্রকৃতি-গাছপালা-প্রাণিজগৎ, সমাজ-বন্ধু-স্বজন থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার উত্তর কিন্তু মা-বাবারও জানা নেই। এসব ঘটনা সহ্যের অতীত। কিন্তু সন্তানটিকে তা সহ্য করতেই হয়। কেননা, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তারই মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া ‘গোল্ডেন এ প্লাস’-এর স্বপ্ন।
এত দিন এই চাপটা বেশি ছিল কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীর ওপর। ইদানীং পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা চালুর কল্যাণে এখন তা শিশুদের ওপরও আছর করেছে। হাতেনাতে এ ধরনের আছরের ফল পেতে অবশ্য বিলম্ব হয়নি। ফলাফল জানান দেওয়া হয়েছে খোদ সরকারের সর্বশেষ ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদনে’। প্রতিবেদনটির চুম্বক অংশ গত মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ছাপাও হয়েছে। এর মূল কথা হলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। ‘সৃজনশীল’ বোঝার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবস্থা যখন এ রকম, তখন শিক্ষার্থীরা কতটা সৃজনশীল হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবকে সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু নিজে সৃজনশীল না হলে কি সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝা সম্ভব? নির্ভরশীলতা আর সৃজনশীলতার অবস্থান তো বিপরীতমুখী। বিরাজমান সমাজবাস্তবতায় সৃজনশীল হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়? নতুন প্রজন্মের শিক্ষকেরা এই বাস্তবতা থেকেই উঠে আসা।
আজকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কাজটা করে দিচ্ছেন অভিভাবক, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার আর গাইড বই। শিক্ষার চাহিদার বাইরে অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্যও শিক্ষার্থীকে প্রায় কিছুই করতে হচ্ছে না। প্রায় সব সমাধানই সে পেয়ে যাচ্ছে প্যাকেজ আকারে। প্রকৃতি-সমাজ-মানুষের মুখোমুখি হওয়ারও তার বালাই নেই। অর্থাৎ সে কোনো কিছুই তার চারপাশের বাস্তবতাকে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে ৩৪ বছর ধরে প্রতিবছর এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ বিদ্যাপীঠে আগমন লক্ষ করছি। এই বিদ্যার্থীদের নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার চর্চায় যুক্ত আছি গত ৩৮ বছর। থিয়েটারের স্থানটি অনেক বেশি সৃজনশীল। কিন্তু বছর যত পেরোচ্ছে হতাশার পাল্লা তত ভারী হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তারা নিজে থেকে প্রায় কিছুই করতে পারে না। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সবাই ভীষণভাবে নির্ভরশীল। তারা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো ঠিকঠাক দেখতে পায় না। ইতিহাস, ঐতিহ্য-সমাজ-দেশ-মানুষ সম্পর্কেও তাদের ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়। অথচ সার্টিফিকেট বলছে তারা ‘মেধাবী’।
মেধার সার্টিফিকেট-সংক্রান্ত একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। গল্পটি একটি নাটকের। মুখে খোঁচা দাঁড়ি আর মলিন পোশাকে এক ভদ্রলোক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকলেন। বললেন: স্যার আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেননি। ১৫ বছর আগে আমি এই বিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে যাই। ওই সময়ে আমি ছিলাম বিদ্যালয়ের সব থেকে মেধাবী ছাত্র।
মেধাবী কথাটি শুনে প্রধান শিক্ষক তাঁর ছাত্রটিকে চিনতে পারেন। চা-বিস্কুট খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁকে বাধা দিয়ে ভদ্রলোক পুনরায় বলতে থাকেন: না স্যার, আমি চা খেতে আসিনি। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করি। এরপর গত সাত-আট বছর বিভিন্ন স্থানে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খাপ খাওয়াতে পারিনি কোথাও। বুঝেছি, এমন কিছু আমি শিখিনি, যা দিয়ে বাস্তবকে মোকাবিলা করা যায়। আমি ব্যর্থ হয়েছি স্যার। আমার জীবনে আপনাদের দেওয়া সার্টিফিকেটের আর কোনো মূল্য নেই। তাই আমি এসেছি সার্টিফিকেট ফেরত দিতে। দয়া করে এই সার্টিফিকেটটি গ্রহণ করে আমাকে মুক্তি দিন!
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
আমি কী পরামর্শ দেব? আমার বন্ধুর সন্তানকে আরও ‘ভালো’ কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিতে বলব? অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। একপর্যায়ে হঠাৎ করেই আমি আমার সহপাঠীর স্ত্রীকে বলে ফেলি: ভর্তি পরীক্ষার এখনো কিছুদিন বাকি, আপনি দয়া করে আপনার ছেলেটিকে একা চলতে দিন! এরপর ছেলেটিকে জানাই, আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম দিনেও বাবা অথবা মায়ের সন্তানের সঙ্গে যাওয়ার চল ছিল না। অভিভাবক আর কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করে তুমি তো একবার ব্যর্থ হয়েছ, সবকিছু দূরে ঠেলে এবার অন্তত নিজের ওপর ভরসা রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে পার কি? আমার কথায় ছেলেটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেও মা খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেন না। বলা বাহুল্য, মা এবং সন্তান কেউই আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
মাস ছয়েক আগের ওই ঘটনাটি আমার নতুন করে মনে পড়ল গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবর দেখে। প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম ছিল ‘স্কুল-কলেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোচিং সেন্টার’। বগুড়া সদর উপজেলার খবর। সেখানে স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ১৯৮টি। আর কেবল লাইসেন্স পাওয়া কোচিং সেন্টারের সংখ্যাই ৩৬০। এ ছাড়া রয়েছে ‘প্রাইভেট হোম’ বা ব্যক্তি শিক্ষকের বাড়ি, যেখানে একসঙ্গে একদল (ব্যাচ) শিক্ষার্থী গিয়ে পড়তে পারে। সন্দেহ নেই, বগুড়া সদরের ওই খবরটি সারা দেশকেই প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ সব স্থানের চিত্র একই।
শিক্ষার্থীরা কেবল তাদের অভিভাবকদের ওপর নয়, নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে কোচিং সেন্টারগুলোর ওপরও। স্কুলের পাঠদান যথেষ্ট কি না অথবা স্কুলগুলোতে কী পড়ানো হয়—এসব নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তুলছেন না। কোচিং সেন্টারের অপরিহার্যতা এখন সমাজ স্বীকার করেই নিয়েছে। নির্ভরশীলতার শেষটা অবশ্য এখানেই নয়, এরপর রয়েছে বিষয়ভিত্তিক প্রাইভেট টিউটর, নোট বা গাইড বই এবং সর্বোপরি নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক লেখাপড়া। ক্রমাগত পরনির্ভর করে ফেলার এই মোক্ষম উপাদানগুলো একজন শিক্ষার্থীর ওপর কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করছে, তার বর্ণনাও পাওয়া যায় বগুড়ার ওই খবরটিতে।
আমার নিকট আত্মীয়ের এক সন্তানের কথা জানি। ওই সন্তানটিকে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে জাগানো হয়। একের পর এক শিক্ষকের বাড়ি ঘুরিয়ে তাকে পাঠানো হয় স্কুলে। সেখান থেকে কোচিং সেন্টার হয়ে অন্য শিক্ষকদের বাড়ি। দুপুরের পর থেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সন্তানটি। সন্ধ্যার আগে ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। আধা ঘুমের মধ্যে রাত ১১টা নাগাদ যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন স্কুল-পোশাক না খুলেই বিছানায় এলিয়ে পড়ে সে। তাকে খাওয়ানোও কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায়ও মা তাকে পরদিনের প্রস্তুতির কথা শুনিয়ে চলেন। পড়ার আতঙ্কে সন্তানটি ঘুমের ঘোরেও কোনো একজন শিক্ষকের দেওয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে শুরু করে। সূর্য ওঠার আগে ঘুম ভাঙলেও এই সন্তানটি সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পায় না। বিকেলে খেলার মাঠ তাকে ডাক দিয়ে যায়, কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই তার। এভাবে প্রকৃতি-গাছপালা-প্রাণিজগৎ, সমাজ-বন্ধু-স্বজন থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার উত্তর কিন্তু মা-বাবারও জানা নেই। এসব ঘটনা সহ্যের অতীত। কিন্তু সন্তানটিকে তা সহ্য করতেই হয়। কেননা, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তারই মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া ‘গোল্ডেন এ প্লাস’-এর স্বপ্ন।
এত দিন এই চাপটা বেশি ছিল কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীর ওপর। ইদানীং পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা চালুর কল্যাণে এখন তা শিশুদের ওপরও আছর করেছে। হাতেনাতে এ ধরনের আছরের ফল পেতে অবশ্য বিলম্ব হয়নি। ফলাফল জানান দেওয়া হয়েছে খোদ সরকারের সর্বশেষ ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদনে’। প্রতিবেদনটির চুম্বক অংশ গত মাসের শেষ সপ্তাহে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ছাপাও হয়েছে। এর মূল কথা হলো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। ‘সৃজনশীল’ বোঝার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবস্থা যখন এ রকম, তখন শিক্ষার্থীরা কতটা সৃজনশীল হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবকে সৃজনশীল পদ্ধতি না বোঝার জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু নিজে সৃজনশীল না হলে কি সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝা সম্ভব? নির্ভরশীলতা আর সৃজনশীলতার অবস্থান তো বিপরীতমুখী। বিরাজমান সমাজবাস্তবতায় সৃজনশীল হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়? নতুন প্রজন্মের শিক্ষকেরা এই বাস্তবতা থেকেই উঠে আসা।
আজকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কাজটা করে দিচ্ছেন অভিভাবক, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার আর গাইড বই। শিক্ষার চাহিদার বাইরে অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্যও শিক্ষার্থীকে প্রায় কিছুই করতে হচ্ছে না। প্রায় সব সমাধানই সে পেয়ে যাচ্ছে প্যাকেজ আকারে। প্রকৃতি-সমাজ-মানুষের মুখোমুখি হওয়ারও তার বালাই নেই। অর্থাৎ সে কোনো কিছুই তার চারপাশের বাস্তবতাকে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে ৩৪ বছর ধরে প্রতিবছর এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ বিদ্যাপীঠে আগমন লক্ষ করছি। এই বিদ্যার্থীদের নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার চর্চায় যুক্ত আছি গত ৩৮ বছর। থিয়েটারের স্থানটি অনেক বেশি সৃজনশীল। কিন্তু বছর যত পেরোচ্ছে হতাশার পাল্লা তত ভারী হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তারা নিজে থেকে প্রায় কিছুই করতে পারে না। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সবাই ভীষণভাবে নির্ভরশীল। তারা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো ঠিকঠাক দেখতে পায় না। ইতিহাস, ঐতিহ্য-সমাজ-দেশ-মানুষ সম্পর্কেও তাদের ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়। অথচ সার্টিফিকেট বলছে তারা ‘মেধাবী’।
মেধার সার্টিফিকেট-সংক্রান্ত একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। গল্পটি একটি নাটকের। মুখে খোঁচা দাঁড়ি আর মলিন পোশাকে এক ভদ্রলোক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকলেন। বললেন: স্যার আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেননি। ১৫ বছর আগে আমি এই বিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে যাই। ওই সময়ে আমি ছিলাম বিদ্যালয়ের সব থেকে মেধাবী ছাত্র।
মেধাবী কথাটি শুনে প্রধান শিক্ষক তাঁর ছাত্রটিকে চিনতে পারেন। চা-বিস্কুট খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁকে বাধা দিয়ে ভদ্রলোক পুনরায় বলতে থাকেন: না স্যার, আমি চা খেতে আসিনি। এই বিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করি। এরপর গত সাত-আট বছর বিভিন্ন স্থানে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খাপ খাওয়াতে পারিনি কোথাও। বুঝেছি, এমন কিছু আমি শিখিনি, যা দিয়ে বাস্তবকে মোকাবিলা করা যায়। আমি ব্যর্থ হয়েছি স্যার। আমার জীবনে আপনাদের দেওয়া সার্টিফিকেটের আর কোনো মূল্য নেই। তাই আমি এসেছি সার্টিফিকেট ফেরত দিতে। দয়া করে এই সার্টিফিকেটটি গ্রহণ করে আমাকে মুক্তি দিন!
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
No comments