জয়ের আনন্দে বারবার কাঁদতে চাই by আনিসুল হক
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বিজয়স্তম্ভে উঠেছেন। গলায় সোনার মেডেল। চোখে দেশপ্রেমের কান্না |
মাদারীপুরের
মেয়ে। বাবা খিলগাঁওয়ে মুদির দোকান চালান। আর্থিক প্রতিকূলতায় একসময় বন্ধ
হয়ে যায় লেখাপড়া। মামা বক্সিং কোচ শাহাদাত কাজী জোর করেই ভাগনিকে
ভারোত্তোলন অনুশীলন করাতে শুরু করেন। এর আগে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলনে রুপা
জেতেন, আফ্রো-এশিয়ায় রুপা, আরও দুটো ব্রোঞ্জ আছে তাঁর থলেতে। গুয়াহাটিতে
এসএ গেমসে গিয়েছিলেন কনুইতে ব্যথা নিয়ে। আগের রাতেও বেশ ব্যথা করছিল। এই
অবস্থায় নামলেন তিনি প্রতিযোগিতায়। ভারতকে হারিয়ে এই তরুণী জিতে নিলেন
সোনা। বাংলাদেশের প্রথম সোনা এবারের এসএ গেমসে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রী মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বিজয়স্তম্ভে উঠেছেন। গলায় সোনার মেডেল। সামনে
জাতীয় পতাকা। তিনি অভিবাদন জানাচ্ছেন। এমন সময় বেজে উঠল সেই সুর—আমার
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। তিনি হুহু করে কাঁদতে লাগলেন। সেই ভিডিও
ছড়িয়ে পড়ল ইন্টারনেটে। বাংলাদেশের মানুষ, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না
কেন, যিনিই এই ভিডিও দেখেছেন, তিনিই চোখ মুছেছেন।
কোত্থেকে আসে এত আবেগ? আমার সোনার বাংলা শুনলেই কেন চোখ ছলছল করে? কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো!
এত মায়া কোত্থেকে আসে?
বাংলাদেশের একদল নারী-সাংবাদিক একবার আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন সাংবাদিকতার কর্মশালায় অংশ নিতে। সেখানে একটা অনুষ্ঠানে তাঁদের বলা হলো গান গাইতে। সবাই কোন গানটা জানেন? অবশ্যই আমাদের জাতীয় সংগীত। তাঁরা গাইতে আরম্ভ করলেন। আর শুরু করে দিলেন কান্না। আমেরিকানরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাঁদছ কেন?
‘কারণ, আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত গাইছি।’
‘জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় কাঁদতে হবে কেন? আমরাও তো গাই। আমরা তো কাঁদি না।’
এটা আমেরিকানরা বুঝবে না, কেন আমরা, বাংলাদেশের মানুষ, বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীত শুনলে কাঁদি। এই দেশটা আমাদের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
আমাদের মেয়েরা আমাদের সোনা এনে দিচ্ছেন এসএ গেমসে। কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা। কতই না প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাঁদের আজকের এই জয়। আমাদের বাংলাদেশও অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন জয়ের পথে, জয়ের রথে, এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকেই।
২.
আইআরআইয়ের সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সমর্থন বাড়ছে। দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে এগোচ্ছে বলে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, দেশ ঠিকপথে এগোচ্ছে, মানুষের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো বা মোটামুটি ভালো। ৪৫ শতাংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি দরকার অর্থনৈতিক উন্নতি। তবে বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকেই বেশি পছন্দ করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একই প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়েছিল, দেশের মানুষ অসন্তুষ্ট দুর্নীতি নিয়ে। তাঁদের প্রধান দুশ্চিন্তা এমনকি রাজনৈতিক হানাহানির চেয়েও বেশি দুর্নীতি নিয়ে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছিল, ৪৩ শতাংশ মানুষ চায় দ্রুত নতুন নির্বাচন, আর ৪০ শতাংশ মানুষ চায় এই সংসদ পুরো মেয়াদ শেষ করুক। আর নভেম্বরে দ্রুত নির্বাচন চাওয়া মানুষের সংখ্যাটা ছিল ৩৬ শতাংশ।
সবটা মিলিয়ে সরকারের নিজের ব্যাপারে আস্থাবান হওয়ার যথেষ্ট উপকরণ আছে আইআরআইয়ের জরিপে।
পাশাপাশি গত বছরের শেষে কিংবা নতুন বছরের প্রাক্কালে আরও কিছু জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। একটা হলো, টিআইবির জরিপ। এ জরিপে আবারও বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে, যা লজ্জার এবং হতাশার। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এ প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপারটা আমরা টাচ করতে পারিনি।’
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেসবও বেশ উদ্বেগজনক। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই প্রতিবেদনে যা বলা হয়, তাতে নতুন কথা কেউ আশাও করেননি। ওই প্রতিবেদনে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি দপ্তরগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটকে রাখা, দুর্বল বিচারিক ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের কাজের পরিবেশের কথা উঠে আসে। অনলাইনে ও গণমাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমে আসার কথাও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে।
সবশেষ খবর হলো, মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাড়াতে পারে। এটা বলার জন্য অবশ্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের দরকার পড়ে না। যেকোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক যেকোনো দেশের জন্য সাধারণভাবে এ কথা সব সময়ই বলবেন যে মানুষকে তার মত প্রকাশ করতে দাও, বিরোধীদের পরিসর দাও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা করার, তা না হলে তাদের ক্ষোভ জমতে থাকবে, তা একসময় বিস্ফোরিত হবে, কিংবা তা প্রকাশের জন্য চোরাগোপ্তা পথ খুঁজবে। এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলী রীয়াজ ইলিনয় থেকে অনেকবার কলাম লিখেছেন; প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পুস্তক প্রকাশ করেছেন।
আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের জয়। বাংলাদেশের মেয়ে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত যখন সোনা জয় করে জাতীয় সংগীতের আবহে লাল-সবুজ পতাকাকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন, তখন আমরা জানি, আমরা এই দেশকে কত ভালোবাসি, আর এই দেশের জন্য জয় ছিনিয়ে আনতে আমরা কতটাই না মরিয়া। বাংলাদেশ নিজের শক্তিতে পদ্মা সেতু বানাতে যাচ্ছে, সেটাও আমাদের মাথা উঁচু করেছে, গৌরবে আমাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠেছে। আমেরিকান সংস্থা আইআরআইয়ের জরিপে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ার খবরে কেউ কেউ মন খারাপ করতে পারেন; বিএনপি তো বলেই দিয়েছে, এই জরিপ ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু সাধারণভাবে এটা গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। জাতীয় সংসদে মাননীয় সাংসদেরা আইআরআইকে ধন্যবাদও দিয়েছেন। আইআরআইয়ের জরিপেই আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং তিনি তাঁর দলের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন, এতে তাঁর খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তিনি যা কিছু অর্জন করতে পেরেছেন, তার পেছনে আছে তাঁর দল। এখন আমরা আইআরআইয়ের জরিপটি যদি গ্রহণ করি, আমাদের আত্মবিশ্বাস যদি বাড়ে, তাহলে আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার জরিপগুলোকে রাবিশ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আশার কথা, টিআইবির জরিপের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই রাবিশ কথাটা উচ্চারণ না করে বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে যে হতাশার কথা প্রতিবেদনগুলোয় ফুটে ওঠে, সেসব আমলে নেওয়া জরুরি।
আমরা সবাই জানি, দুই বছর আগের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তার আগে তারাই ছিল প্রধান বিরোধী দল এবং তারও আগে তারা ছিল সরকারি দল। কাজেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারের জন্য পরম স্বস্তির ও উৎসাহের ব্যাপার হবে, মানুষ সরকারের ওপর আস্থাশীল রয়েছে, দেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে বলেই বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন। এখন এখানেই সরকারের সামনে বড় সুযোগ, করণীয় ক্ষেত্রটি বড়ই স্পষ্ট। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটা উপাদান, হয়তো খুব বড় উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। নির্বাচিত সরকারও দুঃসহ যাতনার কারণ হতে পারে, একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে। গণতন্ত্রের মিটারে পারদের ওঠানামা মাপা যায় বাক্স্বাধীনতা আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি আছে, তা দেখে। মানুষ নির্ভয়ে মনের কথা বলতে পারে কি না, সেখান থেকে। সবচেয়ে বড় লিটমাস টেস্ট হলো, বিরোধী মতের মানুষ যদি একজনও হন, তিনি কেমন আছেন, সেটা দেখা। আর মানবাধিকার রক্ষা করা হচ্ছে কি হচ্ছে না। মানবাধিকার মানে ব্যক্তির অধিকার। বিনা বিচারে একজন মানুষও শাস্তি পেতে পারে না, আটক থাকতে পারে না। বিচারের পরে আইনানুগ শাস্তি হলে কারও তো আপত্তি থাকবেই না, বরং মানুষ সেটাই চায়। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই তো সরকারের কাজ। কিন্তু অস্ত্রের বলে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেন কেউ কাউকে তুলে নিয়ে না যায়, মানুষ যেন গুম না হয়। খালি চোখে সাম্প্রতিক কালে এই বিষয়ে কিছু উন্নতি অবশ্য দেখা যাচ্ছে। আর বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরোধিতা ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে, অসন্তোষ প্রকাশের অসংকোচ সাহস যেন তারা দেখাতে পারে।
আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছে এই দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। বাধা আছে, পরোক্ষ এবং কখনো কখনো প্রত্যক্ষ। তারপরেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের চিত্ত স্বাধীন, তাদের শির উন্নত। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে কয়েকজন মাননীয় সাংসদ জাতীয় সংসদে যে বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তাঁর গ্রেপ্তার, শাস্তি ও কাগজ বন্ধের যে দাবি জানিয়েছেন, সেটা একটা দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি ক্ষমতাসীনদের একাংশের অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ মাত্র। সাত বছর আগে যে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য তাঁরা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সেই প্রতিবেদনগুলো তাঁদের পাশে বসা কোনো কোনো নেতারই জবানবন্দি, এটা মনে রাখলে তাঁরা ভালো করবেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশ মানে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, সোনাজয়ী তরুণী। বাংলাদেশ মানে সাঁতারে সোনাজয়ী মাহফুজা। একেকজন মাবিয়া, মাহফুজা এগিয়ে যাচ্ছেন মানে বাংলাদেশই এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের বিজয়ের পেছনে সরকারের অবদান আছে, আমাদের নেতৃত্বের কৃতিত্ব আছে। তাই তো মানুষ আস্থাশীল। সেই আস্থা আরও বাড়বে, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে যদি আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারি, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারি, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারি এবং বিরোধী দলকে পরিসর দিতে পারি। বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম ভাবমূর্তি নিয়ে জয়ের স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আমরা মারিয়ার মতোই আনন্দাশ্রু চোখে গাইতে চাই—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কোত্থেকে আসে এত আবেগ? আমার সোনার বাংলা শুনলেই কেন চোখ ছলছল করে? কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো!
এত মায়া কোত্থেকে আসে?
বাংলাদেশের একদল নারী-সাংবাদিক একবার আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন সাংবাদিকতার কর্মশালায় অংশ নিতে। সেখানে একটা অনুষ্ঠানে তাঁদের বলা হলো গান গাইতে। সবাই কোন গানটা জানেন? অবশ্যই আমাদের জাতীয় সংগীত। তাঁরা গাইতে আরম্ভ করলেন। আর শুরু করে দিলেন কান্না। আমেরিকানরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাঁদছ কেন?
‘কারণ, আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত গাইছি।’
‘জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় কাঁদতে হবে কেন? আমরাও তো গাই। আমরা তো কাঁদি না।’
এটা আমেরিকানরা বুঝবে না, কেন আমরা, বাংলাদেশের মানুষ, বিদেশের মাটিতে জাতীয় সংগীত শুনলে কাঁদি। এই দেশটা আমাদের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
আমাদের মেয়েরা আমাদের সোনা এনে দিচ্ছেন এসএ গেমসে। কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা। কতই না প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাঁদের আজকের এই জয়। আমাদের বাংলাদেশও অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন জয়ের পথে, জয়ের রথে, এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকেই।
২.
আইআরআইয়ের সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সমর্থন বাড়ছে। দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে এগোচ্ছে বলে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, দেশ ঠিকপথে এগোচ্ছে, মানুষের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো বা মোটামুটি ভালো। ৪৫ শতাংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি দরকার অর্থনৈতিক উন্নতি। তবে বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকেই বেশি পছন্দ করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একই প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়েছিল, দেশের মানুষ অসন্তুষ্ট দুর্নীতি নিয়ে। তাঁদের প্রধান দুশ্চিন্তা এমনকি রাজনৈতিক হানাহানির চেয়েও বেশি দুর্নীতি নিয়ে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছিল, ৪৩ শতাংশ মানুষ চায় দ্রুত নতুন নির্বাচন, আর ৪০ শতাংশ মানুষ চায় এই সংসদ পুরো মেয়াদ শেষ করুক। আর নভেম্বরে দ্রুত নির্বাচন চাওয়া মানুষের সংখ্যাটা ছিল ৩৬ শতাংশ।
সবটা মিলিয়ে সরকারের নিজের ব্যাপারে আস্থাবান হওয়ার যথেষ্ট উপকরণ আছে আইআরআইয়ের জরিপে।
পাশাপাশি গত বছরের শেষে কিংবা নতুন বছরের প্রাক্কালে আরও কিছু জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। একটা হলো, টিআইবির জরিপ। এ জরিপে আবারও বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে, যা লজ্জার এবং হতাশার। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এ প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপারটা আমরা টাচ করতে পারিনি।’
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেসবও বেশ উদ্বেগজনক। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে সেই প্রতিবেদনে যা বলা হয়, তাতে নতুন কথা কেউ আশাও করেননি। ওই প্রতিবেদনে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি দপ্তরগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটকে রাখা, দুর্বল বিচারিক ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের কাজের পরিবেশের কথা উঠে আসে। অনলাইনে ও গণমাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমে আসার কথাও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে।
সবশেষ খবর হলো, মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাড়াতে পারে। এটা বলার জন্য অবশ্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের দরকার পড়ে না। যেকোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক যেকোনো দেশের জন্য সাধারণভাবে এ কথা সব সময়ই বলবেন যে মানুষকে তার মত প্রকাশ করতে দাও, বিরোধীদের পরিসর দাও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা করার, তা না হলে তাদের ক্ষোভ জমতে থাকবে, তা একসময় বিস্ফোরিত হবে, কিংবা তা প্রকাশের জন্য চোরাগোপ্তা পথ খুঁজবে। এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলী রীয়াজ ইলিনয় থেকে অনেকবার কলাম লিখেছেন; প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পুস্তক প্রকাশ করেছেন।
আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের জয়। বাংলাদেশের মেয়ে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত যখন সোনা জয় করে জাতীয় সংগীতের আবহে লাল-সবুজ পতাকাকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন, তখন আমরা জানি, আমরা এই দেশকে কত ভালোবাসি, আর এই দেশের জন্য জয় ছিনিয়ে আনতে আমরা কতটাই না মরিয়া। বাংলাদেশ নিজের শক্তিতে পদ্মা সেতু বানাতে যাচ্ছে, সেটাও আমাদের মাথা উঁচু করেছে, গৌরবে আমাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠেছে। আমেরিকান সংস্থা আইআরআইয়ের জরিপে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ার খবরে কেউ কেউ মন খারাপ করতে পারেন; বিএনপি তো বলেই দিয়েছে, এই জরিপ ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু সাধারণভাবে এটা গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। জাতীয় সংসদে মাননীয় সাংসদেরা আইআরআইকে ধন্যবাদও দিয়েছেন। আইআরআইয়ের জরিপেই আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং তিনি তাঁর দলের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন, এতে তাঁর খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তিনি যা কিছু অর্জন করতে পেরেছেন, তার পেছনে আছে তাঁর দল। এখন আমরা আইআরআইয়ের জরিপটি যদি গ্রহণ করি, আমাদের আত্মবিশ্বাস যদি বাড়ে, তাহলে আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার জরিপগুলোকে রাবিশ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আশার কথা, টিআইবির জরিপের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই রাবিশ কথাটা উচ্চারণ না করে বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে যে হতাশার কথা প্রতিবেদনগুলোয় ফুটে ওঠে, সেসব আমলে নেওয়া জরুরি।
আমরা সবাই জানি, দুই বছর আগের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তার আগে তারাই ছিল প্রধান বিরোধী দল এবং তারও আগে তারা ছিল সরকারি দল। কাজেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারের জন্য পরম স্বস্তির ও উৎসাহের ব্যাপার হবে, মানুষ সরকারের ওপর আস্থাশীল রয়েছে, দেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে বলেই বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন। এখন এখানেই সরকারের সামনে বড় সুযোগ, করণীয় ক্ষেত্রটি বড়ই স্পষ্ট। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটা উপাদান, হয়তো খুব বড় উপাদান, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। নির্বাচিত সরকারও দুঃসহ যাতনার কারণ হতে পারে, একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে। গণতন্ত্রের মিটারে পারদের ওঠানামা মাপা যায় বাক্স্বাধীনতা আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি আছে, তা দেখে। মানুষ নির্ভয়ে মনের কথা বলতে পারে কি না, সেখান থেকে। সবচেয়ে বড় লিটমাস টেস্ট হলো, বিরোধী মতের মানুষ যদি একজনও হন, তিনি কেমন আছেন, সেটা দেখা। আর মানবাধিকার রক্ষা করা হচ্ছে কি হচ্ছে না। মানবাধিকার মানে ব্যক্তির অধিকার। বিনা বিচারে একজন মানুষও শাস্তি পেতে পারে না, আটক থাকতে পারে না। বিচারের পরে আইনানুগ শাস্তি হলে কারও তো আপত্তি থাকবেই না, বরং মানুষ সেটাই চায়। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই তো সরকারের কাজ। কিন্তু অস্ত্রের বলে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেন কেউ কাউকে তুলে নিয়ে না যায়, মানুষ যেন গুম না হয়। খালি চোখে সাম্প্রতিক কালে এই বিষয়ে কিছু উন্নতি অবশ্য দেখা যাচ্ছে। আর বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরোধিতা ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে, অসন্তোষ প্রকাশের অসংকোচ সাহস যেন তারা দেখাতে পারে।
আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছে এই দেশের স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। বাধা আছে, পরোক্ষ এবং কখনো কখনো প্রত্যক্ষ। তারপরেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের চিত্ত স্বাধীন, তাদের শির উন্নত। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে কয়েকজন মাননীয় সাংসদ জাতীয় সংসদে যে বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তাঁর গ্রেপ্তার, শাস্তি ও কাগজ বন্ধের যে দাবি জানিয়েছেন, সেটা একটা দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি ক্ষমতাসীনদের একাংশের অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ মাত্র। সাত বছর আগে যে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য তাঁরা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সেই প্রতিবেদনগুলো তাঁদের পাশে বসা কোনো কোনো নেতারই জবানবন্দি, এটা মনে রাখলে তাঁরা ভালো করবেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশ মানে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, সোনাজয়ী তরুণী। বাংলাদেশ মানে সাঁতারে সোনাজয়ী মাহফুজা। একেকজন মাবিয়া, মাহফুজা এগিয়ে যাচ্ছেন মানে বাংলাদেশই এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের বিজয়ের পেছনে সরকারের অবদান আছে, আমাদের নেতৃত্বের কৃতিত্ব আছে। তাই তো মানুষ আস্থাশীল। সেই আস্থা আরও বাড়বে, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে যদি আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারি, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারি, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারি এবং বিরোধী দলকে পরিসর দিতে পারি। বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম ভাবমূর্তি নিয়ে জয়ের স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আমরা মারিয়ার মতোই আনন্দাশ্রু চোখে গাইতে চাই—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments