অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মুখে ইরান? by মাসুমুর রহমান খলিলী
তেহরানের আসন থেকে বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রার্থী হওয়ার জন্য নিবন্ধন করছেন আয়াতুল্লাহ খোমেনির নাতি হাসান খোমেনি |
মধ্যপ্রাচ্যের
অন্যতম প্রধান আঞ্চলিক শক্তি ইরান অভ্যন্তরীণভাবে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের
মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ইরানের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ-
মজলিসের নির্বাচন। একই সময়ে দেশটির শক্তিশালী ৮৮ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ
পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই পরিষদের সদস্যরা আট বছর মেয়াদের জন্য
নির্বাচিত হন। আর তারা দেশটির রাহবার বা সুপ্রিম লিডার নির্বাচন করেন।
সুপ্রিম নেতার কোনো কারণে পদচ্যুতির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেটিও করা এই
বিশেষজ্ঞ পরিষদের দায়িত্ব। ২০১৪ সালে বিশেষজ্ঞ পরিষদের নির্বাচন
অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও সংসদ নির্বাচনের একই সাথে অনুষ্ঠানের জন্য তা
বছরাধিক সময় পিছিয়ে দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচিত মুস্তাহিদ
বা বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরাই নতুন সুপ্রিম লিডার নির্বাচিত করবেন। ৭৬ বছর
বয়সী বর্তমান নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পোস্টেড গ্লান্ডে ক্যান্সারে
আক্রান্ত। তার শারীরিক অবস্থাও খুব ভালো যাচ্ছে না। ফলে রাহবারের মৃত্যু
অথবা শারীরিক অক্ষমতা- যেকোনো কারণেই নতুন সুপ্রিম নেতা নির্বাচনের প্রয়োজন
দেখা দিতে পারে। আর সুপ্রিম নেতা এই মুস্তাহিদদের পক্ষ থেকেই কেউ একজন
হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০টি মনোনীত আসন বাদ দেয়া হলে ২৯০ আসনের মজলিসের ২৮৫টি আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাকি পাঁচটি আসন সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ১৯৬টি নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন মজলিস সদস্যরা, যাদের মধ্যে একক নির্বাচনী এলাকা এবং মিশ্র নির্বাচনী এলাকাও রয়েছে। সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি এক-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন না পেলে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দু’জনের মধ্যে পুনর্নির্বাচনের বিধান রয়েছে।
এবারের নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশটি এক ধরনের পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। রক্ষণশীল বা মূলনীতিবাদী এবং সংস্কারপন্থী এ দুই ধারার রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ইরানে আয়াতুল্লাহ রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রক্ষণশীলদের ছিল একক আধিপত্য। মোট ৩১০ আসনবিশিষ্ট বিদায়ী মজলিসে ১৮২ জনই ছিলেন মূলনীতিবাদী বা রক্ষণশীল। আর মাত্র ১৩টি আসন ছিল সংস্কারবাদীদের হাতে। প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশসহ ছয় বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক চুক্তির পর অবরোধ প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হলে যে নতুন পরিস্থিতি ইরানে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এবারের মজলিস সংস্কারবাদীদের দখলে চলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি যে বিদায়ী বিশেষজ্ঞ পরিষদে সংস্কারপন্থীদের মাত্র ২৯টি আসন ছিল, সেখানেও গরিষ্ঠ আসনে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সংস্কারবাদীরা। যদিও প্রার্থিতা বাতিলের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট রুহানি বিশেষজ্ঞ পরিষদের ব্যাপারে সংস্কারপন্থীদের প্রার্থিতা ব্যাপক হারে বাতিল করার অভিযোগ করেছেন। বাতিলকৃতদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবের মূল নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নাতিও রয়েছেন। তার প্রার্থিতা বাতিলের ব্যাপারে যুক্তি দেখানো হয়েছে খোমেনির পরিবারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খোমেনির নাতি অবশ্য পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছেন, আহলে বাইত যেখানে নেতৃত্ব ইমামত নির্বাচনের মূলসূত্র, সেখানে পরিবারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার যুক্তি মানতে হলে রাসূল স:-এর উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে আনার যুক্তি হারিয়ে যাবে। যা হোক, ইতোমধ্যে বেশ কিছু বাতিল হওয়া প্রার্থির প্রার্থিতা পুনর্বহালও হয়েছে। আপিল ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় আরো বেশ কিছু সদস্য তাদের প্রার্থিতা ফেরত পেতে পারেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের শেষ মেয়াদ থেকে সংস্কারপন্থীদের ইরানি রাজনীতিতে শক্তিমান হয়ে ওঠার প্রবণতা শুরু হয়। প্রথম নির্বাচনেই সংস্কারপন্থী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহানি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবার। এর মধ্যে বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ইরানি রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যায়। রক্ষণশীলদের ব্যাপক বিরোধিতার পরও এই চুক্তি সংসদের অনুমোদন লাভ করে। ইরানের অভ্যন্তরীণ জনমতের চাপে এটি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এক দিকে বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে সমঝোতা এবং অভ্যন্তরীণভাবে উদার যুগের সূচনার কিছু লক্ষণ; আর অন্য দিকে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সিরিয়াসহ আরব জাহানে ইরানের আগ্রাসী নীতি অভ্যন্তরীণ জনমতকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে।
অতি সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। ম্যারিল্যান্ডের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের বহুল আলোচিত এই জনমত জরিপে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির নীতিকে সমর্থন করছেন, যাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ জোরালোভাবে এবং ৪০ শতাংশ মোটামুটি সমর্থন করছেন তার নীতিকে। পূর্ববর্তী আগস্টের তুলনায় গত জানুয়ারি মাসে জোরালো সমর্থন ৬১ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে নেমে এলেও সার্বিক সমর্থনের অবনতি ঘটেছে মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো রুহানি ইরানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তার কাছাকাছি জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেন পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ। মজার ব্যাপার হলো কট্টরপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদকে ২৪ শতাংশ ইরানি খুবই পছন্দ করেন, আবার সমানসংখ্যক লোক করেন খুবই অপছন্দ। আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানির অবস্থাও একই। তাকে ১৯ শতাংশ খুবই পছন্দ করেন আর সমসংখ্যক ইরানি খুবই অপছন্দ করেন। এই হার প্রেসিডেন্ট রুহানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের ক্ষেত্রে অন্য রকম। রুহানিকে খুবই পছন্দ করেন ৪৩ শতাংশ আর খুবই অপছন্দ করেন মাত্র ৮ শতাংশ। আর জাভেদ জারিফের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ ইরানি তাকে খুবই পছন্দ করেন আর অপছন্দ করেন ৮ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে ৮৬ শতাংশ ইরানি মনে করেন প্রেসিডেন্ট রুহানি জাতীয় নিরাপত্তার উন্নয়নে সফল হয়েছেন, ৮০ শতাংশ মনে করেন ইউরোপের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নেও তিনি সফল হয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি সফল হয়েছেন বলে মনে করেন ৬৪ শতাংশ আর বেকারত্ব দূর করতে প্রেসিডেন্টকে সফল মনে করেন ৩৭ শতাংশ। এটি ঠিক যে অবরোধ প্রত্যাহারের ইতিবাচক প্রভাব যত দ্রুত পড়বে বলে ইরানি জনগণ মনে করেছিলেন, তত দ্রুত তা পড়েনি তেলের দাম হ্রাসসহ অন্য কয়েকটি কারণে। এজন্য ৪৭ শতাংশ ইরানি মনে করছেন, তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আর ৪১ শতাংশ এর উল্টোটা মনে করেন। এর পরও আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ইরানিদের বেশ উৎসাহ রয়েছে। ৬৭ শতাংশ ইরানি মনে করেন, এই নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০ শতাংশ মনে করেন মোটামুটি সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই মনে করেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ।
জরিপে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল এসেছে নির্বাচনের আউটকাম নিয়ে। জরিপের ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রুহানির সমর্থকদের জয়ী হওয়া উচিত। আর প্রেসিডেন্টের সমালোচকদের জয়ী হওয়া উচিত মনে করেন মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ।
এই জরিপ থেকে ধারণা করা যায়, ২৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমন এক বিস্ময়কর ফল হতে যাচ্ছে যাতে ইরানি রাজনীতির ওপর বেশ কয়েক দশক পর সংস্কারপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতে পারে। এবার তাদের শুধু মজলিসেই নয়, একই সথে বিশেষজ্ঞ পরিষদেও গরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি হলে এর আগে সংস্কারপন্থী খাতেমি যেসব নীতিগত পরিবর্র্তন আনতে বাধার মুখে পড়েছিলেন তেমন অবস্থা রুহানির ক্ষেত্রে হবে না। আর এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু উদার নীতি ইরানের নীতিনির্ধারকেরা নিতে পারেন। আর খামেনির উত্তরাধিকারী হিসেবে নমনীয় কোনো ধর্মীয় নেতা এলে পরিবর্তন হতে পারে আরো দ্রুত।
পশ্চিমা নেতাদের ইরানের প্রতি নরম নীতি নেয়ার পেছনে দু’টি কারণ কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। প্রথমটি হলো অবরোধ আরোপসহ অন্যান্য চাপ প্রয়োগের নীতিতে ভালো কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে তারা মনে করছেন। নির্বাচনের কারচুপির কথা বলে আন্দোলন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এখন সংস্কারপন্থী রুহানির সময় পারমাণবিক সমঝোতার মাধ্যমে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে ইরানি অর্থনীতিতে এক ধরনের জোয়ার আসবে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য চলে আসবে। তারা কট্টরপন্থীদের পরিবর্তে নরমপন্থীদের সমর্থন দেবে। আর সংস্কারপন্থীরা পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক বাড়াবে। ইতোমধ্যে এর কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০ বোয়িং কেনার অর্ডার দিয়েছে ইরান। ফ্রান্স থেকে এয়ার বাস আমদানির অর্ডার দেয়া হয়েছে ১০০টি। এসব দেশে আটকে থাকা অর্থ দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করা যাবে বলে তা থেকে দুই দেশই লাভবান হবে।
অন্য দিকে, মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু শিয়া প্রধান ইরানকে শক্তিশালী হতে সহায়তা দেয়া হলে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্ঘাত স্থায়ী রূপ নেবে। এতে পশ্চিমাদের অস্ত্রবাণিজ্য দীর্ঘ সময় জমজমাট থাকবে। সঙ্ঘাতের লক্ষ্যবস্তু ইসরাইল অথবা পাশ্চাত্য হওয়ার পরিবর্তে হবে শিয়া বনাম সুন্নি শক্তি। মধ্যযুগে অর্থোডক্স খ্রিষ্ট শক্তির সাথে রোমান খ্রিষ্টশক্তির এ ধরনের লড়াইয়ের পর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ধর্মীয় প্রভাব বিদায় নেয় আর সেকুলাররা শক্তিমান হয়ে ওঠে। মুসলিম দেশগুলোতে একইভাবে জাতিতাত্ত্বিক সঙ্ঘাত সংঘর্ষ চলতে থাকলে সেকুলার মুসলিমরা রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। পাশ্চাত্যের এই দুই লক্ষ্যের কতটা অর্জিত হবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে ইরানের অভ্যন্তরে যে বড় ধরনের পরিবর্তনে সূচনা ঘটতে যাচ্ছে তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এই পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণটি দেখা যাবে সম্ভবত মজলিস ও বিশেষজ্ঞ পরিষদ নির্বাচনে।
২০টি মনোনীত আসন বাদ দেয়া হলে ২৯০ আসনের মজলিসের ২৮৫টি আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাকি পাঁচটি আসন সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ১৯৬টি নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন মজলিস সদস্যরা, যাদের মধ্যে একক নির্বাচনী এলাকা এবং মিশ্র নির্বাচনী এলাকাও রয়েছে। সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি এক-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন না পেলে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দু’জনের মধ্যে পুনর্নির্বাচনের বিধান রয়েছে।
এবারের নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশটি এক ধরনের পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। রক্ষণশীল বা মূলনীতিবাদী এবং সংস্কারপন্থী এ দুই ধারার রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ইরানে আয়াতুল্লাহ রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রক্ষণশীলদের ছিল একক আধিপত্য। মোট ৩১০ আসনবিশিষ্ট বিদায়ী মজলিসে ১৮২ জনই ছিলেন মূলনীতিবাদী বা রক্ষণশীল। আর মাত্র ১৩টি আসন ছিল সংস্কারবাদীদের হাতে। প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশসহ ছয় বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক চুক্তির পর অবরোধ প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হলে যে নতুন পরিস্থিতি ইরানে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এবারের মজলিস সংস্কারবাদীদের দখলে চলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি যে বিদায়ী বিশেষজ্ঞ পরিষদে সংস্কারপন্থীদের মাত্র ২৯টি আসন ছিল, সেখানেও গরিষ্ঠ আসনে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সংস্কারবাদীরা। যদিও প্রার্থিতা বাতিলের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট রুহানি বিশেষজ্ঞ পরিষদের ব্যাপারে সংস্কারপন্থীদের প্রার্থিতা ব্যাপক হারে বাতিল করার অভিযোগ করেছেন। বাতিলকৃতদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবের মূল নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নাতিও রয়েছেন। তার প্রার্থিতা বাতিলের ব্যাপারে যুক্তি দেখানো হয়েছে খোমেনির পরিবারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খোমেনির নাতি অবশ্য পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছেন, আহলে বাইত যেখানে নেতৃত্ব ইমামত নির্বাচনের মূলসূত্র, সেখানে পরিবারকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার যুক্তি মানতে হলে রাসূল স:-এর উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে আনার যুক্তি হারিয়ে যাবে। যা হোক, ইতোমধ্যে বেশ কিছু বাতিল হওয়া প্রার্থির প্রার্থিতা পুনর্বহালও হয়েছে। আপিল ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় আরো বেশ কিছু সদস্য তাদের প্রার্থিতা ফেরত পেতে পারেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের শেষ মেয়াদ থেকে সংস্কারপন্থীদের ইরানি রাজনীতিতে শক্তিমান হয়ে ওঠার প্রবণতা শুরু হয়। প্রথম নির্বাচনেই সংস্কারপন্থী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহানি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবার। এর মধ্যে বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ইরানি রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যায়। রক্ষণশীলদের ব্যাপক বিরোধিতার পরও এই চুক্তি সংসদের অনুমোদন লাভ করে। ইরানের অভ্যন্তরীণ জনমতের চাপে এটি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এক দিকে বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে সমঝোতা এবং অভ্যন্তরীণভাবে উদার যুগের সূচনার কিছু লক্ষণ; আর অন্য দিকে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সিরিয়াসহ আরব জাহানে ইরানের আগ্রাসী নীতি অভ্যন্তরীণ জনমতকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে।
অতি সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। ম্যারিল্যান্ডের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের বহুল আলোচিত এই জনমত জরিপে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির নীতিকে সমর্থন করছেন, যাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ জোরালোভাবে এবং ৪০ শতাংশ মোটামুটি সমর্থন করছেন তার নীতিকে। পূর্ববর্তী আগস্টের তুলনায় গত জানুয়ারি মাসে জোরালো সমর্থন ৬১ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে নেমে এলেও সার্বিক সমর্থনের অবনতি ঘটেছে মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো রুহানি ইরানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তার কাছাকাছি জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেন পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ। মজার ব্যাপার হলো কট্টরপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদকে ২৪ শতাংশ ইরানি খুবই পছন্দ করেন, আবার সমানসংখ্যক লোক করেন খুবই অপছন্দ। আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানির অবস্থাও একই। তাকে ১৯ শতাংশ খুবই পছন্দ করেন আর সমসংখ্যক ইরানি খুবই অপছন্দ করেন। এই হার প্রেসিডেন্ট রুহানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের ক্ষেত্রে অন্য রকম। রুহানিকে খুবই পছন্দ করেন ৪৩ শতাংশ আর খুবই অপছন্দ করেন মাত্র ৮ শতাংশ। আর জাভেদ জারিফের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ ইরানি তাকে খুবই পছন্দ করেন আর অপছন্দ করেন ৮ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে ৮৬ শতাংশ ইরানি মনে করেন প্রেসিডেন্ট রুহানি জাতীয় নিরাপত্তার উন্নয়নে সফল হয়েছেন, ৮০ শতাংশ মনে করেন ইউরোপের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নেও তিনি সফল হয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি সফল হয়েছেন বলে মনে করেন ৬৪ শতাংশ আর বেকারত্ব দূর করতে প্রেসিডেন্টকে সফল মনে করেন ৩৭ শতাংশ। এটি ঠিক যে অবরোধ প্রত্যাহারের ইতিবাচক প্রভাব যত দ্রুত পড়বে বলে ইরানি জনগণ মনে করেছিলেন, তত দ্রুত তা পড়েনি তেলের দাম হ্রাসসহ অন্য কয়েকটি কারণে। এজন্য ৪৭ শতাংশ ইরানি মনে করছেন, তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আর ৪১ শতাংশ এর উল্টোটা মনে করেন। এর পরও আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ইরানিদের বেশ উৎসাহ রয়েছে। ৬৭ শতাংশ ইরানি মনে করেন, এই নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০ শতাংশ মনে করেন মোটামুটি সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচন অবাধ ও মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই মনে করেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ।
জরিপে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল এসেছে নির্বাচনের আউটকাম নিয়ে। জরিপের ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রুহানির সমর্থকদের জয়ী হওয়া উচিত। আর প্রেসিডেন্টের সমালোচকদের জয়ী হওয়া উচিত মনে করেন মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ।
এই জরিপ থেকে ধারণা করা যায়, ২৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এমন এক বিস্ময়কর ফল হতে যাচ্ছে যাতে ইরানি রাজনীতির ওপর বেশ কয়েক দশক পর সংস্কারপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতে পারে। এবার তাদের শুধু মজলিসেই নয়, একই সথে বিশেষজ্ঞ পরিষদেও গরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি হলে এর আগে সংস্কারপন্থী খাতেমি যেসব নীতিগত পরিবর্র্তন আনতে বাধার মুখে পড়েছিলেন তেমন অবস্থা রুহানির ক্ষেত্রে হবে না। আর এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু উদার নীতি ইরানের নীতিনির্ধারকেরা নিতে পারেন। আর খামেনির উত্তরাধিকারী হিসেবে নমনীয় কোনো ধর্মীয় নেতা এলে পরিবর্তন হতে পারে আরো দ্রুত।
পশ্চিমা নেতাদের ইরানের প্রতি নরম নীতি নেয়ার পেছনে দু’টি কারণ কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। প্রথমটি হলো অবরোধ আরোপসহ অন্যান্য চাপ প্রয়োগের নীতিতে ভালো কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে তারা মনে করছেন। নির্বাচনের কারচুপির কথা বলে আন্দোলন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এখন সংস্কারপন্থী রুহানির সময় পারমাণবিক সমঝোতার মাধ্যমে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে ইরানি অর্থনীতিতে এক ধরনের জোয়ার আসবে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য চলে আসবে। তারা কট্টরপন্থীদের পরিবর্তে নরমপন্থীদের সমর্থন দেবে। আর সংস্কারপন্থীরা পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক বাড়াবে। ইতোমধ্যে এর কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০ বোয়িং কেনার অর্ডার দিয়েছে ইরান। ফ্রান্স থেকে এয়ার বাস আমদানির অর্ডার দেয়া হয়েছে ১০০টি। এসব দেশে আটকে থাকা অর্থ দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করা যাবে বলে তা থেকে দুই দেশই লাভবান হবে।
অন্য দিকে, মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু শিয়া প্রধান ইরানকে শক্তিশালী হতে সহায়তা দেয়া হলে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্ঘাত স্থায়ী রূপ নেবে। এতে পশ্চিমাদের অস্ত্রবাণিজ্য দীর্ঘ সময় জমজমাট থাকবে। সঙ্ঘাতের লক্ষ্যবস্তু ইসরাইল অথবা পাশ্চাত্য হওয়ার পরিবর্তে হবে শিয়া বনাম সুন্নি শক্তি। মধ্যযুগে অর্থোডক্স খ্রিষ্ট শক্তির সাথে রোমান খ্রিষ্টশক্তির এ ধরনের লড়াইয়ের পর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ধর্মীয় প্রভাব বিদায় নেয় আর সেকুলাররা শক্তিমান হয়ে ওঠে। মুসলিম দেশগুলোতে একইভাবে জাতিতাত্ত্বিক সঙ্ঘাত সংঘর্ষ চলতে থাকলে সেকুলার মুসলিমরা রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। পাশ্চাত্যের এই দুই লক্ষ্যের কতটা অর্জিত হবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে ইরানের অভ্যন্তরে যে বড় ধরনের পরিবর্তনে সূচনা ঘটতে যাচ্ছে তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এই পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণটি দেখা যাবে সম্ভবত মজলিস ও বিশেষজ্ঞ পরিষদ নির্বাচনে।
No comments