নতুন ভূ-অর্থনীতির সন্ধানে by জোসেফ ই স্টিগলিৎস
গত
বছরটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য স্মরণীয় বছর ছিল। সেটা শুধু এই কারণে নয় যে
অর্থনীতির সূচক নিম্নমুখী ছিল। গত বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর
পরিবর্তন এসেছে, তার গতি যেমন ভালোর দিকে ছিল, তেমনি খারাপের দিকেও ছিল।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল গত মাসে প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু-বিষয়ক চুক্তি। চুক্তির ধারা অনুসারে এটি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক্-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই রাখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই চুক্তি একটি ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে, তা হলো পৃথিবী অপ্রতিরোধ্যভাবে সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেদিন খুব দূরে নয়, যখন জীবাশ্ম জ্বালানি প্রধানত অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে। ফলে যাঁরা কয়লায় বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা নিজেদের ঝুঁকিতেই তা করছেন। আর সবুজ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমরা আশা করতে পারি, এই খাতের বিনিয়োগকারীরা কয়লাশিল্পে বিনিয়োগকারী লবির শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন, যাঁরা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে পৃথিবীকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।
উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী অর্থনীতি থেকে এই সরে আসা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে কয়েকটি বড়সড় পরিবর্তনের একটি হিসেবে চিহ্নিত হবে। চীনের উৎপাদনের পরিমাণ এবং তার বাজারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য পরিবর্তনগুলোও অবশ্যম্ভাবী। নতুন উন্নয়ন ব্যাংক ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) গত বছরই চালু হয়েছে। এটি দুনিয়ার প্রথম বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার নেতৃত্বে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বাধা সত্ত্বেও গত বছর চীনের নেতৃত্বে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার কার্যক্রম এ মাসেই শুরু হওয়ার কথা। মুদ্রাবাজারে যেখানে চীনের মুদ্রার প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বেশ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মজুত সম্পদে চীনের মুদ্রা রেনমিনবি (ইউয়ান) যুক্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাদ সাধেনি। এর পাশাপাশি ওবামা প্রশাসন পাঁচ বছর আগে আইএমএফে চীনসহ অন্যান্য উদীয়মান দেশের ভোটাধিকারের প্রশ্নে যে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল, মার্কিন কংগ্রেস গত বছর সেটা অনুমোদন করেছে। এটা অর্থনীতির নতুন বাস্তবতাকে একরকম মেনে নেওয়া।
গত বছরের ভূ-অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হয়েছে বাণিজ্যক্ষেত্রে। অনেক বছর ধরে উদ্দেশ্যহীন আলোচনার পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা ডেভেলপমেন্ট রাউন্ডকে নীরবে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বাণিজ্য চুক্তির ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য, যেসব চুক্তিতে উন্নত দেশগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামি দোহা রাউন্ডের পথে এক অনতিক্রম্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে মুক্তবাণিজ্যের কথা বললেও সুতাসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে নিতে রাজি নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বাণিজ্য চুক্তি ও ব্লকগুলোকে টপকে ‘ভাগ করো ও দখল করো’ নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে দেখা গেল, যেখানে বৈশ্বিক পরিসরে মুক্তবাণিজ্যের জগৎ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এক বিসদৃশ ও নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য জগৎ সৃষ্টি হলো। প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় পাশের অধিকাংশ বাণিজ্যই এখন এই চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, পণ্যের জটিল উৎসবিধি নিয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা হবে, যেটা দক্ষতার মৌলিক নীতি ও পণ্যের অবাধ প্রবাহের বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্র এই দশকের সবচেয়ে বাজে বাণিজ্য চুক্তি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) করতে গোপনে নানা আলোচনা চালিয়েছে। অবশ্য এই চুক্তি নিয়ে দেশটিতে গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে; ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও রিপাবলিকান দলের অনেকেই এর বিরোধিতা করছেন, ফলে ওবামা প্রশাসনের পক্ষে কংগ্রেসে এটার অনুসমর্থন পাওয়া সহজ হবে না। সমস্যাটা চুক্তির বাণিজ্যের ধারা নিয়ে নয়, ‘বিনিয়োগ’ ধারা নিয়ে। এসব ধারা মারাত্মকভাবে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিধির পরিপন্থী। এমনকি আর্থিক নিয়ন্ত্রণবিধির সঙ্গেও টিপিপি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ওই ধারায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই অধিকার দেওয়া হয়েছে যে সরকারের কোনো বিধান টিপিপির (ছয় হাজার পাতারও বেশি পরিসরে তা লেখা আছে) পরিপন্থী হলে তারা সংশ্লিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে বেসরকারিভাবে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারবে। অতীতে এই ধরনের ট্রাইব্যুনাল সরকারি আইন বিলোপ করার ভিত্তি হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাধ্যবাধকতাকে ‘ন্যায্য ও যথাযথ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি সেই আইন যদি বৈষম্যমূলক নাও হয় এবং জনগণকে শুধু নতুন নতুন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত হয়ে থাকে, তাহলেও।
এই চুক্তির ভাষা জটিল। এমনকি পৃথিবীকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ থেকে রক্ষা করার জন্য যে আইন আছে, তাও এর সামনে ঠুনকো হয়ে যায়। শুধু সিগারেট-সংক্রান্ত আইনই নিরাপদ মনে হয় (সিগারেটের মোড়কে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নরম কথা লেখার জন্য উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়া সরকার যে বিধান করেছিল, তার বিরুদ্ধে করপোরেশন মামলা করেছিল। এটা বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল)। কিন্তু আরও অনেক ক্ষেত্রে মামলা করার সম্ভাবনা নিয়ে বহু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তা ছাড়া, ‘সবচেয়ে আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের’ যে বিধান রয়েছে, তাতে করপোরেশনগুলো দাবি করতে পারে, সংশ্লিষ্ট দেশের চুক্তিতে যে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার বিধান রয়েছে, তাদের সেটা দিতে হবে। এতে মান অবনমনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে, যদিও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঠিক এর উল্টোটাই চান।
এমনকি ওবামা যেভাবে এই বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে কথা বলেন, তাতে বোঝা যায়, তাঁর প্রশাসন উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে কতটা দূরে। তিনি বারবার বলেছেন, টিপিপির মাধ্যমে ঠিক হবে, ২১ শতকের বাণিজ্যবিধি কে লিখবে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিটি হচ্ছে, স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এমন বিধান প্রণয়ন করা, যেখানে সবার কথাই থাকবে। ওবামা পুরোনো রীতিকেই চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে মার্কিন করপোরেশন তার নিজের স্বার্থেই বৈশ্বিক বাণিজ্যবিধি প্রণয়ন করে। যাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থা রাখেন, তাঁদের কাছে এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল গত মাসে প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু-বিষয়ক চুক্তি। চুক্তির ধারা অনুসারে এটি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক্-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই রাখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই চুক্তি একটি ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে, তা হলো পৃথিবী অপ্রতিরোধ্যভাবে সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেদিন খুব দূরে নয়, যখন জীবাশ্ম জ্বালানি প্রধানত অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে। ফলে যাঁরা কয়লায় বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা নিজেদের ঝুঁকিতেই তা করছেন। আর সবুজ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমরা আশা করতে পারি, এই খাতের বিনিয়োগকারীরা কয়লাশিল্পে বিনিয়োগকারী লবির শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন, যাঁরা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে পৃথিবীকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।
উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী অর্থনীতি থেকে এই সরে আসা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে কয়েকটি বড়সড় পরিবর্তনের একটি হিসেবে চিহ্নিত হবে। চীনের উৎপাদনের পরিমাণ এবং তার বাজারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য পরিবর্তনগুলোও অবশ্যম্ভাবী। নতুন উন্নয়ন ব্যাংক ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) গত বছরই চালু হয়েছে। এটি দুনিয়ার প্রথম বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার নেতৃত্বে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বাধা সত্ত্বেও গত বছর চীনের নেতৃত্বে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার কার্যক্রম এ মাসেই শুরু হওয়ার কথা। মুদ্রাবাজারে যেখানে চীনের মুদ্রার প্রসঙ্গ এসেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বেশ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মজুত সম্পদে চীনের মুদ্রা রেনমিনবি (ইউয়ান) যুক্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাদ সাধেনি। এর পাশাপাশি ওবামা প্রশাসন পাঁচ বছর আগে আইএমএফে চীনসহ অন্যান্য উদীয়মান দেশের ভোটাধিকারের প্রশ্নে যে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল, মার্কিন কংগ্রেস গত বছর সেটা অনুমোদন করেছে। এটা অর্থনীতির নতুন বাস্তবতাকে একরকম মেনে নেওয়া।
গত বছরের ভূ-অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হয়েছে বাণিজ্যক্ষেত্রে। অনেক বছর ধরে উদ্দেশ্যহীন আলোচনার পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা ডেভেলপমেন্ট রাউন্ডকে নীরবে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বাণিজ্য চুক্তির ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য, যেসব চুক্তিতে উন্নত দেশগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামি দোহা রাউন্ডের পথে এক অনতিক্রম্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে মুক্তবাণিজ্যের কথা বললেও সুতাসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের ওপর ভর্তুকি উঠিয়ে নিতে রাজি নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনার বদলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বাণিজ্য চুক্তি ও ব্লকগুলোকে টপকে ‘ভাগ করো ও দখল করো’ নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে দেখা গেল, যেখানে বৈশ্বিক পরিসরে মুক্তবাণিজ্যের জগৎ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এক বিসদৃশ ও নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য জগৎ সৃষ্টি হলো। প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় পাশের অধিকাংশ বাণিজ্যই এখন এই চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, পণ্যের জটিল উৎসবিধি নিয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা হবে, যেটা দক্ষতার মৌলিক নীতি ও পণ্যের অবাধ প্রবাহের বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্র এই দশকের সবচেয়ে বাজে বাণিজ্য চুক্তি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) করতে গোপনে নানা আলোচনা চালিয়েছে। অবশ্য এই চুক্তি নিয়ে দেশটিতে গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে; ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও রিপাবলিকান দলের অনেকেই এর বিরোধিতা করছেন, ফলে ওবামা প্রশাসনের পক্ষে কংগ্রেসে এটার অনুসমর্থন পাওয়া সহজ হবে না। সমস্যাটা চুক্তির বাণিজ্যের ধারা নিয়ে নয়, ‘বিনিয়োগ’ ধারা নিয়ে। এসব ধারা মারাত্মকভাবে পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিধির পরিপন্থী। এমনকি আর্থিক নিয়ন্ত্রণবিধির সঙ্গেও টিপিপি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ওই ধারায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই অধিকার দেওয়া হয়েছে যে সরকারের কোনো বিধান টিপিপির (ছয় হাজার পাতারও বেশি পরিসরে তা লেখা আছে) পরিপন্থী হলে তারা সংশ্লিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে বেসরকারিভাবে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারবে। অতীতে এই ধরনের ট্রাইব্যুনাল সরকারি আইন বিলোপ করার ভিত্তি হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাধ্যবাধকতাকে ‘ন্যায্য ও যথাযথ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি সেই আইন যদি বৈষম্যমূলক নাও হয় এবং জনগণকে শুধু নতুন নতুন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত হয়ে থাকে, তাহলেও।
এই চুক্তির ভাষা জটিল। এমনকি পৃথিবীকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ থেকে রক্ষা করার জন্য যে আইন আছে, তাও এর সামনে ঠুনকো হয়ে যায়। শুধু সিগারেট-সংক্রান্ত আইনই নিরাপদ মনে হয় (সিগারেটের মোড়কে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নরম কথা লেখার জন্য উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়া সরকার যে বিধান করেছিল, তার বিরুদ্ধে করপোরেশন মামলা করেছিল। এটা বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল)। কিন্তু আরও অনেক ক্ষেত্রে মামলা করার সম্ভাবনা নিয়ে বহু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তা ছাড়া, ‘সবচেয়ে আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের’ যে বিধান রয়েছে, তাতে করপোরেশনগুলো দাবি করতে পারে, সংশ্লিষ্ট দেশের চুক্তিতে যে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার বিধান রয়েছে, তাদের সেটা দিতে হবে। এতে মান অবনমনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে, যদিও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঠিক এর উল্টোটাই চান।
এমনকি ওবামা যেভাবে এই বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে কথা বলেন, তাতে বোঝা যায়, তাঁর প্রশাসন উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে কতটা দূরে। তিনি বারবার বলেছেন, টিপিপির মাধ্যমে ঠিক হবে, ২১ শতকের বাণিজ্যবিধি কে লিখবে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিটি হচ্ছে, স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এমন বিধান প্রণয়ন করা, যেখানে সবার কথাই থাকবে। ওবামা পুরোনো রীতিকেই চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে মার্কিন করপোরেশন তার নিজের স্বার্থেই বৈশ্বিক বাণিজ্যবিধি প্রণয়ন করে। যাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থা রাখেন, তাঁদের কাছে এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস |
যাঁরা
পৃথিবীর অর্থনীতির অঙ্গীভূতকরণের কথা বলেন, তাঁদের ঘাড়ে বৈশ্বিক
শাসনব্যবস্থা সংস্কারের বিশেষ দায়িত্ব বর্তেছে। অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়নের
দায়িত্ব যদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়, তাহলে ওসব নীতি প্রণয়ন
ও বাস্তবায়নে বিশেষভাবে গণতান্ত্রিক হতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে
২০১৫ সালে ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। ২০১৬ সালে আমাদের আশা করা উচিত,
টিপিপির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য চুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে,
যেখানে শক্তিশালীরা পুরস্কৃত হবে না, দুর্বলেরা শাস্তি পাবে না। প্যারিস
সম্মেলন এই চেতনা ও মনোভাবের অগ্রদূত হোক, সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক সহযোগিতা
টিকিয়ে রাখার জন্য যার প্রয়োজন রয়েছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
No comments