ব্র্যাকের আইনের শাসনসূচক ও বাস্তবতা by মিজানুর রহমান খান

কোনো দেশের আইনের শাসনের তল মাপতে জাতিসংঘ যতগুলো সূচক ব্যবহার করে, তার মধ্যে পুলিশ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সততা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা অন্যতম। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে, কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের মধ্যে সংঘাত কতটা?
বেশ কিছুদিন ধরে আমরা আইএস বা জঙ্গিবাদ আছে কি নেই বা থাকলেও সে জন্য কে কতটা দায়ী কিংবা সত্যিই কতখানি আছে, তা নিয়ে বিরাট একটা তর্কাতর্কির মধ্যে আছি। কিন্তু এর আড়ালে সাধারণভাবে সামাজিক অপরাধ বেশ উদ্বেগজনকভাবে যে বেড়ে চলছে, সেটা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণাপত্র।
ইদানীং যখন জানছি যে, আমাদের গড় আয়ুষ্কাল ৭০ বছর ছাড়িয়ে গেছে, তখন বেশ একটা গর্ববোধ হলো যে, আমরা অনেক উন্নত দেশের মতো এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দ্য স্টেট অব গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ ২০১৪-১৫: ইনস্টিটিউশন্স আউটকামস অ্যাকাউন্টিবিলিটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে, দেশে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে আর কমে না। জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়লে আর কমে না। সেভাবে দিন যত গড়াবে, ততই কি এ দেশে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে? এর হার কখনো কমবে না? পদ্মা সেতু, পাতালরেল, বর্ধিষ্ণু জিডিপি ইত্যাদি দিয়ে আমরা বিএনপির শাসনামলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শাসন তফাত করতে পারি, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে মানুষের জীবনে নিরাপত্তাবোধ বেড়েছে, সেটা আমরা কী করে দাবি করব? এমনটা নিশ্চয় কোনো যুক্তির কথা নয় যে, বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলাটা একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রবণতা।
২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ের অপরাধচিত্র তুলে ধরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বলেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র্যা বের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গত ১২ বছরে বাংলাদেশে অপরাধ বাড়ছেই। ২০০২–এ ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার অপরাধ, সেটা এখন বেড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গত ১২ বছরে সব থেকে কম অপরাধের মামলা রেকর্ডভুক্ত হয়েছিল ২০০৪ সালে। মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার। পুলিশের সংস্কার বা নির্দলীয়করণ নিয়ে কথা বলায় এখন ক্লান্তিকাল চলছে। অথচ ঘটনাগুলো এমন ঘটছে যে, গুম (২০১৪ সালে ৮৮টি) নামের একটি মহা আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে, যা আগে ছিল না। ২০০৫ সালে যেখানে নির্যাতনের ঘটনা ছিল ২৬টি, ২০০৯ সালে তা ৮৯টিতে উন্নীত হয়েছে।
সর্বোচ্চ অপরাধের মামলা রেকর্ড হয়েছে একতরফা নির্বাচনের বছর হিসেবে খ্যাত ২০১৪ সালে। ওই প্রতিবেদন আরও বলেছে, ‘নরহত্যা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। বছরে তিন হাজার নরহত্যা একটি স্থায়ী প্রবণতায় রূপ নিয়েছে। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫১৪টি নরহত্যার ঘটনা ঘটেছে।’ পুলিশ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই হিসাব। বাস্তবে এটা নিশ্চয় আরও বেশি। ইদানীং আমরা ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন থাকার একটি পরিসংখ্যান উচ্চারিত হতে দেখি। কিন্তু সব থেকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত নরহত্যার মামলাগুলোর কতগুলো নিষ্পত্তি হলো, কতগুলো বিচারাধীন থাকল, সে বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে জানতে পারি না। পুলিশ বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে এ বিষয়ে পরিসংখ্যানগত একটা আদান–প্রদান চালু করা দরকার। বর্তমানে এ ধরনের তথ্যগত কোনো বিনিময় এই দুই বিভাগের মধ্যে ঘটে না।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে তুলনা করে দেখি, ভারতে হত্যা আমাদের থেকে বেশি। মিয়ানমারে অনেক কম। ২০০০ সালে জনসংখ্যার প্রতি এক লাখে হত্যা ছিল ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে যথাক্রমে সাড়ে চার, দুই ও আড়াই জন। ২০১২ সালে এসে এটা বদলে গেছে। ভারতে একজন কমে গেছে। মিয়ানমারে হত্যা বেড়ে বাংলাদেশের সমান হয়েছে। যাঁরা যুক্তি দিতে চাইবেন যে, নরহত্যা হলো এমন একটি বিষয়, যা কোনো রাষ্ট্রে ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে। এটা বাড়বে, কখনো কমবে না। আশা করি, তাঁরা দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উদাহরণ বিবেচনায় নেবেন। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা ও গবেষণা সংস্থা ‘নিমা’র তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আমরা আরও একটি তুলনা করেছি। কারণ, অনেক সময় আমাদের মন্ত্রীগণ উদাহরণ হিসেবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সংঘটিত অপরাধের তথ্য হাজির করেন। তাঁরা বলেন, উন্নত রাষ্ট্রে যদি বড় ধরনের অপরাধ ঘটে, তাতে যদি শাসনব্যবস্থার সবলতা-দুর্বলতা প্রসঙ্গ না আসে, তাহলে বাংলাদেশে আসবে কেন?
আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নরহত্যা–সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখি, এই দুটি উন্নত রাষ্ট্রেও নরহত্যা ক্রমবর্ধমান নয়। দুই প্রতিবেশীর মতো এই দুই উন্নত রাষ্ট্রেও নরহত্যার পরিসংখ্যানের মধ্যে ওঠানামা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে কেবলই বাড়ে। ব্র্যাক প্রতিবেদনের ৫৪ পৃষ্ঠায় সরকারি তথ্যসূত্রের বরাতে হত্যা বিষয়ে একটি লেখচিত্র আছে। তাতে দেখানো হয়েছে, ২০০৪ সালে বছরে তিন হাজার নরহত্যা দিয়ে যে ধারা শুরু হয়েছে, তার আর থামাথামি নেই। ২০০৯ থেকে ২০১২—এই চার বছরের প্রতিবছরে চার হাজার নরহত্যা ঘটেছে। আর সেটা ২০১৪ সালে সাড়ে চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এটাও আমরা বিবেচনায় নেব যে, এই বর্ধিত হারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম। সেখানে ২০০৯ সালে প্রতি লাখে প্রায় পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু ২০১২ পর্যন্ত সেটা ক্রমাগত কমেছে। আর ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক ধাপে প্রতি লাখে চারটি নরহত্যার নিচে নেমে এসেছে। নিমার লেখচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ে (২০০৯-২০১২) বাংলাদেশ প্রতি লাখে গড়ে আড়াই জনের বেশি নরহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে। উন্নত রাষ্ট্র হলেই নরহত্যা বেশি ঘটবে, তা-ও কিন্তু ঠিক নয়। যুক্তরাজ্য তার উদাহরণ। ওই চার বছরে যুক্তরাজ্যে প্রতি লাখে মাত্র একটি নরহত্যা ঘটেছে। ২০১৩ সালে সেই পরিসংখ্যান আরও নিম্নমুখী হয়েছে। অথচ ২০০২ সালে প্রতি লাখে দুটি নরহত্যার ঘটনা ঘটেছিল।
আমরা জেনেছি, আমাদের পুলিশ নরহত্যার চেয়ে ডাকাতিতে বেশি বিচলিত হয়। এর কারণ, স্বামী-স্ত্রী বা জমিসংক্রান্ত বিরোধে খুনোখুনি করলে পুলিশের কী করার আছে। তাদের ওপর দায় চাপে যখন নাকি সংঘটিত গোষ্ঠীর হাতে হত্যাকাণ্ড ঘটে। নরহত্যা বৃদ্ধির জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে শতভাগ নিশ্চয় দায়ী করা যাবে না। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, নরহত্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ব্র্যাক গবেষকেরা বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট থেকেই তথ্য নিয়েছে। কিন্তু পুলিশের ওয়েবসাইটে ধর্ষণ–বিষয়ক তথ্য পরিষ্কারভাবে পাওয়ার সুযোগ নেই। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন’-এর নিচে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে। এভাবে গুলিয়ে ফেলায় না বোঝা যাবে নারী নির্যাতন, না বোঝা যাবে শিশু নির্যাতনের হ্রাস-বৃদ্ধি। তদুপরি একটা প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক যে, গত ১২ বছরের ব্যবধানে ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বছরে ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে পরের তিন বছরে ক্রমাগত কমিয়ে এটা ১১ হাজারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ২০০৩ সালের পরে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ২০ হাজারের সংখ্যা ছাড়িয়েছে। আর পরের তিন বছরের যা প্রবণতা তাতে ধারণা করি, বাংলাদেশ বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হওয়া দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। উপরন্তু এসব ঘটনায় দোষীদের সাজা পাওয়ার হার এখনো ২ শতাংশের নিচে। সরকারের পক্ষে যাঁরা বিদেশি খুনখারাবির উদাহরণ দেন তাঁরা একচোখা, কারণ তাঁরা সেসব দেশের খুন বা সন্ত্রাসী কাণ্ডের দ্রুত ও সার্থক বিচারের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেন না। ২০১৪ সালে ওই যে সাড়ে চার হাজার নরহত্যা, তাতে একজন করে খুনি থাকলে আমরা সাড়ে চার হাজার খুনি পেয়েছি। কিন্তু এটা অনুমেয় যে দোষীর শাস্তি পাওয়ার হার ১০ শতাংশের কম।
২০০৫ ও ২০০৬ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (যথাক্রমে ৩৯৬ ও ৩৫৫) ঘটেছিল। কিন্তু এরপর এটা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে ২০১২ সালে ১০০–র নিচে আসে। কিন্তু লম্বা বিরতির পর ২০১৩ সালে বিচারের বাইরের খুনখারাবি আবার সোয়া তিন শ অতিক্রম করেছে। অথচ ২০০১ সালে মাত্র ৪৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সব থেকে লক্ষণীয়, এর কোনো দায় রাষ্ট্র বা সরকার নিতে রাজি নয়। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের জোট আমলের সাড়ে চার শর বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটির তদন্ত চালাতে চাইছে না বর্তমান সরকার। এটা কী নির্দেশ করে? আইনের শাসনের উঠতি না পড়তি? ২০০২-০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টে ৫০ জনের বেশি ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা যান। এই পর্বের একটি দায়মুক্তি আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ শিগগিরই আশা করছেন ড. শাহদীন মালিক। তিনি জানালেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে, তবে দরখাস্ত হাতে তাদের আদালতে আসতে হবে।’
ব্র্যাক গবেষণাপত্র সীমিতভাবে আইনের শাসনের একটি সূচক তৈরি করেছে। বিচারবহির্ভূত খুন, নিরাপত্তা হেফাজতে খুন, নির্যাতন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তির ভিত্তিতে তারা একটি ঋণাত্মক সূচক (দশমিক ৮৯) স্থির করেছে। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আইনের শাসনের বিষয়ে যে গভীর নিম্নমুখী সূচক (১০২টি দেশের মধ্যে ৯৩তম) দিয়েছিল, তার সঙ্গে এর অমিল পাওয়া গেল না। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো, কিন্তু সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ার চেয়ে নিচে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল আইনের শাসন। দেশে সে রকম একটা ন্যূনতম অনুকূল পরিবেশ থাকুক, ওই হার্ট অ্যাটাকে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা, যাঁরা যদিও জানেন ম্যাজিস্ট্রেটরা তদন্ত করে ‘হৃদ্রোগে মৃত্যুর’ পাকা রিপোর্ট দিয়েছেন, প্রতিকারের জন্য তাঁরাও নতুন করে আশায় বুক বাঁধবেন। নতুন খ্রিষ্টীয় বছরের সূচনায় সম্ভবত আমাদের সবারই দ্বিধা কাটিয়ে তেমন আশা করা উচিত!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.