ক্ষেপিয়ে দাও, তারা হারবে by আলমগীর মহিউদ্দিন
মানুষের জীবনের একটি বাস্তবতা হলো, আশঙ্কা। সে জানে না, পরমুহূর্তে কী হবে। এর মাঝে সবচেয়ে বড় হলো ভয়। এটা সারা বিশ্বের মানুষকে আদিকাল থেকে তাড়িয়ে আসছে। ভীত নয়, এমন কেউ নেই। যে বা যারা ভীতির সৃষ্টি করছে, তারাও ভীত। সম্প্রতি রাজনীতির অধ্যাপক মাইকেল ব্রেনার (পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়) ইসলামের ওপর লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘মার্কিনিরা এখন মৃগীরোগগ্রস্ত। একের পর এক অভিঘাত দিয়ে তাদের মানসিক ভারসাম্য ও চিন্তা-অনুভূতির বিকাশকে স্থবির করে দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা দিয়ে ইসলামকে একটি ভয়ানক নির্যাতনের বাহন হিসেবে চিত্রায়িত করে বিশ্বের সব সমস্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যায়-অবিচারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এখানে আসলে মূল খেলোয়াড় হলো রাজনীতি ও ক্ষমতা। যারা রাজনীতি করেন এবং ক্ষমতাকে দখল ও ব্যবহার করতে চান, তারা সামাজিক অশান্তির কোনো ছেদ হোক, তা চান না।’
তাই গবেষণার শেষ নেই। কোনো ভয় এবং তা সৃষ্টির জন্য কোন পদ্ধতি সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী, তা নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে অবিরত। আসলে ভীতি সৃষ্টি করা ক্ষমতাবানদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তাদের মিথ্যাচার-অন্যায়ের প্রতিবাদ কেউ করতে পারে না। তবুও চক্ষুলজ্জা বলে তো একটি কথা আছে। ক্ষমতাবানেরা কোনো অন্যায় করতে পারে না- এটা তারা প্রমাণ না করতে পারলেও প্রতিভাত করতে চায়। সে জন্য প্রচারের মাধ্যমের ওপর তাদের আগ্রহ ও সজাগ দৃষ্টি। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাই মানুষকে ‘রাজনৈতিক জীব’ বলেছেন। অর্থাৎ এই ধর্মনিরপেক্ষ দার্শনিক ভাবতেন, মানুষ আসলে একটি পশু; কেননা তাদের উদ্ভব হয়েছিল পশু হিসেবে। কালের বিবর্তনে তারা মনুষ্যত্বের রূপ পায়। এরা অবশ্য ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুকূলে কিছুই বলেন না। একদল পশুকে নিরীক্ষণ করে একজন দার্শনিক মন্তব্য করেছিলেন, তারা একে অন্যকে আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে ভয়ের মধ্যে নীত হলেই শুধু শান্ত থাকে। তিনি বলেছেন, এটা মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। যেমন শক্তিমান ও প্রভুত্বকামী পশুটি অযথাই অন্য পশুদের খোঁচায় কিংবা তাদের খাদ্য বা অবস্থানকে দখলের চেষ্টা করে। তখন অন্য পশুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর তখন শুরু হয় যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে তারা শক্তিমানদের কাছে হেরে যায়।
এখন এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান উপাত্ত হয়ে পড়েছে। আর জন লেননের ভাষায় বলা যায়, ত্রাস সৃষ্টির উপাত্ত হলেই সবাই পদ্ধতির পুতুল হয়ে পড়ে। লেনন আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ক্ষমতা তোমাকে জ্বালাতন করবে, খোঁচাবে, বিরক্ত করবে যেমন তোমার দাড়ি ধরে টানবে, গালে টোকা দেবে যাতে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করো; যাতে তুমি ক্ষেপে যাও। সরকার ঠিক এমনটিই চাইছে। কারণ, মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে গেলে সে লড়াই করবে তার অধিকারের জন্য এবং তখন সরকার তাকে কেমনভাবে পোষ মানাতে হয়, জানে।’ রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আইনজ্ঞ জন ডব্লিউ হোয়াইটহেড এ সম্পর্কে তেরোটি অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন, সরকার এভাবে জনগণকে তাদের পুতুল বানায়- ক্ষমতার পুতুল। অবস্থাগুলো কী? (১) সরকার পুরোপুরি দুর্নীতিবাজ হয়; (২) নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সব কিছুতে নাক গলায়; (৩) জনগণের ওপর নানভাবে অত্যাচার করে, যাতে সাধারণ মানুষ ভীত থাকে; (৪) খবরদারি, সরকারি বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি; (৫) সবাইকে অপরাধী গণ্য করে ধরপাকড়, হেনস্তা করা দৈনন্দিন বিষয় হওয়া এবং এমন কর্মকাণ্ডে শিশু-বৃদ্ধ-নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা; (৬) রাজনীতিকে ঠাট্টার বিষয় হিসেবে পরিগণিত করা এবং সরকার কোনো জবাবদিহিতায় না যাওয়া ও জনগণের সব অধিকার সীমিত করা; (৭) জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার পরিবর্তে জনগণের ওপর শাসন ও শোষণ করা, প্রতিবাদ-সমালোচনার অধিকার কেড়ে নেয়া, নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা; (৮) আঘাতগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্তরা যেন কোনোক্রমে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেয়া; (৯) অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে যে কাউকে অন্তরীণ, গুম বা খুন করা; (১০) জনগণের নামে ক্ষমতাবানদের সরকারি অর্থ খরচ করা এবং কৌশলে লুট করা; (১১) সরকারি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিকভাবে জনগণের বিরক্তির চিহ্নকে প্রচার দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা; (১২) ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার ওপর সরকারি নজরদারি; (১৩) সরকারের বহু অনাকাঙ্ক্ষিত আইন প্রণয়ন, যাতে বক্তব্যের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত এবং মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
হোয়াইটহেড বলেছেন, এগুলোর ফলে জনগণ ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে বাধ্য এবং একসময়ে তারা ক্ষেপে যায়। এটাই সরকার চায়। কারণ, এই ছুতায় তারা চায় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার নামে তীব্র দমনক্রিয়া চালু রেখে ক্ষমতার ভিত পোক্ত করতে। আসলে এসব কর্মকাণ্ড ও অনাচারের মূলে একটি মাত্র বিষয় এবং তা হলো- প্রভু কে? দাস কে? জনগণ প্রভু, না সরকার প্রভু? ক্ষমতাবানেরা সরকার চালায় এবং তারা প্রভু থাকতে চায়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দাস নয়, প্রভুই হতে চায়।
এই অবস্থা এখন প্রথম বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বে বিশেষভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছে। ‘জনকল্যাণ, গণ-অধিকার এখন কোনো আলোচ্য বিষয় নয়।’ হোয়াইটহেডের সাথে সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করবেন না। তিনি এ অবস্থাকে ‘প্রেসারকুকারের’ সাথে তুলনা করেছেন। প্রেসারকুকারের কিছু বাষ্প সময়মতো বেরিয়ে যেতে না দিলে যেমন এটাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, তেমনি জনগণের ওপর নিবর্তনের চাপ ক্রমান্বয়ে চালু রাখলে বিস্ফোরণ ঘটে। ক্ষমতাবান এবং সরকার তা জানে। এ অবস্থাকে দার্শনিক আব্রাহাম কাপলান হাতুড়ি ও পেরেকের সম্পর্কের সাথে তুলনা করে বলেছেন, হাতুড়ি যেমন সব কিছুকেই পেরেক মনে করে আঘাত হানে, ঠিক তেমনি আজকের সরকারগুলো প্রত্যেক মানুষকে প্রতিপক্ষ ভেবে আঘাত হানতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হাতুড়ি আঘাত করলে যেমন পেরেক থেকে স্ফুলিঙ্গ বের হয়, তেমনি সরকারি নিষ্পেষণ পরিণামে জনবিস্ফোরণ ঘটায়।
সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রী ড. পল ক্রেইগ রবার্টস ‘পশ্চিমা সভ্যতায় আইনের শাসন’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ‘জনবিস্ফোরণ ঠেকাতে আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি। আইন যেমন জনকল্যাণকামী হওয়া প্রয়োজন, তেমনি কোর্টগুলোও নিরপেক্ষভাবে জনগণের সেবা করা প্রয়োজন। তিনি আইন ও কোর্টের কার্যক্রমের ওপর বিশদ আলোচনা করে বলেছেন, সেই আইন জনবিস্ফোরণ ঠেকায়, যা কল্যাণকামী। যদি আইন ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রণয়ন হয় এবং তা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে প্রয়োগ করতে হয়, সে আইন জনবিরোধী হয়ে থাকে। এমন আইনের শাসনে ন্যায়ের অবস্থিতি থাকে না এবং জনপ্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ক্ষমতালোভীরা এমন অবস্থাই কামনা করে। এমন অবস্থায় দেখা যায়, আইনের শাসনের নামে আইনভঙ্গ সরকারই করে থাকে। এর জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবাদী প্রতিপক্ষকে। ফলে সামাজিক অশান্তি বিরাজ করে সব সময়। এতে জনগণের ক্ষতি বা কষ্ট হলেও সরকারের সুবিধা হয় বলে মন্তব্য করেছেন ড. রবার্টস। কারণ, এমন ক্ষেত্রে সরকারের অন্যায়কারীরা আইনের আশ্রয় পায় এবং জনগণ প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। আর এমন অবস্থায় সত্যিকারের অপরাধীরা সরকারের সাথে লীন হয়ে তাদের কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিদিনের সংবাদে ভয়াবহ মৃত্যু ও ধ্বংসের খবর এলেও তা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন পুলিশের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং কেউ কেউ এই অবস্থাকে ‘পুলিশি রাজ্য’ বলে বর্ণনা করে থাকেন।
ড. রবার্টস লিখেছেন, ‘এমন পুলিশি রাষ্ট্র তখনই কায়েম হয় যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় থাকেন। রাষ্ট্রশক্তির এই অংশের সদস্যদের ক্ষমতাবানেরা কখনো তাদের অপকর্মে বাধা দেন না বা বাধা দিলে তাদের ক্ষমতার সময় স্বল্প হয়ে যায়।’ তাই তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘এমন পরিস্থিতিতে আইন জনগণের রক্ষাকবচ না হয়ে ক্ষমতাসীনদের অস্ত্রে পরিণত হয়।’
এখন সর্বত্র সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা। তবে তা দু’ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। সন্ত্রাসে অভিযুক্তরা যদি মুসলমান হয়, তবে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর অন্যদের জন্য যুক্তি বের করার চেষ্টা হয় এই বলে যে, তাদের এমনটি করতে হয়েছে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড মুসলিম দেশগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে। অমুসলিম শক্তিশালী দেশগুলোর জন্য এ স্লোগান অত্যন্ত যুৎসই। কারণ এ অপবাদের ধুয়া তুলে তারা কয়েক দশক ধরে মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং তাকে বৈধ করে নিচ্ছে। আর মুসলিম দেশগুলোতে এটা ব্যবহার করছে বিশেষ করে স্বৈরশাসকেরা, যারা পুরোপুরিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। এ ছাড়া তৃতীয় বিশ্বেও এর ব্যবহার কম নয়। হয়তো শিগগিরই সন্ত্রাসের বুলির নতুন শব্দ আসবে। যেমন মৌলবাদী শব্দটি এখন কম ব্যবহার হচ্ছে। ইকোনমিস্টের মতে, এটা ছিল মুসলমানদের নিন্দা করার জন্য ২০তম শব্দ।
হোয়াইটহেডের কথা দিয়ে এ উপসংহার টানা যায় যে, বাংলাদেশের পুরনো প্রবাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রবাদটি হলো- ‘শঠে শাঠ্যং সমাচারেৎ’- অর্থাৎ শঠের সাথে শঠতা করতে হবে। নতুবা সে কোনো কথা বোঝে না। এটা সত্যি। তবে তাতে পূর্ণ সফলতা নেই। সরকার ক্ষেপিয়ে দিয়ে তার ‘স্টিম রোলার চালাতে’ চায় সত্য, তবে সে রোলারের মানুষটি সে কর্মকাণ্ডটি নাও চাইতে পারে। কেবল ঐক্য ও কৌশলী পন্থাই শ্রেয়।
তাই গবেষণার শেষ নেই। কোনো ভয় এবং তা সৃষ্টির জন্য কোন পদ্ধতি সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী, তা নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে অবিরত। আসলে ভীতি সৃষ্টি করা ক্ষমতাবানদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তাদের মিথ্যাচার-অন্যায়ের প্রতিবাদ কেউ করতে পারে না। তবুও চক্ষুলজ্জা বলে তো একটি কথা আছে। ক্ষমতাবানেরা কোনো অন্যায় করতে পারে না- এটা তারা প্রমাণ না করতে পারলেও প্রতিভাত করতে চায়। সে জন্য প্রচারের মাধ্যমের ওপর তাদের আগ্রহ ও সজাগ দৃষ্টি। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাই মানুষকে ‘রাজনৈতিক জীব’ বলেছেন। অর্থাৎ এই ধর্মনিরপেক্ষ দার্শনিক ভাবতেন, মানুষ আসলে একটি পশু; কেননা তাদের উদ্ভব হয়েছিল পশু হিসেবে। কালের বিবর্তনে তারা মনুষ্যত্বের রূপ পায়। এরা অবশ্য ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুকূলে কিছুই বলেন না। একদল পশুকে নিরীক্ষণ করে একজন দার্শনিক মন্তব্য করেছিলেন, তারা একে অন্যকে আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে ভয়ের মধ্যে নীত হলেই শুধু শান্ত থাকে। তিনি বলেছেন, এটা মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। যেমন শক্তিমান ও প্রভুত্বকামী পশুটি অযথাই অন্য পশুদের খোঁচায় কিংবা তাদের খাদ্য বা অবস্থানকে দখলের চেষ্টা করে। তখন অন্য পশুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর তখন শুরু হয় যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে তারা শক্তিমানদের কাছে হেরে যায়।
এখন এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান উপাত্ত হয়ে পড়েছে। আর জন লেননের ভাষায় বলা যায়, ত্রাস সৃষ্টির উপাত্ত হলেই সবাই পদ্ধতির পুতুল হয়ে পড়ে। লেনন আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ক্ষমতা তোমাকে জ্বালাতন করবে, খোঁচাবে, বিরক্ত করবে যেমন তোমার দাড়ি ধরে টানবে, গালে টোকা দেবে যাতে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করো; যাতে তুমি ক্ষেপে যাও। সরকার ঠিক এমনটিই চাইছে। কারণ, মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে গেলে সে লড়াই করবে তার অধিকারের জন্য এবং তখন সরকার তাকে কেমনভাবে পোষ মানাতে হয়, জানে।’ রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আইনজ্ঞ জন ডব্লিউ হোয়াইটহেড এ সম্পর্কে তেরোটি অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন, সরকার এভাবে জনগণকে তাদের পুতুল বানায়- ক্ষমতার পুতুল। অবস্থাগুলো কী? (১) সরকার পুরোপুরি দুর্নীতিবাজ হয়; (২) নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সব কিছুতে নাক গলায়; (৩) জনগণের ওপর নানভাবে অত্যাচার করে, যাতে সাধারণ মানুষ ভীত থাকে; (৪) খবরদারি, সরকারি বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি; (৫) সবাইকে অপরাধী গণ্য করে ধরপাকড়, হেনস্তা করা দৈনন্দিন বিষয় হওয়া এবং এমন কর্মকাণ্ডে শিশু-বৃদ্ধ-নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা; (৬) রাজনীতিকে ঠাট্টার বিষয় হিসেবে পরিগণিত করা এবং সরকার কোনো জবাবদিহিতায় না যাওয়া ও জনগণের সব অধিকার সীমিত করা; (৭) জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার পরিবর্তে জনগণের ওপর শাসন ও শোষণ করা, প্রতিবাদ-সমালোচনার অধিকার কেড়ে নেয়া, নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা; (৮) আঘাতগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্তরা যেন কোনোক্রমে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেয়া; (৯) অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে যে কাউকে অন্তরীণ, গুম বা খুন করা; (১০) জনগণের নামে ক্ষমতাবানদের সরকারি অর্থ খরচ করা এবং কৌশলে লুট করা; (১১) সরকারি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিকভাবে জনগণের বিরক্তির চিহ্নকে প্রচার দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা; (১২) ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার ওপর সরকারি নজরদারি; (১৩) সরকারের বহু অনাকাঙ্ক্ষিত আইন প্রণয়ন, যাতে বক্তব্যের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত এবং মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
হোয়াইটহেড বলেছেন, এগুলোর ফলে জনগণ ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে বাধ্য এবং একসময়ে তারা ক্ষেপে যায়। এটাই সরকার চায়। কারণ, এই ছুতায় তারা চায় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার নামে তীব্র দমনক্রিয়া চালু রেখে ক্ষমতার ভিত পোক্ত করতে। আসলে এসব কর্মকাণ্ড ও অনাচারের মূলে একটি মাত্র বিষয় এবং তা হলো- প্রভু কে? দাস কে? জনগণ প্রভু, না সরকার প্রভু? ক্ষমতাবানেরা সরকার চালায় এবং তারা প্রভু থাকতে চায়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দাস নয়, প্রভুই হতে চায়।
এই অবস্থা এখন প্রথম বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বে বিশেষভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছে। ‘জনকল্যাণ, গণ-অধিকার এখন কোনো আলোচ্য বিষয় নয়।’ হোয়াইটহেডের সাথে সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করবেন না। তিনি এ অবস্থাকে ‘প্রেসারকুকারের’ সাথে তুলনা করেছেন। প্রেসারকুকারের কিছু বাষ্প সময়মতো বেরিয়ে যেতে না দিলে যেমন এটাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, তেমনি জনগণের ওপর নিবর্তনের চাপ ক্রমান্বয়ে চালু রাখলে বিস্ফোরণ ঘটে। ক্ষমতাবান এবং সরকার তা জানে। এ অবস্থাকে দার্শনিক আব্রাহাম কাপলান হাতুড়ি ও পেরেকের সম্পর্কের সাথে তুলনা করে বলেছেন, হাতুড়ি যেমন সব কিছুকেই পেরেক মনে করে আঘাত হানে, ঠিক তেমনি আজকের সরকারগুলো প্রত্যেক মানুষকে প্রতিপক্ষ ভেবে আঘাত হানতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হাতুড়ি আঘাত করলে যেমন পেরেক থেকে স্ফুলিঙ্গ বের হয়, তেমনি সরকারি নিষ্পেষণ পরিণামে জনবিস্ফোরণ ঘটায়।
সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রী ড. পল ক্রেইগ রবার্টস ‘পশ্চিমা সভ্যতায় আইনের শাসন’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ‘জনবিস্ফোরণ ঠেকাতে আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি। আইন যেমন জনকল্যাণকামী হওয়া প্রয়োজন, তেমনি কোর্টগুলোও নিরপেক্ষভাবে জনগণের সেবা করা প্রয়োজন। তিনি আইন ও কোর্টের কার্যক্রমের ওপর বিশদ আলোচনা করে বলেছেন, সেই আইন জনবিস্ফোরণ ঠেকায়, যা কল্যাণকামী। যদি আইন ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রণয়ন হয় এবং তা রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে প্রয়োগ করতে হয়, সে আইন জনবিরোধী হয়ে থাকে। এমন আইনের শাসনে ন্যায়ের অবস্থিতি থাকে না এবং জনপ্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ক্ষমতালোভীরা এমন অবস্থাই কামনা করে। এমন অবস্থায় দেখা যায়, আইনের শাসনের নামে আইনভঙ্গ সরকারই করে থাকে। এর জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবাদী প্রতিপক্ষকে। ফলে সামাজিক অশান্তি বিরাজ করে সব সময়। এতে জনগণের ক্ষতি বা কষ্ট হলেও সরকারের সুবিধা হয় বলে মন্তব্য করেছেন ড. রবার্টস। কারণ, এমন ক্ষেত্রে সরকারের অন্যায়কারীরা আইনের আশ্রয় পায় এবং জনগণ প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। আর এমন অবস্থায় সত্যিকারের অপরাধীরা সরকারের সাথে লীন হয়ে তাদের কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতিদিনের সংবাদে ভয়াবহ মৃত্যু ও ধ্বংসের খবর এলেও তা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন পুলিশের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং কেউ কেউ এই অবস্থাকে ‘পুলিশি রাজ্য’ বলে বর্ণনা করে থাকেন।
ড. রবার্টস লিখেছেন, ‘এমন পুলিশি রাষ্ট্র তখনই কায়েম হয় যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় থাকেন। রাষ্ট্রশক্তির এই অংশের সদস্যদের ক্ষমতাবানেরা কখনো তাদের অপকর্মে বাধা দেন না বা বাধা দিলে তাদের ক্ষমতার সময় স্বল্প হয়ে যায়।’ তাই তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘এমন পরিস্থিতিতে আইন জনগণের রক্ষাকবচ না হয়ে ক্ষমতাসীনদের অস্ত্রে পরিণত হয়।’
এখন সর্বত্র সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা। তবে তা দু’ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। সন্ত্রাসে অভিযুক্তরা যদি মুসলমান হয়, তবে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আর অন্যদের জন্য যুক্তি বের করার চেষ্টা হয় এই বলে যে, তাদের এমনটি করতে হয়েছে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড মুসলিম দেশগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে। অমুসলিম শক্তিশালী দেশগুলোর জন্য এ স্লোগান অত্যন্ত যুৎসই। কারণ এ অপবাদের ধুয়া তুলে তারা কয়েক দশক ধরে মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং তাকে বৈধ করে নিচ্ছে। আর মুসলিম দেশগুলোতে এটা ব্যবহার করছে বিশেষ করে স্বৈরশাসকেরা, যারা পুরোপুরিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। এ ছাড়া তৃতীয় বিশ্বেও এর ব্যবহার কম নয়। হয়তো শিগগিরই সন্ত্রাসের বুলির নতুন শব্দ আসবে। যেমন মৌলবাদী শব্দটি এখন কম ব্যবহার হচ্ছে। ইকোনমিস্টের মতে, এটা ছিল মুসলমানদের নিন্দা করার জন্য ২০তম শব্দ।
হোয়াইটহেডের কথা দিয়ে এ উপসংহার টানা যায় যে, বাংলাদেশের পুরনো প্রবাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রবাদটি হলো- ‘শঠে শাঠ্যং সমাচারেৎ’- অর্থাৎ শঠের সাথে শঠতা করতে হবে। নতুবা সে কোনো কথা বোঝে না। এটা সত্যি। তবে তাতে পূর্ণ সফলতা নেই। সরকার ক্ষেপিয়ে দিয়ে তার ‘স্টিম রোলার চালাতে’ চায় সত্য, তবে সে রোলারের মানুষটি সে কর্মকাণ্ডটি নাও চাইতে পারে। কেবল ঐক্য ও কৌশলী পন্থাই শ্রেয়।
No comments