তেল রফতানি বাজারে আমেরিকানদের প্রবেশ ঠেকানো by গৌতম দাস
ব্যাপারটা শেষ বিচারে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের দাম নামিয়ে ফেলার প্রতিযোগিতা। খবরটা আমাদের এ দিকের মিডিয়ায় নজরেই আসে নি। সেই খবরটা হলো, আমেরিকা এখন তেল রফতানিকারক দেশ। অনেকে অবশ্য খেয়াল করেননি আগে বা নিশ্চিত ছিলেন না যে আমেরিকা কি তেল রফতানিকারক দেশ ছিল না আগে! জবাব হচ্ছে হ্যাঁ, ছিল না। তবে কথাটা ভেঙে বলতে হবে- ছিল না মানে কী? রফতানি করার মতো তেল ছিল না নাকি, তেল ছিল কিন্তু আইন করে রোধ বা নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছিল? অর্থাৎ আমেরিকার রফতানি করার মতো তেল থাকা সত্ত্বেও আইন করে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছিল, যাতে রফতানি করা না যায়।
কবে থেকে এবং কেন?
কারণের বিস্তারে যাওয়া যাবে না এখন, সে অন্য প্রসঙ্গ তাই। তবে সংক্ষেপে বললে, আরব জাতীয়তাবাদী হয়ে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় ও শেষবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে আরবেরা খুব খারাপভাবে হেরে যায়। কিন্তু এতে এর চেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে সবাই আরব জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা ফেলে নিজ নিজ রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে ধরা; আরব জাতিয়তাবাদের ঝাণ্ডা আর কেউ বইতে রাজি না হওয়া। যেমনÑ আরব জাতীয়তাবাদী জামাল নাসেরের মিসর এর পর থেকে হয়ে যায় মিসরীয় জাতীয়তাবাদে। এখানে বলে রাখা ভালো, বাক্যগুলোকে এভাবে লেখা হচ্ছে এটা ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ হারানোর শোক থেকে একেবারেই নয়। বরং কথাগুলোকে আরব জোটবদ্ধতা হারানোর শোক হিসেবে দেখতে হবে। সেভাবেই লেখা। আরব জোটবদ্ধ যেটা ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য খুবই জরুরি পূর্বশর্ত। কিন্তু যুদ্ধে হেরে আরবদের দিক থেকে রাগের মাথায় একটা খুব বাজে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘তেল অবরোধ’ নামে পরিচিত সেই সিদ্ধান্ত। জ্বালানি তেলে সমৃদ্ধ আরবেরা পশ্চিমকে আর তেল বেচবে না। এই ছিল সিদ্ধান্তের সারকথা। মনে করা হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমকে খুব বড় বিপদে ফেলা যাবে। কারণ পশ্চিমা সভ্যতাÑ এর অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ফসিল ফুয়েল বা মাটির নিচের জ্বালানির ওপরে। দুনিয়াতে এই জ্বালানির বিরাট এক অংশ মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের কাছে। ফলে পশ্চিমারা বিরাট অসুবিধায় পড়বে। কথা সত্য কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রিলেশনাল, মানে পশ্চিমের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকার দিকটা কেউ ভালো করে দেখেনি। তেল না বেচলে ক্রেতার কী দশা হবে এটা যত বেশি নজর করা হয়েছিল, এর কণামাত্র নজর দেয়া হয়নি এতে বিক্রেতার কী দশা হবে। এতে ধরে নেয়া হয়ে গিয়েছিল যেন তেল বিক্রি করা বিক্রেতার একটা ঐচ্ছিক ব্যাপারÑ খেয়াল বা শখ। তেল বিক্রি যেন বিক্রেতারও গভীর প্রয়োজনের বিষয় নয়। অথচ ব্যাপারটা ছিল ঠিক এর উল্টো। প্রতিটি আরব রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশেষ করে বাজেটের রাজস্ব আয়ের একমাত্র উৎস ছিল ফসিল ফুয়েল বিক্রি। ফলে তেল বিক্রি না করলে পশ্চিমা শক্তি বিশাল বিপদে পড়বে সন্দেহ নেই; কিন্তু তেল বিক্রেতা দেশের অর্থনীতি চলবে কীভাবে? এ দিকটাতে এত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ফলাফল শেষ বিচারে আত্মঘাতী হিসেবে হাজির হয়েছিল। আরব জাতীয়তাবাদ থেকে মিসরীয় জাতীয়তাবাদ অথবা সিরীয় জাতীয়তাবাদ হয়ে যাওয়ার পেছনে এই ফ্যাক্টরগুলোও কাজ করেছিল। শেষ বিচারে তেল অবরোধ হয়ে ওঠে আরবদের জন্যই বুমেরাং, কাউন্টার প্রোডাকটিভ। এ ছাড়া যুদ্ধ মানেই আয়বিহীন একটি রাষ্ট্রের ব্যয়ে জড়িয়ে পড়া। সব আরব রাষ্ট্রের দশা ছিল তাই। যখন দরকার আরো আয় যাতে ওই আয়বিহীন একটি ব্যয়ে ভারসাম্য ফেরে। ফলে তেল অবরোধ না টেকার পেছনে এটাও একটি কারণ।
তবে তেল অবরোধ নামে তৎপরতাটাই, তা সে যত কম দিন কার্যকর থাকুকÑ তা পশ্চিমকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছিল। এরই প্রমাণ হলো ১৯৭৫ সালে উদ্বৃত্ত হোক আর না হোক, আমেরিকান তেল কোনো ব্যবসায়ী রফতানি করতে পারবে না বলে আইন পাস হয়েছিল। আইনটা পাসের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘আমেরিকার নিজের মজুদ তেল সংরক্ষণের (মানে এই তেল একমাত্র শেষ হতে হবে কেবল নিজেরা ভোগ করে, বিক্রি নয়) জন্য রফতানিকে নিরুৎসাহিত করতে এই বিল আনা দরকার’, তাই। ‘সংরক্ষণের’ এ কথা থেকে বোঝা যায় তাদের ভয়ের মাত্রা সম্পর্কে।
চল্লিশ বছর পরে এখন সেই আইন সংশোধন করে নেয়া হলো। এখন থেকে আমেরিকান তেল রফতানি করা যাবে। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, মূলত রিপাবলিকানদের উৎসাহ ও তাদেরই আনা বিল এবং তেল ব্যবসায়ী লবি যারা গত দু’বছর ধরে চেষ্টা করছিল এদেরই মিলিত আগ্রহে বিলটা আসে। আর ডেমোক্র্যাটরা যারা সংখ্যালঘু, এখন তারা অন্য একটি কিছু পাওয়ার আসায় সেই বিনিময়ে আনা এই আইনকে পাস হতে সম্মতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে আইনটি পাস হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫। প্রায় এক মাস আগে। এই অর্থে এটা কোনো একটা দলের একক নয়, বাই-পার্টিজান বা আমেরিকান দুই পার্টি মিলে নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত। আমেরিকান পুঁজিবাজারবিষয়ক মুখ্য পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করে লিখেছে, চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার পরে ‘এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক’ এবং ‘এতে আমেরিকান তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ের মুখে পড়ে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটবদল’ প্রতিফলিত। এসব বক্তব্য থেকে বোঝা গেল চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার ঘটনা এটা। কিন্তু ‘তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ে’ ঘটা ঘটনাটা কী? মানে ঠিক এখনই কেন তেল রফতানির অবরোধ তুলে নেয়া?
নতুন ধরনের এক তেলের উৎস একালে চালু হয়েছে- শেল অয়েল। চালু হয়েছে কথাটা টেকনোলজির দিক থেকে- টেকনোলজি চালু হওয়াতে শক্ত শ্লেট থেকে তেল উৎপাদন করা যাচ্ছে। শ্লেট-পেন্সিলে লেখার শ্লেটের মতো দেখতে স্তরের ওপর স্তর পড়া শক্ত মাটির শ্লেট- মাটির নিচে এর ওপর উচ্চ চাপ ও তাপের পানি পাঠিয়ে তা থেকে তেল ও গ্যাস সংগ্রহ করার টেকনোলজি ব্যবহার করে এই তেল উৎপাদন করা হয়। এটাও আরেক ধরনের জীবাশ্ম, যেটা থেকে তেল বের করার কার্যকর টেকনোলজি ছিল না বলে এর ব্যবহার আগে ছিল না। এখন এই টেকনোলজির পর্যাপ্ত উপস্থিতি ও খরচ পোষায় মনে করাতে শেল অয়েলের ব্যবসায় একটা উচ্ছ্বাস চলছে। এভাবে তেল বের করার এই টেকনোলজিটাকে বলা হয় ফ্রেকিং। তাই অনেকে এটাকে ফ্রেকিং অয়েলও বলে। অথবা শ্লেট জাতীয় উপাদান বা কাঁচামাল থেকে এই তেল বের করা হয় বলে একে শেল অয়েলও বলা হয়। এ ছাড়া এই টেকনোলজিতে প্রচুর পানি ব্যবহার করতে হয় বলে এবং এর প্রক্রিয়ায় প্রচুর অব্যবহৃত তাপ উদ্ভব হয়, যেখানে দুনিয়ার তাপমাত্রা কমানোটাই এখন ইস্যু সেখানে পরিবেশগত দিক থেকে পরিবেশ বিনষ্ট আরো বাড়িয়ে তোলে এই টেকনোলজি। ফলে অনেকে একে নোংরা তেল বা ডার্টি অয়েল নামেও ডাকে। মাটির নিচে এর মজুদ শ্লেটের দিক থেকে শীর্ষে থাকা দেশ হলো আমেরিকা, জর্ডান, কানাডা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, আমেরিকান মজুদের পরিমাণ এত বেশি যে, তা দিয়ে আমেরিকান জ্বালানি চাহিদা মেটানো তো বটেই তা মিটিয়েও আমেরিকা শেল অয়েল রফতানি করতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় এই শেল অয়েল উৎপাদনের জোয়ার উঠেছে। ফলে গত তিন বছর ধরে এই জোয়ার ওঠাতে আমেরিকান মিডিয়ায় শেল অয়েলের বিরুদ্ধে নেগেটিভ দিক যেগুলো আছে তা খুব কমই ছাপা হয়। এই টেকনোলজির আরেক বড় নেগেটিভ দিক হলো এই টেকনোলজি ব্যবহারের তুলনামূলক খরচ অনেক বেশি। বলা হয়েছিল বাজারে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের বেশি হলে বেশ আয়েশে এই ব্যবসা করা যায়। সারকথায় তরল জীবাশ্ম তেল উৎপাদনের চেয়ে এর খরচ বেশি। সেটা যাই হোক, আমেরিকার এই শেল অয়েল বা ফ্রেকিং অয়েল উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে বলেই এই তেল উৎপাদনকারীদের লবি চাপ ইত্যাদিতে পরে এখন চল্লিশ বছর পরে আমেরিকা থেকে তেল রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
আর ঠিক এখানেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তেল উৎপাদকদের (মূলত মধ্যপ্রাচ্যের) এক কার্টেল জোট হলো ওপেক। ওপেকের সাথে পশ্চিমের স্বার্থবিরোধ অনেক পুরনো। আমেরিকান রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উপলক্ষে লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট গত মাসে ১৮ ডিসেম্বর এক রিপোর্ট বের করেছে। ওই রিপোর্টের প্রথম বাক্যটা অনুবাদ করলে হয় এরকম : “যুগ যুগ ধরে ‘বাজার’ শব্দটা বিশ্বব্যাপী তেলবাণিজ্যে এক আনফিট শব্দ হয়ে আছে। তেল উৎপাদনকারীদের আন্তর্জাতিক কার্টেল ওপেক শুধু তেলের বাজারে ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপ করেছেই শুধু নয়, নিজের জন্য নানা মাত্রার সফলতাও বের করে নিয়ে গেছে।” এই বাক্য থেকে ওপেকের সাথে আমেরিকার স্বার্থবিরোধের তীব্রতা টের পাওয়া যায়। সারা দুনিয়ায় যে তেল উৎপাদন হয় এর এক-তৃতীয়াংশ করে ওপেক সদস্যরা। আর ওপেকে উৎপাদনেরও এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি একাই উৎপাদন করে সৌদি আরব- এটা প্রতিদিন মোটামুটি ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যেখানে দুনিয়ায় মোট উৎপাদন ৮০ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি। ফলে ওপেকের কোনো সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের প্রভাব প্রায় একচেটিয়া। ফলে তেলের বাজারে আমেরিকার শেল অয়েল নিয়ে প্রবেশ ঠেকাতে সৌদি আরব লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কাজে সে সহজেই ওপেককে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে নিতে পেরেছে। এখানে শেল অয়েলকে ঠেকানোর সৌদি কৌশল হলো- শেল অয়েলের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি, এটাকে কাজে লাগানো। এ কারণে এক দিকে সৌদি আরব ক্রমান্বয়ে তেলের দাম ফেলে দিচ্ছে। আবার একই সাথে ওপেকে জোটবদ্ধ হয়ে উৎপাদন না কমিয়ে (তেলের দাম বেড়ে যাবে বলে) বরং বাড়িয়ে চলেছে। এভাবে তেলের দাম ফেলে দিয়ে ২০০৩ সালের সমান ২৭ ডলারে নামিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাজার থেকে হটানোর মতো ফল এতে পেয়েছে। যেমন ব্রিটিশ বিপিসহ বহু তেল কোম্পানি ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই লাখ কর্মী ছাঁটাই করেছে, নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে, নতুন করে রিগ বসানোর যত পরিকল্পনা তেল তোলা কোম্পানির ছিল, সব স্থগিত হয়ে গেছে। এতে ক্ষতি সৌদি আরবের কম হয়নি। বলা হয়, প্রতিদিন নাকি সৌদি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার মানে হাফ বিলিয়ন ডলার কম হচ্ছে। আইএমএফ হিসাব করে বলছে, এ বছরে মধ্যপ্রাচ্য মোট ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হারাবে। আইএমএফ সৌদি আরবকে সাবধান করেছে এভাবে সীমাহীন তেল উৎপাদন বাড়ানোর বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে।
সৌদিদের এই লড়াইয়ে জেতার কৌশল সহজ। তারা মনে করে, দীর্ঘ দিন ২০ ডলার বা কম দামে তেল বিক্রি করে লোকসান সহ্য করার ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে দেউলিয়া বানানোর পরেই সে বাজারের লাগাম টেনে ধরবে, উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম বাড়াবে। এ ব্যাপারে সৌদিদের অনুমিত সময়কাল এক বছর। অর্থাৎ আগামী বছর থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বা সৌদিরা দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে। এ বছরের জুন মাসের পর থেকে এসব ব্যাপারে আলামত ফুটতে শুরু করবে সৌদি আরবের বিশ্বাস। এ কাজে তার প্রধান টার্গেট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমত আমেরিকান শেল অয়েল। আর এর পরের টার্গেট আবার বাজারে ফিরে আসা ইরান। দেখা যাক কার নার্ভ কত শক্ত, কে কতক্ষণ টেকে!
goutamdas1958@hotmail.com
কবে থেকে এবং কেন?
কারণের বিস্তারে যাওয়া যাবে না এখন, সে অন্য প্রসঙ্গ তাই। তবে সংক্ষেপে বললে, আরব জাতীয়তাবাদী হয়ে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় ও শেষবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে আরবেরা খুব খারাপভাবে হেরে যায়। কিন্তু এতে এর চেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে সবাই আরব জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা ফেলে নিজ নিজ রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে ধরা; আরব জাতিয়তাবাদের ঝাণ্ডা আর কেউ বইতে রাজি না হওয়া। যেমনÑ আরব জাতীয়তাবাদী জামাল নাসেরের মিসর এর পর থেকে হয়ে যায় মিসরীয় জাতীয়তাবাদে। এখানে বলে রাখা ভালো, বাক্যগুলোকে এভাবে লেখা হচ্ছে এটা ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ হারানোর শোক থেকে একেবারেই নয়। বরং কথাগুলোকে আরব জোটবদ্ধতা হারানোর শোক হিসেবে দেখতে হবে। সেভাবেই লেখা। আরব জোটবদ্ধ যেটা ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য খুবই জরুরি পূর্বশর্ত। কিন্তু যুদ্ধে হেরে আরবদের দিক থেকে রাগের মাথায় একটা খুব বাজে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘তেল অবরোধ’ নামে পরিচিত সেই সিদ্ধান্ত। জ্বালানি তেলে সমৃদ্ধ আরবেরা পশ্চিমকে আর তেল বেচবে না। এই ছিল সিদ্ধান্তের সারকথা। মনে করা হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমকে খুব বড় বিপদে ফেলা যাবে। কারণ পশ্চিমা সভ্যতাÑ এর অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ফসিল ফুয়েল বা মাটির নিচের জ্বালানির ওপরে। দুনিয়াতে এই জ্বালানির বিরাট এক অংশ মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের কাছে। ফলে পশ্চিমারা বিরাট অসুবিধায় পড়বে। কথা সত্য কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রিলেশনাল, মানে পশ্চিমের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকার দিকটা কেউ ভালো করে দেখেনি। তেল না বেচলে ক্রেতার কী দশা হবে এটা যত বেশি নজর করা হয়েছিল, এর কণামাত্র নজর দেয়া হয়নি এতে বিক্রেতার কী দশা হবে। এতে ধরে নেয়া হয়ে গিয়েছিল যেন তেল বিক্রি করা বিক্রেতার একটা ঐচ্ছিক ব্যাপারÑ খেয়াল বা শখ। তেল বিক্রি যেন বিক্রেতারও গভীর প্রয়োজনের বিষয় নয়। অথচ ব্যাপারটা ছিল ঠিক এর উল্টো। প্রতিটি আরব রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশেষ করে বাজেটের রাজস্ব আয়ের একমাত্র উৎস ছিল ফসিল ফুয়েল বিক্রি। ফলে তেল বিক্রি না করলে পশ্চিমা শক্তি বিশাল বিপদে পড়বে সন্দেহ নেই; কিন্তু তেল বিক্রেতা দেশের অর্থনীতি চলবে কীভাবে? এ দিকটাতে এত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ফলাফল শেষ বিচারে আত্মঘাতী হিসেবে হাজির হয়েছিল। আরব জাতীয়তাবাদ থেকে মিসরীয় জাতীয়তাবাদ অথবা সিরীয় জাতীয়তাবাদ হয়ে যাওয়ার পেছনে এই ফ্যাক্টরগুলোও কাজ করেছিল। শেষ বিচারে তেল অবরোধ হয়ে ওঠে আরবদের জন্যই বুমেরাং, কাউন্টার প্রোডাকটিভ। এ ছাড়া যুদ্ধ মানেই আয়বিহীন একটি রাষ্ট্রের ব্যয়ে জড়িয়ে পড়া। সব আরব রাষ্ট্রের দশা ছিল তাই। যখন দরকার আরো আয় যাতে ওই আয়বিহীন একটি ব্যয়ে ভারসাম্য ফেরে। ফলে তেল অবরোধ না টেকার পেছনে এটাও একটি কারণ।
তবে তেল অবরোধ নামে তৎপরতাটাই, তা সে যত কম দিন কার্যকর থাকুকÑ তা পশ্চিমকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছিল। এরই প্রমাণ হলো ১৯৭৫ সালে উদ্বৃত্ত হোক আর না হোক, আমেরিকান তেল কোনো ব্যবসায়ী রফতানি করতে পারবে না বলে আইন পাস হয়েছিল। আইনটা পাসের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘আমেরিকার নিজের মজুদ তেল সংরক্ষণের (মানে এই তেল একমাত্র শেষ হতে হবে কেবল নিজেরা ভোগ করে, বিক্রি নয়) জন্য রফতানিকে নিরুৎসাহিত করতে এই বিল আনা দরকার’, তাই। ‘সংরক্ষণের’ এ কথা থেকে বোঝা যায় তাদের ভয়ের মাত্রা সম্পর্কে।
চল্লিশ বছর পরে এখন সেই আইন সংশোধন করে নেয়া হলো। এখন থেকে আমেরিকান তেল রফতানি করা যাবে। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, মূলত রিপাবলিকানদের উৎসাহ ও তাদেরই আনা বিল এবং তেল ব্যবসায়ী লবি যারা গত দু’বছর ধরে চেষ্টা করছিল এদেরই মিলিত আগ্রহে বিলটা আসে। আর ডেমোক্র্যাটরা যারা সংখ্যালঘু, এখন তারা অন্য একটি কিছু পাওয়ার আসায় সেই বিনিময়ে আনা এই আইনকে পাস হতে সম্মতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে আইনটি পাস হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫। প্রায় এক মাস আগে। এই অর্থে এটা কোনো একটা দলের একক নয়, বাই-পার্টিজান বা আমেরিকান দুই পার্টি মিলে নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত। আমেরিকান পুঁজিবাজারবিষয়ক মুখ্য পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করে লিখেছে, চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার পরে ‘এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক’ এবং ‘এতে আমেরিকান তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ের মুখে পড়ে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটবদল’ প্রতিফলিত। এসব বক্তব্য থেকে বোঝা গেল চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার ঘটনা এটা। কিন্তু ‘তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ে’ ঘটা ঘটনাটা কী? মানে ঠিক এখনই কেন তেল রফতানির অবরোধ তুলে নেয়া?
নতুন ধরনের এক তেলের উৎস একালে চালু হয়েছে- শেল অয়েল। চালু হয়েছে কথাটা টেকনোলজির দিক থেকে- টেকনোলজি চালু হওয়াতে শক্ত শ্লেট থেকে তেল উৎপাদন করা যাচ্ছে। শ্লেট-পেন্সিলে লেখার শ্লেটের মতো দেখতে স্তরের ওপর স্তর পড়া শক্ত মাটির শ্লেট- মাটির নিচে এর ওপর উচ্চ চাপ ও তাপের পানি পাঠিয়ে তা থেকে তেল ও গ্যাস সংগ্রহ করার টেকনোলজি ব্যবহার করে এই তেল উৎপাদন করা হয়। এটাও আরেক ধরনের জীবাশ্ম, যেটা থেকে তেল বের করার কার্যকর টেকনোলজি ছিল না বলে এর ব্যবহার আগে ছিল না। এখন এই টেকনোলজির পর্যাপ্ত উপস্থিতি ও খরচ পোষায় মনে করাতে শেল অয়েলের ব্যবসায় একটা উচ্ছ্বাস চলছে। এভাবে তেল বের করার এই টেকনোলজিটাকে বলা হয় ফ্রেকিং। তাই অনেকে এটাকে ফ্রেকিং অয়েলও বলে। অথবা শ্লেট জাতীয় উপাদান বা কাঁচামাল থেকে এই তেল বের করা হয় বলে একে শেল অয়েলও বলা হয়। এ ছাড়া এই টেকনোলজিতে প্রচুর পানি ব্যবহার করতে হয় বলে এবং এর প্রক্রিয়ায় প্রচুর অব্যবহৃত তাপ উদ্ভব হয়, যেখানে দুনিয়ার তাপমাত্রা কমানোটাই এখন ইস্যু সেখানে পরিবেশগত দিক থেকে পরিবেশ বিনষ্ট আরো বাড়িয়ে তোলে এই টেকনোলজি। ফলে অনেকে একে নোংরা তেল বা ডার্টি অয়েল নামেও ডাকে। মাটির নিচে এর মজুদ শ্লেটের দিক থেকে শীর্ষে থাকা দেশ হলো আমেরিকা, জর্ডান, কানাডা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, আমেরিকান মজুদের পরিমাণ এত বেশি যে, তা দিয়ে আমেরিকান জ্বালানি চাহিদা মেটানো তো বটেই তা মিটিয়েও আমেরিকা শেল অয়েল রফতানি করতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় এই শেল অয়েল উৎপাদনের জোয়ার উঠেছে। ফলে গত তিন বছর ধরে এই জোয়ার ওঠাতে আমেরিকান মিডিয়ায় শেল অয়েলের বিরুদ্ধে নেগেটিভ দিক যেগুলো আছে তা খুব কমই ছাপা হয়। এই টেকনোলজির আরেক বড় নেগেটিভ দিক হলো এই টেকনোলজি ব্যবহারের তুলনামূলক খরচ অনেক বেশি। বলা হয়েছিল বাজারে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের বেশি হলে বেশ আয়েশে এই ব্যবসা করা যায়। সারকথায় তরল জীবাশ্ম তেল উৎপাদনের চেয়ে এর খরচ বেশি। সেটা যাই হোক, আমেরিকার এই শেল অয়েল বা ফ্রেকিং অয়েল উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে বলেই এই তেল উৎপাদনকারীদের লবি চাপ ইত্যাদিতে পরে এখন চল্লিশ বছর পরে আমেরিকা থেকে তেল রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
আর ঠিক এখানেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তেল উৎপাদকদের (মূলত মধ্যপ্রাচ্যের) এক কার্টেল জোট হলো ওপেক। ওপেকের সাথে পশ্চিমের স্বার্থবিরোধ অনেক পুরনো। আমেরিকান রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উপলক্ষে লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট গত মাসে ১৮ ডিসেম্বর এক রিপোর্ট বের করেছে। ওই রিপোর্টের প্রথম বাক্যটা অনুবাদ করলে হয় এরকম : “যুগ যুগ ধরে ‘বাজার’ শব্দটা বিশ্বব্যাপী তেলবাণিজ্যে এক আনফিট শব্দ হয়ে আছে। তেল উৎপাদনকারীদের আন্তর্জাতিক কার্টেল ওপেক শুধু তেলের বাজারে ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপ করেছেই শুধু নয়, নিজের জন্য নানা মাত্রার সফলতাও বের করে নিয়ে গেছে।” এই বাক্য থেকে ওপেকের সাথে আমেরিকার স্বার্থবিরোধের তীব্রতা টের পাওয়া যায়। সারা দুনিয়ায় যে তেল উৎপাদন হয় এর এক-তৃতীয়াংশ করে ওপেক সদস্যরা। আর ওপেকে উৎপাদনেরও এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি একাই উৎপাদন করে সৌদি আরব- এটা প্রতিদিন মোটামুটি ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যেখানে দুনিয়ায় মোট উৎপাদন ৮০ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি। ফলে ওপেকের কোনো সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের প্রভাব প্রায় একচেটিয়া। ফলে তেলের বাজারে আমেরিকার শেল অয়েল নিয়ে প্রবেশ ঠেকাতে সৌদি আরব লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কাজে সে সহজেই ওপেককে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে নিতে পেরেছে। এখানে শেল অয়েলকে ঠেকানোর সৌদি কৌশল হলো- শেল অয়েলের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি, এটাকে কাজে লাগানো। এ কারণে এক দিকে সৌদি আরব ক্রমান্বয়ে তেলের দাম ফেলে দিচ্ছে। আবার একই সাথে ওপেকে জোটবদ্ধ হয়ে উৎপাদন না কমিয়ে (তেলের দাম বেড়ে যাবে বলে) বরং বাড়িয়ে চলেছে। এভাবে তেলের দাম ফেলে দিয়ে ২০০৩ সালের সমান ২৭ ডলারে নামিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাজার থেকে হটানোর মতো ফল এতে পেয়েছে। যেমন ব্রিটিশ বিপিসহ বহু তেল কোম্পানি ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই লাখ কর্মী ছাঁটাই করেছে, নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে, নতুন করে রিগ বসানোর যত পরিকল্পনা তেল তোলা কোম্পানির ছিল, সব স্থগিত হয়ে গেছে। এতে ক্ষতি সৌদি আরবের কম হয়নি। বলা হয়, প্রতিদিন নাকি সৌদি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার মানে হাফ বিলিয়ন ডলার কম হচ্ছে। আইএমএফ হিসাব করে বলছে, এ বছরে মধ্যপ্রাচ্য মোট ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হারাবে। আইএমএফ সৌদি আরবকে সাবধান করেছে এভাবে সীমাহীন তেল উৎপাদন বাড়ানোর বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে।
সৌদিদের এই লড়াইয়ে জেতার কৌশল সহজ। তারা মনে করে, দীর্ঘ দিন ২০ ডলার বা কম দামে তেল বিক্রি করে লোকসান সহ্য করার ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে দেউলিয়া বানানোর পরেই সে বাজারের লাগাম টেনে ধরবে, উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম বাড়াবে। এ ব্যাপারে সৌদিদের অনুমিত সময়কাল এক বছর। অর্থাৎ আগামী বছর থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বা সৌদিরা দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে। এ বছরের জুন মাসের পর থেকে এসব ব্যাপারে আলামত ফুটতে শুরু করবে সৌদি আরবের বিশ্বাস। এ কাজে তার প্রধান টার্গেট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমত আমেরিকান শেল অয়েল। আর এর পরের টার্গেট আবার বাজারে ফিরে আসা ইরান। দেখা যাক কার নার্ভ কত শক্ত, কে কতক্ষণ টেকে!
goutamdas1958@hotmail.com
No comments