বিশ্বব্যাংককে টিকে থাকতে হলে by জি. মুনীর
বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বড় বড় কর্মসূচির জন্য ঋণ দেয়া এর কাজ। এর প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য দারিদ্র্যবিমোচন। এটি গড়ে উঠেছে দু’টি প্রতিষ্ঠান সহযোগে : ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)। বিশ্বব্যাংক হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের একটি উপাদান, যা ইউনাইটেড ন্যাশনস সিস্টেমের একটি অংশ।
আর্টিকলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট অনুসারে বিশ্বব্যাংকের সব সিদ্ধান্ত চলবে বিদেশী বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নয়ন এবং ক্যাপিটাল ইনভেস্টের সুযোগ সৃষ্টির প্রতি প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে। আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্রিটন উডস সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক গড়ে তোলা হয় ১৯৪৮ সালে, যার মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। প্রথাগতভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হন একজন আমেরিকান। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয়ই ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক। এরা উভয়ে ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে কাজ করে। যদিও ব্রিটন উডস সম্মেলনে অনেক দেশই যোগ দিয়েছিল, ইউএসএ ও ইউকেই ছিল সমঝোতা তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ।
কিন্তু সময়ের সাথে বিশ্বব্যাংক ও একই সাথে আইএমএফ বেশি থেকে বেশি সমালোচিত এগুলোর প্রায়োগিক ভূমিকা নিয়ে। সমালোচনা এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের অবলম্বিত নীতি ও এর প্রশাসন পদ্ধতি নিয়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। এর জন্য বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না সেসব দেশের কাছে, যেসব দেশ এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়। এই দুই প্রতিষ্ঠান ঋণগ্রহীতা দেশের ওপর যেসব অযৌক্তিক শর্তারোপ করে সমালোচকেরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এরা বলে, এগুলো ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর ওপর শর্তারোপ করে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাসে’র ওপর ভিত্তি করে। এ কনসাসে আলোকপাত রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থ খাতের উদারীকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয়করণ করা শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণের ওপর। কিন্তু এরা যে শর্তাবলি আরোপ করে তা অনেক সময় ঋণগ্রহীতা দেশের পরিস্থিতির সাথে মোটেও খাপ খায় না। ফলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ঋণ অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান আনতে পারে না। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, আইএমএফ প্যাকেজের আওতায় ঋণের শর্তাবলির পরিধি এমন সীমাও ছাড়িয়ে যায়, যেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ এর নিজের অর্থনীতির ওপর কার্যত কর্তৃত্ব করার অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্পে অর্থসহায়তা দেয়, সেসব প্রকল্প সে দেশের জন্য কতটুকু উপকার বয়ে আনবে, তা নিয়েও আছে উদ্বেগ। অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ অর্থায়ন করে। সেখানেও দেখা যায়, এসব প্রকল্পের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ে। এ নিয়েও বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা আছে। আর এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে বেশি জোর দেয়ার ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ব্যাপক কমে যায়।
বিশ্ব আবহাওয়া পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা ও অর্থায়নকাঠামো ব্যাপক বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সুশীল সমাজগোষ্ঠী মনে করে, আবহাওয়া পরিবর্তন অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি। কারণ, এ ক্ষেত্রের ঋণের সাথে পরামর্শক সেবা ও নানা অযৌক্তিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ব্যাংকটির অগণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোতে প্রাধান্য রয়েছে শিল্পায়িত দেশগুলার। এর বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন নির্ধারণ করে শিল্পায়িত দেশগুলোর গোষ্ঠী জি-৭। এরা অগ্রাধিকার দেয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে। বিতর্ক আছে বিশ্বব্যাংকের ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমঝোতা তৈরির মূল খেলোয়াড় হিসেবেও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়। বিশ্বব্যাংক অর্থসহায়তা অব্যাহত রেখেছে সেই সব শিল্পে, যেগুলো অব্যাহতভাবে পরিবেশ দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে। যেমন কয়লাচালিত-বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিশ্বব্যাংক অগ্রাধিকার দেয় বেসরকারি খাতের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে। এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে রাষ্ট্রের ভূমিকা অবদমনের, যেখানে রাষ্ট্রই হচ্ছে অপরিহার্য পণ্য ও সেবার প্রাথমিক সরবরাহকারী। যেমন রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হয় স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসেবা। বেসরকারি খাতকে রাষ্ট্রের চেয়ে অগ্রাধিকার দিলে এসব সেবায় ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, উন্নয়ন অর্থায়ন সরকারি খাত থেকে চলে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের দিকে। বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতের ঋণদানে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনও (আইএফসি) সমালেচনার মুখে পড়েছে এর বিজনেস মডেলের কারণে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সমালোচিত উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর তেমন জোরালো গবেষণা না থাকার কারণে।
আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একটি সমালোচনা হলোÑ ব্যাংকটি আইএমএফের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে থেকে শুধু সেসব কর্মসূচিতেই ঋণ দেয়, যেগুলোকে কঠিন শর্তের আওতায় আনা যায়। অনেকের বিশ্বাস, এসব কর্মসূচি গরিবদের আরো দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেয়, আর বড় করপোরেশনগুলোকে আরো অর্থবিত্তের অধিকারী করে তোলে। এর বাইরে আরো অনেক অনন্য বিষয় আছে, যেগুলোর কারণে বিশ্বব্যাংক ক্রমেই অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক প্রায়ই এমন সব প্রকল্প এড়িয়ে চলে, যেগুলো সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত। যেমন, বিশ্বব্যাংক ব্রাজিলের অ্যামাজোনিয়ান স্টেট রন্ডোনিয়ায় ১৯৮১ সালে উদ্বোধন করা পলোনরোয়েস্টি উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থসহায়তা জোগায়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বনের ভেতর দিয়ে মূল সড়ক নির্মাণ করা হয় ভূমিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে। সেখানে যাওয়া বসবাসকারীদের দেয়া হয় ভূমি মালিকানার অধিকার। ফলে সেখানে গিয়ে বিপুল মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এর ফলে ব্যাপকভাবে বিনাশ হয় সেখানকার রেইন ফরেস্ট, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাংক ১৮৭৮ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে ভারতে তহবিল জোগান দিয়েছে নরমেদা নদী উপত্যকায় নরমেদা বাঁধ প্রকল্পে। বাঁধটি নির্মিত হওয়ার পর এ এলাকায় প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বাস করে আসা লোকজনের জমি ও বসতবাড়ি হারিয়ে যায় মানুষের তৈরি জলাধারের নিচে। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয় এক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশিক সমস্যা। এর জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় বিশ্বব্যাংকেই। একইভাবে বিশ্বব্যাংক সমালোচিত চীনের ‘ওয়েস্টার্ন পোভার্টি রিডাকশন প্রজেক্ট’-এর জন্যও। চীনের নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের তিব্বতিরা এর সমালোচনা করে বলছে, এর ফলে তিব্বতের ৩৭০০০ মানুষকে তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। অতি সম্প্রতি বাকু-চিহান পাইপলাইন প্রকল্পও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এর সমালোচকেরা বলছেন, এটি সে এলাকায় ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ সৃষ্টি করবে অধিকতর ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর তেলনির্ভরতা বেড়ে যাবে, বন উজাড় করবে, কমাবে এ অঞ্চলের পানি সরবরাহ। একই সাথে লঙ্ঘিত হবে মানবাধিকার। বিশ্বব্যাংক ও একই সাথে আইএমএফের বিরুদ্ধে আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে- এগুলো উন্নয়নশীল দেশে ঋণের বোঝা বাড়িয়েই তুলছে। গত ২০ বছরে এসব দেশে ঋণের বোঝা এতই বেড়ে গেছে যে, কোনো কোনো দেশ সামাজিক খাতে যত খরচ করে, তার চেয়ে বেশি খরচ করে ঋণ-সার্ভিস খাতে। এ থেকে মুক্তি পেতে এরই মধ্যে জুবিলি মুভমেন্ট নামের এক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বিশ্বব্যাংকের এই শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান চায়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিট্জসহ এর সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের। তাদের সমালোচনার ফলে সাধারণ সমালোচকেরা মনে করছেন, তাদের সমালোচনার পেছনে যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক বিশ্ববাসীর আশার আলো হয়ে জন্ম নিয়েছিল, সে আলো যেন ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। সেই সাথে বিশ্বব্যাংকও হয়ে উঠছে এক গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সময়ের সাথে এর বিরুদ্ধে সমালোচনার তীব্রতাও বাড়ছে। একই সাথে যেন বেজে উঠছে এর মৃত্যুঘণ্টাও। কারণ এর গ্রাহক দেশগুলো এখন চলে যাচ্ছে অন্যান্য ঋণদাতার কাছে। এমনি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংককে টিকে থাকতে হলে, এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এর ঋণদান প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে বৈকি! এর ঋণ অনুদান প্রক্রিয়াকে আরো উন্নততর করতে হবে এর প্রতিযোগীদের তুলনায়। ঋণগ্রহীতাকে শর্তের বেড়াজালে বন্দী করে রাখার পুরনো প্রবণতা থেকে বের করে আনতে হবে বিশ্বব্যাংককে।
আমরা তো একসময় দেখেছি, এই ব্যাংককে সহজেই নিজের করা আয়ের অর্থেই টিকে থাকতে। কিন্তু আজ এটি দ্রুত পরিণত হয়েছে একটি দাতব্যনির্ভর তথা ওয়েলফেয়ার ডিপেন্ডেন্ট প্রতিষ্ঠানে। ধনী দেশগুলোর কনট্রিবিউশন থেকে আসা অর্থ দিয়েই গরিব দেশগুলাকে দেয়া হচ্ছে ঋণ। কিন্তু ধনী দেশগুলোর এই কনট্রিবিউশন আর বাড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। বরং এমন হতে পারে, কিছু ধনী দেশ এই কনট্রিবিউশন দেয়া বন্ধ করে দেবে। কারণ দাতাদের এখন বর্ধিত পরিমাণে তহবিল জোগাতে হচ্ছে শরণার্থী কর্মসূচিতে।
সমস্যা এটি নয় যে, বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো এখন আর ঋণ নিতে চায় না। বরং এসব দেশের আবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন আরো বেশি বেশি তহবিল। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়াটা বড়ই ধীরগতির। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়ার বিষয়টিকে অনেক সম্ভাবনাময় ঋণগ্রহীতা দেশ ‘সর্বশেষ পছন্দে’র তালিকায় ফেলে। বাণিজ্যিক ঋণদাতারা একটি ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া করে ঋণ সরবরাহ করতে সময় নেয় মাত্র তিন মাস। অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের সে সময় লাগে দুই বছরেরও বেশি। এই সময় কমিয়ে আনতে ব্যাংকটি ২০১৩ সালে একটি উদ্যোগ নেয়। এর ফলে এই সময় কিছুটা কমিয়ে ২৮ মাস থেকে সাড়ে ২৫ মাসে নামিয়ে আনা হয়। তবে কেনো কোনো অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই সময়পরিধি কার্যত আরো বেড়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক দেশের সরকার এই ব্যাংকের কম সুদের ঋণ না নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে আরো বেশি সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংক থেকে ২০ বছরমেয়াদি ঋণের জন্য সুদ দিতে হয় ৪ শতাংশ হারে। গরিব দেশগুলোর জন্য তা ১ শতাংশ (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের লোন)। তা সত্ত্বেও অনেক দেশ আরো অনেক বেশি হারের বাণিজ্যিক সুদ নেয়াই পছন্দ করে। যেমন ঘানা সম্প্রতি এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুদহারের বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করেছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অনেক বিকাশমান অর্থনীতির দেশ খুশি হয়েছে ‘ব্রিকস (BRICS) দেশগুলোর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চীনের নেতৃত্বে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করায়। এই উভয় ব্যাংকই দ্রুত ঋণ সরবরাহ স্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংককে টিকে থাকতে হলে এর ব্যবস্থাপনাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের করে আনতে হবে। দূর করতে হবে এক দশক আগের পর্যালোচনায় চিহ্নিত ‘ফ্র্যাগমেন্টেশেন, ডুপ্লিকেশন অ্যান্ড ডিলে’ সমস্যা। একই সাথে এই প্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করতে হবে এর অনন্য কিছু করণীয়, যা অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে একে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ঘোষণা করেছিল এর নতুন লক্ষ্য- ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যবিমোচন করা। বিশ্বব্যাংকের বিশেষত্ব হলো- ১৮৮টি দেশ এটি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এটি এসব দেশের হয়ে কাজ করতে পারে দুয়েকটির হয়ে কাজ না করে। অধিকন্তু, এটি হতে পারে আর সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আরো বেশি মাত্রায় স্বায়ত্তশাসিত, স্বনির্ভর ও কর্মে লেগে থাকায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এগুলো হতে পারে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
কোনো কোনো দেশ দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থায় ঋণ দেয়। কিন্তু এই ঋণ কোন দেশ পাবে বা না পাবে, তা নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর। দ্বিপক্ষীয় ঋণ হচ্ছে এইড ইন্ডাস্ট্রির খেয়াল-খুশি ও প্রবণতার বিষয়। কোনো কোনো সময় এ ঋণপ্রবাহ চলে বিশেষ কোনো খাতের দিকে কিংবা এই ঋণ সমর্থন জোগায় বিশেষ কোনো উদ্যোগের পেছনে। এর ফলে কোনো কোনো দেশ প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ঋণ পায়। অপর দিকে অন্য দেশগুলো চাহিদামতো ঋণ পায় না। ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের মতে, ৩০টি দেশের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দেশ সঠিক মাত্রার ঋণ পাওয়ার আশা করতে পারে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্র্তৃপক্ষ ও সদস্য দেশগুলোকে একসাথে মিলে কাজ করে ব্যাংকটিকে একটি গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে বিশ্বব্যাংকের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন দেশের বা মহলের অসন্তুষ্টি কোথায়, তা চিহ্নিত করে সে অসন্তুষ্টি দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে। তবেই যদি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় এই প্রতিষ্ঠানকে। একই সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো নিশ্চিত করে, এমন সব কর্মসূচিতে তহবিল জোগান দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আর্টিকলস অব অ্যাগ্রিমেন্ট অনুসারে বিশ্বব্যাংকের সব সিদ্ধান্ত চলবে বিদেশী বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নয়ন এবং ক্যাপিটাল ইনভেস্টের সুযোগ সৃষ্টির প্রতি প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে। আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্রিটন উডস সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক গড়ে তোলা হয় ১৯৪৮ সালে, যার মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। প্রথাগতভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হন একজন আমেরিকান। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয়ই ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক। এরা উভয়ে ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে কাজ করে। যদিও ব্রিটন উডস সম্মেলনে অনেক দেশই যোগ দিয়েছিল, ইউএসএ ও ইউকেই ছিল সমঝোতা তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ।
কিন্তু সময়ের সাথে বিশ্বব্যাংক ও একই সাথে আইএমএফ বেশি থেকে বেশি সমালোচিত এগুলোর প্রায়োগিক ভূমিকা নিয়ে। সমালোচনা এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের অবলম্বিত নীতি ও এর প্রশাসন পদ্ধতি নিয়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। এর জন্য বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না সেসব দেশের কাছে, যেসব দেশ এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়। এই দুই প্রতিষ্ঠান ঋণগ্রহীতা দেশের ওপর যেসব অযৌক্তিক শর্তারোপ করে সমালোচকেরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এরা বলে, এগুলো ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর ওপর শর্তারোপ করে ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাসে’র ওপর ভিত্তি করে। এ কনসাসে আলোকপাত রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থ খাতের উদারীকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয়করণ করা শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণের ওপর। কিন্তু এরা যে শর্তাবলি আরোপ করে তা অনেক সময় ঋণগ্রহীতা দেশের পরিস্থিতির সাথে মোটেও খাপ খায় না। ফলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ঋণ অর্থনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান আনতে পারে না। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, আইএমএফ প্যাকেজের আওতায় ঋণের শর্তাবলির পরিধি এমন সীমাও ছাড়িয়ে যায়, যেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ এর নিজের অর্থনীতির ওপর কার্যত কর্তৃত্ব করার অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্পে অর্থসহায়তা দেয়, সেসব প্রকল্প সে দেশের জন্য কতটুকু উপকার বয়ে আনবে, তা নিয়েও আছে উদ্বেগ। অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ অর্থায়ন করে। সেখানেও দেখা যায়, এসব প্রকল্পের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ে। এ নিয়েও বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা আছে। আর এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে বেশি জোর দেয়ার ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ব্যাপক কমে যায়।
বিশ্ব আবহাওয়া পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা ও অর্থায়নকাঠামো ব্যাপক বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সুশীল সমাজগোষ্ঠী মনে করে, আবহাওয়া পরিবর্তন অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি। কারণ, এ ক্ষেত্রের ঋণের সাথে পরামর্শক সেবা ও নানা অযৌক্তিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ব্যাংকটির অগণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোতে প্রাধান্য রয়েছে শিল্পায়িত দেশগুলার। এর বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন নির্ধারণ করে শিল্পায়িত দেশগুলোর গোষ্ঠী জি-৭। এরা অগ্রাধিকার দেয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে। বিতর্ক আছে বিশ্বব্যাংকের ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমঝোতা তৈরির মূল খেলোয়াড় হিসেবেও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়। বিশ্বব্যাংক অর্থসহায়তা অব্যাহত রেখেছে সেই সব শিল্পে, যেগুলো অব্যাহতভাবে পরিবেশ দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে। যেমন কয়লাচালিত-বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিশ্বব্যাংক অগ্রাধিকার দেয় বেসরকারি খাতের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে। এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে রাষ্ট্রের ভূমিকা অবদমনের, যেখানে রাষ্ট্রই হচ্ছে অপরিহার্য পণ্য ও সেবার প্রাথমিক সরবরাহকারী। যেমন রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হয় স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসেবা। বেসরকারি খাতকে রাষ্ট্রের চেয়ে অগ্রাধিকার দিলে এসব সেবায় ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, উন্নয়ন অর্থায়ন সরকারি খাত থেকে চলে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের দিকে। বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতের ঋণদানে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনও (আইএফসি) সমালেচনার মুখে পড়েছে এর বিজনেস মডেলের কারণে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সমালোচিত উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর তেমন জোরালো গবেষণা না থাকার কারণে।
আইএমএফের মতো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একটি সমালোচনা হলোÑ ব্যাংকটি আইএমএফের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে থেকে শুধু সেসব কর্মসূচিতেই ঋণ দেয়, যেগুলোকে কঠিন শর্তের আওতায় আনা যায়। অনেকের বিশ্বাস, এসব কর্মসূচি গরিবদের আরো দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেয়, আর বড় করপোরেশনগুলোকে আরো অর্থবিত্তের অধিকারী করে তোলে। এর বাইরে আরো অনেক অনন্য বিষয় আছে, যেগুলোর কারণে বিশ্বব্যাংক ক্রমেই অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক প্রায়ই এমন সব প্রকল্প এড়িয়ে চলে, যেগুলো সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত। যেমন, বিশ্বব্যাংক ব্রাজিলের অ্যামাজোনিয়ান স্টেট রন্ডোনিয়ায় ১৯৮১ সালে উদ্বোধন করা পলোনরোয়েস্টি উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থসহায়তা জোগায়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বনের ভেতর দিয়ে মূল সড়ক নির্মাণ করা হয় ভূমিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে। সেখানে যাওয়া বসবাসকারীদের দেয়া হয় ভূমি মালিকানার অধিকার। ফলে সেখানে গিয়ে বিপুল মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এর ফলে ব্যাপকভাবে বিনাশ হয় সেখানকার রেইন ফরেস্ট, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাংক ১৮৭৮ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে ভারতে তহবিল জোগান দিয়েছে নরমেদা নদী উপত্যকায় নরমেদা বাঁধ প্রকল্পে। বাঁধটি নির্মিত হওয়ার পর এ এলাকায় প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বাস করে আসা লোকজনের জমি ও বসতবাড়ি হারিয়ে যায় মানুষের তৈরি জলাধারের নিচে। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয় এক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশিক সমস্যা। এর জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় বিশ্বব্যাংকেই। একইভাবে বিশ্বব্যাংক সমালোচিত চীনের ‘ওয়েস্টার্ন পোভার্টি রিডাকশন প্রজেক্ট’-এর জন্যও। চীনের নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের তিব্বতিরা এর সমালোচনা করে বলছে, এর ফলে তিব্বতের ৩৭০০০ মানুষকে তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। অতি সম্প্রতি বাকু-চিহান পাইপলাইন প্রকল্পও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এর সমালোচকেরা বলছেন, এটি সে এলাকায় ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ সৃষ্টি করবে অধিকতর ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর তেলনির্ভরতা বেড়ে যাবে, বন উজাড় করবে, কমাবে এ অঞ্চলের পানি সরবরাহ। একই সাথে লঙ্ঘিত হবে মানবাধিকার। বিশ্বব্যাংক ও একই সাথে আইএমএফের বিরুদ্ধে আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে- এগুলো উন্নয়নশীল দেশে ঋণের বোঝা বাড়িয়েই তুলছে। গত ২০ বছরে এসব দেশে ঋণের বোঝা এতই বেড়ে গেছে যে, কোনো কোনো দেশ সামাজিক খাতে যত খরচ করে, তার চেয়ে বেশি খরচ করে ঋণ-সার্ভিস খাতে। এ থেকে মুক্তি পেতে এরই মধ্যে জুবিলি মুভমেন্ট নামের এক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বিশ্বব্যাংকের এই শোষণমূলক ব্যবস্থার অবসান চায়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিট্জসহ এর সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের। তাদের সমালোচনার ফলে সাধারণ সমালোচকেরা মনে করছেন, তাদের সমালোচনার পেছনে যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক বিশ্ববাসীর আশার আলো হয়ে জন্ম নিয়েছিল, সে আলো যেন ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। সেই সাথে বিশ্বব্যাংকও হয়ে উঠছে এক গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সময়ের সাথে এর বিরুদ্ধে সমালোচনার তীব্রতাও বাড়ছে। একই সাথে যেন বেজে উঠছে এর মৃত্যুঘণ্টাও। কারণ এর গ্রাহক দেশগুলো এখন চলে যাচ্ছে অন্যান্য ঋণদাতার কাছে। এমনি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংককে টিকে থাকতে হলে, এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এর ঋণদান প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে বৈকি! এর ঋণ অনুদান প্রক্রিয়াকে আরো উন্নততর করতে হবে এর প্রতিযোগীদের তুলনায়। ঋণগ্রহীতাকে শর্তের বেড়াজালে বন্দী করে রাখার পুরনো প্রবণতা থেকে বের করে আনতে হবে বিশ্বব্যাংককে।
আমরা তো একসময় দেখেছি, এই ব্যাংককে সহজেই নিজের করা আয়ের অর্থেই টিকে থাকতে। কিন্তু আজ এটি দ্রুত পরিণত হয়েছে একটি দাতব্যনির্ভর তথা ওয়েলফেয়ার ডিপেন্ডেন্ট প্রতিষ্ঠানে। ধনী দেশগুলোর কনট্রিবিউশন থেকে আসা অর্থ দিয়েই গরিব দেশগুলাকে দেয়া হচ্ছে ঋণ। কিন্তু ধনী দেশগুলোর এই কনট্রিবিউশন আর বাড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। বরং এমন হতে পারে, কিছু ধনী দেশ এই কনট্রিবিউশন দেয়া বন্ধ করে দেবে। কারণ দাতাদের এখন বর্ধিত পরিমাণে তহবিল জোগাতে হচ্ছে শরণার্থী কর্মসূচিতে।
সমস্যা এটি নয় যে, বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো এখন আর ঋণ নিতে চায় না। বরং এসব দেশের আবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন আরো বেশি বেশি তহবিল। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়াটা বড়ই ধীরগতির। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়ার বিষয়টিকে অনেক সম্ভাবনাময় ঋণগ্রহীতা দেশ ‘সর্বশেষ পছন্দে’র তালিকায় ফেলে। বাণিজ্যিক ঋণদাতারা একটি ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া করে ঋণ সরবরাহ করতে সময় নেয় মাত্র তিন মাস। অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের সে সময় লাগে দুই বছরেরও বেশি। এই সময় কমিয়ে আনতে ব্যাংকটি ২০১৩ সালে একটি উদ্যোগ নেয়। এর ফলে এই সময় কিছুটা কমিয়ে ২৮ মাস থেকে সাড়ে ২৫ মাসে নামিয়ে আনা হয়। তবে কেনো কোনো অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই সময়পরিধি কার্যত আরো বেড়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক দেশের সরকার এই ব্যাংকের কম সুদের ঋণ না নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে আরো বেশি সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংক থেকে ২০ বছরমেয়াদি ঋণের জন্য সুদ দিতে হয় ৪ শতাংশ হারে। গরিব দেশগুলোর জন্য তা ১ শতাংশ (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের লোন)। তা সত্ত্বেও অনেক দেশ আরো অনেক বেশি হারের বাণিজ্যিক সুদ নেয়াই পছন্দ করে। যেমন ঘানা সম্প্রতি এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুদহারের বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করেছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অনেক বিকাশমান অর্থনীতির দেশ খুশি হয়েছে ‘ব্রিকস (BRICS) দেশগুলোর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চীনের নেতৃত্বে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করায়। এই উভয় ব্যাংকই দ্রুত ঋণ সরবরাহ স্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংককে টিকে থাকতে হলে এর ব্যবস্থাপনাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের করে আনতে হবে। দূর করতে হবে এক দশক আগের পর্যালোচনায় চিহ্নিত ‘ফ্র্যাগমেন্টেশেন, ডুপ্লিকেশন অ্যান্ড ডিলে’ সমস্যা। একই সাথে এই প্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করতে হবে এর অনন্য কিছু করণীয়, যা অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে একে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি ঘোষণা করেছিল এর নতুন লক্ষ্য- ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যবিমোচন করা। বিশ্বব্যাংকের বিশেষত্ব হলো- ১৮৮টি দেশ এটি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এটি এসব দেশের হয়ে কাজ করতে পারে দুয়েকটির হয়ে কাজ না করে। অধিকন্তু, এটি হতে পারে আর সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আরো বেশি মাত্রায় স্বায়ত্তশাসিত, স্বনির্ভর ও কর্মে লেগে থাকায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এগুলো হতে পারে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
কোনো কোনো দেশ দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থায় ঋণ দেয়। কিন্তু এই ঋণ কোন দেশ পাবে বা না পাবে, তা নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর। দ্বিপক্ষীয় ঋণ হচ্ছে এইড ইন্ডাস্ট্রির খেয়াল-খুশি ও প্রবণতার বিষয়। কোনো কোনো সময় এ ঋণপ্রবাহ চলে বিশেষ কোনো খাতের দিকে কিংবা এই ঋণ সমর্থন জোগায় বিশেষ কোনো উদ্যোগের পেছনে। এর ফলে কোনো কোনো দেশ প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ঋণ পায়। অপর দিকে অন্য দেশগুলো চাহিদামতো ঋণ পায় না। ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের মতে, ৩০টি দেশের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দেশ সঠিক মাত্রার ঋণ পাওয়ার আশা করতে পারে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্র্তৃপক্ষ ও সদস্য দেশগুলোকে একসাথে মিলে কাজ করে ব্যাংকটিকে একটি গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে বিশ্বব্যাংকের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন দেশের বা মহলের অসন্তুষ্টি কোথায়, তা চিহ্নিত করে সে অসন্তুষ্টি দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে। তবেই যদি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় এই প্রতিষ্ঠানকে। একই সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো নিশ্চিত করে, এমন সব কর্মসূচিতে তহবিল জোগান দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
No comments