থাকার দেশ না টাকার দেশ বাংলাদেশ? by ফারুক ওয়াসিফ

ভূমিকম্পে মাটি কাঁপে কিন্তু ব্যবস্থা কাঁপে না,
বাসযোগ্যতা বাড়ে না দেশের
ধানমন্ডিবাসী খুবই অসন্তুষ্ট, এলাকাটি আর আবাসিক থাকছে না। একই অসন্তোষ হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ১৬ হাজার চা-শ্রমিকের। শতবর্ষ পুরোনো আবাদি জমি আর তাঁদের থাকবে না, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিতে যাবে। প্রশ্নটা কিন্তু আরও বড়, ঢাকা শহর মায় বাংলাদেশটাই কি আবাসিক থাকছে? অভিজাতপাড়ার দুঃখটা সমগ্র ঢাকারও। ঢাকা বাসযোগ্য নেই, বৈশ্বিক জরিপ চোখে আঙুল দিচ্ছে। আমরা চোখটাই ঢাকছি, সমস্যাটা দেখছি না।
বসবাসের জায়গা আর কারবারের জায়গা আলাদা থাকছে না বাংলাদেশে। সব দেশে ও নগরে ভাগ করা থাকে এবং থাকার ও অর্থনৈতিক কারবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও পরিসর সৃষ্টি করা থাকে। আমাদের এমন পরিকল্পনা থাকলেও এখন কাগজের সঙ্গে বাস্তবের দারুণ অমিল। ঢাকার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার মধ্যে ধানমন্ডি পুরোনো। এর বাইরে গুলশান-বনানী-মোহাম্মদপুর ও উত্তরাকে আবাসিক রাখার কথা ছিল। কিন্ত কথা রাখা হচ্ছে না। বৃহত্তর ঢাকা-চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জে আগে আবাসিক এলাকায় পোশাক কারখানা চলত, এখন কারখানার মাঝে মাঝে আবাসিক এলাকা। এই মডেলই ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশময়। এই পরিবেশ জীবনযাপনের বিপক্ষে যাচ্ছে। সামাজিক মেলামেশা ও অন্তরঙ্গতার সুযোগ কমছে। ফ্ল্যাট-রাস্তা-বাজার-টিভি ছাড়া করার কিছু থাকছে না। নির্ভার নির্মল বিচরণের জায়গাগুলোর দখল নিচ্ছে বাজারি কারবার। বাণিজ্যের শক্তির চাপে প্রতিদিন পিছু হটছে সামাজিক সমবায়।
প্রাণ ও প্রকৃতির স্পর্শহীন যে জীবন, সে জীবন সুস্থ থাকতে পারে না। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা, হতাশা, নিঃসঙ্গতা আর হিংস্রতা বাড়ছে। অনেককেই তাই বলতে শুনি, ‘দেশটা আর দেশ নাই’। দেশের আরেক অর্থ ঘর। ইংরেজিতে বলে ‘অ্যাট হোম ফিল’ করা। যদি নিজ নিবাসে আপনি ঘরোয়া শান্তি না পান, তাহলে দেশে আছেন বলা যাবে না।
দেশ মানে আপন পরিবেশে শান্তিতে থাকার জায়গা। কে থাকবে? থাকবে আপন সন্তান-পরিজন, থাকবে যে জনগোষ্ঠীর অংশ আমরা, তারা। অর্থ থাকলে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই এই নিরাপত্তা ও শান্তি কিনে থাকা সম্ভব। কিন্তু কোনো আবাসিক জায়গাকে দেশ বানাতে কয়েক প্রজন্মের বসবাসের দরকার হয়। দেশের ধারণা তাই অনেক বড়। দেশ মানে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত আপন প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে হুমকিহীন বসবাসের ভরসা। দেশ মানে চারপাশের সঙ্গে সুন্দর-সাবলীল সম্পর্ক। প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে বন্ধনের সম্পর্ক ছাড়া তাই দেশ ও ঘর কোনোটাই হয় না। জায়গা বদলানো যত সহজ, দেশ বদলানো ততই কঠিন। দেশ তাই এমন এক আশ্বাস, ভবিষ্যতেও তা যাতে থাকে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ইতিহাস দেখায়, যেই শাসন করেছে, দেশটাকে বাসযোগ্য রাখার চিন্তা করেনি। ইংরেজরা আড়াই শ বছর থেকেও ভারতভূমিকে দেশ ভাবতে পারেনি। জমিদার ও পাঞ্জাবিরা কলকাতা–করাচি গড়েছে, বাংলাদেশ গড়েনি। অথচ কয়েক প্রজন্ম বিদেশে থেকেও নাড়ির টান টনটন করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে। জীবনের অনেকটা সময় বিদেশে পার করে শেষ বয়সে দেশে চলে আসেন অনেকেই। জনগণের ৯৯ শতাংশেরও জন্মভূমিতে থাকার ইচ্ছা ও সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং, দেশকে দেশের মতো রাখার ও তেমন করে গড়বার প্রয়োজনই হওয়া উচিত উন্নয়নের লক্ষ্য। তার জন্য এমনভাবে উন্নয়ন ও বাণিজ্য হতে হবে, যাতে দেশের আবাসিকতা এবং পরিবেশগত ও সামাজিক নিরাপত্তা ঠিক থাকে। তা না হলে থাকার জায়গাকে দেশ বলব কীভাবে?
এ কারণেই ধানমন্ডিবাসীর উদ্বেগটা বৈধ। যেমন বৈধ নদী-জলাশয়, অরণ্য-পাহাড় বাঁচানোর দাবি। নদী বাঁচছে না, অরণ্য-পাহাড় ধ্বংসের গতি থামছে না। নদী ছাড়া, অরণ্যের দান সজীব জলবায়ু ছাড়া দেশের বাসযোগ্যতা রাখা যাবে—এমন চিন্তা অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক। কাজেই আড়িয়ল বিলে নতুন বিমানবন্দর করার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ওসমানী উদ্যান বাঁচাও আন্দোলন বৈধ ছিল। এ কারণেই ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি করা, সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গ্যাসক্ষেত্র করা, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটসহ কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক কারবার বসানো ঠিক না।
কিন্তু দেশের মানুষের রুটি-রুজি মর্যাদার উন্নতিও তো দরকার। উন্নয়ন শব্দটা বিতর্কিত, উন্নতিই সবকিছুর আসল কথা। মূলত পরাধীনতার কারণে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে এগিয়ে আনার দোহাইয়ে উন্নয়ন ধারণার জন্ম হয়। এই ধারণার রূপায়ণ ও বাস্তবায়নের সর্দার তাঁরাই হন, যাঁরা নাকি কিছুদিন আগেও এসব দেশকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ-শাসন করেছেন।
একসময় তাঁদের ধ্যানধারণা স্থানীয় শাসকেরাও গ্রহণ করেন। কারণ, এমন ধারার উন্নয়নে একটি-দুটি শ্রেণিকে খুশি করে অধিকাংশ জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায়। উন্নয়ন তাই হয়ে দাঁড়ায় অল্প কিছু মানুষের উন্নতির মন্ত্র। বাংলাদেশটা যা এগিয়েছে তা দেশে ও প্রবাসে খাটুনি করা শ্রমিকদের দ্বারা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের উদ্যোক্তাদের কারণে।
জাপান ও জার্মানির মতো উন্নত দেশ আবাসিক এলাকার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প রাখছে না। ঘনতম বসতির দেশে আমরা রূপপুর বা রামপালের মেতা ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণের সাহস করছি কেন? বাড়তি ভয় ভূমিকম্পের। ভূমিকম্পসহ আবাসন নিরাপদ আবাসনের শর্ত। অথচ মাটি-ভবন কাঁপল আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অকম্পিতভাবে বলে চললেন, ঢাকার কোনো ক্ষতি হবে না!
উন্নতি কার না দরকার? শিল্পায়ন লাগবে, বিদ্যুৎ লাগবে। এর জন্য কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষকে জমি ছাড়তে হবেও। তার মানে, আজ এখানে, কাল ওখানে খাবলা দিয়ে উচ্ছেদ করা নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব করতে হবে। সেই পরিকল্পনায় আবাসিকতা আর উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য মানতে হবে। সবার স্বার্থে উন্নয়নের নীতি ও পরিকল্পনা কী হবে তা-ই হওয়া উচিত মূল প্রশ্ন। সারা দেশে প্রায়ই যে উন্নয়নের পরিকল্পনার সঙ্গে স্থানীয় জনগণের স্বার্থের বিরোধ হয়, তা কি ওই সব পরিকল্পনারও দোষ নয়? নীতি-কৌশল আর বাস্তবতার মধ্যে এসব সংঘাত পরিকল্পনার দুর্বলতাই দেখায়। যেমন হাতিরঝিল প্রকল্পের কথা বলা যায়। সুন্দর প্রকল্প। কিন্তু প্রতিদিন একে সচল ও পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থাপনা দুর্বল। অন্যদিকে আশপাশের সড়ক, পানি, পয়োব্যবস্থা ঠিক না হলে এখানে আলাদা করে সুন্দর টিকবে না।
সামষ্টিক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাধা দুটি: অ্যাডহকইজম বা অস্থায়ী পদক্ষেপ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ। উদ্ভূত কোনো সমস্যা মেটাতে আগপাছ চিন্তা না করে অস্থায়ীভিত্তিক সমাধান করতে গেলে তা বুমেরাং হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীর দিকে পরিকল্পনাকে বাঁক নেওয়ানো যাবে না। শিল্পায়নের জমির সমস্যা মিটে যায়, যদি প্রতাপশালী দখলদারদের উচ্ছেদ করা যায়। খাসজমিগুলোকে উদ্ধার করা যায়। তা না করে খাদ্য জোগান দেওয়া জমি নষ্ট করা কেন? কেন গরিব মানুষের আশ্রয় কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত?
অনুমতি ছাড়াই যে কেউ যেকোনো জায়গায় যেকোনো কায়দার বাড়ি-দোকান-দপ্তর স্থাপন করতে পারে না। অজস্র ক্ষুদ্র দোকান-কারখানা-ওয়ার্কশপ ও ভবনই বলে দেয় পরিকল্পনাহীন নৈরাজ্যের কথা। এসবের সম্মিলিত অবদান হলো দেশের বাস-অযোগ্যতা। এভাবেই চলছে, চলবে? সুবিধাভোগীরা হয়তো দেশটাকে তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আবাসভূমি মনে করেন না। তাঁদের বিদেশমুখিতাও আর লুকোছাপা নেই। বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ২০১৪-১৫ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয়ের সমান। ভাবা যায়? এক বছরের জাতীয় উন্নয়ন ব্যয়ের সমান অর্থ বিদেশেই চলে গেছে। এই তথ্যই প্রমাণ করে, উন্নয়নের কান্ডারিদের অনেকেরই পরিবার ও সম্পদের ঠিকানা বিদেশ। দেশটা তাঁদের থাকার জায়গা নয়, টাকা বানানোর খনি।
বাণিজ্যের শক্তি আর আবাসনের শক্তির এই বিরোধ বাংলাদেশের মৌলিক বিরোধগুলোর একটি। দেশটাকে আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে গেলে সমাজশক্তিকে ব্যবসাশক্তির ওপরে স্থান দিতে হবে। এটা আপনাআপনি হওয়ার নয়। দেশটাকে সবার বাসযোগ্য রাখতে হলে সমাজকেই দাবি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। নিরাপদ সুস্থ আবাসনের দাবি জনপ্রিয় হলেও, বড় দলগুলো এ নিয়ে ভাবিত না। চাইলেই শহরগুলোতে ‘নিরাপদ আবাসন, দেশবাসীর উন্নয়ন’ স্লোগান জনপ্রিয় করা যায়। এটুকু উন্নতির জন্য বিপ্লবী হওয়ার দরকার নেই, সুষম-বৈজ্ঞানিক ও দূরদর্শী গণতান্ত্রিক নীতি ও তা বাস্তবায়নের কর্তৃপক্ষই কেবল প্রয়োজন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.