স্টিভ জবস: জিনিয়াস না নিষ্ঠুর ছিলেন? by অ্যান্ড্রু রস সরকিন
স্টিভ
জবস কি এতটা শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য? এ প্রশ্নটিই তোলা হয়েছে অ্যাপলের
সহ-প্রতিষ্ঠাতার জীবনী নিয়ে বানানো একটি নতুন প্রামাণ্যচিত্রে। অ্যালেক্স
জিবনির ‘স্টিভস জবস: দ্য ম্যান ইন দ্য মেশিন’ নামের এ তথ্যচিত্রে তো বটেই,
একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে আরন সরকিনের পরিচালনায় স্টিভ জবসের
জীবনীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র ‘স্টিভ জবস’-এও। এ চলচ্চিত্রটি এ সপ্তাহান্তে
টেলুরাইড চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। আগামী ৯ই অক্টোবর এটি মুক্তি
পাবে। নিঃসন্দেহে জবস একজন জটিল নেতা। ভীষণ মেধাবী ও সৃজনশীল। একই সঙ্গে
তিনি এত বদমেজাজি ছিলেন যে সহকর্মীরা প্রায়ই তার আচরণে কষ্ট পেয়ে কাঁদতেন। এ
আচরণ থেকে বাঁচার কোন উপায়ও ছিল না। অনেক সময়, নিজের কথাই সত্য বলে
প্রতিষ্ঠিত করতেন জবস। সমপ্রতি সায়েন্টোলজি নিয়ে এইচবিও চ্যানেলের
তথ্যচিত্র ‘গোয়িং ক্লিয়ার’ পরিচালনা করেছেন অ্যালেক্স জিবনি। ‘স্টিভস জবস:
দ্য ম্যান ইন দ্য মেশিন’ প্রামাণ্যচিত্রের প্রথমেই জিবনি নিজ নেপথ্য কণ্ঠে
ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন স্টিভ জবস নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গেলেন
তিনি। সে সময় তিনি বলেন, যখন স্টিভ জবস মারা গেলেন, আমি এক রহস্যে বাধা
পড়লাম। এ কথাগুলো যখন জিবনি বলছিলেন, তখন চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছিল জবসের
মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী মানুষের শোক প্রকাশের বিভিন্ন ছবি। জিবনি বলে
যাচ্ছেন, লাখো মানুষ কেন এমন একজনের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন হবে যাকে তারা
জানতোই না? জন লেনন ও মার্টিন লুথার কিং-এর মৃত্যুতেও একই অবস্থা দেখেছি
আমি। কিন্তু স্টিভ জবস কোনো গায়ক বা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ছিলেন
না। জবসের জন্য শোক প্রকাশের মাত্রা তার উদ্ভাবিত পণ্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
আমরা ওই ব্যক্তি বিশেষের জন্য শোক প্রকাশ করছিলাম। কিন্তু কেন? অত্যন্ত
মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা জিবনি এর পরের দুই ঘণ্টায় যুক্তি দিয়ে দেখালেন,
জবস মানুষ হিসেবে অতটা অনুসরণীয় তকমা পাওয়ার যোগ্য নন, যতটা তিনি পেয়েছেন।
পুরো তথ্যচিত্রে বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জিবনি। এর মধ্যে রয়েছে
বহুদিন ধরে জবসের অস্বীকৃত সন্তানের মায়ের সাক্ষাৎকারও। চূড়ান্তভাবে
পরিচালক স্টিভ জবসকে রূপায়িত করেছেন একজন ‘নির্মম, ঠগ ও নিষ্ঠুর’ ব্যক্তি
হিসেবে। জবসের পাপের রীতিমতো তালিকা বানিয়েছেন জিবনি। এর মধ্যে রয়েছে, পণ্য
উৎপাদনের তারিখ পরিবর্তন, চীনে অ্যাপলের কারখানার নিম্নমাণের কর্ম ও শ্রম
পরিবেশ, কর্মী হাতিয়ে নেয়া ঠেকাতে সিলিকন ভ্যালির অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপন চুক্তি ইত্যাদি। কিন্তু জবসকে নায়ক বা ভিলেন
প্রমাণের গোটা প্রচেষ্টায় একটি বড় সত্যকে যোগ করা হয় না। সেটি হলো, তিনি
কিন্তু একাধারে নায়ক ও ভিলেন দু’টিই হতে পারেন। এবং এরপরও, যে প্রশংসা তিনি
পেয়েছেন, তা পাওয়ার যোগ্যও তিনি হতে পারেন। এ সমীকরণ কেউই ভেবে দেখেনি।
বিশ্বব্যাপী ৭০ কোটি আইফোন বিক্রি হয়েছে। বিশ্বের কোটি মানুষ অন্য যে কোন
ডিভাইসের চেয়ে আইফোনেই এখন অধিক সময় কাটায়। চিন্তা করুন: জবস মানুষের সঙ্গে
একটি যন্ত্রের আবেগী সমপর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আপনি এ লোকটি সমপর্কে
যা ইচ্ছা তা বলতে পারেন। কিন্তু এ প্রজন্মের সময় বিশ্বকে পাল্টে দেয়ার
কৃতিত্ব্ব দাবি করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে তার। এ বিষয়টি স্বীকার করতে হলে
আপনাকে অ্যাপল ব্যবহারকারী হতে হবে না। বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সক্ষম
এমন বেশিরভাগ মানুষই ত্রুটিযুক্ত। এতে অবাক হবার কিছু নেই। এক দিকে বা অন্য
দিকে বেশিরভাগ মানুষই ত্রুটিযুক্ত। জিবনি নিজের চলচ্চিত্রে জন লেনন ও
লুথার কিং-কে দোষত্রুটির ঊর্ধ্বের ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
তিনজনের মৃত্যুতেই বিশ্বজুড়ে শোকাবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জিবনির
মতে, জবস এসবের যোগ্য না হলেও, লেনন ও লুথার কিং এসবের যোগ্য। কিন্তু সত্য
হলো, এরা উভয়ই জবসের মতো বহু দোষের অধিকারী। ১৯৯৮ সালে লেননের নিজের ছেলে
দ্য লন্ডন টেলিগ্রাফকে বলেছিলেন, আমার মনে হয় সে (লেনন) একজন ভণ্ড। বিশ্বকে
চিৎকার করে ভালবাসা ও শান্তির কথা বলতে পারতেন পিতা। কিন্তু তার সবচেয়ে
কাছের মানুষ হওয়ার কথা ছিল যাদের, সেই স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতিই তিনি
ভালবাসা দেখাতে পারেননি কখনই। যার নিজের পরিবারই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, যে
ব্যক্তি পরিবারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেনি, বরং অবাধ ব্যাভিচার আর
ছাড়াছাড়িতেই ব্যস্ত ছিল সবসময়, সে ব্যক্তি কিভাবে শান্তি আর ভালবাসার
আহ্বান জানাতে পারে? লুথার কিং-এর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তিনি ছিলেন
একজন সিরিয়াল ব্যভিচারী। দুঃখজনক হলেও সত্য, ত্রুটিযুক্ত ব্যক্তিরাই সফল
হয়। দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনে ‘হোয়াই ইট পেইস টু বি আ জার্ক?’ শীর্ষক একটি
নিবন্ধে লেখক জেরি উসীম বেশ কয়েকটি গবেষণাকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছিলেন, ভাল
মানুষরা সাধারণত সফল হন না। গত বছর ভ্যানিটি ফেয়ারকে অসাধারণ একটি
সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন অ্যাপলের বিখ্যাত ডিজাইনার ও স্টিভ জবসের দীর্ঘদিনের
বন্ধু জনি আইভ। সেখানে তিনি এমন এক সময়ের কথা স্মরণ করেন, যে সময়টায় জবস
তার কর্মীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ কঠিন। একদিন আইভ তাকে পাশে ডেকে নিয়ে
কর্মীদের প্রতি আরেকটু নরম হতে বললেন। জবসের পাল্টা প্রশ্ন, কেন? আইভ
প্রত্যুত্তরে বলেন, কারণ আমি কর্মীদের প্রতি যত্নবান। কিন্তু এর পাল্টা
উত্তরে স্টিভ জবস এমন এক কথা বলেন, যা আইভের মতে ছিল ‘নিষ্ঠুর ও
বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মন্তব্য’। জবস বলেন, না, জনি। তুমি আসলে
স্রেফ অসার একজন মানুষ। তুমি শুধু চাও, মানুষ তোমাকে পছন্দ করুক। আমি তোমার
কথায় আশ্চর্য হয়েছি। কেননা, আমি ভাবতাম, মানুষ তোমার কাজকে কীভাবে গ্রহণ
করবে, সে চিন্তার চেয়ে, তোমার কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ভেবেই তুমি কাজ
কর। জনি আইভের ওই গল্প আর অ্যালেক্স জিবনির তথ্যচিত্র দেখে এখন দুটি
প্রশ্নই মনে বাজছে। ১. তুমি কি এমন কোন অসাধারণ কাজ করবে, যার ফলে বিশ্বে
লাখো মানুষের জীবনে উন্নতি ঘটবে? নাকি এমন কিছু যা কয়েকশ’ মানুষের পছন্দ
হবে? ২. ওপরের দু’টি লক্ষ্য কি একে অপরটির বিকল্প হতে পারে? দুটি প্রশ্নের
উত্তরই জবসের মতোই জটিল।
[অ্যান্ড্রু রস সরকিনের এ নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন নাজমুল আহসান]
[অ্যান্ড্রু রস সরকিনের এ নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন নাজমুল আহসান]
No comments