বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট: প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অচল ঢাকা, দুর্ভোগ
হাতে
ফুল, মাথায় ভ্যাটবিরোধী পট্টি, বুক ও পিঠে নানা স্লোগান, প্ল্যাকার্ডে
ভ্যাট দিয়ে শিক্ষা নয় এমন প্রতিবাদের ভাষা। গতকাল এভাবেই ফের রাস্তা অবরোধ
করে আরোপিত ভ্যাটের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে বিভিন্ন বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরের প্রধান সড়কে অবস্থান নেন। এতে
ধানমন্ডি, রামপুরা, গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় যান
চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। একই দাবিতে আজও অবস্থান ও
বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা । শুধু ঢাকা নয়, প্রচণ্ড
যানজটে একইভাবে ভুগতে হয়েছে সাভার, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী শহরের
বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
একইসঙ্গে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় টিউশন ফির উপর আরোপিত ভ্যাট শিক্ষার্থীদের
কাছ থেকে না নেয়ার কথা জানানো হয়েছে। এর মধ্যে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
আগামী তিন বছর বেতন-ফি না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল সকাল ৯টা থেকে রাজধানীর বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা ও রামপুরা ব্রিজ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়কে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে এসব এলাকাকে ঘিরে থাকা সড়কগুলোয় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুরনো ঢাকাসহ পুরো রাজধানীতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বুধবার থেকে রাজধানীসহ তিনটি বিভাগীয় শহরে একযোগ আন্দোলনে নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ৬টি রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এদিকে শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউবি), নর্থ সাউথ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গতকাল থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে রোববার ছুটির এই নোটিশ দেয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও ইস্ট ওয়েস্টসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন ভ্যাট নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রর সোহেল আহসান নিপু। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, আগামী ৩ বছর শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হবে না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কোন ভ্যাট দিতে হবে না। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোনা রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনবিআরের সিদ্ধান্ত অনুসারে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট নেয়া হবে না। এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভ্যাট বাবদ যে টাকা দিয়েছে তা ২০১৬ সালের স্প্রিং সেমিস্টারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
ধানমন্ডিতে বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলনে আছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ছাত্র সাদ্দাম হোসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা সরকার ও অর্থমন্ত্রীর কোন কথায় আশ্বাস রাখতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ভ্যাট দিবে বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমন্ত্রী একেক সময় একেক কথা বলছেন। আমরা সরকারের কথায় আশ্বাস রাখতে পারছি না। আমাদের একটা দাবি, ভ্যাট দিয়ে পড়াশুনা করবো না। টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনবো না। স্টেট ইউনিভাসির্টি কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ঈশিতা বলেন, জুলাই মাস থেকে শুধু টিউশন ফি নয়, আইডি কার্ডের ওপর ভ্যাট বসিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ভ্যাটের ফলে প্রতি সেমিস্টারে অতিরিক্ত ৮ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অজুহাতে সকল ধরনের ফি’র ওপর ভ্যাট বসিয়ে দিয়েছে। এই ভ্যাট বসানোর ফলে আমাদের পরিবারের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। আলাদাভাবে বাজেট বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইমন বলেন, ভ্যাট নিয়ে আলাদা আইন করা দরকার। যাতে ভবিষ্যতে কোন সরকার শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসাতে না পারে। আমাদের একটাই দাবি, ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা চাই।
উত্তরায় শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঝর্ণা দাস বলেন, আমাদের বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। অনেক কষ্ট করে আমার টিউশন ফি ব্যবস্থা করে দেন। এই ভ্যাটের ফলে প্রতি সেমিস্টারে নতুন করে আরও ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা যোগ হবে। এটা আমার পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব না। এমনিতেই রাজধানীতে থাকার খরচ বেড়ে গেছে। প্রয়োজনে পড়াশুনা বন্ধ করে দিবো কিন্তু ভ্যাট দেবো না।
নগরজুড়ে দুর্ভোগ: ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করায় যানজটে পুরো নগর গতকালও স্থবির হয়ে পড়ে। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির সারি। অন্যদিকে যানবাহন না থাকায় কিছু রাস্তা একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়ে। গণপরিবহনের জন্য হাহাকার দেখা দেয়। সকাল থেকেই উত্তরার আবদুল্লাহপুর, প্রগতি সরণির মেরুল ও রামপুরা, কাকলীতে বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালীতে গুলশানমুখী সড়ক এবং ধানমন্ডির কয়েকটি অংশে শিক্ষার্থীদের অবরোধ ও বিক্ষোভের ফলে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও কোলে শিশু নিয়ে ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমেই পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্য পৌঁছাতে দেখা যায়। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। বিকালের বৃষ্টি এই ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আফতাবনগরের ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে এসে রামপুরা ব্রিজ ও মেরুল বাড্ডার মধ্যবর্তী সড়ক অবরোধ করে। ফলে রামপুরা থেকে প্রগতি সরণি ও রামপুরা থেকে মৌচাকমুখী সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেরুল বাড্ডার বাঁশপট্টি থেকে বাঁশ নিয়ে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। এতে মালিবাগ-রামপুরা-নতুন বাজার মূল সড়ক বন্ধ হয়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে থেকে যাত্রী ও পথচারীদের ভোগান্তি চরমে ওঠে। এ সময় বিমানবন্দর সড়কের খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড, এমইএস ও কাকলীতে শত শত মানুষকে গাড়ির প্রতীক্ষায় থাকতে দেখা যায়। সেখানকার স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরাও দুর্ভোগে পড়ে। অনেকেই গণপরিবহন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন।
ইস্টওয়েস্টের পরপরই সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বনানীর কাকলী মোড়ে মিছিল শুরু করে। এর ঘণ্টাখানেক পর সেখানে এলোপাতাড়ি কয়েকটি বাস রেখে তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। ফলে বিমানবন্দর সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহাখালীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমে তাদের ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তা আটকে পরে মিছিল নিয়ে গুলশান ১ এর দিকে অগ্রসর হয়। ফলে গুলশান ১ থেকে মহাখালীর পথেও যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
আবদুল্লাহপুর ও হাউজ বিল্ডিংয়ে আইইউবিএটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি ও বিইউএফটির শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে টঙ্গীর দিক থেকে গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুপুরে বিমানবন্দর সড়কে যানবাহন ছিল একেবারেই কম। এই পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর, কাউলা এবং খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষকে যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে কাকলী মোড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়ায় আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত এলাকায় থমকে দাঁড়ায় যানবাহন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভার পেরিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সড়কে বিভিন্ন যানবাহনকে আটকে থাকতে দেখা যায়। কাকলী মোড়ে কামাল আতাতুর্ক সড়কের দিকে শ্যামলী বাংলা পরিবহনের একটি বড় বাস এবং ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিসের বাস আড়াআড়ি রেখে রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। একইভাবে বনানী ডিওএইচএসের দিকের রাস্তাও দুটি বাস রেখে আটকে দেয়া হয়।
সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, এআইইউবি, সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া, নর্দান ইউনিভার্সিটি এবং অতীশ দিপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীকে সেখানে ছোট ছোট জটলা করে নো ভ্যাট লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে নো ভ্যাট, নো ভ্যাট স্লোগান দিতে দেখা যায়। সাভারের আশুলিয়ায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।
ছাত্র ফেডারেশনের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের আহ্বান
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ক্যাম্পাসগুলোতে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈকত মল্লিক। আরও উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সোহেল, ঢাবি শাখার সভাপতি মনোয়ার হোসেন মাসুদ, সাধারণ সম্পাদক সাদিক রেজা প্রমুখ। লিখিত বক্তব্যে সৈকত মল্লিক বলেন, রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা নমক পণ্যের খরিদ্দার হিসেবে বিবেচনা করার এই বর্বর নীতি সমগ্র ছাত্র সমাজের মর্যাদাকেই ভূলুণ্ঠিত করেছে। তাই ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট চলবে। অপর একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারাও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জনার্দন দত্ত নান্টু, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সলিমান রহমান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সৈকত মল্লিক, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান। এ সময় লিখিত বক্তব্যে জনার্দন দত্ত নান্টু বলেন, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করছি। তিনদিনের ছাত্র ধর্মঘট সর্বাত্মকভাবে পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান শিক্ষকদের
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনরত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। গতকাল সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। এই সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ৮ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিষয়ে অসংলগ্ন মন্তব্যের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। মন্ত্রী বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ক্ষমা চান এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু মন্ত্রী ক্ষমা চাইতে গিয়ে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অতিকথন করেছেন। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে শিক্ষকদের বিষয়ে আগের মতো আরও কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। এতে মন্ত্রী জাতির সামনে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অসম্মান ও হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। গত ১০ই সেপ্টেম্বর ক্ষমা চাইতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্য সম্বন্ধে খুবই দুঃখিত, তবে বিস্মিত যে তারা সরকারি সিদ্ধান্ত জানার আগেই আন্দোলনে নেমে যান।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি আরও বলেন, ২২ ধাপ বিশিষ্ট এই বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের ৪ ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক আছেন তারা গ্রেড-১ এ সচিবদের সমতুল্য বেতন পাবেন ঠিকই কিন্তু যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক নন কিংবা নতুনভাবে অধ্যাপক হবেন তাদের পক্ষে গ্রেড-১ এ যাওয়ার সুযোগ থাকলো না। সিলেকশন গ্রেড অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে অধ্যাপকদের গ্রেড-১ এ যাওয়ার অধিকার বন্ধ করে দেয়া হল। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অধ্যাপকরা আগের মতো সচিবদের সঙ্গে অবস্থান করছেন, সেই গ্রেডের মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা। যারা ভবিষ্যতে অধ্যাপক হবেন তারা কিভাবে গ্রেড-১ এর বেতন পাবেন? অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল এর ব্যাখ্যা চান অর্থমন্ত্রীর কাছে। ‘অধ্যাপকদের যেভাবে পদোন্নতি হয় তা বেশ অস্বচ্ছ’ এবং ‘শিক্ষকদের করাপট প্রাকটিস নিয়ন্ত্রন করা দরকার’ বলে বক্তব্য দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তার এসব বক্তব্যের জেরে অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, মন্ত্রীর এমন বক্তব্য যে তথ্য নির্ভর নয় এবং এটি যে কোন কারণে শিক্ষকতা পেশার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণের মানসিকতার পরিচায়ক। তিনি বলেন, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে ন্যূনতম ৬ বছর চাকরি করতে হয়, সহযোগী অধ্যাপক থাকাকালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা থাকতে হয় ৬টি। গবেষণা খাতে বরাদ্দ কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে শিক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ১.৮৩ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৭.৭ শতাংশ। যা মোট জিডিপির ০.১৭ শতাংশ। সংগঠনের মহাসচিব বলেন, বয়স্ক অর্থমন্ত্রী দেশের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করা এবং শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করার নীল নকশা বাস্তবায়নে নেমেছেন। আমাদের প্রশ্ন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সাবেক আমলা ও বর্তমান আমলাপক্ষের একজন অর্থমন্ত্রী হয়ে তার পক্ষে বিভ্রান্তিকর তথ্যসংবলিত এমন বক্তব্য দেয়া কি শোভা পায়? উচ্চ শিক্ষা বিরোধী মনোভাবের পরিচয় দিয়ে অথবা উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে তিনি কার স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন? তিনি বলেন, বেতন বৈষম্য বিষয়ক যে কমিটি রয়েছে তার প্রধান হিসেবে অর্থমন্ত্রী রয়েছেন। ইতিমধ্যে যিনি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এবং শিক্ষকদের ব্যাপারে প্রতিহিংসাপরায়ন বক্তব্য রেখে নিজেকে বিতর্ক করেছেন- সেই ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন কোন কমিটি শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানান। একই সঙ্গে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ও ১৭ই সেপ্টেম্বর কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ঈদের পর আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ার করা হয়। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কারা অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, জাতিকে বিভ্রান্ত না করে পড়ালেখা করে জেনেশুনে কথা বলবেন। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর বয়স হয়েছে। কোন সময় কোন কথা বলবেন বুঝতে পারেন না। তাই আমরা মনে করি অর্থমন্ত্রীর এখনই পদত্যাগ করার উপযুক্ত সময়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আক্তারুজ্জামান, বিজয় ৭১ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া, অধ্যাপক ড. আক্তার হোসাইন খান, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম, সহকারী অধ্যাপক শহিদুল হাসান প্রমুখ। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে গতকাল দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে কর্মবিরতি পালন করা হয়।
গতকাল সকাল ৯টা থেকে রাজধানীর বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা ও রামপুরা ব্রিজ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়কে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে এসব এলাকাকে ঘিরে থাকা সড়কগুলোয় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুরনো ঢাকাসহ পুরো রাজধানীতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বুধবার থেকে রাজধানীসহ তিনটি বিভাগীয় শহরে একযোগ আন্দোলনে নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ৬টি রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এদিকে শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউবি), নর্থ সাউথ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গতকাল থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে রোববার ছুটির এই নোটিশ দেয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও ইস্ট ওয়েস্টসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন ভ্যাট নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রর সোহেল আহসান নিপু। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, আগামী ৩ বছর শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হবে না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কোন ভ্যাট দিতে হবে না। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোনা রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনবিআরের সিদ্ধান্ত অনুসারে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট নেয়া হবে না। এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভ্যাট বাবদ যে টাকা দিয়েছে তা ২০১৬ সালের স্প্রিং সেমিস্টারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
ধানমন্ডিতে বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলনে আছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ছাত্র সাদ্দাম হোসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা সরকার ও অর্থমন্ত্রীর কোন কথায় আশ্বাস রাখতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ভ্যাট দিবে বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমন্ত্রী একেক সময় একেক কথা বলছেন। আমরা সরকারের কথায় আশ্বাস রাখতে পারছি না। আমাদের একটা দাবি, ভ্যাট দিয়ে পড়াশুনা করবো না। টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনবো না। স্টেট ইউনিভাসির্টি কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ঈশিতা বলেন, জুলাই মাস থেকে শুধু টিউশন ফি নয়, আইডি কার্ডের ওপর ভ্যাট বসিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ভ্যাটের ফলে প্রতি সেমিস্টারে অতিরিক্ত ৮ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অজুহাতে সকল ধরনের ফি’র ওপর ভ্যাট বসিয়ে দিয়েছে। এই ভ্যাট বসানোর ফলে আমাদের পরিবারের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। আলাদাভাবে বাজেট বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইমন বলেন, ভ্যাট নিয়ে আলাদা আইন করা দরকার। যাতে ভবিষ্যতে কোন সরকার শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসাতে না পারে। আমাদের একটাই দাবি, ভ্যাট ছাড়া শিক্ষা চাই।
উত্তরায় শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঝর্ণা দাস বলেন, আমাদের বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। অনেক কষ্ট করে আমার টিউশন ফি ব্যবস্থা করে দেন। এই ভ্যাটের ফলে প্রতি সেমিস্টারে নতুন করে আরও ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা যোগ হবে। এটা আমার পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব না। এমনিতেই রাজধানীতে থাকার খরচ বেড়ে গেছে। প্রয়োজনে পড়াশুনা বন্ধ করে দিবো কিন্তু ভ্যাট দেবো না।
নগরজুড়ে দুর্ভোগ: ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করায় যানজটে পুরো নগর গতকালও স্থবির হয়ে পড়ে। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির সারি। অন্যদিকে যানবাহন না থাকায় কিছু রাস্তা একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়ে। গণপরিবহনের জন্য হাহাকার দেখা দেয়। সকাল থেকেই উত্তরার আবদুল্লাহপুর, প্রগতি সরণির মেরুল ও রামপুরা, কাকলীতে বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালীতে গুলশানমুখী সড়ক এবং ধানমন্ডির কয়েকটি অংশে শিক্ষার্থীদের অবরোধ ও বিক্ষোভের ফলে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও কোলে শিশু নিয়ে ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমেই পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্য পৌঁছাতে দেখা যায়। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। বিকালের বৃষ্টি এই ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আফতাবনগরের ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে এসে রামপুরা ব্রিজ ও মেরুল বাড্ডার মধ্যবর্তী সড়ক অবরোধ করে। ফলে রামপুরা থেকে প্রগতি সরণি ও রামপুরা থেকে মৌচাকমুখী সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেরুল বাড্ডার বাঁশপট্টি থেকে বাঁশ নিয়ে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। এতে মালিবাগ-রামপুরা-নতুন বাজার মূল সড়ক বন্ধ হয়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে থেকে যাত্রী ও পথচারীদের ভোগান্তি চরমে ওঠে। এ সময় বিমানবন্দর সড়কের খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড, এমইএস ও কাকলীতে শত শত মানুষকে গাড়ির প্রতীক্ষায় থাকতে দেখা যায়। সেখানকার স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরাও দুর্ভোগে পড়ে। অনেকেই গণপরিবহন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন।
ইস্টওয়েস্টের পরপরই সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বনানীর কাকলী মোড়ে মিছিল শুরু করে। এর ঘণ্টাখানেক পর সেখানে এলোপাতাড়ি কয়েকটি বাস রেখে তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। ফলে বিমানবন্দর সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহাখালীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমে তাদের ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তা আটকে পরে মিছিল নিয়ে গুলশান ১ এর দিকে অগ্রসর হয়। ফলে গুলশান ১ থেকে মহাখালীর পথেও যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
আবদুল্লাহপুর ও হাউজ বিল্ডিংয়ে আইইউবিএটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি ও বিইউএফটির শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে টঙ্গীর দিক থেকে গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুপুরে বিমানবন্দর সড়কে যানবাহন ছিল একেবারেই কম। এই পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর, কাউলা এবং খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষকে যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে কাকলী মোড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়ায় আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত এলাকায় থমকে দাঁড়ায় যানবাহন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভার পেরিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সড়কে বিভিন্ন যানবাহনকে আটকে থাকতে দেখা যায়। কাকলী মোড়ে কামাল আতাতুর্ক সড়কের দিকে শ্যামলী বাংলা পরিবহনের একটি বড় বাস এবং ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিসের বাস আড়াআড়ি রেখে রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। একইভাবে বনানী ডিওএইচএসের দিকের রাস্তাও দুটি বাস রেখে আটকে দেয়া হয়।
সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, এআইইউবি, সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া, নর্দান ইউনিভার্সিটি এবং অতীশ দিপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীকে সেখানে ছোট ছোট জটলা করে নো ভ্যাট লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে নো ভ্যাট, নো ভ্যাট স্লোগান দিতে দেখা যায়। সাভারের আশুলিয়ায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।
ছাত্র ফেডারেশনের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের আহ্বান
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ক্যাম্পাসগুলোতে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈকত মল্লিক। আরও উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সোহেল, ঢাবি শাখার সভাপতি মনোয়ার হোসেন মাসুদ, সাধারণ সম্পাদক সাদিক রেজা প্রমুখ। লিখিত বক্তব্যে সৈকত মল্লিক বলেন, রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা নমক পণ্যের খরিদ্দার হিসেবে বিবেচনা করার এই বর্বর নীতি সমগ্র ছাত্র সমাজের মর্যাদাকেই ভূলুণ্ঠিত করেছে। তাই ভ্যাট প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট চলবে। অপর একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারাও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জনার্দন দত্ত নান্টু, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সলিমান রহমান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সৈকত মল্লিক, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান। এ সময় লিখিত বক্তব্যে জনার্দন দত্ত নান্টু বলেন, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করছি। তিনদিনের ছাত্র ধর্মঘট সর্বাত্মকভাবে পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান শিক্ষকদের
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনরত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। গতকাল সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। এই সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ৮ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিষয়ে অসংলগ্ন মন্তব্যের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। মন্ত্রী বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ক্ষমা চান এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু মন্ত্রী ক্ষমা চাইতে গিয়ে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অতিকথন করেছেন। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে শিক্ষকদের বিষয়ে আগের মতো আরও কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। এতে মন্ত্রী জাতির সামনে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অসম্মান ও হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। গত ১০ই সেপ্টেম্বর ক্ষমা চাইতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্য সম্বন্ধে খুবই দুঃখিত, তবে বিস্মিত যে তারা সরকারি সিদ্ধান্ত জানার আগেই আন্দোলনে নেমে যান।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি আরও বলেন, ২২ ধাপ বিশিষ্ট এই বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের ৪ ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক আছেন তারা গ্রেড-১ এ সচিবদের সমতুল্য বেতন পাবেন ঠিকই কিন্তু যারা সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক নন কিংবা নতুনভাবে অধ্যাপক হবেন তাদের পক্ষে গ্রেড-১ এ যাওয়ার সুযোগ থাকলো না। সিলেকশন গ্রেড অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে অধ্যাপকদের গ্রেড-১ এ যাওয়ার অধিকার বন্ধ করে দেয়া হল। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অধ্যাপকরা আগের মতো সচিবদের সঙ্গে অবস্থান করছেন, সেই গ্রেডের মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা। যারা ভবিষ্যতে অধ্যাপক হবেন তারা কিভাবে গ্রেড-১ এর বেতন পাবেন? অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল এর ব্যাখ্যা চান অর্থমন্ত্রীর কাছে। ‘অধ্যাপকদের যেভাবে পদোন্নতি হয় তা বেশ অস্বচ্ছ’ এবং ‘শিক্ষকদের করাপট প্রাকটিস নিয়ন্ত্রন করা দরকার’ বলে বক্তব্য দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তার এসব বক্তব্যের জেরে অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, মন্ত্রীর এমন বক্তব্য যে তথ্য নির্ভর নয় এবং এটি যে কোন কারণে শিক্ষকতা পেশার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণের মানসিকতার পরিচায়ক। তিনি বলেন, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে ন্যূনতম ৬ বছর চাকরি করতে হয়, সহযোগী অধ্যাপক থাকাকালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা থাকতে হয় ৬টি। গবেষণা খাতে বরাদ্দ কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে শিক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ১.৮৩ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৭.৭ শতাংশ। যা মোট জিডিপির ০.১৭ শতাংশ। সংগঠনের মহাসচিব বলেন, বয়স্ক অর্থমন্ত্রী দেশের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করা এবং শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করার নীল নকশা বাস্তবায়নে নেমেছেন। আমাদের প্রশ্ন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সাবেক আমলা ও বর্তমান আমলাপক্ষের একজন অর্থমন্ত্রী হয়ে তার পক্ষে বিভ্রান্তিকর তথ্যসংবলিত এমন বক্তব্য দেয়া কি শোভা পায়? উচ্চ শিক্ষা বিরোধী মনোভাবের পরিচয় দিয়ে অথবা উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে তিনি কার স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন? তিনি বলেন, বেতন বৈষম্য বিষয়ক যে কমিটি রয়েছে তার প্রধান হিসেবে অর্থমন্ত্রী রয়েছেন। ইতিমধ্যে যিনি শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এবং শিক্ষকদের ব্যাপারে প্রতিহিংসাপরায়ন বক্তব্য রেখে নিজেকে বিতর্ক করেছেন- সেই ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন কোন কমিটি শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানান। একই সঙ্গে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ও ১৭ই সেপ্টেম্বর কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ঈদের পর আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ার করা হয়। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কারা অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, জাতিকে বিভ্রান্ত না করে পড়ালেখা করে জেনেশুনে কথা বলবেন। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর বয়স হয়েছে। কোন সময় কোন কথা বলবেন বুঝতে পারেন না। তাই আমরা মনে করি অর্থমন্ত্রীর এখনই পদত্যাগ করার উপযুক্ত সময়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আক্তারুজ্জামান, বিজয় ৭১ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া, অধ্যাপক ড. আক্তার হোসাইন খান, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম, সহকারী অধ্যাপক শহিদুল হাসান প্রমুখ। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে গতকাল দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে কর্মবিরতি পালন করা হয়।
No comments