‘একুশ শতকের গ্রিক ট্রাজেডি’ by মইনুল ইসলাম
গ্রিসে গণভোটে 'না' ভোট বিজয়ী হবার পর সমর্থকদের উল্লাস |
সারা
বিশ্বে গ্রিক অর্থনীতির মহাসংকট নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিশেষত, ৫ জুলাইয়ের
রেফারেন্ডামে গ্রিক অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরে থাকা ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল
ব্যাংক, আইএমএফ ও ইউরোপিয়ান কমিশন—‘ট্রয়কা’র সরাসরি ব্ল্যাকমেলিংকে
অগ্রাহ্য করে গ্রিক ভোটারদের ৬১ দশমিক ৩১ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ট্রয়কা আরোপিত
শর্তাবলি না মানার পক্ষে রায় দেয়। ফলে পুরো বিষয়টি গণতন্ত্র বনাম আধিপত্য
ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। ইউরোজোনের মূল মাতব্বর হিসেবে ভূমিকা পালনকারী
জার্মানির অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ‘না’ ভোট দিলে গ্রিসকে ইউরোজোন পরিত্যাগ
করতে হবে বলে পরোক্ষ আল্টিমেটাম দেওয়া সত্ত্বেও গ্রিক ভোটারদের বিপুল রায়
গ্রিক বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের জন্য সাময়িকভাবে একটা
বড়সড় রাজনৈতিক বিজয় এনে দিয়েছে। এ বিজয় সামনের দিনগুলোর কঠিন দর-কষাকষিতে
তাঁর অবস্থানকে অনেকটা সংহত করবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত।
তবে রেফারেন্ডামের ফলাফল ওই দর-কষাকষিতে ইউরোজোনের অন্যান্য দেশের অবস্থানকে আরও গ্রিসবিরোধী করে তোলার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। অতএব, গ্রিস তার অর্থনীতির মহাবিপদ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছে কি না, সেটা বলার সময় এখনো হয়নি। এখনো পণ্ডিতদের অনেকেই রেফারেন্ডামের ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কর্তৃক ট্রয়কার শর্তাবলি প্রত্যাখ্যানকে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর স্পর্ধিত বিরুদ্ধাচরণ ও ইউরোজোনের অন্যান্য দেশের প্রতি অবজ্ঞামূলক আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং এই ফলাফল অচিরেই ‘একুশ শতকের গ্রিক ট্র্যাজেডি’তে পরিণত হবে বলে ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। আসলে মূল সমস্যাটা যেহেতু গ্রিসের ৩২৩ বিলিয়ন ইউরো বা ৩৬৩ বিলিয়ন ডলারের অবিশ্বাস্য ঋণের বোঝা সামলানোর এবং ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতা আদৌ গ্রিক অর্থনীতির রয়েছে কি না, সে প্রশ্নেই ঘুরপাক খাবে।
সমস্যার গোড়া রয়ে গেছে ২০০৭-০৮ সালে শুরু হওয়া পুঁজিবাদী বিশ্বের মন্দা বা মহামন্দার মধ্যে। ওই মন্দার শুরুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও এর সংক্রমণ (কনটেজিয়ন ইফেক্ট) ইউরোপসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের দেশে দেশে ঢেউয়ের মতো পৌঁছে গেছে বিশ্বায়নের অমোঘ নিয়মে। গ্রিসের অর্থনীতিও ক্রমেই এই মন্দার শিকার হয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঘাটতি এবং সরকারি বাজেট ঘাটতির কবলে পড়ে। মন্দা মোকাবিলায় কিনসীয় প্রেসক্রিপশন অনুসারে সম্প্রসারণমূলক ঘাটতি অর্থায়ন নীতিমালা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোজোনের একক মানিটরি ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে গ্রিস ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোজোনের দেশগুলোর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নিয়ে সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রয়াস চালায়। আইএমএফও গ্রিসকে দফায় দফায় ঋণ মঞ্জুর করে অর্থনীতি সচল রাখতে সহায়তা করে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক, ইউরোপিয়ান কমিশন ও আইএমএফ—এই তিনটি সংস্থাই কালক্রমে ‘ট্রয়কা’ নামে অভিহিত হয়। এই ঋণগুলোর শর্তের তালিকায় নিউ লিবারেল মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন মোতাবেক সরকারের ব্যয় সংকোচন ও কৃচ্ছ্রসাধনের এবং অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকোচনের প্রায় অভিন্ন প্রেসক্রিপশনগুলো প্রতিবারই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোকে সারা বিশ্ব ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি’ হিসেবে চিনতে শিখেছে।
এই শর্তাবলি মানতে গিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন গ্রিক সরকারকে যেসব নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হয়েছে, তার ফলে সাধারণ শ্রমজীবী গ্রিক জনগণের জীবন ও জীবিকায় টানাপোড়েন ক্রমেই বাড়তে বাড়তে অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বয়স্কদের পেনশন, বেকার ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি—প্রতিটি গণমুখী সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রেই কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে প্রত্যক্ষ ব্যয় কাটছাঁটের শিকার হয় সাধারণ জনগণ। অথচ সরকারের বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত গ্রিকদের ওপর কর আরোপের বা কর বৃদ্ধির ব্যাপারে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলো বরাবরই বিরোধিতা জারি রাখে ‘নিউ লিবারেলিজমের’ মতাদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ধুয়া তুলে।
ফলে মন্দা কাটাতে যেখানে প্রয়োজন ছিল সম্প্রসারণমূলক নীতিমালা, সেখানে ট্রয়কার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গৃহীত সরকারি ব্যয় সংকোচনমূলক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত হিসেবে গ্রিসে বেকারত্বের হার বাড়তে বাড়তে শ্রমশক্তির ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়; যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫০ শতাংশ অতিক্রম করে যায়। গ্রিকদের মাথাপিছু আয় গত ছয় বছরে ২৫ শতাংশ কমে যায়, যার অসহনীয় ভার মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মানুসারেই বেশি করে বিপর্যস্ত করতে থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী জনগণের জীবন ও জীবিকাকে। আরও গুরুতর হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির এত বড় সংকোচন সরকারের রাজস্ব আয়কে আরও বেশি সংকুচিত করে দিতে থাকে। ফলে সরকারি ব্যয় সংকোচন সত্ত্বেও সরকারের রাজস্ব সংকোচনের হার আরও বেশি হওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি ক্রমাগতভাবে আরও বেড়ে গিয়ে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনকেও অপরিহার্যভাবে বাড়াতে থাকে অর্থনীতিকে সচল রাখার প্রয়োজনে।
অপর দিকে অর্থনীতি সংকুচিত হতে থাকায় রপ্তানি আয়ও বাড়ার পরিবর্তে কমতেই থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের ঘাটতিও (ট্রেড ডেফিসিট) বেড়ে যেতে থাকে। অতএব, আবারও ঋণের জন্য বেশি করে হাত পাততে হয় গ্রিসকে। এই প্রক্রিয়াতেই গ্রিক অর্থনীতির ঋণ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে গ্রিসের জিডিপির ১৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শেষের দিকের কয়েক বছর গ্রিসকে নতুন নতুন ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থের ৮০-৯০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো পুরোনো ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করার জন্য, মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ পাওয়া যেত বিনিয়োগের জন্য। এর মানে, ওই সব ঋণ সত্যিকার কর্মসংস্থানমূলক বিনিয়োগে খাটানো যায়নি, যার ফলে মন্দা থেকে উত্তরণে ওই সব ঋণ তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, গ্রিসকে এহেন তলাবিহীন ঝুড়ি বানানোর পরও জেনেশুনে বারবার এত ঋণ দেওয়া হলো কেন? ইউরোপীয়রা তো বেশ কয়েক বছর ধরে পর্তুগাল, ইতালি, গ্রিস ও স্পেনকে ‘পিগস’ (শুয়োর) বলে গালাগাল করে আসছে। তারপরও বারবার ঋণ দেওয়া হয়েছে কেন? এখানেই নিহিত রয়েছে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের মূল সংকট—এক দেশের সংকট শুধু ওই দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বিশ্বব্যাপী ঢেউয়ের আদলে ছড়িয়ে পড়ে। অতএব, লোকালাইজড সংকটকে যতখানি সম্ভব ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদ এড়ানো যায় না।
আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসকে দেউলিয়া হতে দিতে চাইছে না গ্রিসের পতনের ঢেউ খোদ ইউরোজোনের বড়-ছোট সব অর্থনীতিতেই কনটেজিয়ন ইফেক্টকে বেসামাল করে দিতে পারে, ওই ভয়ে। এমনকি শুধু ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা নয়, এই সংকটের ধারাবাহিকতায় পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নে ধস নামার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোর এই বিপদকে সাইডলাইনে বসে উপভোগ করছে। ইউরো ধসে গেলে বা বিলুপ্ত হয়ে গেলে ডলারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আপাতত অন্য কোনো মুদ্রা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে! বিশ্বে মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্য তাতে আরও কিছুদিন নিরঙ্কুশ থাকবে।
ছয় বছর ধরে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ে দিশেহারা গ্রিক ভোটাররা ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দল সিরিজা পার্টিকে জয়ী করে ক্ষমতায় আনেন। বলা বাহুল্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন ডানপন্থী সরকারগুলো গ্রিক জনগণের এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী রায়কে মোটেও ইতিবাচকভাবে নেয়নি। জার্মানির চ্যান্সেলর ম্যার্কেলও মনে মনে চাইছেন, এই সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগে বামপন্থী সিরিজা পার্টির সরকারের পতন হোক। ইউরোজোনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকারপ্রধানদেরও গোপন অভিলাষ এটাই। হয়তো এ জন্যই সংকট-সম্পর্কিত গত ছয় মাসের আলাপ-আলোচনায় ইউরোপের একাধিক দেশের অর্থমন্ত্রী বারবার অভিযোগ তুলছিলেন যে সংকট সমাধানে গ্রিক অর্থমন্ত্রী ভারোফাকিসের ‘ড্যাম কেয়ার’ মনোভাব এবং আলোচনা বৈঠকগুলোতে তাঁর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টিতে অনভিপ্রেত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে ভারোফাকিস একজন নির্ভীক, স্পষ্টভাষী, বামপন্থী অর্থনীতিবিদ ও খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক; যিনি ট্রয়কার ব্ল্যাকমেলিংকে ‘টেররিস্ট ট্যাকটিক্স’ হিসেবে অভিহিত করে গ্রিক জনগণকে এহেন আধিপত্যবাদী শর্ত প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়ে গ্রিক রাজনীতিতে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রিক প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস রেফারেন্ডাম ডেকে বসার পেছনেও ভারোফাকিসের অবস্থানকেই নির্ধারক বলে মনে করেছেন অনেক বিশ্লেষক। জার্মান অর্থমন্ত্রী সরাসরি বলে দিয়েছেন যে ভবিষ্যতের আলোচনায় তিনি আর ভারোফাকিসের চেহারা দেখতে নারাজ। এহেন বড় ভ্রাতাসুলভ ঔদ্ধত্যের জবাবে ভারোফাকিস রেফারেন্ডামে বিজয় অর্জনের পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ‘আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের কাজকে সহজ করার জন্য’ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, যেটা তাঁর সমালোচকদের মুখে চপেটাঘাতের শামিল। ফলে এখন সারা বিশ্বের সহানুভূতি গ্রিসের দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলা চলে। অতএব, এই যাত্রায় গ্রিস হয়তো তার অসহনীয় ঋণের বোঝা কিঞ্চিৎ লাঘবের পথ পেয়েও যেতে পারে।
চলমান গ্রিক সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনো বড়সড় অভিঘাত সৃষ্টি না করলেও যদি সংকট সমাধানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং এর পরিণামে গ্রিসকে ইউরোজোন থেকে বের হয়ে যেতে হয়, তাহলে এর কনটেজিয়ন ইফেক্ট বাংলাদেশেও খানিকটা অনুভূত হবে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইউরোপের দেশগুলোর অব্যাহত মন্দার কারণে এবং ইউরোর বিনিময় হার ডলারের তুলনায় ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৩ শতাংশের সামান্য বেশি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকখানি কম ছিল। এভাবে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারকে ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করার টার্গেট অদূর ভবিষ্যতে অর্জন করা যাবে না।
অন্যদিকে গ্রিক সংকট থেকে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের শিক্ষণীয় হলো, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও শুধু তথাকথিত ‘সফট লোনের’ আকর্ষণে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক-এডিবির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের বদ খাসলত ঝেড়ে ফেলতে হবে তাদের ‘নিউ লিবারেল’ প্রেসক্রিপশনের কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচির খপ্পর থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে। বাংলাদেশ যে ক্রমেই তাদের আধিপত্যের জাল থেকে বেরিয়ে আসছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। যত্রতত্র সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নেওয়ার লোভটাও সামলাতে হবে, কারণ অর্থনীতিকে ঋণের ফাঁদে ফেলার দুর্মতি নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে রেফারেন্ডামের ফলাফল ওই দর-কষাকষিতে ইউরোজোনের অন্যান্য দেশের অবস্থানকে আরও গ্রিসবিরোধী করে তোলার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। অতএব, গ্রিস তার অর্থনীতির মহাবিপদ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছে কি না, সেটা বলার সময় এখনো হয়নি। এখনো পণ্ডিতদের অনেকেই রেফারেন্ডামের ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কর্তৃক ট্রয়কার শর্তাবলি প্রত্যাখ্যানকে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর স্পর্ধিত বিরুদ্ধাচরণ ও ইউরোজোনের অন্যান্য দেশের প্রতি অবজ্ঞামূলক আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং এই ফলাফল অচিরেই ‘একুশ শতকের গ্রিক ট্র্যাজেডি’তে পরিণত হবে বলে ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। আসলে মূল সমস্যাটা যেহেতু গ্রিসের ৩২৩ বিলিয়ন ইউরো বা ৩৬৩ বিলিয়ন ডলারের অবিশ্বাস্য ঋণের বোঝা সামলানোর এবং ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতা আদৌ গ্রিক অর্থনীতির রয়েছে কি না, সে প্রশ্নেই ঘুরপাক খাবে।
সমস্যার গোড়া রয়ে গেছে ২০০৭-০৮ সালে শুরু হওয়া পুঁজিবাদী বিশ্বের মন্দা বা মহামন্দার মধ্যে। ওই মন্দার শুরুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও এর সংক্রমণ (কনটেজিয়ন ইফেক্ট) ইউরোপসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের দেশে দেশে ঢেউয়ের মতো পৌঁছে গেছে বিশ্বায়নের অমোঘ নিয়মে। গ্রিসের অর্থনীতিও ক্রমেই এই মন্দার শিকার হয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঘাটতি এবং সরকারি বাজেট ঘাটতির কবলে পড়ে। মন্দা মোকাবিলায় কিনসীয় প্রেসক্রিপশন অনুসারে সম্প্রসারণমূলক ঘাটতি অর্থায়ন নীতিমালা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোজোনের একক মানিটরি ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে গ্রিস ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোজোনের দেশগুলোর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নিয়ে সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রয়াস চালায়। আইএমএফও গ্রিসকে দফায় দফায় ঋণ মঞ্জুর করে অর্থনীতি সচল রাখতে সহায়তা করে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক, ইউরোপিয়ান কমিশন ও আইএমএফ—এই তিনটি সংস্থাই কালক্রমে ‘ট্রয়কা’ নামে অভিহিত হয়। এই ঋণগুলোর শর্তের তালিকায় নিউ লিবারেল মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন মোতাবেক সরকারের ব্যয় সংকোচন ও কৃচ্ছ্রসাধনের এবং অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকোচনের প্রায় অভিন্ন প্রেসক্রিপশনগুলো প্রতিবারই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোকে সারা বিশ্ব ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি’ হিসেবে চিনতে শিখেছে।
এই শর্তাবলি মানতে গিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন বিভিন্ন গ্রিক সরকারকে যেসব নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হয়েছে, তার ফলে সাধারণ শ্রমজীবী গ্রিক জনগণের জীবন ও জীবিকায় টানাপোড়েন ক্রমেই বাড়তে বাড়তে অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বয়স্কদের পেনশন, বেকার ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি—প্রতিটি গণমুখী সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রেই কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে প্রত্যক্ষ ব্যয় কাটছাঁটের শিকার হয় সাধারণ জনগণ। অথচ সরকারের বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত গ্রিকদের ওপর কর আরোপের বা কর বৃদ্ধির ব্যাপারে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলো বরাবরই বিরোধিতা জারি রাখে ‘নিউ লিবারেলিজমের’ মতাদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ধুয়া তুলে।
ফলে মন্দা কাটাতে যেখানে প্রয়োজন ছিল সম্প্রসারণমূলক নীতিমালা, সেখানে ট্রয়কার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গৃহীত সরকারি ব্যয় সংকোচনমূলক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত হিসেবে গ্রিসে বেকারত্বের হার বাড়তে বাড়তে শ্রমশক্তির ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়; যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫০ শতাংশ অতিক্রম করে যায়। গ্রিকদের মাথাপিছু আয় গত ছয় বছরে ২৫ শতাংশ কমে যায়, যার অসহনীয় ভার মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মানুসারেই বেশি করে বিপর্যস্ত করতে থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী জনগণের জীবন ও জীবিকাকে। আরও গুরুতর হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির এত বড় সংকোচন সরকারের রাজস্ব আয়কে আরও বেশি সংকুচিত করে দিতে থাকে। ফলে সরকারি ব্যয় সংকোচন সত্ত্বেও সরকারের রাজস্ব সংকোচনের হার আরও বেশি হওয়ার কারণে বাজেট ঘাটতি ক্রমাগতভাবে আরও বেড়ে গিয়ে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনকেও অপরিহার্যভাবে বাড়াতে থাকে অর্থনীতিকে সচল রাখার প্রয়োজনে।
অপর দিকে অর্থনীতি সংকুচিত হতে থাকায় রপ্তানি আয়ও বাড়ার পরিবর্তে কমতেই থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের ঘাটতিও (ট্রেড ডেফিসিট) বেড়ে যেতে থাকে। অতএব, আবারও ঋণের জন্য বেশি করে হাত পাততে হয় গ্রিসকে। এই প্রক্রিয়াতেই গ্রিক অর্থনীতির ঋণ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে গ্রিসের জিডিপির ১৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শেষের দিকের কয়েক বছর গ্রিসকে নতুন নতুন ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থের ৮০-৯০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো পুরোনো ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করার জন্য, মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ পাওয়া যেত বিনিয়োগের জন্য। এর মানে, ওই সব ঋণ সত্যিকার কর্মসংস্থানমূলক বিনিয়োগে খাটানো যায়নি, যার ফলে মন্দা থেকে উত্তরণে ওই সব ঋণ তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, গ্রিসকে এহেন তলাবিহীন ঝুড়ি বানানোর পরও জেনেশুনে বারবার এত ঋণ দেওয়া হলো কেন? ইউরোপীয়রা তো বেশ কয়েক বছর ধরে পর্তুগাল, ইতালি, গ্রিস ও স্পেনকে ‘পিগস’ (শুয়োর) বলে গালাগাল করে আসছে। তারপরও বারবার ঋণ দেওয়া হয়েছে কেন? এখানেই নিহিত রয়েছে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের মূল সংকট—এক দেশের সংকট শুধু ওই দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বিশ্বব্যাপী ঢেউয়ের আদলে ছড়িয়ে পড়ে। অতএব, লোকালাইজড সংকটকে যতখানি সম্ভব ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদ এড়ানো যায় না।
আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসকে দেউলিয়া হতে দিতে চাইছে না গ্রিসের পতনের ঢেউ খোদ ইউরোজোনের বড়-ছোট সব অর্থনীতিতেই কনটেজিয়ন ইফেক্টকে বেসামাল করে দিতে পারে, ওই ভয়ে। এমনকি শুধু ইউরো মুদ্রাব্যবস্থা নয়, এই সংকটের ধারাবাহিকতায় পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নে ধস নামার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোর এই বিপদকে সাইডলাইনে বসে উপভোগ করছে। ইউরো ধসে গেলে বা বিলুপ্ত হয়ে গেলে ডলারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আপাতত অন্য কোনো মুদ্রা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে! বিশ্বে মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্য তাতে আরও কিছুদিন নিরঙ্কুশ থাকবে।
ছয় বছর ধরে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ে দিশেহারা গ্রিক ভোটাররা ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দল সিরিজা পার্টিকে জয়ী করে ক্ষমতায় আনেন। বলা বাহুল্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন ডানপন্থী সরকারগুলো গ্রিক জনগণের এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী রায়কে মোটেও ইতিবাচকভাবে নেয়নি। জার্মানির চ্যান্সেলর ম্যার্কেলও মনে মনে চাইছেন, এই সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগে বামপন্থী সিরিজা পার্টির সরকারের পতন হোক। ইউরোজোনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকারপ্রধানদেরও গোপন অভিলাষ এটাই। হয়তো এ জন্যই সংকট-সম্পর্কিত গত ছয় মাসের আলাপ-আলোচনায় ইউরোপের একাধিক দেশের অর্থমন্ত্রী বারবার অভিযোগ তুলছিলেন যে সংকট সমাধানে গ্রিক অর্থমন্ত্রী ভারোফাকিসের ‘ড্যাম কেয়ার’ মনোভাব এবং আলোচনা বৈঠকগুলোতে তাঁর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টিতে অনভিপ্রেত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে ভারোফাকিস একজন নির্ভীক, স্পষ্টভাষী, বামপন্থী অর্থনীতিবিদ ও খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক; যিনি ট্রয়কার ব্ল্যাকমেলিংকে ‘টেররিস্ট ট্যাকটিক্স’ হিসেবে অভিহিত করে গ্রিক জনগণকে এহেন আধিপত্যবাদী শর্ত প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়ে গ্রিক রাজনীতিতে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রিক প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস রেফারেন্ডাম ডেকে বসার পেছনেও ভারোফাকিসের অবস্থানকেই নির্ধারক বলে মনে করেছেন অনেক বিশ্লেষক। জার্মান অর্থমন্ত্রী সরাসরি বলে দিয়েছেন যে ভবিষ্যতের আলোচনায় তিনি আর ভারোফাকিসের চেহারা দেখতে নারাজ। এহেন বড় ভ্রাতাসুলভ ঔদ্ধত্যের জবাবে ভারোফাকিস রেফারেন্ডামে বিজয় অর্জনের পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ‘আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের কাজকে সহজ করার জন্য’ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, যেটা তাঁর সমালোচকদের মুখে চপেটাঘাতের শামিল। ফলে এখন সারা বিশ্বের সহানুভূতি গ্রিসের দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলা চলে। অতএব, এই যাত্রায় গ্রিস হয়তো তার অসহনীয় ঋণের বোঝা কিঞ্চিৎ লাঘবের পথ পেয়েও যেতে পারে।
চলমান গ্রিক সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনো বড়সড় অভিঘাত সৃষ্টি না করলেও যদি সংকট সমাধানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং এর পরিণামে গ্রিসকে ইউরোজোন থেকে বের হয়ে যেতে হয়, তাহলে এর কনটেজিয়ন ইফেক্ট বাংলাদেশেও খানিকটা অনুভূত হবে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইউরোপের দেশগুলোর অব্যাহত মন্দার কারণে এবং ইউরোর বিনিময় হার ডলারের তুলনায় ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৩ শতাংশের সামান্য বেশি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকখানি কম ছিল। এভাবে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারকে ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করার টার্গেট অদূর ভবিষ্যতে অর্জন করা যাবে না।
অন্যদিকে গ্রিক সংকট থেকে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের শিক্ষণীয় হলো, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও শুধু তথাকথিত ‘সফট লোনের’ আকর্ষণে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক-এডিবির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের বদ খাসলত ঝেড়ে ফেলতে হবে তাদের ‘নিউ লিবারেল’ প্রেসক্রিপশনের কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচির খপ্পর থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে। বাংলাদেশ যে ক্রমেই তাদের আধিপত্যের জাল থেকে বেরিয়ে আসছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। যত্রতত্র সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নেওয়ার লোভটাও সামলাতে হবে, কারণ অর্থনীতিকে ঋণের ফাঁদে ফেলার দুর্মতি নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments