গল্প- না বলা কথা by তামান্না ইসলাম
রাত
প্রায় ১০টার মতো বাজে। গলির মুখে মানুষের জটলা কমে গেছে। অনেকক্ষণ পর পর
একটা-দুটা রিকশা দেখা যায়। মোড়ের ওষুধের দোকানটা শুধু খোলা, তাও দোকানি
বাড়ি যাওয়ার জন্য উসখুস করছে। এমন সময় ইমন খুব সংকোচ নিয়ে কাউন্টারের সামনে
গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, একটা ফোন করা যাবে?
দোকানি ওর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝল কে জানে। কিছু না বলে ফোনের তালা খুলে এগিয়ে দিল ওর দিকে। তারপরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
ওপাশে রিং বেজে চলছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইমনের বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। ইমন ভাবছে মিতুকে ও কি বলবে? যেটা বলতে চাইছে সেটা বলা খুবই কঠিন। ইমন মিতুর শিক্ষক। ও বুয়েটে নতুন জয়েন করেছে। মিতুদের একটা সেশন নেয়। ওর কল্পনার রাজ্যজুড়ে আছে মিতু। কিন্তু এক বছরের জুনিয়র মিতুকে ছাত্রজীবনেও বলি বলি করে কিছু বলা হয়নি। এখন সরাসরি শিক্ষক হয়ে সেটা বলা যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইমনের হাতে আর যে সময় নেই একদম। মিতুর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। সামনের সপ্তাহেই আসবে। দুই সপ্তাহ পরে ওর বিয়ে। তাই সব সংকোচকে ঠেলে অনেক সাহস সঞ্চয় করে ইমন এসেছে এই রাতে মিতুকে ফোন করতে। ওকে আজ পারতেই হবে।
ফোনটা ধরলেন মিতুর মা। এত রাতে কিছুটা বিরক্ত। হ্যালো, কাকে চাই?
শুকনো ঠোট জিভে ভিজিয়ে ইমন কোনোমতে বলল, জি, মিতা আছে?
আপনি কে বলছেন? এবার একই সঙ্গে বিস্ময় ও প্রবল বিরক্তি।
ইমন সেটাকে প্রাণপণে উপেক্ষা করে বলল, আমি ওর টিচার, ও একটা প্রজেক্টের কিছু জিনিস জমা দেয়নি। নম্বর দেওয়ার আগে ভাবলাম একটু শিওর হয়ে নেই, হারিয়ে গেল কি না কোনোভাবে।
এবার আর মিতুর মা আপত্তি করলেন না। মিতুকে ডেকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।
মিতু, আমি ইমন।
ইমন ভাই, আপনি, এত রাতে! মিতুর গলায় একরাশ বিস্ময়।
ইয়ে মিতু মানে তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে চাচ্ছিলাম, যদি তোমার সময় হয়।
তা তো বটেই। তবে ইমন ভাই, রনি, মানে আমার হবু বর তো প্রতিদিন এই সময় ফোন করে, বেশিক্ষণ ফোন এনগেজড রাখা যাবে না, আমাকে না পেলে ও একদম অস্থির হয়ে যায়।
শেষ কথাটা শুনে একদম ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল ইমন, গলার কাছে কথাটা এসে আটকে গেছে।
আর ওপাশে নিজের অনামিকার আংটিটা নিয়ে খেলা করতে করতে মিতু ভাবছে, ইমন ভাইয়ের গলাটা এমন কেন? সেশনালে মনে হয় একটু বেশি সময় নিয়ে ওকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। যেদিন ওদের ক্লাস থাকে সেদিন দেখা যায় পোশাক আশাকেও একটু যত্নের ছাপ। এক অজানা কৌতূহল ও শঙ্কায় ওর বুক কাঁপে।
মিতু তোমার প্রজেক্টটা খুব ভালো হয়েছে। একা একাই করেছো পুরাটা?
বাহ, আপনিই তো বুঝিয়ে দিলেন বেশির ভাগ।
তোমার জন্য আমি একটা নীল শাড়ি কিনেছি, নীল রঙে তোমাকে খুব মানায়।
মিতুর গলা কাঁপছে, মানে? কি বলছেন এসব?
না মানে, তোমার বিয়েতে উপহার দেব বলে। আচ্ছা রাখি।
জরুরি কথাটা তো বললেন না?
ওহ, ভুলে গেছি।
ইমন ভাই, আমার বিয়েতে আপনি আসবেন না দয়া করে। সব নিমন্ত্রণে যেতে নেই। আর শাড়িটা আপনার কাছে রেখে দিয়েন, আমার স্মৃতি হিসেবে।
দুই.
শিকাগো এয়ারপোর্টে বসে আছে মিতু। ঢাকা যাচ্ছে সে একা। দুর্যোগের কারণে কানেক্টিং ফ্লাইট ক্যানসেল। কাল বিকেলে আবার ফ্লাইট থাকতেও পারে। ওকে হোটেল দেওয়া হয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে যেতে হবে। একা একা ট্যাক্সি চড়তে কেন জানি এখনো স্বস্তি পায় না মিতু। তা ছাড়া ও অন্য কথা ভাবছে। ইমন ভাই এখানেই থাকেন। অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। ইমেইলে কিছুটা যোগাযোগ আছে। তার সেল ফোন নম্বরটাও আছে মিতুর কাছে। যদিও ফোন করা হয়নি কখনো। কোথায় যেন এক ধরনের ভয় কাজ করে। নিজের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু আজকে আর পারল না ও—এত কাছে এসে ইমনকে দেখার লোভটুকু সংবরণ করতে। শুধু একবার দেখা করবে। এর বেশি কিছু না। দুই রিংয়েই ফোন ধরল ইমন। মিতুর গলা শুনে মনের খুশিটা গোপন করার চেষ্টাও করল না কোনো। অফিস ফেলে এক ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে চলে আসল এয়ারপোর্ট থেকে মিতুকে হোটেলে পৌঁছে দিতে।
প্রায় আট বছর পরে দেখা। দুজনের শরীরেই কিছুটা সুখের মেদ জমেছে। আর চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ যোগ হয়েছে। কোথা থেকে একরাশ আবেগ আর লজ্জা এসে ঘিরে ধরল ওদেরকে। কারও মুখেই কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। বুকের ভেতরে তোলপাড়।
তোমার লাগেজ কই? গাড়িতে তুলতে হবে না। বলল ইমন। আর যেন কোনো কথা খুঁজে পায় না ইমন। তাড়াহুড়া করে গাড়িতে লাগেজ তুলতে তুলতে আবারও আড়চোখে একবার মিতুকে দেখে নেয় ইমন। ক্লান্ত, অথচ কী ভীষণ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে যেন পরিপূর্ণতা এসেছে।
ব্যস্ত ইমনকে খেয়াল করে মিতুও। কী সাবলীল আর আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে ইমন ভাইকে। আগের মতো একটুও জড়তা নেই।
মিতুর কাছ থেকে হোটেলের ঠিকানাটা নিয়ে সে দিকে রওনা দেয় ইমন।
মিতুই প্রথম নীরবতা ভাঙে। তারপর, আপনার খবর কি বলেন, ভাবির গল্প শুনি। নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী।
ইমন যেন শুনতেই পায় না। বহুদূর থেকে উত্তর দেয়, কেমন আছ মিতু? গোধূলির লালচে আভা এসে পরেছে মিতুর গালের বা পাশটায় এলোমেলো কয়েক গোছা চুল। ঠিক যেমনটা ইমন দেখে প্রায়ই স্বপ্নে। মনে মনে ভাবে শুধু স্বপ্নে সেই নীল শাড়িটা পরে থাক তুমি, এটুকুই যা পার্থক্য। জানো, সেই শাড়িটা আমি বীথিকেও দিতে পারিনি, এখনো অনেক যত্নে ঢাকার বাসার চিলেকোঠায় পুরোনো আলমারিটাতে তোলা আছে। ইমনের খুব ইচ্ছা করে সেই স্বপ্নের কথাটা ওকে বলতে, আলতো করে চুলের গোছাটা সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেতে।
ইমনের আনমনা ভাবটা চোখ এড়ায় না মিতুর। ওর সেই বুকের ভেতরের ধুক ধুক ফিরে আসে, ইমনের কোনো ইমেইল খুলতে গেলেই যেটা হয় ওর। খুব সাধারণ কথাবার্তা হয় ওদের, সংসারের কথা, চাকরির কথা।
তাদের সেই ইমেইল আদান প্রদানও হয় হয়তো দুই মাসে একটা। কিন্তু তারপরেও, প্রতিটা ইমেইলেই যেন কিছু না বলা কথা থেকে যায়। রনির সাথে কখনো প্রচণ্ড ঝগড়া হলে কেন জানি ইমন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে মিতুর। আর সেদিনের সেই স্বপ্নটা, ভাবতেই কান–মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে মিতুর। যেন ইমন পড়ে ফেলছে ওর মনের সব কথা, জেনে যাচ্ছে সেই পাগলামি স্বপ্নের কথা। নিজেকে লুকাতে রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় মিতু। শেষ বিকেলের আলোয় ওদের মাঝে ভেসে বেড়ায় সেই না বলা কথাগুলো, যেগুলো আর কখনোই বলা হবে না।
জানালা দিয়ে বাইরে যত দূর চোখ যায়, খালি সাদা আর সাদা। অঝোরে তুষার পড়ছে। হাইওয়েতে গাড়ির ঠেলাঠেলি। বিষণ্ন বিকেল। মিতু ভাবছে, কেন আজকে এমন হলো? ইমন ভাইকে ফোনটা না করলেই ভালো হতো। হঠাৎ বাম গালে একটা উষ্ণতা টের পায় মিতু। এক মুহূর্তের জন্য ইমনের হাতের উল্টো দিকের আলতো ছোঁয়া। চমকে উঠে ইমনকে দেখে সে। কি অদ্ভুত দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির উষ্ণতায় মোমের মতো গলে যেতে থাকে মিতু। এক মুহূর্তের জন্য রনির আবেগহীন চোখ দুটো ভেসে উঠে মনে। যে চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। কিন্তু ভালোবাসার এই ছায়া কখনোই পড়েনি সেই চোখে। আর কিছু মনে থাকে না। কখন যেন নিজের অজান্তেই একটা হাত সঁপে দিয়েছে ইমনের হাতের মুঠোয়। আর ঠিক তখনই ঘ্যাস শব্দ। গাড়িটা কালো হয়ে যাওয়া বরফে স্লিপ করে নিয়ন্ত্রণ হারায়। চারটা চক্কর দেয় হাইওয়েতে। পেছন থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটা ট্রাক আঘাত করে মিতুর সাইডে। তারপরে আর কিছুই মনে নাই ওদের কারওর।
ইমনের যখন জ্ঞান ফেরে, প্রথম যে কথাটা মনে হয়, বীথিকে খবর দেওয়া দরকার। তারপর মনে পড়ে ও তো ঢাকায়। এখন হঠাৎ করে খবর দিলে ঘাবড়ে যাবে। আর তারপরেই একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ওর গা বেয়ে। মনে পড়ে মিতুর কথা। মিতু কেমন আছে? ওর কিছু হয়নি তো? তাড়াহুড়োয় উঠতে চেষ্টা করে ইমন। কিন্তু বুঝতে পারে তার সারা শরীরে তীব্র ব্যথা। হাতে স্যালাইন আটকানো। নড়াচড়ার শব্দে ছুটে আসে নার্স। একগাল হাসি দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক গড যে তোমার জ্ঞান ফিরেছে। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! পুরো ২৪ ঘণ্টা পর তোমার জ্ঞান ফিরল। আর খবরদার একটুও নড়াচড়া না। ওদিকে তোমার স্ত্রীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
ইমন বুঝতে পারে মস্ত বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। বলে, তুমি ভুল করছ, ও আমার পরিচিত। স্কুলের বন্ধু।
নার্সকে এবার চিন্তিত দেখায়। তাহলে তো ওর বাড়িতে খবর দেওয়া দরকার। তোমার কাছে ওর নম্বর আছে?
ইমন বিপদে পড়ে যায়। ওর কাছে আছে শুধু মিতুর সেল নম্বর। উপায় না দেখে নার্সের কাছেই সাহায্য চায় ও। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে বাসার ঠিকানা ধরে হাসপাতালের সাহায্যে মিতুর বাড়ির ফোন নম্বর পায় ইমন। প্রায় দেড় দিন পরে মিতুর বাসায় ফোন করছে ইমন। আজও সেই অনেক দিন আগের মতো বুক কাঁপছে ওর। কি বলবে রনিকে?
হ্যালো। ওই প্রান্তে রনির উৎকণ্ঠিত স্বর।
এটা কি মিতুদের বাসা? আমি কি একটু রনি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
জি বলছি।
আমি শিকাগো থেকে ইমন বলছি। আপনি আমাকে ঠিক চিনবেন না। আমি মিতুর পূর্ব পরিচিত। গত দুই দিন মিতু আমার কাছেই আছে।
তার মানে? আপনি কি আবোলতাবোল বলছেন এ সব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর তো দেশে যাওয়ার কথা। শিকাগোতে ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। তারপর থেকে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষের দিকে রনির গলাটা কেমন যেন ধরে এল।
ইমন কীভাবে খবরটা দেবে বুঝতে পারছে না। আসলে ওর একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এখনো কমাতে আছে, হাসপাতালে।
কি-ই-ই? আপনি ওকে কোথায় পেলেন?
আমি গাড়িতে ওকে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নামিয়ে দিচ্ছিলাম।
রনির কেমন যেন খুব ক্লান্ত লাগে। আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করতে রুচি হয় না। যদিও অজস্র প্রশ্ন মনে এসে ভিড় করছে। মিতু এই ভদ্রলোককে কীভাবে চেনে? কত দিন ধরে চেনে? কই, কখনো বলেনি তো এর কথা। তাহলে কি লুকিয়ে লুকিয়ে...। না, ও আর কিছুই ভাবতে পারছে না। ছি, গোপনে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে? আসলেই কি হাসপাতালে আছে, নাকি ইমনের সঙ্গে...? এ কথা ভাবতে রাগে ওর শরীর কিছুটা কাঁপছে। ওপাশে ইমন তাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিচ্ছে। মিতুর অবস্থা পুরাটা না শুনে কিছুটা অভদ্রের মতোই ফোন রেখে দিল রনি।
ইমন খানিকটা অপ্রস্তুত। ও অবশ্য জানে না কি আশা করেছিল সে। রনি কি আসবে মিতুকে নিতে? ওর আসাটা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইমন তো আবার তাকে ফোন করতে পারে না। এই মুহূর্তে ও দারুণ ভাবে বীথির অভাব অনুভব করে। যদি ওকে সব খুলে বলা যেত। ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করতে পারত। বীথিকে ফোন করে ইমন এটা সেটা বলল, কিন্তু আসল কথাটা আর বলতে পারে না। বীথিকে ও আসলে খানিকটা ভয় পায়। মেয়েটা একটু কঠিন হৃদয়ের আর মুখরা। তা ছাড়া, ওর শপিংয়ের লিস্ট আর টাকার হিসাব শুনতে শুনতে ইমন ক্লান্ত হয়ে যায়। এক সময় বলে ফেলে, ঠিক আছে আমি দিন দু-একের মধ্যে আরও হাজার পাঁচেক ডলার পাঠিয়ে দেব। গয়নাটা তুলে নিও। তারপরে ফোনটা নামিয়ে রাখে।
রনির পৃথিবীটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এত দিনেও কি মিতুকে চিনতে পারেনি সে? ওদের দুজনের ব্যক্তিত্ব দুই রকম। মিতু অনেক কথা বলে, মিশুক, হইচই করতে ভালোবাসে। রনি কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক, ঘরকুনো, নিজের মধ্য থাকতে ভালোবাসে। মিতু খুব নরম, আবেগপ্রবণ। রনি ঠিক তার উল্টো। আবেগটাবেগ একদম নেই তার মধ্যে। কিন্তু তাই বলে? সে তো কখনো মিতুকে ঠকায়নি। মিতুর ভেতরে একটা অন্য রকম আকর্ষণ আছে। ছেলেরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যায় তার প্রতি। এটা নিয়ে রনির সব সময়ই একটা আশঙ্কা কাজ করে। কখনো প্রকাশ করেনি যদিও। আজ তার আশঙ্কাই সত্য হলো। কয়েক ঘণ্টা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে শিকাগোর টিকিট কিনল রনি। মিতুর সঙ্গে অন্তত একটা বোঝাপড়া করা দরকার।
মিতুর জ্ঞান এসেছে কিছুক্ষণ আগে। চোখ খুলেই ও দেখে মাথার কাছে বসে আছে ইমন। একটা হাত দিয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুটো ভীষণ উদ্বিগ্ন চোখ। ইমন ওকে ধীরে ধীরে বলে রনিকে ফোন করার কথা। মিতু যখন জানতে চায় রনি কখন আসছে, ইমন কোনো উত্তর দিতে পারে না। যা বোঝার বুঝে নেয় মিতু। রনির সন্দেহটা ও টের পায় আর মনে মনে ভাবে তাহলে সেটারই জয় হলো। মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় মিতুর। তার মনে হয় সব ভুল। তার এত দিনের বিবাহিত জীবন, সব মিথ্যা। যে সম্পর্কে আবেগ নেই সে সম্পর্কে প্রেমও নেই। একটি মায়াময় স্পর্শের জন্য সে সারা জীবন অপেক্ষা করেছে। ইমনের প্রেমময় চোখ দুটোতে ডুব দিতে ইচ্ছা করে ওর। দুর্বল দুটো হাতে আঁকড়ে ধরে ও ইমনকে। দুর্বল মিতুকে নিজের বুকে আশ্রয় দেয় ইমন। মিতু তার সেই স্বপ্নের মিতু।
এদিকে সারা রাত জার্নি করে ক্লান্ত রনি তুষারের পাহাড় ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছে। ও ঠিক জানে না ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। হয়তো দেখবে সব ভুল, হয়তো বা না। খানিকটা ফাঁকা মাথা নিয়েই মিতুর রুমে ঢুকতে গিয়ে দৃশ্যটা চোখে পরে ওর। যাকে সে এত দিন শুধু নিজের বলে জেনেছে, সেই মিতুকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে অচেনা একজন। ওদের ভঙ্গিটাই বলে দেয় কত আপন সেই আলিঙ্গন। আর কিছু জানতে চায় না রনি। তার যা জানার সেটা জানা হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করে। একটিও কথা না বলে ফিরে যাওয়ার পথে পা বাড়ায় সে। ততক্ষণে তাকে দেখে ফেলেছে ইমন আর মিতু। মিতু পেছন থেকে ডাক দেয় রনি, চলে যেও না। ইমন মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিতুর দুর্বল কণ্ঠ পৌঁছায় না রনির কানে। সে ততক্ষণে অন্য পৃথিবীর মানুষ। মিতু কাতর চোখে একবার ইমনের দিকে তাকায় আর একবার রনির যাওয়ার পথে। সেও জানে না তার পথ মিলবে কোন পথে। (ক্রমশ)
(লেখিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াপ্রবাসী)
দোকানি ওর কাঁচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝল কে জানে। কিছু না বলে ফোনের তালা খুলে এগিয়ে দিল ওর দিকে। তারপরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
ওপাশে রিং বেজে চলছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইমনের বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড ধকধক করছে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। ইমন ভাবছে মিতুকে ও কি বলবে? যেটা বলতে চাইছে সেটা বলা খুবই কঠিন। ইমন মিতুর শিক্ষক। ও বুয়েটে নতুন জয়েন করেছে। মিতুদের একটা সেশন নেয়। ওর কল্পনার রাজ্যজুড়ে আছে মিতু। কিন্তু এক বছরের জুনিয়র মিতুকে ছাত্রজীবনেও বলি বলি করে কিছু বলা হয়নি। এখন সরাসরি শিক্ষক হয়ে সেটা বলা যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইমনের হাতে আর যে সময় নেই একদম। মিতুর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। সামনের সপ্তাহেই আসবে। দুই সপ্তাহ পরে ওর বিয়ে। তাই সব সংকোচকে ঠেলে অনেক সাহস সঞ্চয় করে ইমন এসেছে এই রাতে মিতুকে ফোন করতে। ওকে আজ পারতেই হবে।
ফোনটা ধরলেন মিতুর মা। এত রাতে কিছুটা বিরক্ত। হ্যালো, কাকে চাই?
শুকনো ঠোট জিভে ভিজিয়ে ইমন কোনোমতে বলল, জি, মিতা আছে?
আপনি কে বলছেন? এবার একই সঙ্গে বিস্ময় ও প্রবল বিরক্তি।
ইমন সেটাকে প্রাণপণে উপেক্ষা করে বলল, আমি ওর টিচার, ও একটা প্রজেক্টের কিছু জিনিস জমা দেয়নি। নম্বর দেওয়ার আগে ভাবলাম একটু শিওর হয়ে নেই, হারিয়ে গেল কি না কোনোভাবে।
এবার আর মিতুর মা আপত্তি করলেন না। মিতুকে ডেকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।
মিতু, আমি ইমন।
ইমন ভাই, আপনি, এত রাতে! মিতুর গলায় একরাশ বিস্ময়।
ইয়ে মিতু মানে তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে চাচ্ছিলাম, যদি তোমার সময় হয়।
তা তো বটেই। তবে ইমন ভাই, রনি, মানে আমার হবু বর তো প্রতিদিন এই সময় ফোন করে, বেশিক্ষণ ফোন এনগেজড রাখা যাবে না, আমাকে না পেলে ও একদম অস্থির হয়ে যায়।
শেষ কথাটা শুনে একদম ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল ইমন, গলার কাছে কথাটা এসে আটকে গেছে।
আর ওপাশে নিজের অনামিকার আংটিটা নিয়ে খেলা করতে করতে মিতু ভাবছে, ইমন ভাইয়ের গলাটা এমন কেন? সেশনালে মনে হয় একটু বেশি সময় নিয়ে ওকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। যেদিন ওদের ক্লাস থাকে সেদিন দেখা যায় পোশাক আশাকেও একটু যত্নের ছাপ। এক অজানা কৌতূহল ও শঙ্কায় ওর বুক কাঁপে।
মিতু তোমার প্রজেক্টটা খুব ভালো হয়েছে। একা একাই করেছো পুরাটা?
বাহ, আপনিই তো বুঝিয়ে দিলেন বেশির ভাগ।
তোমার জন্য আমি একটা নীল শাড়ি কিনেছি, নীল রঙে তোমাকে খুব মানায়।
মিতুর গলা কাঁপছে, মানে? কি বলছেন এসব?
না মানে, তোমার বিয়েতে উপহার দেব বলে। আচ্ছা রাখি।
জরুরি কথাটা তো বললেন না?
ওহ, ভুলে গেছি।
ইমন ভাই, আমার বিয়েতে আপনি আসবেন না দয়া করে। সব নিমন্ত্রণে যেতে নেই। আর শাড়িটা আপনার কাছে রেখে দিয়েন, আমার স্মৃতি হিসেবে।
দুই.
শিকাগো এয়ারপোর্টে বসে আছে মিতু। ঢাকা যাচ্ছে সে একা। দুর্যোগের কারণে কানেক্টিং ফ্লাইট ক্যানসেল। কাল বিকেলে আবার ফ্লাইট থাকতেও পারে। ওকে হোটেল দেওয়া হয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে যেতে হবে। একা একা ট্যাক্সি চড়তে কেন জানি এখনো স্বস্তি পায় না মিতু। তা ছাড়া ও অন্য কথা ভাবছে। ইমন ভাই এখানেই থাকেন। অনেক দিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। ইমেইলে কিছুটা যোগাযোগ আছে। তার সেল ফোন নম্বরটাও আছে মিতুর কাছে। যদিও ফোন করা হয়নি কখনো। কোথায় যেন এক ধরনের ভয় কাজ করে। নিজের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু আজকে আর পারল না ও—এত কাছে এসে ইমনকে দেখার লোভটুকু সংবরণ করতে। শুধু একবার দেখা করবে। এর বেশি কিছু না। দুই রিংয়েই ফোন ধরল ইমন। মিতুর গলা শুনে মনের খুশিটা গোপন করার চেষ্টাও করল না কোনো। অফিস ফেলে এক ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে চলে আসল এয়ারপোর্ট থেকে মিতুকে হোটেলে পৌঁছে দিতে।
প্রায় আট বছর পরে দেখা। দুজনের শরীরেই কিছুটা সুখের মেদ জমেছে। আর চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ যোগ হয়েছে। কোথা থেকে একরাশ আবেগ আর লজ্জা এসে ঘিরে ধরল ওদেরকে। কারও মুখেই কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। বুকের ভেতরে তোলপাড়।
তোমার লাগেজ কই? গাড়িতে তুলতে হবে না। বলল ইমন। আর যেন কোনো কথা খুঁজে পায় না ইমন। তাড়াহুড়া করে গাড়িতে লাগেজ তুলতে তুলতে আবারও আড়চোখে একবার মিতুকে দেখে নেয় ইমন। ক্লান্ত, অথচ কী ভীষণ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে যেন পরিপূর্ণতা এসেছে।
ব্যস্ত ইমনকে খেয়াল করে মিতুও। কী সাবলীল আর আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে ইমন ভাইকে। আগের মতো একটুও জড়তা নেই।
মিতুর কাছ থেকে হোটেলের ঠিকানাটা নিয়ে সে দিকে রওনা দেয় ইমন।
মিতুই প্রথম নীরবতা ভাঙে। তারপর, আপনার খবর কি বলেন, ভাবির গল্প শুনি। নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী।
ইমন যেন শুনতেই পায় না। বহুদূর থেকে উত্তর দেয়, কেমন আছ মিতু? গোধূলির লালচে আভা এসে পরেছে মিতুর গালের বা পাশটায় এলোমেলো কয়েক গোছা চুল। ঠিক যেমনটা ইমন দেখে প্রায়ই স্বপ্নে। মনে মনে ভাবে শুধু স্বপ্নে সেই নীল শাড়িটা পরে থাক তুমি, এটুকুই যা পার্থক্য। জানো, সেই শাড়িটা আমি বীথিকেও দিতে পারিনি, এখনো অনেক যত্নে ঢাকার বাসার চিলেকোঠায় পুরোনো আলমারিটাতে তোলা আছে। ইমনের খুব ইচ্ছা করে সেই স্বপ্নের কথাটা ওকে বলতে, আলতো করে চুলের গোছাটা সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেতে।
ইমনের আনমনা ভাবটা চোখ এড়ায় না মিতুর। ওর সেই বুকের ভেতরের ধুক ধুক ফিরে আসে, ইমনের কোনো ইমেইল খুলতে গেলেই যেটা হয় ওর। খুব সাধারণ কথাবার্তা হয় ওদের, সংসারের কথা, চাকরির কথা।
তাদের সেই ইমেইল আদান প্রদানও হয় হয়তো দুই মাসে একটা। কিন্তু তারপরেও, প্রতিটা ইমেইলেই যেন কিছু না বলা কথা থেকে যায়। রনির সাথে কখনো প্রচণ্ড ঝগড়া হলে কেন জানি ইমন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে মিতুর। আর সেদিনের সেই স্বপ্নটা, ভাবতেই কান–মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে মিতুর। যেন ইমন পড়ে ফেলছে ওর মনের সব কথা, জেনে যাচ্ছে সেই পাগলামি স্বপ্নের কথা। নিজেকে লুকাতে রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় মিতু। শেষ বিকেলের আলোয় ওদের মাঝে ভেসে বেড়ায় সেই না বলা কথাগুলো, যেগুলো আর কখনোই বলা হবে না।
জানালা দিয়ে বাইরে যত দূর চোখ যায়, খালি সাদা আর সাদা। অঝোরে তুষার পড়ছে। হাইওয়েতে গাড়ির ঠেলাঠেলি। বিষণ্ন বিকেল। মিতু ভাবছে, কেন আজকে এমন হলো? ইমন ভাইকে ফোনটা না করলেই ভালো হতো। হঠাৎ বাম গালে একটা উষ্ণতা টের পায় মিতু। এক মুহূর্তের জন্য ইমনের হাতের উল্টো দিকের আলতো ছোঁয়া। চমকে উঠে ইমনকে দেখে সে। কি অদ্ভুত দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির উষ্ণতায় মোমের মতো গলে যেতে থাকে মিতু। এক মুহূর্তের জন্য রনির আবেগহীন চোখ দুটো ভেসে উঠে মনে। যে চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। কিন্তু ভালোবাসার এই ছায়া কখনোই পড়েনি সেই চোখে। আর কিছু মনে থাকে না। কখন যেন নিজের অজান্তেই একটা হাত সঁপে দিয়েছে ইমনের হাতের মুঠোয়। আর ঠিক তখনই ঘ্যাস শব্দ। গাড়িটা কালো হয়ে যাওয়া বরফে স্লিপ করে নিয়ন্ত্রণ হারায়। চারটা চক্কর দেয় হাইওয়েতে। পেছন থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটা ট্রাক আঘাত করে মিতুর সাইডে। তারপরে আর কিছুই মনে নাই ওদের কারওর।
ইমনের যখন জ্ঞান ফেরে, প্রথম যে কথাটা মনে হয়, বীথিকে খবর দেওয়া দরকার। তারপর মনে পড়ে ও তো ঢাকায়। এখন হঠাৎ করে খবর দিলে ঘাবড়ে যাবে। আর তারপরেই একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ওর গা বেয়ে। মনে পড়ে মিতুর কথা। মিতু কেমন আছে? ওর কিছু হয়নি তো? তাড়াহুড়োয় উঠতে চেষ্টা করে ইমন। কিন্তু বুঝতে পারে তার সারা শরীরে তীব্র ব্যথা। হাতে স্যালাইন আটকানো। নড়াচড়ার শব্দে ছুটে আসে নার্স। একগাল হাসি দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক গড যে তোমার জ্ঞান ফিরেছে। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! পুরো ২৪ ঘণ্টা পর তোমার জ্ঞান ফিরল। আর খবরদার একটুও নড়াচড়া না। ওদিকে তোমার স্ত্রীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
ইমন বুঝতে পারে মস্ত বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। বলে, তুমি ভুল করছ, ও আমার পরিচিত। স্কুলের বন্ধু।
নার্সকে এবার চিন্তিত দেখায়। তাহলে তো ওর বাড়িতে খবর দেওয়া দরকার। তোমার কাছে ওর নম্বর আছে?
ইমন বিপদে পড়ে যায়। ওর কাছে আছে শুধু মিতুর সেল নম্বর। উপায় না দেখে নার্সের কাছেই সাহায্য চায় ও। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে বাসার ঠিকানা ধরে হাসপাতালের সাহায্যে মিতুর বাড়ির ফোন নম্বর পায় ইমন। প্রায় দেড় দিন পরে মিতুর বাসায় ফোন করছে ইমন। আজও সেই অনেক দিন আগের মতো বুক কাঁপছে ওর। কি বলবে রনিকে?
হ্যালো। ওই প্রান্তে রনির উৎকণ্ঠিত স্বর।
এটা কি মিতুদের বাসা? আমি কি একটু রনি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
জি বলছি।
আমি শিকাগো থেকে ইমন বলছি। আপনি আমাকে ঠিক চিনবেন না। আমি মিতুর পূর্ব পরিচিত। গত দুই দিন মিতু আমার কাছেই আছে।
তার মানে? আপনি কি আবোলতাবোল বলছেন এ সব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর তো দেশে যাওয়ার কথা। শিকাগোতে ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। তারপর থেকে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষের দিকে রনির গলাটা কেমন যেন ধরে এল।
ইমন কীভাবে খবরটা দেবে বুঝতে পারছে না। আসলে ওর একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এখনো কমাতে আছে, হাসপাতালে।
কি-ই-ই? আপনি ওকে কোথায় পেলেন?
আমি গাড়িতে ওকে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নামিয়ে দিচ্ছিলাম।
রনির কেমন যেন খুব ক্লান্ত লাগে। আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করতে রুচি হয় না। যদিও অজস্র প্রশ্ন মনে এসে ভিড় করছে। মিতু এই ভদ্রলোককে কীভাবে চেনে? কত দিন ধরে চেনে? কই, কখনো বলেনি তো এর কথা। তাহলে কি লুকিয়ে লুকিয়ে...। না, ও আর কিছুই ভাবতে পারছে না। ছি, গোপনে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে? আসলেই কি হাসপাতালে আছে, নাকি ইমনের সঙ্গে...? এ কথা ভাবতে রাগে ওর শরীর কিছুটা কাঁপছে। ওপাশে ইমন তাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিচ্ছে। মিতুর অবস্থা পুরাটা না শুনে কিছুটা অভদ্রের মতোই ফোন রেখে দিল রনি।
ইমন খানিকটা অপ্রস্তুত। ও অবশ্য জানে না কি আশা করেছিল সে। রনি কি আসবে মিতুকে নিতে? ওর আসাটা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইমন তো আবার তাকে ফোন করতে পারে না। এই মুহূর্তে ও দারুণ ভাবে বীথির অভাব অনুভব করে। যদি ওকে সব খুলে বলা যেত। ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করতে পারত। বীথিকে ফোন করে ইমন এটা সেটা বলল, কিন্তু আসল কথাটা আর বলতে পারে না। বীথিকে ও আসলে খানিকটা ভয় পায়। মেয়েটা একটু কঠিন হৃদয়ের আর মুখরা। তা ছাড়া, ওর শপিংয়ের লিস্ট আর টাকার হিসাব শুনতে শুনতে ইমন ক্লান্ত হয়ে যায়। এক সময় বলে ফেলে, ঠিক আছে আমি দিন দু-একের মধ্যে আরও হাজার পাঁচেক ডলার পাঠিয়ে দেব। গয়নাটা তুলে নিও। তারপরে ফোনটা নামিয়ে রাখে।
রনির পৃথিবীটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এত দিনেও কি মিতুকে চিনতে পারেনি সে? ওদের দুজনের ব্যক্তিত্ব দুই রকম। মিতু অনেক কথা বলে, মিশুক, হইচই করতে ভালোবাসে। রনি কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক, ঘরকুনো, নিজের মধ্য থাকতে ভালোবাসে। মিতু খুব নরম, আবেগপ্রবণ। রনি ঠিক তার উল্টো। আবেগটাবেগ একদম নেই তার মধ্যে। কিন্তু তাই বলে? সে তো কখনো মিতুকে ঠকায়নি। মিতুর ভেতরে একটা অন্য রকম আকর্ষণ আছে। ছেলেরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যায় তার প্রতি। এটা নিয়ে রনির সব সময়ই একটা আশঙ্কা কাজ করে। কখনো প্রকাশ করেনি যদিও। আজ তার আশঙ্কাই সত্য হলো। কয়েক ঘণ্টা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে শিকাগোর টিকিট কিনল রনি। মিতুর সঙ্গে অন্তত একটা বোঝাপড়া করা দরকার।
মিতুর জ্ঞান এসেছে কিছুক্ষণ আগে। চোখ খুলেই ও দেখে মাথার কাছে বসে আছে ইমন। একটা হাত দিয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুটো ভীষণ উদ্বিগ্ন চোখ। ইমন ওকে ধীরে ধীরে বলে রনিকে ফোন করার কথা। মিতু যখন জানতে চায় রনি কখন আসছে, ইমন কোনো উত্তর দিতে পারে না। যা বোঝার বুঝে নেয় মিতু। রনির সন্দেহটা ও টের পায় আর মনে মনে ভাবে তাহলে সেটারই জয় হলো। মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় মিতুর। তার মনে হয় সব ভুল। তার এত দিনের বিবাহিত জীবন, সব মিথ্যা। যে সম্পর্কে আবেগ নেই সে সম্পর্কে প্রেমও নেই। একটি মায়াময় স্পর্শের জন্য সে সারা জীবন অপেক্ষা করেছে। ইমনের প্রেমময় চোখ দুটোতে ডুব দিতে ইচ্ছা করে ওর। দুর্বল দুটো হাতে আঁকড়ে ধরে ও ইমনকে। দুর্বল মিতুকে নিজের বুকে আশ্রয় দেয় ইমন। মিতু তার সেই স্বপ্নের মিতু।
এদিকে সারা রাত জার্নি করে ক্লান্ত রনি তুষারের পাহাড় ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছে। ও ঠিক জানে না ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। হয়তো দেখবে সব ভুল, হয়তো বা না। খানিকটা ফাঁকা মাথা নিয়েই মিতুর রুমে ঢুকতে গিয়ে দৃশ্যটা চোখে পরে ওর। যাকে সে এত দিন শুধু নিজের বলে জেনেছে, সেই মিতুকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে অচেনা একজন। ওদের ভঙ্গিটাই বলে দেয় কত আপন সেই আলিঙ্গন। আর কিছু জানতে চায় না রনি। তার যা জানার সেটা জানা হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করে। একটিও কথা না বলে ফিরে যাওয়ার পথে পা বাড়ায় সে। ততক্ষণে তাকে দেখে ফেলেছে ইমন আর মিতু। মিতু পেছন থেকে ডাক দেয় রনি, চলে যেও না। ইমন মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিতুর দুর্বল কণ্ঠ পৌঁছায় না রনির কানে। সে ততক্ষণে অন্য পৃথিবীর মানুষ। মিতু কাতর চোখে একবার ইমনের দিকে তাকায় আর একবার রনির যাওয়ার পথে। সেও জানে না তার পথ মিলবে কোন পথে। (ক্রমশ)
(লেখিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াপ্রবাসী)
No comments