এই বেলা নে ঘর ছেয়ে by সৈয়দ আবুল মকসুদ
শিয়ালদা
থেকে ট্রেনে বোলপুর গিয়ে নামলাম। শান্তিনিকেতনে যাব কয়েক দিনের জন্য
বেড়াতে। ওই ট্রেনেরই এক যাত্রীকে কয়েকজন যুবক-যুবতী স্টেশনে ফুল দিয়ে
অভ্যর্থনা জানালেন। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত
ভদ্রলোক। তিনি অন্য ট্রেনে কোথাও যাবেন। তিনি তাঁর পরিচিত ওই যাত্রীকে
বললেন, খুব যে দাঁত কেলাচ্ছ হে? পুষ্পস্তবক হাতে যাত্রী বললেন, কাজটা হয়ে
গেছে। ভদ্রলোক বললেন, খুব ভালো, খুব ভালো। তাঁর ট্রেন এসে গিয়েছিল।
ঘণ্টা বেজে উঠেছে। তিনি হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, এই বেলা নে ঘর
ছেয়ে।
মানুষের জীবনে সুযোগ সব সময় আসে না। দাঁও মারার লগ্ন আছে। সেই শুভক্ষণটি ধরতে হয়। নিজের ঘরের ফুটো চালটি ছেয়ে নেওয়ার সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না। বোলপুর স্টেশনের ওই যাত্রী সিপিএমের এক বিধায়ক বা মন্ত্রীকে ধরে একটি লাভজনক কাজ বাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতা থেকে। তাই তাঁকে শুনিয়ে বোলপুরী ভদ্রলোক স্বগতোক্তির মতো বলছিলেন, এই বেলা নে ঘর ছেয়ে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী।
আমাদের বাংলার মাটিতেও কোনো কোনো বঙ্গবাসীর জীবনে এসেছে নিজেদের ঘর ছেয়ে নেওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ—মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই লগ্নের তাঁরা সদ্ব্যবহার করছেন সর্বোচ্চ দক্ষতায়। কয়েক দিন যাবৎ একটি খবরে কী যে ভালো লাগছে! গর্বে বুকের ছাতি উঁচু হয়ে গেছে দেড় হাত। দেশীয় ব্যাংকগুলোর সিন্দুক আর ধারণ করতে পারছে না। আমাদেরই ভাইবোনদের টাকা জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে। আমাদের জন্য এ যে কত বড় গৌরবের কথা, তা কোনো কলামে লিখে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ধারণা করি, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে আগে যে ভল্ট ছিল, তাতে আর কুলাচ্ছে না। আরও বড় ভল্ট দরকার। প্রত্যেক ব্যাংকে একটি করে ভল্ট দরকার শুধু বাংলাদেশিদের টাকা রাখার জন্য। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সর্বশেষ খতিয়ান থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাঙালি ভাইয়েরা/বোনেরা বস্তায় ভরে সেখানে নিয়ে জমা করেছেন ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা (৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ)। তাঁরা ২০১২ অব্দে জমা করেছিলেন ১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা এবং ২০১৩-তে ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করায় কোনো পরশ্রীকাতর বাঙালি অথবা মিডিয়ার লোকদের অন্তর্দাহ হওয়ার কোনো কারণই থাকত না, যদি ওই টাকা ভ্রাতা-ভগ্নিরা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরিবাকরি করে কামাই করতেন। বঙ্গমাতার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এবং তারই দানাপানি খেয়ে এখানে বসেই জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাত যেকোনো উপায়ে রোজগার করে টাকাগুলো তাঁরা অতি সংগোপনে জুরিখ বা জেনেভায় পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের মতো একজন বাঙালির জন্য বেদনাদায়ক যা তা হলো, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারতাম, তা পারছি না। কারণ, তাঁদের নাম জানি না। জানলে আজ পাড়ার চা–দোকানে, ড্রয়িংরুমে চায়ের পেয়ালা হাতে, অফিসের কাজকাম ফেলে টেবিলে টেবিলে, বাস টার্মিনালে, রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে, এমনকি নিষিদ্ধপল্লিতে পর্যন্ত তাঁদের নাম ধরে আলোচনা হতো। তাঁরা হতে পারতেন সেলিব্রিটি। কিন্তু সে সুযোগ তাঁরা দেননি। তাঁরা তাঁদের নামধাম প্রকাশ করার ঘোর বিরোধী। বাংলা ভাষার কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিকের মতো তাঁরা খুবই প্রচারবিমুখ। তবে আমাদের আবদার, তাঁদের নামগুলো প্রকাশ করা হোক।
ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলার মাটি থেকে অবৈধ পুঁজি বিদেশে পাচার হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা (১৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। শুধু ২০০৬ সালেই ২০ হাজার ৮০২ কোটি বঙ্গীয় টাকা বিদেশে উড়ে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশ হলে এত টাকা বিদেশে পাচার সম্ভব হতো না। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, বাংলাদেশ বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকেই উচ্চ আয়ের দেশে প্রমোশন পেয়েছে। বাংলার মাটি টাকা কামাই করার জন্য যদি সবচেয়ে চমৎকার জায়গা হয়ে থাকে, টাকা পাচারের জন্য তা সর্বোচ্চ স্বর্গ।
টাকা যাঁরা পাচার করছেন, তাঁদেরও শক্ত যুক্তি রয়েছে। সাংবাদিকদের ভাষায় বলতে গেলে ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ অনেকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশটা ভালো না, শান্তি-শৃঙ্খলা নেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোন সময় গাড়িতে ঢিল মারে তার ঠিক নেই। আর সাড়ে তিনজন মন্ত্রী ও নেতার ভাষ্যমতে সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো এখানে জঙ্গি গিজগিজ করছে। সুতরাং এখানে বালবাচ্চা নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েদের আগেই বিদেশে পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে ওরা বউ-বাচ্চা নিয়ে কী খাবে, সে জন্য কিঞ্চিৎ অর্থ সুইস ব্যাংকে হোক বা অন্য কোনো দেশের ব্যাংকে জমা রাখা জরুরি। আরে ভাই, পিঁপড়াও তো বর্ষাকালের জন্য সঞ্চয় করে রাখে কোনো শুকনা জায়গায়!
তাঁদের এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। শুধু বলার থাকে এইটুকু যে, এই খারাপ দেশটাতে আছেন বলেই তো টাকাগুলো কামাই করলেন। সুইজারল্যান্ডে থেকে যদি টাকাগুলো কামাই করে সেখানকার ব্যাংকে রাখতেন, আমরা খুবই প্রীত হতাম। তা ছাড়া যে অবৈধ উপায়েই টাকা রোজগার করুন না কেন, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নিষ্প্রয়োজন, তবে টাকাগুলো বৈধভাবে পাঠালেন না কেন? যাদের সব কাজেই অসাধুতা ও গোপনীয়তা, তাদের তো ঘৃণা ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নয়।
সর্দি-কাশি হলে বাঙালি চায়ের সঙ্গে চ্যাবনপ্রাশ সেবন করেন। কিন্তু ভোজ্যতেলের সঙ্গে কোকেন—এ কথা আমরা চৌদ্দ পুরুষে শুনিনি। স্বর্ণ ও কোকেন চোরাচালানের রুট আজ বাংলাদেশ। কতকাল থেকে কোকেন প্রভৃতি মাদকদ্রব্য বাংলাদেশ হয়ে চোরাচালান হচ্ছে, তা বিধাতা বলতে পারবেন, গোয়েন্দারা নন। সেদিন ধরা পড়ল বলিভিয়া থেকে আমদানি করা ১০৭ ড্রাম সূর্যমুখী ভোজ্যতেল। তেলটা সূর্যমুখী না চন্দ্রমুখী নাকি তিসির তেল, সেটা বড় কথা নয়। তেলের ড্রামে কোকেন। বলিভিয়া থেকে বাংলাদেশে আগে কখনো সূর্যমুখী ভোজ্যতেল আমদানি হয়নি। এলসি বা ঋণপত্র ছাড়াই এসেছে এ তেল। অন্য কোনো পণ্যের সঙ্গে এসেছে এবং তা পুনরায় ইউরোপের বা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা হতো। এ কাজ হামেশাই হয়ে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ণ সহযোগিতায়। বৈধভাবে যাঁরা টাকা উপার্জন করেন, তাঁদের তো আমরা স্যালুট দিই। যে দেশে মাদক ব্যবসা জমজমাট এবং সে কারবারের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত, সে দেশের টাকার গন্তব্য সুইজারল্যান্ড না হয়েই পারে না।
ডিলান টোমাসের একটি কবিতা কলকাতার এক কবি তর্জমা করেছেন। তাঁর শুরু এ রকম: ‘এই যে রুটিকে ছিঁড়ি একদা এ শস্য ছিল মাঠে/ এই মদ বিদেশি লতায় ফলের শরীরে জড়ানো ছিল একদিন।’ খাবারের টেবিলে গমের রুটি চিবোতে গিয়ে পঙ্ক্তিগুলো মনে পড়ল। গম থেকেই রুটি হয়। সে গম বাংলাদেশের মাঠেরও হতে পারে, ব্রাজিলের খেতেরও হতে পারে। বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পৃথিবীর একটি খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ—এ বাণী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় ঘোষিত হয়।
মাঠের গম রুটি হয়ে পেটে গিয়ে পচবেই। এবং তা বিশেষ পথ দিয়ে বেরিয়ে সুয়ারেজ লাইনে গিয়ে পড়বেই। তবে এবার ফুটবল কিংবদন্তি পেলের দেশ থেকেই এসেছে পচা গম। কেউ বলবেন, ও গমের পুষ্টিগুণ বেশি। কারণ, ওতে কার্বোহাইড্রেড যেমন আছে, তেমনি আছে প্রাণিজ প্রোটিন। ভোক্তাদের একসঙ্গে দুটি উপাদান পাওয়া ভাগ্যের কথা। যেসব গরিব মানুষ শুধু কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে রুটি খায়, মাংস-ডিম চোখে দেখে না, তাদের জন্য নিম্নমানের গম বড়ই উপকারী। ডাবল পুষ্টি। নিম্নমানের গমের সঙ্গে পেলের দেশের ব্রাজিলীয় পোকাও বাংলার মাটিতে এসে থাকতে পারে বিনা পাসপোর্ট-ভিসায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু আমদানিকারকের পকেট ভরছে টাকায় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের বাড়তেই পারে সুইস ব্যাংকে জমার পরিমাণ। তবে বাংলাদেশ সহ-অবস্থানের জন্য বিশ্বখ্যাত। এখানে পচা গমও থাকবে, গমের আমদানিকারকও থাকবেন এবং মন্ত্রিত্বও থাকবে।
আজ যে যেভাবে পারছে ছেয়ে নিচ্ছে তার ঘরের চাল। জমাচ্ছে টাকা সুইস ব্যাংকে। ‘সেকেন্ড হোমে’র বাসিন্দা যে কত বঙ্গবাসী, তাদের নামধাম আমরা জানি না। যদিও একাত্তরে অনেকের বাড়িতেই মরচে পড়া দুই বান্ডিল টিনের দোচালা ছিল, আজ প্রাসাদ। কারও কারও বাড়ি বাকিংহাম প্যালেস বা সম্রাট আকিহিতোর প্রাসাদকে হার মানায়। তবু তাদের আর একটি বাড়ি দরকার। সে বাড়ি মালয়েশিয়ায় হতে পারে, কানাডায় হতে পারে অথবা অন্য কোনো দ্বীপরাষ্ট্রে। বাংলাদেশে গোলমাল দেখা দিলেই সেকেন্ড হোমে গিয়ে উঠবেন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিমধ্যেই কারও কারও থার্ড হোম বা ফোর্থ হোমের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে।
এত বৈষম্য, এত অনাচার, এত অপরাধ বঙ্গমাতা সইবে না। ১ ভাগ ভাগ্যবান মানুষের বাড়াবাড়ি ৯৯ ভাগ মানুষ হাসিমুখে দেখবে না। বিশেষ করে সচেতন যুবসমাজ বসে বসে আঙুল চুষবে, তা আশা করা ঠিক নয়। ভয়টা ওখানেই যে তাদের কেউ বিন লাদেনের আত্মার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্লানচেটে বসবে, কেউ আইএস খলিফা আল বোগদাদির আলখাল্লার নিচে আশ্রয় নেবে, কেউ চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই থেকে দীক্ষা নেবে। তখন আমাদের কারোরই পালানোর পথ থাকবে না। প্রত্যেকের প্রয়োজন হবে একটি করে সেকেন্ড হোমের।
এটা কুচপরোয়া না করার দেশ। এখানে বলিভিয়া থেকে কোকেনসমেত ভোজ্যতেল আসুক, ব্রাজিল থেকে পচা গম আসুক, ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট হোক—নজরদারির কেউ নেই। ফ্রি স্টাইল। সবাই স্বাধীন। শামসুর রাহমান এখন বেঁচে থাকলে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি হয় পুনর্বার লিখতেন অথবা ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখতেন:
স্বাধীনতা তুমি
সুইস ব্যাংকে জমানো টাকা,
স্বাধীনতা তুমি
সেকেন্ড হোমে সুখী সংসার,
স্বাধীনতা তুমি
৫৫ হাজার কোটি খেলাপিঋণ,
স্বাধীনতা তুমি
পচা গমের মদির গন্ধ
স্বাধীনতা তুমি
বিএমডব্লিউ জাগুয়ার লেক্সাস,
স্বাধীনতা তুমি
মধ্যসাগরে ভাসমান শব,
স্বাধীনতা তুমি
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আর্তনাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
মানুষের জীবনে সুযোগ সব সময় আসে না। দাঁও মারার লগ্ন আছে। সেই শুভক্ষণটি ধরতে হয়। নিজের ঘরের ফুটো চালটি ছেয়ে নেওয়ার সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না। বোলপুর স্টেশনের ওই যাত্রী সিপিএমের এক বিধায়ক বা মন্ত্রীকে ধরে একটি লাভজনক কাজ বাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতা থেকে। তাই তাঁকে শুনিয়ে বোলপুরী ভদ্রলোক স্বগতোক্তির মতো বলছিলেন, এই বেলা নে ঘর ছেয়ে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী।
আমাদের বাংলার মাটিতেও কোনো কোনো বঙ্গবাসীর জীবনে এসেছে নিজেদের ঘর ছেয়ে নেওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ—মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই লগ্নের তাঁরা সদ্ব্যবহার করছেন সর্বোচ্চ দক্ষতায়। কয়েক দিন যাবৎ একটি খবরে কী যে ভালো লাগছে! গর্বে বুকের ছাতি উঁচু হয়ে গেছে দেড় হাত। দেশীয় ব্যাংকগুলোর সিন্দুক আর ধারণ করতে পারছে না। আমাদেরই ভাইবোনদের টাকা জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে। আমাদের জন্য এ যে কত বড় গৌরবের কথা, তা কোনো কলামে লিখে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ধারণা করি, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে আগে যে ভল্ট ছিল, তাতে আর কুলাচ্ছে না। আরও বড় ভল্ট দরকার। প্রত্যেক ব্যাংকে একটি করে ভল্ট দরকার শুধু বাংলাদেশিদের টাকা রাখার জন্য। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সর্বশেষ খতিয়ান থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাঙালি ভাইয়েরা/বোনেরা বস্তায় ভরে সেখানে নিয়ে জমা করেছেন ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা (৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ)। তাঁরা ২০১২ অব্দে জমা করেছিলেন ১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা এবং ২০১৩-তে ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করায় কোনো পরশ্রীকাতর বাঙালি অথবা মিডিয়ার লোকদের অন্তর্দাহ হওয়ার কোনো কারণই থাকত না, যদি ওই টাকা ভ্রাতা-ভগ্নিরা বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরিবাকরি করে কামাই করতেন। বঙ্গমাতার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা এবং তারই দানাপানি খেয়ে এখানে বসেই জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাত যেকোনো উপায়ে রোজগার করে টাকাগুলো তাঁরা অতি সংগোপনে জুরিখ বা জেনেভায় পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের মতো একজন বাঙালির জন্য বেদনাদায়ক যা তা হলো, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারতাম, তা পারছি না। কারণ, তাঁদের নাম জানি না। জানলে আজ পাড়ার চা–দোকানে, ড্রয়িংরুমে চায়ের পেয়ালা হাতে, অফিসের কাজকাম ফেলে টেবিলে টেবিলে, বাস টার্মিনালে, রেলস্টেশনে, লঞ্চঘাটে, এমনকি নিষিদ্ধপল্লিতে পর্যন্ত তাঁদের নাম ধরে আলোচনা হতো। তাঁরা হতে পারতেন সেলিব্রিটি। কিন্তু সে সুযোগ তাঁরা দেননি। তাঁরা তাঁদের নামধাম প্রকাশ করার ঘোর বিরোধী। বাংলা ভাষার কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিকের মতো তাঁরা খুবই প্রচারবিমুখ। তবে আমাদের আবদার, তাঁদের নামগুলো প্রকাশ করা হোক।
ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলার মাটি থেকে অবৈধ পুঁজি বিদেশে পাচার হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা (১৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। শুধু ২০০৬ সালেই ২০ হাজার ৮০২ কোটি বঙ্গীয় টাকা বিদেশে উড়ে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশ হলে এত টাকা বিদেশে পাচার সম্ভব হতো না। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, বাংলাদেশ বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকেই উচ্চ আয়ের দেশে প্রমোশন পেয়েছে। বাংলার মাটি টাকা কামাই করার জন্য যদি সবচেয়ে চমৎকার জায়গা হয়ে থাকে, টাকা পাচারের জন্য তা সর্বোচ্চ স্বর্গ।
টাকা যাঁরা পাচার করছেন, তাঁদেরও শক্ত যুক্তি রয়েছে। সাংবাদিকদের ভাষায় বলতে গেলে ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ অনেকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশটা ভালো না, শান্তি-শৃঙ্খলা নেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোন সময় গাড়িতে ঢিল মারে তার ঠিক নেই। আর সাড়ে তিনজন মন্ত্রী ও নেতার ভাষ্যমতে সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো এখানে জঙ্গি গিজগিজ করছে। সুতরাং এখানে বালবাচ্চা নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েদের আগেই বিদেশে পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে ওরা বউ-বাচ্চা নিয়ে কী খাবে, সে জন্য কিঞ্চিৎ অর্থ সুইস ব্যাংকে হোক বা অন্য কোনো দেশের ব্যাংকে জমা রাখা জরুরি। আরে ভাই, পিঁপড়াও তো বর্ষাকালের জন্য সঞ্চয় করে রাখে কোনো শুকনা জায়গায়!
তাঁদের এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। শুধু বলার থাকে এইটুকু যে, এই খারাপ দেশটাতে আছেন বলেই তো টাকাগুলো কামাই করলেন। সুইজারল্যান্ডে থেকে যদি টাকাগুলো কামাই করে সেখানকার ব্যাংকে রাখতেন, আমরা খুবই প্রীত হতাম। তা ছাড়া যে অবৈধ উপায়েই টাকা রোজগার করুন না কেন, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নিষ্প্রয়োজন, তবে টাকাগুলো বৈধভাবে পাঠালেন না কেন? যাদের সব কাজেই অসাধুতা ও গোপনীয়তা, তাদের তো ঘৃণা ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নয়।
সর্দি-কাশি হলে বাঙালি চায়ের সঙ্গে চ্যাবনপ্রাশ সেবন করেন। কিন্তু ভোজ্যতেলের সঙ্গে কোকেন—এ কথা আমরা চৌদ্দ পুরুষে শুনিনি। স্বর্ণ ও কোকেন চোরাচালানের রুট আজ বাংলাদেশ। কতকাল থেকে কোকেন প্রভৃতি মাদকদ্রব্য বাংলাদেশ হয়ে চোরাচালান হচ্ছে, তা বিধাতা বলতে পারবেন, গোয়েন্দারা নন। সেদিন ধরা পড়ল বলিভিয়া থেকে আমদানি করা ১০৭ ড্রাম সূর্যমুখী ভোজ্যতেল। তেলটা সূর্যমুখী না চন্দ্রমুখী নাকি তিসির তেল, সেটা বড় কথা নয়। তেলের ড্রামে কোকেন। বলিভিয়া থেকে বাংলাদেশে আগে কখনো সূর্যমুখী ভোজ্যতেল আমদানি হয়নি। এলসি বা ঋণপত্র ছাড়াই এসেছে এ তেল। অন্য কোনো পণ্যের সঙ্গে এসেছে এবং তা পুনরায় ইউরোপের বা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা হতো। এ কাজ হামেশাই হয়ে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ণ সহযোগিতায়। বৈধভাবে যাঁরা টাকা উপার্জন করেন, তাঁদের তো আমরা স্যালুট দিই। যে দেশে মাদক ব্যবসা জমজমাট এবং সে কারবারের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত, সে দেশের টাকার গন্তব্য সুইজারল্যান্ড না হয়েই পারে না।
ডিলান টোমাসের একটি কবিতা কলকাতার এক কবি তর্জমা করেছেন। তাঁর শুরু এ রকম: ‘এই যে রুটিকে ছিঁড়ি একদা এ শস্য ছিল মাঠে/ এই মদ বিদেশি লতায় ফলের শরীরে জড়ানো ছিল একদিন।’ খাবারের টেবিলে গমের রুটি চিবোতে গিয়ে পঙ্ক্তিগুলো মনে পড়ল। গম থেকেই রুটি হয়। সে গম বাংলাদেশের মাঠেরও হতে পারে, ব্রাজিলের খেতেরও হতে পারে। বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পৃথিবীর একটি খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ—এ বাণী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় ঘোষিত হয়।
মাঠের গম রুটি হয়ে পেটে গিয়ে পচবেই। এবং তা বিশেষ পথ দিয়ে বেরিয়ে সুয়ারেজ লাইনে গিয়ে পড়বেই। তবে এবার ফুটবল কিংবদন্তি পেলের দেশ থেকেই এসেছে পচা গম। কেউ বলবেন, ও গমের পুষ্টিগুণ বেশি। কারণ, ওতে কার্বোহাইড্রেড যেমন আছে, তেমনি আছে প্রাণিজ প্রোটিন। ভোক্তাদের একসঙ্গে দুটি উপাদান পাওয়া ভাগ্যের কথা। যেসব গরিব মানুষ শুধু কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে রুটি খায়, মাংস-ডিম চোখে দেখে না, তাদের জন্য নিম্নমানের গম বড়ই উপকারী। ডাবল পুষ্টি। নিম্নমানের গমের সঙ্গে পেলের দেশের ব্রাজিলীয় পোকাও বাংলার মাটিতে এসে থাকতে পারে বিনা পাসপোর্ট-ভিসায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু আমদানিকারকের পকেট ভরছে টাকায় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের বাড়তেই পারে সুইস ব্যাংকে জমার পরিমাণ। তবে বাংলাদেশ সহ-অবস্থানের জন্য বিশ্বখ্যাত। এখানে পচা গমও থাকবে, গমের আমদানিকারকও থাকবেন এবং মন্ত্রিত্বও থাকবে।
আজ যে যেভাবে পারছে ছেয়ে নিচ্ছে তার ঘরের চাল। জমাচ্ছে টাকা সুইস ব্যাংকে। ‘সেকেন্ড হোমে’র বাসিন্দা যে কত বঙ্গবাসী, তাদের নামধাম আমরা জানি না। যদিও একাত্তরে অনেকের বাড়িতেই মরচে পড়া দুই বান্ডিল টিনের দোচালা ছিল, আজ প্রাসাদ। কারও কারও বাড়ি বাকিংহাম প্যালেস বা সম্রাট আকিহিতোর প্রাসাদকে হার মানায়। তবু তাদের আর একটি বাড়ি দরকার। সে বাড়ি মালয়েশিয়ায় হতে পারে, কানাডায় হতে পারে অথবা অন্য কোনো দ্বীপরাষ্ট্রে। বাংলাদেশে গোলমাল দেখা দিলেই সেকেন্ড হোমে গিয়ে উঠবেন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিমধ্যেই কারও কারও থার্ড হোম বা ফোর্থ হোমের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে।
এত বৈষম্য, এত অনাচার, এত অপরাধ বঙ্গমাতা সইবে না। ১ ভাগ ভাগ্যবান মানুষের বাড়াবাড়ি ৯৯ ভাগ মানুষ হাসিমুখে দেখবে না। বিশেষ করে সচেতন যুবসমাজ বসে বসে আঙুল চুষবে, তা আশা করা ঠিক নয়। ভয়টা ওখানেই যে তাদের কেউ বিন লাদেনের আত্মার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্লানচেটে বসবে, কেউ আইএস খলিফা আল বোগদাদির আলখাল্লার নিচে আশ্রয় নেবে, কেউ চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই থেকে দীক্ষা নেবে। তখন আমাদের কারোরই পালানোর পথ থাকবে না। প্রত্যেকের প্রয়োজন হবে একটি করে সেকেন্ড হোমের।
এটা কুচপরোয়া না করার দেশ। এখানে বলিভিয়া থেকে কোকেনসমেত ভোজ্যতেল আসুক, ব্রাজিল থেকে পচা গম আসুক, ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট হোক—নজরদারির কেউ নেই। ফ্রি স্টাইল। সবাই স্বাধীন। শামসুর রাহমান এখন বেঁচে থাকলে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি হয় পুনর্বার লিখতেন অথবা ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখতেন:
স্বাধীনতা তুমি
সুইস ব্যাংকে জমানো টাকা,
স্বাধীনতা তুমি
সেকেন্ড হোমে সুখী সংসার,
স্বাধীনতা তুমি
৫৫ হাজার কোটি খেলাপিঋণ,
স্বাধীনতা তুমি
পচা গমের মদির গন্ধ
স্বাধীনতা তুমি
বিএমডব্লিউ জাগুয়ার লেক্সাস,
স্বাধীনতা তুমি
মধ্যসাগরে ভাসমান শব,
স্বাধীনতা তুমি
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আর্তনাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments