আমরা সুস্থ আছি তো? by মশিউল আলম
হাসপাতালে সুখী আক্তার ও তাঁর মা |
‘সুখীর
ডান চোখ একেবারে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সুখীকে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি করাতে
এসেছিলেন, তাঁরা তুলে ফেলা চোখটি সঙ্গে করে এনেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন,
চিকিৎসকেরা যদি চোখটি আবার লাগাতে পারেন। আসলে তা করা সম্ভব নয়।’
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জালাল আহমেদের এই কথাগুলো বড্ড ক্লিনিক্যাল—নির্লিপ্ত, নিরাবেগ। আর যাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করতে গিয়ে তিনি কথাগুলো বলেছেন, সেই ২৪ বছর বয়সী গৃহবধূ সুখী আক্তারের বক্তব্যেও কোনো আবেগ টের পাওয়া যায় না। তিনি প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘টাকা দেওনের লাইগ্যা আগে থেইকাই মারধর করত। রোজার দিন। আমার মেয়েরে দোকানে পাঠাইয়্যা দেয়। প্রথমে আমার হাত বান্ধে। প্রথম ভাবি, আজকেও মারব। কিন্তু ওর দুই ভাই আর এক বইনও যখন আমারে ধরে তখন বুঝি, অন্য কিছু করব।’
সেই অন্য কিছু হলো একটা ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে সুখী আক্তারের চোখ আমূল উপড়ে ফেলা।
সুখীর নামটা এক নির্মম পরিহাস: তাঁর একটা চোখ উপড়ে ফেলেছেন তাঁরই স্বামী রবিউল ইসলাম। আর রবিউলকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর দুই ভাই ও এক বোন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যায় সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। সুখী আক্তারেরও নিশ্চয়ই সেই স্বপ্ন ছিল।
সুখীর উপড়ে ফেলা চোখটা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এক দর্শনীয় বস্তুর মর্যাদা পেয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকেরা চোখটি বোতলে ভরে রেখেছেন। সেখানকার আনসার কমান্ডার আবুল কাশেম প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেছেন, তিনি ও অন্য অনেকে সেই চোখ দেখেছেন। ‘অনেকে মোবাইলে ছবিও তুলছে।’—আবুল কাশেমের এই কথা সত্য হলে অচিরেই ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সুখীর ওপড়ানো চোখটির ছবি দর্শনীয় হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।
টাকার দাবিতে প্রায়ই প্রহারকারী স্বামীর হাতে সুখী আক্তারের চোখ ওপড়ানোর ঘটনাটি ঘটেছে ঈদুল ফিতরের আনন্দোৎসবের ঠিক আগের দিন, শুক্রবার দুপুরে। আগ্রহী পাঠক এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর পাবেন ২১ জুলাই মঙ্গলবারের প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। তাঁর ওপড়ানো চোখের জায়গায় একটা প্লাস্টিকের চোখ বসানো হয়েছে—এই খবর পাবেন পরদিনের প্রথম আলোয়।
দুই. তিন সন্তানের মা, ৩৫ বছরের গৃহবধূ রাবেয়া বশরি চেয়েছিলেন ঈদের দিনটি স্বামীসহ পরিবারের সবাই মিলে আনন্দে কাটাবেন। কিন্তু তাঁর স্বামী কবির মিয়া যাবেন জুয়া খেলতে। স্বামী জুয়ায় আসক্ত—রাবেয়া এটা জানেন। কিন্তু অন্তত ঈদের দিনটিতে স্বামী জুয়ার আসরে যাবেন না, এটুকুই চেয়েছিলেন রাবেয়া। তাই বাধা দিয়েছিলেন স্বামীকে। ফল ভালো হলো না: কবির মিয়া শোয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে পেটালেন রাবেয়াকে। রাবেয়া আধমরা হলে কবির পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে; কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন; ভীতসন্ত্রস্ত, কান্নারত ছেলেমেয়েদের বললেন তিনি তাদের মায়ের জন্য ওষুধ এনেছেন।
কিন্তু ওষুধ নয়, আধমরা স্ত্রীর মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কবির মিয়া। ১৫ বছরের একটি মেয়ে, সাত ও পাঁচ বছর বয়সী দুটি ছেলে রেখে মরে গেলেন রাবেয়া বশরি, ঈদুল ফিতরের দিন। মৌলভীবাজারের জুড়ীর কুলাউড়া পৌরসভার উছলাপাড়া এলাকায় ঘটেছে এই ঘটনা।
তিন. টাঙ্গাইলের গোপালপুরের নবগ্রাম দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আল্পনা আক্তার (৩৫) ও সোনা মিয়ার (৪৫) বিয়ে হয়েছে ১৮-২০ বছর আগে। দুই ছেলেমেয়ে, অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। ছেলেটি ছোট। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন ঢাকায়, পৃথক দুটি গার্মেন্টস কারখানায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন দুজনেই।
ঈদের পরদিন স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে গোসল করতে গেছেন গ্রামের পাশের ঝিনাই নদীতে। কিন্তু নদী থেকে সোনা মিয়া উঠে আসেন একা। কল্পনাকে তিনি নদী থেকে জীবিত উঠতে দেননি।
নদী থেকে কল্পনার লাশ উদ্ধার করেন গ্রামবাসী।
পুলিশ সোনা মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি পুলিশকে বলেছেন, কল্পনাকে তিনি নদীতে ডুবিয়ে মেরেছেন। কারণ, কল্পনার অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদক খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সোনা মিয়া ও কল্পনা আক্তারের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল অনেক দিন ধরে।
সেই ‘কলহ’ এমনই যে, অবশেষে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে গোসল করতে নেমে স্বামী আবির্ভূত হলেন যমের ভূমিকায়।
চার. সমাজবিজ্ঞানী, নারী অধিকার সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এই তিনটি ঘটনার বিবরণে ‘পারিবারিক সহিংসতা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো বলবে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’র কথা। সুখী আক্তারের ঘটনার পেছনে স্পষ্টতই যৌতুক নামের ‘সামাজিক অভিশাপ’ দেখতে পাওয়া যাবে। আর সোনা মিয়া ও আল্পনা আক্তারের ‘দাম্পত্য কলহ’ থেকে সোনা মিয়ার মধ্যে জন্ম নেওয়া ও ঘনিয়ে ওঠা ঈর্ষার কথা তো সোনা মিয়ার স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট।
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে যৌতুক, দাম্পত্য কলহ, ঈর্ষা, প্রেম-বিয়ের প্রত্যাখ্যান—এসব কারণ বাস্তবসম্মতভাবেই চিহ্নিত করা গেছে। এসব প্রবণতা দমন বা প্রশমনের জন্য আইনের প্রয়োগের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। আইন প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করাই প্রথম কর্তব্য বটে। তবে দুটো কর্তব্যেরই প্রয়োজন দেখা দেয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, তার আগে নয়। সুখী আক্তারের একটি চোখ উপড়ে ফেলার আগে তাঁর স্বামী রবিউলকে, রাবেয়া বশরিকে পিটিয়ে আধমরা করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে মেরে ফেলার আগে তাঁর জুয়াড়ি স্বামী কবির মিয়াকে, কিংবা আল্পনা আক্তারকে নদীর পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলার আগে তাঁর স্বামী সোনা মিয়াকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার প্রশ্ন ছিল না। আবার, এই তিন অপরাধীর বিচার ও শাস্তি হলেই সুখী আক্তার তাঁর একটি চোখ এবং রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তার তাঁদের প্রাণ ফিরে পাবেন না।
আমরা তাহলে কী করব?
রাষ্ট্রকে তার কাজ করতে হবে: আইনের সুষ্ঠু ও দক্ষ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ওই তিন পাষণ্ডকে শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত গড়তে হবে। যেন কেউ মনে করতে না পারে এই দেশে এ ধরনের নৃশংস অপরাধ করে অবলীলায় পার পাওয়া যায়। সমাজ-মনোবিজ্ঞানী ও অন্য বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন, বিচারহীনতার পরিবেশ নিষ্ঠুরতা বাড়ার প্রধান কারণ। এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, কিন্তু শেষ কথা নয়। শেষ কথাটা একটা গভীর প্রশ্ন: সুখী আক্তার, রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তারের সঙ্গে তাঁদের স্বামীরা যে আচরণ করেছেন তার স্বরূপ কী? নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা—এ ধরনের আরও যত শব্দ বাংলা ভাষায় আছে, তার কোনোটাই যথেষ্ট বলে মনে হয় না।
শুধু এই তিনটি ঘটনা নয়, এ রকম কিংবা এর থেকেও অনেক বেশি বিভীষিকাপূর্ণ অনেক ঘটনা এই দেশে ঘটে চলেছে। এবং তা শুধু নারীর ক্ষেত্রে নয়; নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-পেশা-বয়সনির্বিশেষে ঘটে চলেছে ভয়ংকর নানা অপরাধ। আমাদের সংবেদনশীলতাও হয়তো খানিক ভোঁতা হয়েছে, যদিও দর্শকসুলভ আহাজারির মাত্রা কমেনি। সুখী আক্তারের চোখ ওপড়ানোর ঘটনাটি আরও প্রচারিত হলে সিলেটের শিশু সামিউল হত্যাকাণ্ডের মতো দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় উঠতে পারে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুরু হতে পারে আবেগ প্রকাশের প্রতিযোগিতা। ঠিক আছে, তা হোক; দর্শকসুলভ আবেগেরও মূল্য আছে, দরকারও আছে। কারণ তাতে সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়, সেই চাপ অনুভব করে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তারা সক্রিয় হয়, তার ফলে অপরাধীদের পার পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।
কিন্তু এসব কিছুই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের ব্যাপার। তার আগের নয়।
আগে দেখা দরকার, মানুষ হিসেবে আমরা ঠিক আছি কি না, সুস্থ আছি কি না, মানবিক আছি কি না। এই জিজ্ঞাসা আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য, শুধু সুখী আক্তার, রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তারের স্বামীদের জন্য নয়। কারণ, তাঁরা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসেননি।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জালাল আহমেদের এই কথাগুলো বড্ড ক্লিনিক্যাল—নির্লিপ্ত, নিরাবেগ। আর যাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করতে গিয়ে তিনি কথাগুলো বলেছেন, সেই ২৪ বছর বয়সী গৃহবধূ সুখী আক্তারের বক্তব্যেও কোনো আবেগ টের পাওয়া যায় না। তিনি প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘টাকা দেওনের লাইগ্যা আগে থেইকাই মারধর করত। রোজার দিন। আমার মেয়েরে দোকানে পাঠাইয়্যা দেয়। প্রথমে আমার হাত বান্ধে। প্রথম ভাবি, আজকেও মারব। কিন্তু ওর দুই ভাই আর এক বইনও যখন আমারে ধরে তখন বুঝি, অন্য কিছু করব।’
সেই অন্য কিছু হলো একটা ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে সুখী আক্তারের চোখ আমূল উপড়ে ফেলা।
সুখীর নামটা এক নির্মম পরিহাস: তাঁর একটা চোখ উপড়ে ফেলেছেন তাঁরই স্বামী রবিউল ইসলাম। আর রবিউলকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর দুই ভাই ও এক বোন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যায় সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। সুখী আক্তারেরও নিশ্চয়ই সেই স্বপ্ন ছিল।
সুখীর উপড়ে ফেলা চোখটা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এক দর্শনীয় বস্তুর মর্যাদা পেয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকেরা চোখটি বোতলে ভরে রেখেছেন। সেখানকার আনসার কমান্ডার আবুল কাশেম প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেছেন, তিনি ও অন্য অনেকে সেই চোখ দেখেছেন। ‘অনেকে মোবাইলে ছবিও তুলছে।’—আবুল কাশেমের এই কথা সত্য হলে অচিরেই ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সুখীর ওপড়ানো চোখটির ছবি দর্শনীয় হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়।
টাকার দাবিতে প্রায়ই প্রহারকারী স্বামীর হাতে সুখী আক্তারের চোখ ওপড়ানোর ঘটনাটি ঘটেছে ঈদুল ফিতরের আনন্দোৎসবের ঠিক আগের দিন, শুক্রবার দুপুরে। আগ্রহী পাঠক এ বিষয়ে বিস্তারিত খবর পাবেন ২১ জুলাই মঙ্গলবারের প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। তাঁর ওপড়ানো চোখের জায়গায় একটা প্লাস্টিকের চোখ বসানো হয়েছে—এই খবর পাবেন পরদিনের প্রথম আলোয়।
দুই. তিন সন্তানের মা, ৩৫ বছরের গৃহবধূ রাবেয়া বশরি চেয়েছিলেন ঈদের দিনটি স্বামীসহ পরিবারের সবাই মিলে আনন্দে কাটাবেন। কিন্তু তাঁর স্বামী কবির মিয়া যাবেন জুয়া খেলতে। স্বামী জুয়ায় আসক্ত—রাবেয়া এটা জানেন। কিন্তু অন্তত ঈদের দিনটিতে স্বামী জুয়ার আসরে যাবেন না, এটুকুই চেয়েছিলেন রাবেয়া। তাই বাধা দিয়েছিলেন স্বামীকে। ফল ভালো হলো না: কবির মিয়া শোয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে পেটালেন রাবেয়াকে। রাবেয়া আধমরা হলে কবির পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে; কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন; ভীতসন্ত্রস্ত, কান্নারত ছেলেমেয়েদের বললেন তিনি তাদের মায়ের জন্য ওষুধ এনেছেন।
কিন্তু ওষুধ নয়, আধমরা স্ত্রীর মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কবির মিয়া। ১৫ বছরের একটি মেয়ে, সাত ও পাঁচ বছর বয়সী দুটি ছেলে রেখে মরে গেলেন রাবেয়া বশরি, ঈদুল ফিতরের দিন। মৌলভীবাজারের জুড়ীর কুলাউড়া পৌরসভার উছলাপাড়া এলাকায় ঘটেছে এই ঘটনা।
তিন. টাঙ্গাইলের গোপালপুরের নবগ্রাম দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আল্পনা আক্তার (৩৫) ও সোনা মিয়ার (৪৫) বিয়ে হয়েছে ১৮-২০ বছর আগে। দুই ছেলেমেয়ে, অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। ছেলেটি ছোট। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন ঢাকায়, পৃথক দুটি গার্মেন্টস কারখানায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন দুজনেই।
ঈদের পরদিন স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে গোসল করতে গেছেন গ্রামের পাশের ঝিনাই নদীতে। কিন্তু নদী থেকে সোনা মিয়া উঠে আসেন একা। কল্পনাকে তিনি নদী থেকে জীবিত উঠতে দেননি।
নদী থেকে কল্পনার লাশ উদ্ধার করেন গ্রামবাসী।
পুলিশ সোনা মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি পুলিশকে বলেছেন, কল্পনাকে তিনি নদীতে ডুবিয়ে মেরেছেন। কারণ, কল্পনার অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদক খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সোনা মিয়া ও কল্পনা আক্তারের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল অনেক দিন ধরে।
সেই ‘কলহ’ এমনই যে, অবশেষে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে গোসল করতে নেমে স্বামী আবির্ভূত হলেন যমের ভূমিকায়।
চার. সমাজবিজ্ঞানী, নারী অধিকার সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এই তিনটি ঘটনার বিবরণে ‘পারিবারিক সহিংসতা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো বলবে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’র কথা। সুখী আক্তারের ঘটনার পেছনে স্পষ্টতই যৌতুক নামের ‘সামাজিক অভিশাপ’ দেখতে পাওয়া যাবে। আর সোনা মিয়া ও আল্পনা আক্তারের ‘দাম্পত্য কলহ’ থেকে সোনা মিয়ার মধ্যে জন্ম নেওয়া ও ঘনিয়ে ওঠা ঈর্ষার কথা তো সোনা মিয়ার স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট।
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে যৌতুক, দাম্পত্য কলহ, ঈর্ষা, প্রেম-বিয়ের প্রত্যাখ্যান—এসব কারণ বাস্তবসম্মতভাবেই চিহ্নিত করা গেছে। এসব প্রবণতা দমন বা প্রশমনের জন্য আইনের প্রয়োগের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। আইন প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করাই প্রথম কর্তব্য বটে। তবে দুটো কর্তব্যেরই প্রয়োজন দেখা দেয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, তার আগে নয়। সুখী আক্তারের একটি চোখ উপড়ে ফেলার আগে তাঁর স্বামী রবিউলকে, রাবেয়া বশরিকে পিটিয়ে আধমরা করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে মেরে ফেলার আগে তাঁর জুয়াড়ি স্বামী কবির মিয়াকে, কিংবা আল্পনা আক্তারকে নদীর পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলার আগে তাঁর স্বামী সোনা মিয়াকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার প্রশ্ন ছিল না। আবার, এই তিন অপরাধীর বিচার ও শাস্তি হলেই সুখী আক্তার তাঁর একটি চোখ এবং রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তার তাঁদের প্রাণ ফিরে পাবেন না।
আমরা তাহলে কী করব?
রাষ্ট্রকে তার কাজ করতে হবে: আইনের সুষ্ঠু ও দক্ষ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ওই তিন পাষণ্ডকে শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত গড়তে হবে। যেন কেউ মনে করতে না পারে এই দেশে এ ধরনের নৃশংস অপরাধ করে অবলীলায় পার পাওয়া যায়। সমাজ-মনোবিজ্ঞানী ও অন্য বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন, বিচারহীনতার পরিবেশ নিষ্ঠুরতা বাড়ার প্রধান কারণ। এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, কিন্তু শেষ কথা নয়। শেষ কথাটা একটা গভীর প্রশ্ন: সুখী আক্তার, রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তারের সঙ্গে তাঁদের স্বামীরা যে আচরণ করেছেন তার স্বরূপ কী? নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা—এ ধরনের আরও যত শব্দ বাংলা ভাষায় আছে, তার কোনোটাই যথেষ্ট বলে মনে হয় না।
শুধু এই তিনটি ঘটনা নয়, এ রকম কিংবা এর থেকেও অনেক বেশি বিভীষিকাপূর্ণ অনেক ঘটনা এই দেশে ঘটে চলেছে। এবং তা শুধু নারীর ক্ষেত্রে নয়; নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-পেশা-বয়সনির্বিশেষে ঘটে চলেছে ভয়ংকর নানা অপরাধ। আমাদের সংবেদনশীলতাও হয়তো খানিক ভোঁতা হয়েছে, যদিও দর্শকসুলভ আহাজারির মাত্রা কমেনি। সুখী আক্তারের চোখ ওপড়ানোর ঘটনাটি আরও প্রচারিত হলে সিলেটের শিশু সামিউল হত্যাকাণ্ডের মতো দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় উঠতে পারে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুরু হতে পারে আবেগ প্রকাশের প্রতিযোগিতা। ঠিক আছে, তা হোক; দর্শকসুলভ আবেগেরও মূল্য আছে, দরকারও আছে। কারণ তাতে সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়, সেই চাপ অনুভব করে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তারা সক্রিয় হয়, তার ফলে অপরাধীদের পার পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।
কিন্তু এসব কিছুই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের ব্যাপার। তার আগের নয়।
আগে দেখা দরকার, মানুষ হিসেবে আমরা ঠিক আছি কি না, সুস্থ আছি কি না, মানবিক আছি কি না। এই জিজ্ঞাসা আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য, শুধু সুখী আক্তার, রাবেয়া বশরি ও আল্পনা আক্তারের স্বামীদের জন্য নয়। কারণ, তাঁরা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসেননি।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments