ধর্ষকদের বিরুদ্ধে লাঠ্যৌষধি by আব্দুল কাইয়ুম
খাস
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’! আর একটু ভদ্র বাংলায় বলে
‘লাঠ্যৌষধি’। প্রায় শতবর্ষ পুরোনো এক বাংলা অভিধানেও আমি এই লাঠ্যৌষধি
শব্দটি পেয়েছি। তার মানে, ওষুধটি বহু বছরের পরীক্ষিত। এটা যদি ফল না দিত,
তাহলে বনেদি অভিধানে এর উল্লেখ থাকত না। এখন যে হারে নারী নির্যাতন ও
ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই অপরাধীরা আইনের আওতার বাইরে
থেকে যাচ্ছে, বীরদর্পে সমাজে চলছে-ফিরছে, তাতে মনে হয় এই বাঙালি সমাজে
প্রচলিত ওষুধটি ছাড়া বোধ হয় কাজ হবে না।
তবে প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই, আক্ষরিক অর্থে এই ওষুধ প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে না। কোনো নাগরিকেরই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই। প্রকৃতপক্ষে, লাঠিপেটা না করেও লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করা চলে এবং তাতে ফলও পাওয়া যায়। আমাদের দেশেই ইদানীং এ রকম কিছু মোক্ষম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। সে কথাতেই আসছি।
পুলিশ যখন নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের ধরল না, অথবা পুলিশের ভাষায়, কারও সহায়তা না পাওয়ায় ধরতে পারল না, তখন সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। কারণ ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা তো কিছু সাহস দেখিয়ে অন্তত একজন নির্যাতনকারীকে পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ‘পালিয়ে’ গেল! তারপর প্রতিবাদ করতে গেলে ছাত্র-তরুণদের বিভিন্ন সময়ে পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হয়েছে।
মানুষের প্রতিবাদ চলতে থাকায় একপর্যায়ে পুলিশ সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু বখাটের ছবি ছাপিয়ে ওই অপরাধীদের ‘ধরিয়ে দিলে পুরস্কার’ ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। আজ পর্যন্ত কাউকে ধরা হয়নি, কেউ তাদের ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার লাভও করেনি। এটা পরিষ্কার যে লোক দেখানো পদক্ষেপে কোনো কাজ হবে না।
এ অবস্থায় দেশের নাগরিক সমাজের নেতা ও সমাজের বিবেক বলে সমাদৃত বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বিবৃতি দিলেন, প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। খুবই অবাক ব্যাপার! এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম ধারণা হতে পারে যে ওই বখাটেরা বোধ হয় ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট কেউ হবে। সে জন্যই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে! সরকারের জন্য এ রকম পরিস্থিতি বিব্রতকর।
পুলিশ তো এতটা অক্ষম নয়। তারা সমাজবিরোধী অপরাধীদের টপাটপ ধরে ফেলছে। আইএসের সমন্বয়কারী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অনায়াসে ধরে ফেলছে। জাল টাকার ব্যবসায়ী, ইন্টারনেটে হুমকিদাতাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে তাদের জুড়ি
নেই। পুলিশের এই সাফল্য ছোট করে দেখা যায় না। বিলেত-আমেরিকাও বাংলাদেশে উগ্রবাদী জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের প্রশংসা করছে। প্রকৃত দক্ষতা না থাকলে এ রকম প্রশংসাপত্র পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কেন আজও সেই নববর্ষে নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের কাউকে ধারা গেল না? কেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না?
এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে বখাটেদের উৎসাহিত করে। ওরা সুযোগ পেয়ে নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো আরও জোরেশোরে চালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। পত্রপত্রিকা খুললে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের খবর দেখা যায়। প্রলোভন দেখিয়ে বন্ধুর বাসায় নিয়ে কোনো নারীকে গণধর্ষণ, সেই সব ছবি মুঠোফোনে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এটা উদ্বেগজনক।
কোনো কোনো ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিচার ঝুলে থাকে। দুর্বলভাবে মামলা সাজানো হয় বলে অপরাধীদের সাজা হয় না। একসময় আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখায়। মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে।
তাহলে কি এই সামাজিক অরাজকতা নির্বিবাদে চলতেই থাকবে? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজাকার-আলবদরেরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন চালিয়েছিল, আজ ৪৪ বছর পর তাদের বিচারের রায় হচ্ছে, রায় কার্যকর হচ্ছে। রক্তস্নাত সেই স্বাধীন বাংলাদেশে আজ কিছু সমাজবিরোধী বখাটে নারী নির্যাতন করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
তাহলে উপায় কী? উপায় একটা আছে। সর্বত্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ১৯৮৩-৮৪ সালে এরশাদের সামরিক শাসনের সময় মেয়েদের বিভিন্ন স্কুলের আশপাশে বখাটেদের অত্যাচার বেড়ে উঠেছিল। সে সময় এলাকার ছাত্র-তরুণ-যুবকেরা কমিটি গঠন করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এলাকায় এলাকায় সেই কমিটির উদ্যোগে সমাবেশ করে বখাটেদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়। তখন আমাদের হাতে লাঠি ছিল না, কিন্তু বুকে ছিল বখাটে দমনের দৃঢ় প্রত্যয়। সেটা টের পেয়ে সেদিন বখাটেরা কেটে পড়েছিল। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ থানা-পুলিশকেও সহায়তা করে। বখাটেদের কাছে একটা বিপৎসংকেত যায়। তারা বুঝতে পারে, মেয়েদের নির্যাতন করে ছাড় পাওয়া যাবে না।
যারা নারী ধর্ষণ–নির্যাতন করে, তাদের কোনো দল নেই। তারা সমাজের নিকৃষ্ট অপরাধী। তাদের অনাচার বন্ধ করতে নাটোরের লাঠি–বাঁশির মতো লাঠ্যৌষধি দরকার উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে কিছুদিন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। রাতে কিছু এলাকায় চুরি-ডাকাতির অভিযোগ আসতে থাকে। কয়েকটি এলাকায় জনমনে ভয়ভীতি ছড়ানোর জন্য একটি মহল তৎপর হয়ে ওঠে। তখন অবশ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল বিরল। কিন্তু অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সেই সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ও পাড়া-মহল্লায় সামাজিক প্রতিরোধ টিম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ ছাত্র ঢাকায় অন্যান্য এলাকার মতো আমাদের মহল্লায়ও একটি প্রতিরোধ ব্রিগেড গড়ে তুলি। পাড়ার মুরব্বিরাও এগিয়ে আসেন। একজন নিজের বাসার গ্যারেজে সমন্বয়কেন্দ্র গড়ে তোলার সুযোগ করে দেন। আমরা সারা রাত বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে নিজেদের মহল্লা সুরক্ষার ব্যবস্থা করি। থানার পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবেই এই সামাজিক প্রতিরোধব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা সেদিন রেখেছিল।
কেউ হয়তো বলবেন, সেসব পুরোনো দিনের কথা। তখন ছিল বিপ্লবী পরিস্থিতি। আজ ওসব হবে-টবে না। কিন্তু না, জীবনে সাফল্য লাভের কোনো ঘটনাই কখনো তাৎপর্যহীন হয়ে যায় না। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে।
ধরা যাক ইদানীংকালে নাটোরের ‘লাঠি-বাঁশি কর্মসূচির’ কথা। নাটোরে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এলাকার ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের সমন্বয়ে শুরু হয় ‘লাঠি-বাঁশি কর্মসূচি’। নেতৃত্বে ছিলেন মো. আব্দুস সালাম। গতকাল তাঁর সঙ্গে আমি মুঠোফোনে কথা বলি। তিনি বলেন, ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে এই কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে। সময়টি লক্ষ করুন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শুরু আর পরবর্তী বিএনপি সরকারের সময় চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন। কৌশলটি খুব সহজ। সবার হাতের কাছে লাঠি ও বাঁশি মজুত থাকে। কেউ চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাস করতে এলে আক্রান্ত ব্যক্তি বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করেন। সবাই রাস্তায় নেমে আসেন। অপরাধী পালানোর পথ পায় না। আব্দুস সালাম বলেন, সমিতির কর্মসূচি এখনো চলছে। এখনো কোথাও ডাকাতি হলে বাঁশি বেজে ওঠে। এলাকা এখন শান্ত।
প্রশাসনও নাটোরের লাঠি–বাঁশি কর্মসূচিকে উচ্চ মূল্যায়ন করে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নাটোরের বিদায়ী পুলিশ সুপার সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য লাঠি–বাঁশি কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ২০০০ সালে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার উত্তরাঞ্চলীয় ১৬টি জেলায় লাঠি–বাঁশি কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন বলে সালাম সাহেব জানান।
আজ যারা নারী ধর্ষণ-নির্যাতন করে, তাদের কোনো দল নেই। তারা সমাজের নিকৃষ্ট অপরাধী। তাদের অনাচার বন্ধ করতে নাটোরের লাঠি–বাঁশির মতো লাঠ্যৌষধি দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail. com
তবে প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই, আক্ষরিক অর্থে এই ওষুধ প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে না। কোনো নাগরিকেরই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই। প্রকৃতপক্ষে, লাঠিপেটা না করেও লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করা চলে এবং তাতে ফলও পাওয়া যায়। আমাদের দেশেই ইদানীং এ রকম কিছু মোক্ষম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। সে কথাতেই আসছি।
পুলিশ যখন নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের ধরল না, অথবা পুলিশের ভাষায়, কারও সহায়তা না পাওয়ায় ধরতে পারল না, তখন সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। কারণ ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা তো কিছু সাহস দেখিয়ে অন্তত একজন নির্যাতনকারীকে পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ‘পালিয়ে’ গেল! তারপর প্রতিবাদ করতে গেলে ছাত্র-তরুণদের বিভিন্ন সময়ে পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হয়েছে।
মানুষের প্রতিবাদ চলতে থাকায় একপর্যায়ে পুলিশ সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু বখাটের ছবি ছাপিয়ে ওই অপরাধীদের ‘ধরিয়ে দিলে পুরস্কার’ ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। আজ পর্যন্ত কাউকে ধরা হয়নি, কেউ তাদের ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার লাভও করেনি। এটা পরিষ্কার যে লোক দেখানো পদক্ষেপে কোনো কাজ হবে না।
এ অবস্থায় দেশের নাগরিক সমাজের নেতা ও সমাজের বিবেক বলে সমাদৃত বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বিবৃতি দিলেন, প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। খুবই অবাক ব্যাপার! এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম ধারণা হতে পারে যে ওই বখাটেরা বোধ হয় ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট কেউ হবে। সে জন্যই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে! সরকারের জন্য এ রকম পরিস্থিতি বিব্রতকর।
পুলিশ তো এতটা অক্ষম নয়। তারা সমাজবিরোধী অপরাধীদের টপাটপ ধরে ফেলছে। আইএসের সমন্বয়কারী জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অনায়াসে ধরে ফেলছে। জাল টাকার ব্যবসায়ী, ইন্টারনেটে হুমকিদাতাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে তাদের জুড়ি
নেই। পুলিশের এই সাফল্য ছোট করে দেখা যায় না। বিলেত-আমেরিকাও বাংলাদেশে উগ্রবাদী জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের প্রশংসা করছে। প্রকৃত দক্ষতা না থাকলে এ রকম প্রশংসাপত্র পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কেন আজও সেই নববর্ষে নারী নির্যাতনকারী বখাটেদের কাউকে ধারা গেল না? কেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না?
এ ধরনের পরিস্থিতি সমাজে বখাটেদের উৎসাহিত করে। ওরা সুযোগ পেয়ে নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো আরও জোরেশোরে চালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। পত্রপত্রিকা খুললে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের খবর দেখা যায়। প্রলোভন দেখিয়ে বন্ধুর বাসায় নিয়ে কোনো নারীকে গণধর্ষণ, সেই সব ছবি মুঠোফোনে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এটা উদ্বেগজনক।
কোনো কোনো ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিচার ঝুলে থাকে। দুর্বলভাবে মামলা সাজানো হয় বলে অপরাধীদের সাজা হয় না। একসময় আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখায়। মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে।
তাহলে কি এই সামাজিক অরাজকতা নির্বিবাদে চলতেই থাকবে? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজাকার-আলবদরেরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন চালিয়েছিল, আজ ৪৪ বছর পর তাদের বিচারের রায় হচ্ছে, রায় কার্যকর হচ্ছে। রক্তস্নাত সেই স্বাধীন বাংলাদেশে আজ কিছু সমাজবিরোধী বখাটে নারী নির্যাতন করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
তাহলে উপায় কী? উপায় একটা আছে। সর্বত্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ১৯৮৩-৮৪ সালে এরশাদের সামরিক শাসনের সময় মেয়েদের বিভিন্ন স্কুলের আশপাশে বখাটেদের অত্যাচার বেড়ে উঠেছিল। সে সময় এলাকার ছাত্র-তরুণ-যুবকেরা কমিটি গঠন করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এলাকায় এলাকায় সেই কমিটির উদ্যোগে সমাবেশ করে বখাটেদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়। তখন আমাদের হাতে লাঠি ছিল না, কিন্তু বুকে ছিল বখাটে দমনের দৃঢ় প্রত্যয়। সেটা টের পেয়ে সেদিন বখাটেরা কেটে পড়েছিল। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ থানা-পুলিশকেও সহায়তা করে। বখাটেদের কাছে একটা বিপৎসংকেত যায়। তারা বুঝতে পারে, মেয়েদের নির্যাতন করে ছাড় পাওয়া যাবে না।
যারা নারী ধর্ষণ–নির্যাতন করে, তাদের কোনো দল নেই। তারা সমাজের নিকৃষ্ট অপরাধী। তাদের অনাচার বন্ধ করতে নাটোরের লাঠি–বাঁশির মতো লাঠ্যৌষধি দরকার উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে কিছুদিন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। রাতে কিছু এলাকায় চুরি-ডাকাতির অভিযোগ আসতে থাকে। কয়েকটি এলাকায় জনমনে ভয়ভীতি ছড়ানোর জন্য একটি মহল তৎপর হয়ে ওঠে। তখন অবশ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল বিরল। কিন্তু অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সেই সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ও পাড়া-মহল্লায় সামাজিক প্রতিরোধ টিম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। তখন আমরা কয়েকজন তরুণ ছাত্র ঢাকায় অন্যান্য এলাকার মতো আমাদের মহল্লায়ও একটি প্রতিরোধ ব্রিগেড গড়ে তুলি। পাড়ার মুরব্বিরাও এগিয়ে আসেন। একজন নিজের বাসার গ্যারেজে সমন্বয়কেন্দ্র গড়ে তোলার সুযোগ করে দেন। আমরা সারা রাত বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে নিজেদের মহল্লা সুরক্ষার ব্যবস্থা করি। থানার পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবেই এই সামাজিক প্রতিরোধব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা সেদিন রেখেছিল।
কেউ হয়তো বলবেন, সেসব পুরোনো দিনের কথা। তখন ছিল বিপ্লবী পরিস্থিতি। আজ ওসব হবে-টবে না। কিন্তু না, জীবনে সাফল্য লাভের কোনো ঘটনাই কখনো তাৎপর্যহীন হয়ে যায় না। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে।
ধরা যাক ইদানীংকালে নাটোরের ‘লাঠি-বাঁশি কর্মসূচির’ কথা। নাটোরে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এলাকার ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের সমন্বয়ে শুরু হয় ‘লাঠি-বাঁশি কর্মসূচি’। নেতৃত্বে ছিলেন মো. আব্দুস সালাম। গতকাল তাঁর সঙ্গে আমি মুঠোফোনে কথা বলি। তিনি বলেন, ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে এই কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে। সময়টি লক্ষ করুন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শুরু আর পরবর্তী বিএনপি সরকারের সময় চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন। কৌশলটি খুব সহজ। সবার হাতের কাছে লাঠি ও বাঁশি মজুত থাকে। কেউ চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাস করতে এলে আক্রান্ত ব্যক্তি বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করেন। সবাই রাস্তায় নেমে আসেন। অপরাধী পালানোর পথ পায় না। আব্দুস সালাম বলেন, সমিতির কর্মসূচি এখনো চলছে। এখনো কোথাও ডাকাতি হলে বাঁশি বেজে ওঠে। এলাকা এখন শান্ত।
প্রশাসনও নাটোরের লাঠি–বাঁশি কর্মসূচিকে উচ্চ মূল্যায়ন করে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নাটোরের বিদায়ী পুলিশ সুপার সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য লাঠি–বাঁশি কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ২০০০ সালে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার উত্তরাঞ্চলীয় ১৬টি জেলায় লাঠি–বাঁশি কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন বলে সালাম সাহেব জানান।
আজ যারা নারী ধর্ষণ-নির্যাতন করে, তাদের কোনো দল নেই। তারা সমাজের নিকৃষ্ট অপরাধী। তাদের অনাচার বন্ধ করতে নাটোরের লাঠি–বাঁশির মতো লাঠ্যৌষধি দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail. com
No comments