সাইবার জগতেও চাই বাকস্বাধীনতা by কামাল আহমেদ
বাংলাদেশে
আমরা যাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি, তাঁদের কাউকেই মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার
নেই যে দৈনিক কত অপ্রয়োজনীয় বার্তা আমাদের বিরক্তির কারণ হয়। শুধু যে
লিখিত বার্তা (টেক্সট) তা নয়, ধারণকৃত বাণীও (ভয়েস মেইল) কম নয়। এঁদের কেউ
বেচতে চান মোবাইলের রিংটোন, কেউ কম দামে বাড়ি, জমি, কাপড়, রেস্তোরাঁর খাবার
ইত্যাদি। এসব পণ্য ও সেবা বিক্রেতার কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার কারণ হচ্ছে
আমরা সেবা কেনার সময় তাঁদের আমাদের টেলিফোন নম্বর দিয়েছি। ফলে সময়ে-সময়ে
তাঁরা তাঁদের পণ্য বা সেবার কথা জানান দিতে আমাদের বার্তা পাঠান। কিন্তু
দৈনিক যেসব অগুনতি বার্তা আসে, সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গেই হয়তো আমাদের কোনো
দিন কোনো যোগাযোগ হয়নি (আমার ক্ষেত্রে পরিমাণটা ৯০ শতাংশের বেশি)। স্বভাবতই
প্রশ্ন ওঠে, ওই সব কোম্পানি বা ব্যক্তি আমাদের নম্বর কোত্থেকে পেলেন? আমার
টেলিফোন নম্বরটি আমার অজান্তে এবং সম্মতি ছাড়াই অন্যের কাছে হস্তান্তর
হওয়া কি আমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন নয়?
এই বিড়ম্বনার অন্য আরও সূত্র আছে। যেমন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি বা তাদের পক্ষের এজেন্ট বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিভেদে কার্ডের ঋণসীমার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা বিক্রেতারা দিন-রাত আমাদের মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠাচ্ছেন। প্লাটিনাম কার্ডের গ্রাহক হলে ইউরোপ-আমেরিকায় ভ্রমণের প্যাকেজসহ নানা ধরনের বিলাসিতার বিষয়ে তথ্য। আর ঋণসীমা বেশি না হলে দেশের ভেতরের নানা পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন। সোজাকথায় এর অর্থ হচ্ছে আমি গরিব না ধনী, নাকি মধ্যবিত্ত সেই তথ্য আমার অগোচরে বড় বড় কোম্পানিগুলোর হাতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু কীভাবে এটা ঘটছে এবং কত দূর পর্যন্ত এটা বিস্তৃত হতে দেওয়া উচিত অথবা অনুচিত, সে প্রশ্নে আমাদের কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
দেশের আইন বলছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সাংবিধানিক অধিকার এবং তা বেআইনিভাবে লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ। আমাদের এসব ব্যক্তিগত তথ্যে আইনগত নাক গলানোর কিছু অধিকার অবশ্য রয়েছে রাষ্ট্রের। অর্থাৎ যুক্তিসংগত কারণে এবং আইনগত অনুমোদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারীরা এসব তথ্য চাইতে ও পেতে পারেন। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যাতে আবার রাজনৈতিক কারণে তার ক্ষমতা অপব্যবহার না করে, সে জন্য ন্যূনতম সুরক্ষাও থাকার কথা। সে ধরনের সুরক্ষা যে নেই সেটা বলাই বাহুল্য। বরং নিরাপত্তা বাহিনীর এই ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, ক্রিকেট তারকা, অভিনেত্রী ও ব্যবসায়ীদের টেলিফোন সংলাপের রেকর্ড প্রকাশ এখন নৈমিত্তিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। সরকারের সমালোচনার জন্য যাঁরা পরিচিত, তাঁরা এখন আর টেলিফোনে কোনো আলোচনা ও মন্তব্য করতে চান না। আর বিরোধী রাজনীতিকদের নাকি দলীয়ভাবেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে টেলিফোনে স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে তাঁরা যেন কথা না বলেন। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত টুঁ শব্দও করেনি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাদের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা কি আইনের বাইরে যেতে পারে? অবশ্য বলা ভালো, কোনো কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা যে টেলিফোনে আড়ি পাতা কিংবা ইন্টারনেটে নজরদারির ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে, তার কারণটা রাজনৈতিক। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষকে হেয় করার রাজনীতি থেকে শিগগির আমাদের মুক্তি নেই। কেননা, বিটিআরসির মতো প্রতিষ্ঠানের যে সংসদের কাছে জবাবদিহি করার কথা, সেই ‘অনির্বাচিত’ সংসদ হলো বিরোধী দলহীন, যেখানে আর যা-ই হোক কারও জবাবদিহি আশা করা যায় না।
মোবাইল ফোনের প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটি শুরু করার কারণ রয়েছে। বিটিআরসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটির সামান্য বেশি। আর এঁদের মধ্যে ৪ কোটি ৪২ লাখই মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগের গ্রাহক। হতে পারে, এঁদের অনেকে ডেস্কটপ বা পিসিই ব্যবহার করছেন, কিন্তু সংযোগটা মোবাইল নেটওয়ার্কের। তবে সংযোগ যা-ই হোক, ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আগের আইন যথেষ্ট নয়, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সরকার নতুন সাইবার আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ‘অনির্বাচিত’ সংসদের যুগে সরকারের ইচ্ছাই তো শেষ কথা। কথিত জনমত সংগ্রহের উদ্যোগও যে সরকারের সমালোচনা এড়ানোর কৌশলমাত্র, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগেও বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে এ ধরনের জনমত সংগ্রহের সুযোগ দিতে দেখা গেলেও সেগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের মতামত উপেক্ষিতই থেকে গেছে। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ঠিক করার দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আমাদের ই-মেইল, আমাদের সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কগুলোতে বিচরণ সবকিছুর ওপর রাষ্ট্র যুক্তিসংগত কারণে আইনগত অনুমোদন নিয়ে নজরদারি করলে সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি অথবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতার নামে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিছুতেই মানা যায় না। রাজনীতিকদের নিয়ে ব্যঙ্গ-কার্টুন করার চল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং তা সারা বিশ্বেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃত। অথচ আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনদের নিয়ে অনলাইনে ব্যঙ্গচিত্র বা প্যারোডি প্রকাশ করলে গন্তব্য হয় কারাগার। এখন আবার নতুন সাইবার আইনে প্রস্তাব করা হচ্ছে, বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ক্ষতিকর’ কিছু সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। ধরা যাক, আমি সুন্দরবনকে রক্ষার স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি, ওই প্রকল্প আমাদের হৃৎপিণ্ডের অক্সিজেন শুষে নিয়ে এ দেশের প্রকৃতিকে অসুস্থ করে ফেলবে। কিন্তু ওই প্রকল্পে যেহেতু বন্ধুরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেহেতু আমার রামপাল প্রকল্প-সম্পর্কিত মতামতকে আমাদের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সাইবার অপরাধ হিসেবে অভিহিত করলে তার প্রতিকার পাব কোথায়? এখন তো আবার নতুন আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী চাইলে দরজা-জানালা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।
এই আইনকে কঠোরতর করার উদ্যোগ নিয়ে যখন সরকার এগোচ্ছে, সে সময়ে জেনেভায় চলছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন। ওই অধিবেশনে জাতিসংঘ সুস্পষ্ট করে বলেছে, কিছু রাষ্ট্র ইন্টারনেটকে শত্রু মনে করে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে প্রবেশাধিকার বন্ধের চেষ্টা হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন। অনলাইনে ব্যক্তির গোপনীয়তা সুরক্ষা এবং মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কে ১৮ জুন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বলেন যে অপরাধীরা সুবিধা নিতে পারে, এই ঝুঁকি সত্ত্বেও অনলাইন ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন।
ব্লগার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা যখন বাস্তব জগতের তুলনায় ডিজিটাল জগতে অনেক বেশি হয়রানির মুখোমুখি হন, তখন ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। এই যুক্তি তুলে ধরে ডেভিড কে সরকারগুলোর প্রতি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তথ্য এনক্রিপ্ট করার ধারণা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। এই এনক্রিপশন ব্যবস্থায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী পরিচয় গোপন রাখার সুবিধা পান। বিভিন্ন নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষকদের অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারে এই কৌশল অনুসরণ করেন। তবে সরকারগুলো এই এনক্রিপশনের বিরোধিতা করে বলছে যে এ ধরনের ব্যবস্থা অপরাধী ও সন্ত্রাসবাদী চক্রগুলোকে নিরাপত্তা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে চলার সুবিধা করে দেবে। ডেভিড কে বলেন যে তিনি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি বা তা তদন্ত করার বিরুদ্ধে নন, তবে তা হতে হবে আদালতের অনুমোদনক্রমে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায় কাজ করা সাবেক গোয়েন্দা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যসূত্রে আমরা এখন জানি যে পাশ্চাত্যের সরকারগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম্পিউটারের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্র স্থাপনে বাধ্য করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে, যাতে সেই কম্পিউটার ব্যবহারকারীর অনলাইনের সব গতিবিধি বা কার্যক্রমে গোপনে নজরদারি করা যায়। ডেভিড কে ওই সরকারগুলোর উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলছেন যে কম্পিউটার প্রস্তুতকারকদের যদি ব্যবহারকারীর তথ্য গোপনে সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য করা হয়, তাহলে বেপরোয়া বা নির্যাতনকারী সরকারগুলো ওই সব তথ্যের অপব্যবহার করবে। আমাদের সরকার এ দেশে যেসব কম্পিউটার ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর নির্মাতাদের এমন কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্যে এনেছে কি না, আমরা জানি না। তবে এ দেশেও অনলাইনভিত্তিক স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
সরকারের কাছে অবশ্য বেশ জোরালো একটি যুক্তি আছে। আর তা হলো, সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ ও ব্যবস্থা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য বিশ্বের নানা দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তির নানা সরঞ্জাম ক্রয়ে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যে বেশ সচেষ্ট, সে কথা আমরা জানি। অবশ্য সেটাও জানা গেছে, প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি নাগরিক অধিকার সংগঠনের তৎপরতায় সুইচ সরকার র্যাবের এ ধরনের একটি ক্রয় উদ্যোগ আটকে দেওয়ার খবরে। ওই নাগরিক সংগঠনটি বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির তুলে ধরে ওই প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিরোধিতা করে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীর কৌশল ও চাহিদা সম্পর্কে জাতিসংঘ র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কে বলছেন, সন্ত্রাসীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের আশঙ্কা যেভাবে দেখানো হয়, তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ওসামা বিন লাদেনের লুকিয়ে থাকার বাড়িটিতে অভিযানের পর যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেল সেখানে পেনড্রাইভের মতো জিনিস ছিল, যেগুলো বাহক মারফত আনা-নেওয়া হতো। তিনি বলছেন সন্ত্রাসবাদীরা অতটা কাঁচা নয় যে তারা মনে করবে অনলাইন ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করলে সেগুলো গোপন রাখা সম্ভব হবে। ডেভিড কে তাই মানবাধিকার হিসেবে অনলাইনে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বৈশ্বিক সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। এই বিতর্ক পাশ কাটিয়ে আমাদের দেশে নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন তৈরি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কারণ, আমরাও চাই সাইবার জগতে বাকস্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। ব্লগিংয়ের জন্য যেমন জঙ্গি ঘাতকের হামলার শিকার হতে চাই না, তেমনি রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও মেনে নিতে পারি না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
এই বিড়ম্বনার অন্য আরও সূত্র আছে। যেমন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি বা তাদের পক্ষের এজেন্ট বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিভেদে কার্ডের ঋণসীমার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা বিক্রেতারা দিন-রাত আমাদের মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠাচ্ছেন। প্লাটিনাম কার্ডের গ্রাহক হলে ইউরোপ-আমেরিকায় ভ্রমণের প্যাকেজসহ নানা ধরনের বিলাসিতার বিষয়ে তথ্য। আর ঋণসীমা বেশি না হলে দেশের ভেতরের নানা পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন। সোজাকথায় এর অর্থ হচ্ছে আমি গরিব না ধনী, নাকি মধ্যবিত্ত সেই তথ্য আমার অগোচরে বড় বড় কোম্পানিগুলোর হাতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু কীভাবে এটা ঘটছে এবং কত দূর পর্যন্ত এটা বিস্তৃত হতে দেওয়া উচিত অথবা অনুচিত, সে প্রশ্নে আমাদের কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
দেশের আইন বলছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সাংবিধানিক অধিকার এবং তা বেআইনিভাবে লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ। আমাদের এসব ব্যক্তিগত তথ্যে আইনগত নাক গলানোর কিছু অধিকার অবশ্য রয়েছে রাষ্ট্রের। অর্থাৎ যুক্তিসংগত কারণে এবং আইনগত অনুমোদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারীরা এসব তথ্য চাইতে ও পেতে পারেন। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যাতে আবার রাজনৈতিক কারণে তার ক্ষমতা অপব্যবহার না করে, সে জন্য ন্যূনতম সুরক্ষাও থাকার কথা। সে ধরনের সুরক্ষা যে নেই সেটা বলাই বাহুল্য। বরং নিরাপত্তা বাহিনীর এই ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, ক্রিকেট তারকা, অভিনেত্রী ও ব্যবসায়ীদের টেলিফোন সংলাপের রেকর্ড প্রকাশ এখন নৈমিত্তিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। সরকারের সমালোচনার জন্য যাঁরা পরিচিত, তাঁরা এখন আর টেলিফোনে কোনো আলোচনা ও মন্তব্য করতে চান না। আর বিরোধী রাজনীতিকদের নাকি দলীয়ভাবেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে টেলিফোনে স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে তাঁরা যেন কথা না বলেন। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত টুঁ শব্দও করেনি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাদের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা কি আইনের বাইরে যেতে পারে? অবশ্য বলা ভালো, কোনো কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা যে টেলিফোনে আড়ি পাতা কিংবা ইন্টারনেটে নজরদারির ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে, তার কারণটা রাজনৈতিক। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষকে হেয় করার রাজনীতি থেকে শিগগির আমাদের মুক্তি নেই। কেননা, বিটিআরসির মতো প্রতিষ্ঠানের যে সংসদের কাছে জবাবদিহি করার কথা, সেই ‘অনির্বাচিত’ সংসদ হলো বিরোধী দলহীন, যেখানে আর যা-ই হোক কারও জবাবদিহি আশা করা যায় না।
মোবাইল ফোনের প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটি শুরু করার কারণ রয়েছে। বিটিআরসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটির সামান্য বেশি। আর এঁদের মধ্যে ৪ কোটি ৪২ লাখই মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগের গ্রাহক। হতে পারে, এঁদের অনেকে ডেস্কটপ বা পিসিই ব্যবহার করছেন, কিন্তু সংযোগটা মোবাইল নেটওয়ার্কের। তবে সংযোগ যা-ই হোক, ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আগের আইন যথেষ্ট নয়, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সরকার নতুন সাইবার আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ‘অনির্বাচিত’ সংসদের যুগে সরকারের ইচ্ছাই তো শেষ কথা। কথিত জনমত সংগ্রহের উদ্যোগও যে সরকারের সমালোচনা এড়ানোর কৌশলমাত্র, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগেও বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে এ ধরনের জনমত সংগ্রহের সুযোগ দিতে দেখা গেলেও সেগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের মতামত উপেক্ষিতই থেকে গেছে। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ঠিক করার দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আমাদের ই-মেইল, আমাদের সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কগুলোতে বিচরণ সবকিছুর ওপর রাষ্ট্র যুক্তিসংগত কারণে আইনগত অনুমোদন নিয়ে নজরদারি করলে সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি অথবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতার নামে স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিছুতেই মানা যায় না। রাজনীতিকদের নিয়ে ব্যঙ্গ-কার্টুন করার চল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং তা সারা বিশ্বেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃত। অথচ আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনদের নিয়ে অনলাইনে ব্যঙ্গচিত্র বা প্যারোডি প্রকাশ করলে গন্তব্য হয় কারাগার। এখন আবার নতুন সাইবার আইনে প্রস্তাব করা হচ্ছে, বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ক্ষতিকর’ কিছু সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা যাবে না। ধরা যাক, আমি সুন্দরবনকে রক্ষার স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি, ওই প্রকল্প আমাদের হৃৎপিণ্ডের অক্সিজেন শুষে নিয়ে এ দেশের প্রকৃতিকে অসুস্থ করে ফেলবে। কিন্তু ওই প্রকল্পে যেহেতু বন্ধুরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেহেতু আমার রামপাল প্রকল্প-সম্পর্কিত মতামতকে আমাদের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সাইবার অপরাধ হিসেবে অভিহিত করলে তার প্রতিকার পাব কোথায়? এখন তো আবার নতুন আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী চাইলে দরজা-জানালা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।
এই আইনকে কঠোরতর করার উদ্যোগ নিয়ে যখন সরকার এগোচ্ছে, সে সময়ে জেনেভায় চলছে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন। ওই অধিবেশনে জাতিসংঘ সুস্পষ্ট করে বলেছে, কিছু রাষ্ট্র ইন্টারনেটকে শত্রু মনে করে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে প্রবেশাধিকার বন্ধের চেষ্টা হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন। অনলাইনে ব্যক্তির গোপনীয়তা সুরক্ষা এবং মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কে ১৮ জুন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বলেন যে অপরাধীরা সুবিধা নিতে পারে, এই ঝুঁকি সত্ত্বেও অনলাইন ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন।
ব্লগার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা যখন বাস্তব জগতের তুলনায় ডিজিটাল জগতে অনেক বেশি হয়রানির মুখোমুখি হন, তখন ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। এই যুক্তি তুলে ধরে ডেভিড কে সরকারগুলোর প্রতি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তথ্য এনক্রিপ্ট করার ধারণা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। এই এনক্রিপশন ব্যবস্থায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী পরিচয় গোপন রাখার সুবিধা পান। বিভিন্ন নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষকদের অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারে এই কৌশল অনুসরণ করেন। তবে সরকারগুলো এই এনক্রিপশনের বিরোধিতা করে বলছে যে এ ধরনের ব্যবস্থা অপরাধী ও সন্ত্রাসবাদী চক্রগুলোকে নিরাপত্তা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে চলার সুবিধা করে দেবে। ডেভিড কে বলেন যে তিনি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি বা তা তদন্ত করার বিরুদ্ধে নন, তবে তা হতে হবে আদালতের অনুমোদনক্রমে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায় কাজ করা সাবেক গোয়েন্দা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যসূত্রে আমরা এখন জানি যে পাশ্চাত্যের সরকারগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম্পিউটারের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্র স্থাপনে বাধ্য করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে, যাতে সেই কম্পিউটার ব্যবহারকারীর অনলাইনের সব গতিবিধি বা কার্যক্রমে গোপনে নজরদারি করা যায়। ডেভিড কে ওই সরকারগুলোর উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলছেন যে কম্পিউটার প্রস্তুতকারকদের যদি ব্যবহারকারীর তথ্য গোপনে সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য করা হয়, তাহলে বেপরোয়া বা নির্যাতনকারী সরকারগুলো ওই সব তথ্যের অপব্যবহার করবে। আমাদের সরকার এ দেশে যেসব কম্পিউটার ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর নির্মাতাদের এমন কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্যে এনেছে কি না, আমরা জানি না। তবে এ দেশেও অনলাইনভিত্তিক স্কাইপ কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
সরকারের কাছে অবশ্য বেশ জোরালো একটি যুক্তি আছে। আর তা হলো, সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ ও ব্যবস্থা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য বিশ্বের নানা দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তির নানা সরঞ্জাম ক্রয়ে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যে বেশ সচেষ্ট, সে কথা আমরা জানি। অবশ্য সেটাও জানা গেছে, প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি নাগরিক অধিকার সংগঠনের তৎপরতায় সুইচ সরকার র্যাবের এ ধরনের একটি ক্রয় উদ্যোগ আটকে দেওয়ার খবরে। ওই নাগরিক সংগঠনটি বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির তুলে ধরে ওই প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিরোধিতা করে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীর কৌশল ও চাহিদা সম্পর্কে জাতিসংঘ র্যাপোর্টিয়ার ডেভিড কে বলছেন, সন্ত্রাসীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের আশঙ্কা যেভাবে দেখানো হয়, তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ওসামা বিন লাদেনের লুকিয়ে থাকার বাড়িটিতে অভিযানের পর যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেল সেখানে পেনড্রাইভের মতো জিনিস ছিল, যেগুলো বাহক মারফত আনা-নেওয়া হতো। তিনি বলছেন সন্ত্রাসবাদীরা অতটা কাঁচা নয় যে তারা মনে করবে অনলাইন ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করলে সেগুলো গোপন রাখা সম্ভব হবে। ডেভিড কে তাই মানবাধিকার হিসেবে অনলাইনে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বৈশ্বিক সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। এই বিতর্ক পাশ কাটিয়ে আমাদের দেশে নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন তৈরি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কারণ, আমরাও চাই সাইবার জগতে বাকস্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। ব্লগিংয়ের জন্য যেমন জঙ্গি ঘাতকের হামলার শিকার হতে চাই না, তেমনি রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও মেনে নিতে পারি না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments