প্রবাস জীবনের প্রথম সকাল by জাবির আল ফাতাহ
কোপেনহেগেন বিমানবন্দর |
অনেক
বছর হলো দেশের বাইরে আছি | প্রবাস জীবনের প্রথম দিনটি সবার জীবনেই একটি
স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকে | ইচ্ছে করে ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না | আমার
ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে এটাই স্বাভাবিক | তবে আমার গল্পের শুরুটা একটু আগে থেকে
করতে চাই |
আমার যেদিন সুইডেনে আসার ফ্লাইট তার বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ছিল প্রচণ্ড জ্বর | কিছুতেই জ্বর কমছিল না | এ রকম আগে খুব কমই হয়েছে | শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ১০৫ ডিগ্রি ছিল | ভেবেছিলাম ফ্লাইট হয়তো মিস করব | যাত্রার নির্ধারিত দিনেও জ্বর ছিল। জ্বর নিয়েই রওনা হলাম |
আসল ম্যাজিকটা তখনই ঘটল যখন প্লেনে উঠলাম | প্লেনের ভেতরের পরিবেশটা যেন হঠাৎ করে আমাকে পুরোপুরি চেঞ্জ করে দিল | আস্তে আস্তে আমি ভালো অনুভব করতে লাগলাম | আমার জ্বরও কমে গেল | এ কথা অনেকে শুনলে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমার জীবনে এই ব্যতিক্রম ঘটনাটিই ঘটল | বাবার কথাটাও খুব মনে পড়ছিল তখন | তিনি বলেছিলেন, বিদেশে গেলেই তুই সুস্থ হয়ে যাবি | আর আমি আমি প্লেনে উঠেই সুস্থ হয়ে গেলাম |
জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ কখনো ভুলবার নয় | শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যখন কাতার এয়ারলাইনসের বিমান রানওয়ে দিয়ে অনেক দ্রুত ওপরে উঠতে লাগলে তখন আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম | উঁচু উঁচু দালানকোঠা ও গাছের সারিগুলো ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল | ফসলের মাঠ গুলোও ছোট হয়ে আসছিল | প্লেনটি যতই দূরে যেতে থাকল মা ও মাতৃভূমি থেকে আমার দূরত্ব তত বাড়তে থাকল |
বিমান ভ্রমণের সময় উত্তেজনার পাশাপাশি অনেক শঙ্কাও কাজ করছিল | শঙ্কাটা ছিল ইমিগ্রেশন নিয়ে | যে বিমানবন্দরে ট্রানজিট হবে সেখানে কর্তব্যরত লোকজন কি প্রশ্ন করবে আর আমি কি উত্তর দেব এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা | আমার বিশ্বাস প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের সময় সবার এ রকম ভয় কাজ করে | সত্যি বলতে ভয়ের কিছু নেই | এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে যে বিমানবন্দর থেকে কেউ উল্টো ফিরে আসে |
যা হোক দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে আমি আমার ফাইনাল ডেস্টিনেশন কোপেনহেগেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পড়লাম | প্লেনটি আস্তে আস্তে ল্যান্ড করার জন্য নিচে নামতে থাকল | কোপেনহেগেন বিমানবন্দর সাগরের পাড়ে | যখন বিমানটি নিচে নামছিল তখন ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, এটি বুঝি শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়বে | এভাবে যতই রানওয়ের কাছে আসতে থাকলাম ততই পাশ দিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট সবুজ মাঠের ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আর আমার ভয়ও কাটতে লাগল |
বিমান অবতরণের মুহূর্তটি ছিল সকাল আটটা | সেই সকালের মুহূর্তটি আমার জীবন থেকে কখনো মুছবে না | এখনো যদি কখনো সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠি তাহলে সেদিনের সকালটার কথা মনে পড়ে | বিমানবন্দরে আমাকে নিতে আসেন ভাইয়া ও তার পরিবার | প্রায় এক ঘণ্টা পর আমি তাদের বাসায় পৌঁছি।
সেদিন সকালে সূর্য উঠতে একটু দেরি হয়েছিল | তাই আমি ভুলে সকালকে রাত ভেবে নিয়েছিলাম | যদিও আগে থেকে জানতাম যে, আমি সকালে ল্যান্ড করব, তারপরও কেন জানি সময়সূচিটা এলোমেলো মনে হচ্ছিল | বোকার মতো ভাবিকে প্রশ্ন করলাম, এখন কি রাত না সকাল? এভাবে সময়-ভ্রান্তি নিয়ে কয়েক দিন পার করলাম | যেহেতু উত্তর গোলার্ধে সাধারণত শীতকালে রাতের দৈর্ঘ্য ও গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য খুব বেশি থাকে, তাই প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়েছিল।
এভাবে দিন পার হতে থাকল আর আমি নতুন দেশের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম | মাস গড়িয়ে বছর যায় | এক বছর নয়, দুই বছর নয়, অনেক বছর | এখন মনে হয় বছরগুলোও যেন রানওয়ের বিমানের মতো অনেক দ্রুত চলে যাচ্ছে | সবার কাছে আমি একজন প্রবাসী | এখন আমি পৃথিবীর যে দেশই ভ্রমণ করি না কেন, কোপেনহেগেন বিমানবন্দরের সেই মিষ্টি সকালটির মতো আর কোনো সকাল আমার জীবনে আসবে না |
(লেখক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী)
আমার যেদিন সুইডেনে আসার ফ্লাইট তার বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ছিল প্রচণ্ড জ্বর | কিছুতেই জ্বর কমছিল না | এ রকম আগে খুব কমই হয়েছে | শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ১০৫ ডিগ্রি ছিল | ভেবেছিলাম ফ্লাইট হয়তো মিস করব | যাত্রার নির্ধারিত দিনেও জ্বর ছিল। জ্বর নিয়েই রওনা হলাম |
আসল ম্যাজিকটা তখনই ঘটল যখন প্লেনে উঠলাম | প্লেনের ভেতরের পরিবেশটা যেন হঠাৎ করে আমাকে পুরোপুরি চেঞ্জ করে দিল | আস্তে আস্তে আমি ভালো অনুভব করতে লাগলাম | আমার জ্বরও কমে গেল | এ কথা অনেকে শুনলে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমার জীবনে এই ব্যতিক্রম ঘটনাটিই ঘটল | বাবার কথাটাও খুব মনে পড়ছিল তখন | তিনি বলেছিলেন, বিদেশে গেলেই তুই সুস্থ হয়ে যাবি | আর আমি আমি প্লেনে উঠেই সুস্থ হয়ে গেলাম |
জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ কখনো ভুলবার নয় | শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যখন কাতার এয়ারলাইনসের বিমান রানওয়ে দিয়ে অনেক দ্রুত ওপরে উঠতে লাগলে তখন আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম | উঁচু উঁচু দালানকোঠা ও গাছের সারিগুলো ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল | ফসলের মাঠ গুলোও ছোট হয়ে আসছিল | প্লেনটি যতই দূরে যেতে থাকল মা ও মাতৃভূমি থেকে আমার দূরত্ব তত বাড়তে থাকল |
বিমান ভ্রমণের সময় উত্তেজনার পাশাপাশি অনেক শঙ্কাও কাজ করছিল | শঙ্কাটা ছিল ইমিগ্রেশন নিয়ে | যে বিমানবন্দরে ট্রানজিট হবে সেখানে কর্তব্যরত লোকজন কি প্রশ্ন করবে আর আমি কি উত্তর দেব এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা | আমার বিশ্বাস প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের সময় সবার এ রকম ভয় কাজ করে | সত্যি বলতে ভয়ের কিছু নেই | এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে যে বিমানবন্দর থেকে কেউ উল্টো ফিরে আসে |
যা হোক দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে আমি আমার ফাইনাল ডেস্টিনেশন কোপেনহেগেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পড়লাম | প্লেনটি আস্তে আস্তে ল্যান্ড করার জন্য নিচে নামতে থাকল | কোপেনহেগেন বিমানবন্দর সাগরের পাড়ে | যখন বিমানটি নিচে নামছিল তখন ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, এটি বুঝি শেষ পর্যন্ত সাগরে গিয়ে পড়বে | এভাবে যতই রানওয়ের কাছে আসতে থাকলাম ততই পাশ দিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট সবুজ মাঠের ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আর আমার ভয়ও কাটতে লাগল |
বিমান অবতরণের মুহূর্তটি ছিল সকাল আটটা | সেই সকালের মুহূর্তটি আমার জীবন থেকে কখনো মুছবে না | এখনো যদি কখনো সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠি তাহলে সেদিনের সকালটার কথা মনে পড়ে | বিমানবন্দরে আমাকে নিতে আসেন ভাইয়া ও তার পরিবার | প্রায় এক ঘণ্টা পর আমি তাদের বাসায় পৌঁছি।
সেদিন সকালে সূর্য উঠতে একটু দেরি হয়েছিল | তাই আমি ভুলে সকালকে রাত ভেবে নিয়েছিলাম | যদিও আগে থেকে জানতাম যে, আমি সকালে ল্যান্ড করব, তারপরও কেন জানি সময়সূচিটা এলোমেলো মনে হচ্ছিল | বোকার মতো ভাবিকে প্রশ্ন করলাম, এখন কি রাত না সকাল? এভাবে সময়-ভ্রান্তি নিয়ে কয়েক দিন পার করলাম | যেহেতু উত্তর গোলার্ধে সাধারণত শীতকালে রাতের দৈর্ঘ্য ও গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য খুব বেশি থাকে, তাই প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়েছিল।
এভাবে দিন পার হতে থাকল আর আমি নতুন দেশের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম | মাস গড়িয়ে বছর যায় | এক বছর নয়, দুই বছর নয়, অনেক বছর | এখন মনে হয় বছরগুলোও যেন রানওয়ের বিমানের মতো অনেক দ্রুত চলে যাচ্ছে | সবার কাছে আমি একজন প্রবাসী | এখন আমি পৃথিবীর যে দেশই ভ্রমণ করি না কেন, কোপেনহেগেন বিমানবন্দরের সেই মিষ্টি সকালটির মতো আর কোনো সকাল আমার জীবনে আসবে না |
(লেখক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী)
No comments