বইপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ও রওশনের পরামর্শ by আনিসুল হক
এমন
কাজ কোরো না কেউ বলে, ‘ছোট’, এমন চেয়ারে বোসো না কেউ বলে, ‘ওঠো’।
আমি এই উপদেশটা মেনে চলার চেষ্টা করি। এমন চেয়ারে বোসো না কেউ বলে
‘ওঠো’—খুব একটা বাস্তব উপদেশ। বড় কোনো অনুষ্ঠানে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান
হলে তো কথাই নেই, আমি বসি মাঝামাঝি আসনেরও একটু পেছনে। ওখানে নিজের মুখ
লুকিয়ে রাখা যায়, দরকার হলে অনুষ্ঠানস্থল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এসে বলে না, আপনি কি কাইন্ডলি একটু উঠবেন, আমাদের
সিনিয়র অতিথিরা এসেছেন তো, তাঁদের জায়গা দিতে পারছি না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণপত্র এল, ৮ জুলাই ২০১৫ গণভবনে ইফতার অনুষ্ঠান। একটা না, দুটো আমন্ত্রণপত্র পেলাম। আরেকটা বিষয় আমি শিখেছি কবি শামসুর রাহমানের কাছ থেকে, তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রধান বা সরকারের প্রধান আমন্ত্রণ জানালে সেটাকে সম্মান করতে হয়। আর তো আছেনই আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছে তাঁর ‘পুরস্কার’ কবিতাটি। যেখানে একজন কবি তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে চলেছেন রাজদরবারে, রাজার সঙ্গে দেখা করতে।
স্ত্রী বলেছেন,
‘আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক,
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
লাগিবে কিসের কাজে!’
আর কবির কী হলো?
‘কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,
ভাবিল—বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,
কপালে কী জানি আছে!’
প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে যাওয়া বেশ কঠিন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে হয় এক ঘণ্টা আগে, সঙ্গে মোবাইল ফোন নেওয়া যায় না। বছর দু-এক আগে একবার গণভবন থেকে বেরিয়ে বিপদে পড়েছিলাম, গাড়ি বাইরে দূরে কোথাও, সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই, এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি, উল্টো দিকের দোকানে আশ্রয় নিলাম, কিন্তু কারও কাছ থেকে ফোন ধার নিয়ে যে ড্রাইভারকে কল করব, তারও উপায় নেই। কারণ, ড্রাইভারের নম্বর মুখস্থ রাখিনি।
এবার নিজের গাড়ি নিইনি, আমাদের সহকর্মী আব্দুল কাইয়ুম ভাইয়ের গাড়িতে যেচে উঠে পড়লাম। মোবাইল ফোন তাঁর গাড়িতেই রেখে বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চললাম রাজার বাড়ির দাওয়াতে। হাঁটার কারণ দুটো, স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, দুই. গাড়িওয়ালাদের চেয়ে আধঘণ্টা আগে পৌঁছাতে পারব। আগের দিনেই খবরের কাগজে পড়েছি, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ গণভবনের সামনে যানজটের কারণে প্রধানমন্ত্রীর ইফতার পার্টিতে ঢুকতে পারেননি। পরে জাতীয় সংসদে এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও শুনেছি। তিনি বললেন, আমার গাড়ির সামনে আরও ৫০টা গাড়ি ছিল, ততক্ষণে আজান দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, তারাবির নামাজের সময়ও ঢুকতে পারতাম কি না সন্দেহ। রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়েছেন বোরকা পরে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষÿ করতে।
রওশন এরশাদ কথাটা ভালো বলেছেন। আমাদের ভিআইপিদের উচিত, সাধারণের দুঃখ স্বচক্ষে দেখা, অনুধাবন করা, তাহলে তাঁরা হয়তো বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এর জবাবে জাতীয় সংসদেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন, সে-কথা রসিকতা হলেও সত্য! কৌতুকপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এরশাদ সাহেব আলাদা গাড়িতে আসতে পেরেছেন, তাঁরা দুজনে এক গাড়িতে এলে যানজট কিছুটা কম হতো। এই প্রসঙ্গে আমি সপ্তাহ দু-এক আগে আমার এই কলামে লিখেওছি, ‘পৃথিবীর একটা বসবাস অযোগ্য শহর থেকে বলছি’ শীর্ষক কলামে। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। মানুষ মধ্যবিত্ত হচ্ছে। আর আমাদের গণপরিবহন নেই। কাজেই টাকা হলেই আমরা গাড়ি কিনে ফেলব। আমাদের শহরে রাস্তার পরিমাণ প্রয়োজনের তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু রাস্তার পরিমাণ বাড়ানো হলেও যানজট কমবে না, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, গাড়ির পরিমাণ রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবেই। কাজেই রাস্তার পরিমাণ যতই বাড়াই না কেন, যানজট থেকে আমাদের মুক্তি নেই। নিউইয়র্কে যানজট আছে, সানফ্রান্সিসকোতে যানজট আছে—এই সমস্যার সমাধান হলো, রেলওয়ে এবং নৌপরিবহন। আমাদের আকাশ-রেল লাগবে, পাতাল-রেল লাগবে, ভূমি-রেল লাগবে, ঐতিহ্যবাহী নৌপরিবহনব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে, হাঁটার জন্য ফুটপাত লাগবে এবং সেসব করার জন্য লাগবে মাস্টারপ্ল্যান। আশা করি, সরকার এই বিষয়ে প্রণীত আগের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে বসবে এবং এটাকে যুগোপযোগী করে নতুন মহা কর্মযজ্ঞে নামবে। প্রতিটা সমস্যারই কারিগরি সমাধান আছে, কিন্তু তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমরা নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশ হয়েই গেছি, টাকা এই দেশে সমস্যা নয়। পরিকল্পনার অভাব, দক্ষতার অভাব এবং সততার অভাব আমাদের সমস্যা। স্বপ্নবান উদ্যোগী নেতৃত্ব এই অভাবকে পরাজিত করতে পারবে।
তো বেগম রওশন এরশাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আব্দুল কাইয়ুম ভাই আর আমি বৈকালিক হণ্টনের মাধ্যমে গণভবনে প্রবেশ করলাম। বিশাল আয়োজন। কয়েক হাজার মানুষের বসার ব্যবস্থা। সাংবাদিকদের জন্য মাঝামাঝি একটা সারি। আমরা সাংবাদিক সারির মধ্যভাগে একটা নিরাপদ টেবিলে বসে পড়লাম। যাতে মুখটা লুকিয়ে রাখা যায়, কেউ এসে যেন বলতে না পারে, ‘ওঠো’।
আমার নিজের আরেকটা সমস্যা আছে। অতি অল্প বয়সে চুল পেকে গেছে। বয়সের তুলনায় ঢের বুড়ো দেখায়। আর যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করি, নাটক-সিনেমাও অল্প-বিস্তর লিখেছি, টেলিভিশনে দু-চারটা অনুষ্ঠানে চেহারা দেখানোর সুযোগও হয়েছে, লোকজন আমাকে একটু বেশিই সমাদর করেন, যা আমার ঠিক প্রাপ্য নয়। কেউ না কেউ এসে বলবেনই, আপনি সামনে চলেন। আমি সাধারণত এই ফাঁদে পা দিই না, দুটো কারণে। এক. আমার আশপাশেই অনেক গুণী প্রবীণ মানুষ আছেন, যাঁরা প্রচারবিমুখ, কিন্তু সমাজে যাঁদের অবদান অসামান্য, আমি তাঁদের রেখে সামনে যেতে পারি না। আর দ্বিতীয়টা হলো, যিনি ডেকে নিচ্ছেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন বলে নিচ্ছেন, এরপরে যখন ভিআইপিরা এসে যাবেন, তখন আরেকজন ভালোবেসেই বলবেন, আপনি কি কাইন্ডলি একটু আসনটা ছাড়বেন!
আমরা—লেখক সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী, কবি সরকার আমিন, সাইমন জাকারিয়া, ওবায়েদ আকাশ, দুজন প্রকাশক ও আব্দুল কাইয়ুম—মধ্যখানের নিরাপদ টেবিলে বসে রইলাম। কিন্তু দিনটা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতাটারই যেন একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উঠে বিভিন্ন সারিতে যাবেন, হাঁটবেন, কথা বলবেন, কুশল জিজ্ঞাসা করবেন—এই গুণ যে তাঁর আছে, সেটা আমরা জানি। তাঁর সঙ্গে টুরে যান যে-সাংবাদিকেরা, তাঁরা বলেন। তাঁর বাসভবনে যাঁরা গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর আন্তরিকতায় ও বাঙালি আতিথেয়তার গুণে মুগ্ধ হয়ে ফেরেন। এই গুণ নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছেন তাঁর মহান পিতার কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত অনেক স্মৃতিকথায় আমরা এটা পড়েছি। বাইরে কোনো সভায় ও সম্মেলনে গেলে বঙ্গবন্ধু, তখনো তিনি সরকারপ্রধান হয়েছেন কি হননি, নিজে খাওয়ার আগে প্রথমে খোঁজ নিতেন সঙ্গের সাংবাদিকেরা ও অন্য অতিথিরা খেয়েছেন কি না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন টেবিলের মধ্যবর্তী সারি দিয়ে হাঁটবেন, এটা জানা কথা। এবং এই সময় আমাদের মতো দর্শনপ্রার্থীরা তাঁর কাছাকাছি হওয়ার জন্য, তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য একটু ভদ্রস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হব, তাতে কনুই দুটোরও ভূমিকা থাকবে, তাও জানি।
তিনি আমাদের সারির দিকে আসছেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফটোগ্রাফাররা আগে আগে উল্টো মুখে হাঁটছেন। নিরাপত্তা কর্তারা ভদ্রতা বজায় রেখেই আমাদের পেছনে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজের মুখ লুকিয়ে রাখা গেল না। একে তো ফটোগ্রাফাররা অনেকেই বন্ধু মানুষ, তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল আমাকে পেছনের সারি থেকে টেনে সামনে নিয়ে এলেন। প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘এই যে আনিসুল হক, যারা ভোর এনেছিল বইয়ের লেখক।’
প্রধানমন্ত্রীর হাসিমুখ প্রসন্নতর হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ও আপনি লিখেছেন, এত সুন্দর হয়েছে বইটা! আমি বললাম, ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ’। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা পেড়ে ফেললাম, ‘শাকিল ভাইকে বলেছি, আপনার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট যেন করে দেন, আমার বইয়ের পরের খণ্ড লেখার জন্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে চাই।’ তিনি বললেন, ঠিক আছে, কথা বলা যাবে একদিন। আমি সঙ্গে সঙ্গে শাকিল ভাইকে বললাম, ‘শাকিল ভাই, ব্যবস্থা করে দেবেন।’
এটা আমাদের কাছে আরেক বিস্ময়—প্রধানমন্ত্রী সাহিত্য পাঠ করেন। নিয়মিত বই পড়েন। সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে তিনি হরিশংকর জলদাসের লেখা দহনকাল বইটা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে লিখিত বক্তৃতার বাইরে বেশ খানিকটা আলোচনা করলেন—নিম্নবর্গের মানুষের জীবন সম্পর্কে সাহিত্য কীভাবে আমাদের ধারণা দেয়, তা বললেন। শেখ হাসিনার স্মৃতিশক্তিও অসাধারণ, তাও তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন জেনেটিক্যালি, তাঁর পিতার কাছ থেকে। বই আমরা অনেকেই হয়তো পড়ি, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পারেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দিল্লি-আগ্রা ভ্রমণের কুড়ি বছর পরের স্মৃতিচারণায় তাজমহলের যে অপরূপ বর্ণনা আছে, যে ডিটেইল আছে, কোনো কাগজ না দেখে ইন্টারনেটের সাহায্য ছাড়া তা লেখার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
প্রধানমন্ত্রীর দিনরাত্রি অবসরবিহীন। একটা মুহূর্তও কি তাঁর আছে, যখন তিনি থাকতে পারবেন ভারহীন আর ভাবনাহীন? এর মধ্যে তিনি কী করে তাঁর নাতি-নাতনিদের সময় দেন, কীভাবে রান্নাঘরে গিয়ে প্রিয়জনের জন্য রাঁধেন, আবার একেবারে সমসাময়িক লেখকের লেখা বই পড়েন? সেই বই মনে রাখেন, বক্তৃতায় তা নিয়ে কথা পাড়েন, হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একজন লেখকের সঙ্গে দেখা হলে তাঁর বই নিয়ে আলোচনা করেন?
সংসদে বেগম রওশন এরশাদের পরামর্শ খুবই দরকারি, প্রধানমন্ত্রী বা ভিআইপিদের উচিত সাধারণের বেশে সাধারণের জীবন দেখতে যাওয়া। কিন্তু আরেকটা উপায় আছে, সাধারণ মানুষের জীবন আর মনের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-আশার কথা জানার। তা হলো, পড়া। সাহিত্য পাঠ এবং সংবাদপত্র পাঠ। সংবাদপত্র পড়া খুব জরুরি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) তো বহু আগে বলে দিয়েছেন, সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে হলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রই বেছে নেবেন। তাঁর সঙ্গে যদি সাহিত্য পাঠ করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ, সংবাদপত্রে পাওয়া যায় মানুষের বাহ্যিক কথা আর কাজের খবর, কিন্তু সাহিত্য দেয় মানুষের মনের গহিনের খবর, সাংবাদিকের যেখানে প্রবেশ নিষেধ।
‘পুরস্কার’ কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—রাজাকে কবি বলছেন, কবির কাজ শ্রী!
‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।’
আমাদের অনেক কাঁটা দূর করতে হবে, আমরা যে স্নেহসুধামাখা বাসগৃহটি পেয়েছি, যার নাম বাংলাদেশ, তাকে যে আরও বাসযোগ্য, আরও সুন্দর করে তুলতে হবে—আমাদের ছুটি নেওয়ার আগেই। সেই কাজ সবার—কবির, লেখকের, সাংবাদিকের—সব মানুষের এবং নেতৃবর্গের।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণপত্র এল, ৮ জুলাই ২০১৫ গণভবনে ইফতার অনুষ্ঠান। একটা না, দুটো আমন্ত্রণপত্র পেলাম। আরেকটা বিষয় আমি শিখেছি কবি শামসুর রাহমানের কাছ থেকে, তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রধান বা সরকারের প্রধান আমন্ত্রণ জানালে সেটাকে সম্মান করতে হয়। আর তো আছেনই আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছে তাঁর ‘পুরস্কার’ কবিতাটি। যেখানে একজন কবি তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে চলেছেন রাজদরবারে, রাজার সঙ্গে দেখা করতে।
স্ত্রী বলেছেন,
‘আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক,
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
লাগিবে কিসের কাজে!’
আর কবির কী হলো?
‘কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,
ভাবিল—বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,
কপালে কী জানি আছে!’
প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে যাওয়া বেশ কঠিন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে হয় এক ঘণ্টা আগে, সঙ্গে মোবাইল ফোন নেওয়া যায় না। বছর দু-এক আগে একবার গণভবন থেকে বেরিয়ে বিপদে পড়েছিলাম, গাড়ি বাইরে দূরে কোথাও, সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই, এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি, উল্টো দিকের দোকানে আশ্রয় নিলাম, কিন্তু কারও কাছ থেকে ফোন ধার নিয়ে যে ড্রাইভারকে কল করব, তারও উপায় নেই। কারণ, ড্রাইভারের নম্বর মুখস্থ রাখিনি।
এবার নিজের গাড়ি নিইনি, আমাদের সহকর্মী আব্দুল কাইয়ুম ভাইয়ের গাড়িতে যেচে উঠে পড়লাম। মোবাইল ফোন তাঁর গাড়িতেই রেখে বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চললাম রাজার বাড়ির দাওয়াতে। হাঁটার কারণ দুটো, স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, দুই. গাড়িওয়ালাদের চেয়ে আধঘণ্টা আগে পৌঁছাতে পারব। আগের দিনেই খবরের কাগজে পড়েছি, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ গণভবনের সামনে যানজটের কারণে প্রধানমন্ত্রীর ইফতার পার্টিতে ঢুকতে পারেননি। পরে জাতীয় সংসদে এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও শুনেছি। তিনি বললেন, আমার গাড়ির সামনে আরও ৫০টা গাড়ি ছিল, ততক্ষণে আজান দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, তারাবির নামাজের সময়ও ঢুকতে পারতাম কি না সন্দেহ। রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়েছেন বোরকা পরে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট প্রত্যক্ষÿ করতে।
রওশন এরশাদ কথাটা ভালো বলেছেন। আমাদের ভিআইপিদের উচিত, সাধারণের দুঃখ স্বচক্ষে দেখা, অনুধাবন করা, তাহলে তাঁরা হয়তো বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এর জবাবে জাতীয় সংসদেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন, সে-কথা রসিকতা হলেও সত্য! কৌতুকপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এরশাদ সাহেব আলাদা গাড়িতে আসতে পেরেছেন, তাঁরা দুজনে এক গাড়িতে এলে যানজট কিছুটা কম হতো। এই প্রসঙ্গে আমি সপ্তাহ দু-এক আগে আমার এই কলামে লিখেওছি, ‘পৃথিবীর একটা বসবাস অযোগ্য শহর থেকে বলছি’ শীর্ষক কলামে। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। মানুষ মধ্যবিত্ত হচ্ছে। আর আমাদের গণপরিবহন নেই। কাজেই টাকা হলেই আমরা গাড়ি কিনে ফেলব। আমাদের শহরে রাস্তার পরিমাণ প্রয়োজনের তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু রাস্তার পরিমাণ বাড়ানো হলেও যানজট কমবে না, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, গাড়ির পরিমাণ রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবেই। কাজেই রাস্তার পরিমাণ যতই বাড়াই না কেন, যানজট থেকে আমাদের মুক্তি নেই। নিউইয়র্কে যানজট আছে, সানফ্রান্সিসকোতে যানজট আছে—এই সমস্যার সমাধান হলো, রেলওয়ে এবং নৌপরিবহন। আমাদের আকাশ-রেল লাগবে, পাতাল-রেল লাগবে, ভূমি-রেল লাগবে, ঐতিহ্যবাহী নৌপরিবহনব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে, হাঁটার জন্য ফুটপাত লাগবে এবং সেসব করার জন্য লাগবে মাস্টারপ্ল্যান। আশা করি, সরকার এই বিষয়ে প্রণীত আগের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে বসবে এবং এটাকে যুগোপযোগী করে নতুন মহা কর্মযজ্ঞে নামবে। প্রতিটা সমস্যারই কারিগরি সমাধান আছে, কিন্তু তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমরা নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশ হয়েই গেছি, টাকা এই দেশে সমস্যা নয়। পরিকল্পনার অভাব, দক্ষতার অভাব এবং সততার অভাব আমাদের সমস্যা। স্বপ্নবান উদ্যোগী নেতৃত্ব এই অভাবকে পরাজিত করতে পারবে।
তো বেগম রওশন এরশাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আব্দুল কাইয়ুম ভাই আর আমি বৈকালিক হণ্টনের মাধ্যমে গণভবনে প্রবেশ করলাম। বিশাল আয়োজন। কয়েক হাজার মানুষের বসার ব্যবস্থা। সাংবাদিকদের জন্য মাঝামাঝি একটা সারি। আমরা সাংবাদিক সারির মধ্যভাগে একটা নিরাপদ টেবিলে বসে পড়লাম। যাতে মুখটা লুকিয়ে রাখা যায়, কেউ এসে যেন বলতে না পারে, ‘ওঠো’।
আমার নিজের আরেকটা সমস্যা আছে। অতি অল্প বয়সে চুল পেকে গেছে। বয়সের তুলনায় ঢের বুড়ো দেখায়। আর যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করি, নাটক-সিনেমাও অল্প-বিস্তর লিখেছি, টেলিভিশনে দু-চারটা অনুষ্ঠানে চেহারা দেখানোর সুযোগও হয়েছে, লোকজন আমাকে একটু বেশিই সমাদর করেন, যা আমার ঠিক প্রাপ্য নয়। কেউ না কেউ এসে বলবেনই, আপনি সামনে চলেন। আমি সাধারণত এই ফাঁদে পা দিই না, দুটো কারণে। এক. আমার আশপাশেই অনেক গুণী প্রবীণ মানুষ আছেন, যাঁরা প্রচারবিমুখ, কিন্তু সমাজে যাঁদের অবদান অসামান্য, আমি তাঁদের রেখে সামনে যেতে পারি না। আর দ্বিতীয়টা হলো, যিনি ডেকে নিচ্ছেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন বলে নিচ্ছেন, এরপরে যখন ভিআইপিরা এসে যাবেন, তখন আরেকজন ভালোবেসেই বলবেন, আপনি কি কাইন্ডলি একটু আসনটা ছাড়বেন!
আমরা—লেখক সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী, কবি সরকার আমিন, সাইমন জাকারিয়া, ওবায়েদ আকাশ, দুজন প্রকাশক ও আব্দুল কাইয়ুম—মধ্যখানের নিরাপদ টেবিলে বসে রইলাম। কিন্তু দিনটা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতাটারই যেন একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উঠে বিভিন্ন সারিতে যাবেন, হাঁটবেন, কথা বলবেন, কুশল জিজ্ঞাসা করবেন—এই গুণ যে তাঁর আছে, সেটা আমরা জানি। তাঁর সঙ্গে টুরে যান যে-সাংবাদিকেরা, তাঁরা বলেন। তাঁর বাসভবনে যাঁরা গেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর আন্তরিকতায় ও বাঙালি আতিথেয়তার গুণে মুগ্ধ হয়ে ফেরেন। এই গুণ নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছেন তাঁর মহান পিতার কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত অনেক স্মৃতিকথায় আমরা এটা পড়েছি। বাইরে কোনো সভায় ও সম্মেলনে গেলে বঙ্গবন্ধু, তখনো তিনি সরকারপ্রধান হয়েছেন কি হননি, নিজে খাওয়ার আগে প্রথমে খোঁজ নিতেন সঙ্গের সাংবাদিকেরা ও অন্য অতিথিরা খেয়েছেন কি না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন টেবিলের মধ্যবর্তী সারি দিয়ে হাঁটবেন, এটা জানা কথা। এবং এই সময় আমাদের মতো দর্শনপ্রার্থীরা তাঁর কাছাকাছি হওয়ার জন্য, তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য একটু ভদ্রস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হব, তাতে কনুই দুটোরও ভূমিকা থাকবে, তাও জানি।
তিনি আমাদের সারির দিকে আসছেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফটোগ্রাফাররা আগে আগে উল্টো মুখে হাঁটছেন। নিরাপত্তা কর্তারা ভদ্রতা বজায় রেখেই আমাদের পেছনে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজের মুখ লুকিয়ে রাখা গেল না। একে তো ফটোগ্রাফাররা অনেকেই বন্ধু মানুষ, তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল আমাকে পেছনের সারি থেকে টেনে সামনে নিয়ে এলেন। প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘এই যে আনিসুল হক, যারা ভোর এনেছিল বইয়ের লেখক।’
প্রধানমন্ত্রীর হাসিমুখ প্রসন্নতর হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ও আপনি লিখেছেন, এত সুন্দর হয়েছে বইটা! আমি বললাম, ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ’। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা পেড়ে ফেললাম, ‘শাকিল ভাইকে বলেছি, আপনার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট যেন করে দেন, আমার বইয়ের পরের খণ্ড লেখার জন্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে চাই।’ তিনি বললেন, ঠিক আছে, কথা বলা যাবে একদিন। আমি সঙ্গে সঙ্গে শাকিল ভাইকে বললাম, ‘শাকিল ভাই, ব্যবস্থা করে দেবেন।’
এটা আমাদের কাছে আরেক বিস্ময়—প্রধানমন্ত্রী সাহিত্য পাঠ করেন। নিয়মিত বই পড়েন। সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে তিনি হরিশংকর জলদাসের লেখা দহনকাল বইটা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে লিখিত বক্তৃতার বাইরে বেশ খানিকটা আলোচনা করলেন—নিম্নবর্গের মানুষের জীবন সম্পর্কে সাহিত্য কীভাবে আমাদের ধারণা দেয়, তা বললেন। শেখ হাসিনার স্মৃতিশক্তিও অসাধারণ, তাও তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন জেনেটিক্যালি, তাঁর পিতার কাছ থেকে। বই আমরা অনেকেই হয়তো পড়ি, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পারেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দিল্লি-আগ্রা ভ্রমণের কুড়ি বছর পরের স্মৃতিচারণায় তাজমহলের যে অপরূপ বর্ণনা আছে, যে ডিটেইল আছে, কোনো কাগজ না দেখে ইন্টারনেটের সাহায্য ছাড়া তা লেখার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
প্রধানমন্ত্রীর দিনরাত্রি অবসরবিহীন। একটা মুহূর্তও কি তাঁর আছে, যখন তিনি থাকতে পারবেন ভারহীন আর ভাবনাহীন? এর মধ্যে তিনি কী করে তাঁর নাতি-নাতনিদের সময় দেন, কীভাবে রান্নাঘরে গিয়ে প্রিয়জনের জন্য রাঁধেন, আবার একেবারে সমসাময়িক লেখকের লেখা বই পড়েন? সেই বই মনে রাখেন, বক্তৃতায় তা নিয়ে কথা পাড়েন, হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একজন লেখকের সঙ্গে দেখা হলে তাঁর বই নিয়ে আলোচনা করেন?
সংসদে বেগম রওশন এরশাদের পরামর্শ খুবই দরকারি, প্রধানমন্ত্রী বা ভিআইপিদের উচিত সাধারণের বেশে সাধারণের জীবন দেখতে যাওয়া। কিন্তু আরেকটা উপায় আছে, সাধারণ মানুষের জীবন আর মনের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-আশার কথা জানার। তা হলো, পড়া। সাহিত্য পাঠ এবং সংবাদপত্র পাঠ। সংবাদপত্র পড়া খুব জরুরি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) তো বহু আগে বলে দিয়েছেন, সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে হলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রই বেছে নেবেন। তাঁর সঙ্গে যদি সাহিত্য পাঠ করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ, সংবাদপত্রে পাওয়া যায় মানুষের বাহ্যিক কথা আর কাজের খবর, কিন্তু সাহিত্য দেয় মানুষের মনের গহিনের খবর, সাংবাদিকের যেখানে প্রবেশ নিষেধ।
‘পুরস্কার’ কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—রাজাকে কবি বলছেন, কবির কাজ শ্রী!
‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।’
আমাদের অনেক কাঁটা দূর করতে হবে, আমরা যে স্নেহসুধামাখা বাসগৃহটি পেয়েছি, যার নাম বাংলাদেশ, তাকে যে আরও বাসযোগ্য, আরও সুন্দর করে তুলতে হবে—আমাদের ছুটি নেওয়ার আগেই। সেই কাজ সবার—কবির, লেখকের, সাংবাদিকের—সব মানুষের এবং নেতৃবর্গের।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments