যুক্তরাজ্য কাকে বেছে নেবে—ক্যামেরন না মিলিব্যান্ড? by মহিউদ্দিন আহমদ
বৃহস্পতিবার,
৭ মে-তে যুক্তরাজ্যে যে সাধারণ নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে, তাতে দেশটির
ভোটাররা ২০১০-এর নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ টার্ন আউটের বিপরীতে অধিক সংখ্যায়
ভোট দেবেন ধারণা করি। কারণ, সম্ভবত গত ২ মে শনিবার ব্রিটিশ রাজপরিবারে এক
নতুন প্রিন্সেস, রাজকুমারীর জন্মগ্রহণ। রানি এলিজাবেথের সিংহাসনের চতুর্থ
অধিকারী হতে যাচ্ছেন এই ছোট শিশুটি। ব্রিটিশ জনগণ তো বটেই, কানাডা,
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের লোকজন যাদের বেশির ভাগই পৈতৃক সূত্রে
ব্রিটিশ, তারা ব্রিটিশ রাজপরিবারের যেকোনো ঘটনায় দারুণভাবে আলোড়িত হয়।
তারা উল্লসিত হয়েছিল প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে ডায়ানার এবং পরে তাঁদের প্রথম
ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে প্রিন্সেস কেটের বিয়েতে। তারা আবার
সাংঘাতিকভাবে বিচলিত হয়েছিল, প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানার ছাড়াছাড়িতে এবং
পরে প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুতে।
সদ্য ভূমিষ্ঠ, এখনো ‘অনামিকা’ এই রাজকন্যার জন্ম ব্রিটিশদের উল্লসিত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা। এই শিশুটি ব্রিটিশদের এত গুরুত্বপূর্ণ যে সাধারণ নির্বাচনটিকেও কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে। তার নাম কী হবে, তা নিয়ে হাজার হাজার ব্রিটিশ বাজিও ধরেছে। ব্রিটিশদের মন-মেজাজ এখন ফুরফুরে, সুতরাং তারা ভোট দিতে যাবে বেশি সংখ্যায়।
ব্রিটিশরা অতিসাধারণ কারণেও ভোটবিমুখ হয়ে পড়তে পারে। এমনটি দেখেছি ১৯৭০-এর ১৮ জুনের সাধারণ নির্বাচনে। লেবার পার্টি ১৯৬৪-তে কনজারভেটিভ পার্টির সিটিং প্রাইম মিনিস্টার স্যার আলেক-ডগলাস হিউমকে পরাজিত করে নির্বাচনে জিতে গেল। লেবার পার্টি থেকে ’৬৪ ও ৬৬-তে দুবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৭০-এ এত বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ঘোষণা করলেন। কিন্তু সব হিসাব–নিকাশকে ভুল প্রমাণ করে তিনি পরাজিত হন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা এডওয়ার্ড হিথের কাছে। অন্যতম কারণ হিসেবে তখন বলা হয়েছিল, ১৯৬৬-তে যে ইংল্যান্ড লন্ডনের বিশ্ব ফুটবলের ফাইনালে জিতল, সেই ইংল্যান্ড ১৯৭০-এ মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় কি তৃতীয় রাউন্ডেই ছিটকে পড়ল; আর তাতে মন ভেঙে গেল ব্রিটিশ ভোটারদের। ভোটবিমুখদের মধ্যে বেশি ছিল লেবার পার্টির সমর্থক। সুতরাং হ্যারল্ড উইলসন হেরে গেলেন নির্বাচনে।
‘পুওর’ উইলসন লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছেড়ে দেওয়ার পর লন্ডনে তাঁর থাকার বাসা ছিল না। এই সংকট থেকে উদ্ধার করলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। তিনি উইলসনকে লন্ডনের উপকণ্ঠে চেকার্সে তাঁর কান্ট্রিহোমে মেহমান হিসেবে কয়েক দিন থাকতে দিলেন।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী; আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার আলেক-ডগলাস হিউম ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হ্যারল্ড উইলসন ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁরা তিনজনই সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল প্রায় এককভাবে ব্রিটিশ দ্বীপ থেকে ইউরোপ দখলকারী হিটলারকে পরাজিত করলেন, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা সেই চার্চিল ১৯৪৫-এর সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট অ্যাটলির কাছে পরাজিত হলেন! চার্চিল সম্পর্কে একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘হি ওয়ান দি ওয়ার বাট লস্ট দি ইলেকশন।’ তাই বলে চার্চিল কিন্তু ভোটারদের গালাগাল দেননি।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন অ্যাটলি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। চার্চিল ঘোরতরভাবে ভারতের স্বাধীনতাবিরোধী ও গান্ধীবিদ্বেষী ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ জয় করলেও যুদ্ধকালীন বছরগুলোতে ব্রিটিশ জনগণকে যেসব কষ্ট সহ্য করতে হয়, তার প্রতিশোধ নেয় তারা চার্চিলের ওপর। ব্রিটিশ নির্বাচনের শত শত বছরের ইতিহাসে মাত্র দুবার নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি—দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ ও ১৯৪০-এ।
এখন প্রতিটি পার্লামেন্ট পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হচ্ছে। আগে ‘সিটিং’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর মর্জিমতো ব্রিটিশ রানিকে পার্লামেন্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যেকোনো সময় বাতিল করার পরামর্শ দিতে পারতেন এবং ব্রিটিশ রাজা-রানি সেই পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু ২০১১ সালে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে গৃহীত এক আইনে প্রধানমন্ত্রীর সেই ক্ষমতা রহিত করা হয়।
দুই...
৭ মের নির্বাচনটি অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কারণটি হচ্ছে নির্বাচনটি বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে যাচ্ছে। ‘হাউস অব কমন্সের’ ৬৫০টি আসনের মধ্যে পরের সরকারটি গঠনের জন্য ন্যূনতম ৩২৬টি আসন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন পাবেন, নাকি তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ডের হবে, তা নিশ্চিতভাবে কোনো জনমত
জরিপই বলতে পারছে না। ২৭০ থেকে ২৮০-এর মধ্যে তাঁদের আসনসংখ্যা থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু তাহলে তো অন্য ছোট দল দুটির একটির সঙ্গে কোয়ালিশন করতে হবে। এই ছোট দল দুটি হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা লিব্-ডেম এবং স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এসএনপি।
পাঁচ বছর আগে ২০১০-এর সাধারণ নির্বাচনেও লেবার বা কনজারভেটিভ—কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তখন ডেভিড ক্যামেরন লিব্-ডেমের নেতা নিক ক্লেগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। ডেভিড ক্যামেরন আবার প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেষ্টা চালাবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর তিনি বিরক্ত। আবার লেবার পার্টি যদি স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে, তাহলে এই পার্টিও স্কটল্যান্ডকে যুক্তরাজ্য থেকে বের করে এনে আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বানাতে আবার চাইবে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার ওপর গণভোটে স্কটিশরা অল্প ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যে থেকে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। একবার পরাজিত হলেও এসএনপি সেই দাবি থেকে সরে আসেনি।
ডেভিড ক্যামেরন নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন, তাঁর পাঁচ বছরে যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার বাড়তে শুরু করেছে, দেশের মানুষ সুখেই আছে। সুতরাং তাঁর দল ও তাঁকেই ভোট দেওয়া উচিত। এর বিপরীতে লেবার পার্টির মিলিব্যান্ড বলছেন, গত পাঁচ বছরে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেনি, বরং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। কনজারভেটিভরা আবার ক্ষমতায় এলে মানুষজনের, বিশেষ করে গরিব জনগোষ্ঠীর অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করবে, ধনীদের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দেবে।
ডেভিড ক্যামেরনের বিরুদ্ধে একটি বড় ব্যর্থতার অভিযোগ: বিদেশি অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ প্রত্যাশিতভাবে ঠেকাতে পারেননি। অনেক ব্রিটিশের অভিযোগ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হওয়ার কারণে কোনো রকমের ভিসা বা বাধাবিঘ্ন ছাড়া পূর্ব ইউরোপের ইইউ সদস্যভুক্ত গরিব দেশগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাজ্যে ঢুকছে এবং সরকারি ভাতা নিয়ে মাসের পর মাস কাজকর্ম না পেয়ে বেকার থাকছে। তাদের ট্যাক্সের টাকায় এই লোকগুলোকে পুষতে হচ্ছে। লেবার পার্টিও এমন সব লোকের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। তবে তারা কনজারভেটিভদের মতো এত কঠোর নয়।
অভিবাসী ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে আছে ‘ইউকিপ’, মানে ‘ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্স পার্টি’। তারা বলতে গেলে কোনো বিদেশিকেই যুক্তরাজ্যে সহ্য করতে চায় না। সৌভাগ্যবশত ২০১০-এর নির্বাচনে তারা কোনো আসনই পায়নি, তবে পরে দুটো উপনির্বাচনে তারা জিতে যায় এবং ‘হাউস অব কমন্সে’ ঢুকতেও পারে। এতে অনেকেই আতঙ্কিত বোধ করতে থাকে এই নির্বাচনেও তারা কয়টি আসন পায় এবং মোট ‘কাস্ট’ ভোটের বিপরীতে কত শতাংশ ভোট পায়, ২০১০-এর তুলনায় ভোটের শতাংশে বাড়ল না কমল, তা ‘মনিটর’ করবে যুক্তরাজ্য ও তার বাইরের কোটি কোটি মানুষ। তাদের ভোটসংখ্যা বাড়লে অনেক বছর ধরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরও নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা অযৌক্তিক হবে না যে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সব নেতা-মন্ত্রী বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে এত বক্তৃতা-বিবৃতি, হুমকি-ধমকি দিলেন, কিন্তু তার পরও গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা লাখ লাখ ভোট, প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৩৫ শতাংশ পেলেন কী করে? তাহলে কি নেতা-মন্ত্রীদের এত বক্তৃতা-বিবৃতি এই ভোটাররা গ্রাহ্যই করেননি?
যুক্তরাজ্যের এই সাধারণ নির্বাচনে আমাদের বাংলাদেশিদের আরও বেশি আগ্রহী হওয়ার বড় কারণ: বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ১২ জন বড় তিনটি দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন। রুশনারা আলী ২০১০-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘হাউস অব কমন্সে’ নির্বাচিত হয়েছিলেন, লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে। এবার অন্তত আরও দুজন নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এঁদের একজন ‘সেলিব্রিটি’ টিউলিপ সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধুর নাতনি ও শেখ রেহানার মেয়ে। অনেক বছর ধরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
লেবার পার্টির আর এক সেলিব্রিটি অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ অভিনেত্রী ৮০ বছর বয়সী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। ২০১১ সালে অবসরের ঘোষণা দিলে উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবান আসনে লেবার পার্টি টিউলিপ সিদ্দিককে মনোনয়ন দেয়। ২০১০-এর নির্বাচনে গ্লেন্ডা জ্যাকসন ৪২ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।
ব্রিটিশ নির্বাচনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় যেসব মনোনয়ন পেয়ে থাকে, তা দেওয়া হয় পার্টির স্থানীয় শাখা থেকে, কেন্দ্র থেকে নয়। আমাদের দেশে পার্টিগুলোর শীর্ষ নেতা-নেত্রীরাই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। তাই, ব্রিটেনে কয়লাখনি অধ্যুষিত একটি নির্বাচনী এলাকায় পার্টির স্থানীয় শাখা মনোনয়ন দেবে হয়তো একজন কয়লাশ্রমিককেই। কারণ, এই কয়লাশ্রমিকই অনেক বেশি বুঝবেন ওই এলাকা এবং কয়লাশ্রমিকদের সমস্যা।
আর মনোনয়ন কখনো কখনো নির্বাচনের অনেক আগেই দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন দেওয়া হয়েছে টিউলিপ সিদ্দিককে। নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো বড় জনসভা বা শোডাউন ছিল না, কখনোই থাকে না। প্রচারণা চলে টিভি-রেডিওতে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাগুলো নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্দিষ্ট কোনো দলকে সাধারণত সমর্থন জানায়।
দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট চলতি সংখ্যায় প্রথম সম্পাদকীয়কে কনজারভেটিভ পার্টি ও তার নেতা ডেভিড ক্যামেরনকে সমর্থন দিয়েছে। এ জন্য প্রতিপক্ষ দল পত্রিকাটিকে শত্রু মনে করে না। আমাদের দেশে এই রীতি এখনো গড়ে ওঠেনি।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
mohiuddinahmed1944@yahoo.com
সদ্য ভূমিষ্ঠ, এখনো ‘অনামিকা’ এই রাজকন্যার জন্ম ব্রিটিশদের উল্লসিত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা। এই শিশুটি ব্রিটিশদের এত গুরুত্বপূর্ণ যে সাধারণ নির্বাচনটিকেও কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে। তার নাম কী হবে, তা নিয়ে হাজার হাজার ব্রিটিশ বাজিও ধরেছে। ব্রিটিশদের মন-মেজাজ এখন ফুরফুরে, সুতরাং তারা ভোট দিতে যাবে বেশি সংখ্যায়।
ব্রিটিশরা অতিসাধারণ কারণেও ভোটবিমুখ হয়ে পড়তে পারে। এমনটি দেখেছি ১৯৭০-এর ১৮ জুনের সাধারণ নির্বাচনে। লেবার পার্টি ১৯৬৪-তে কনজারভেটিভ পার্টির সিটিং প্রাইম মিনিস্টার স্যার আলেক-ডগলাস হিউমকে পরাজিত করে নির্বাচনে জিতে গেল। লেবার পার্টি থেকে ’৬৪ ও ৬৬-তে দুবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৭০-এ এত বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ঘোষণা করলেন। কিন্তু সব হিসাব–নিকাশকে ভুল প্রমাণ করে তিনি পরাজিত হন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা এডওয়ার্ড হিথের কাছে। অন্যতম কারণ হিসেবে তখন বলা হয়েছিল, ১৯৬৬-তে যে ইংল্যান্ড লন্ডনের বিশ্ব ফুটবলের ফাইনালে জিতল, সেই ইংল্যান্ড ১৯৭০-এ মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় কি তৃতীয় রাউন্ডেই ছিটকে পড়ল; আর তাতে মন ভেঙে গেল ব্রিটিশ ভোটারদের। ভোটবিমুখদের মধ্যে বেশি ছিল লেবার পার্টির সমর্থক। সুতরাং হ্যারল্ড উইলসন হেরে গেলেন নির্বাচনে।
‘পুওর’ উইলসন লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছেড়ে দেওয়ার পর লন্ডনে তাঁর থাকার বাসা ছিল না। এই সংকট থেকে উদ্ধার করলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। তিনি উইলসনকে লন্ডনের উপকণ্ঠে চেকার্সে তাঁর কান্ট্রিহোমে মেহমান হিসেবে কয়েক দিন থাকতে দিলেন।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী; আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্যার আলেক-ডগলাস হিউম ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হ্যারল্ড উইলসন ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তাঁরা তিনজনই সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল প্রায় এককভাবে ব্রিটিশ দ্বীপ থেকে ইউরোপ দখলকারী হিটলারকে পরাজিত করলেন, কনজারভেটিভ পার্টির নেতা সেই চার্চিল ১৯৪৫-এর সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট অ্যাটলির কাছে পরাজিত হলেন! চার্চিল সম্পর্কে একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘হি ওয়ান দি ওয়ার বাট লস্ট দি ইলেকশন।’ তাই বলে চার্চিল কিন্তু ভোটারদের গালাগাল দেননি।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন অ্যাটলি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। চার্চিল ঘোরতরভাবে ভারতের স্বাধীনতাবিরোধী ও গান্ধীবিদ্বেষী ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ জয় করলেও যুদ্ধকালীন বছরগুলোতে ব্রিটিশ জনগণকে যেসব কষ্ট সহ্য করতে হয়, তার প্রতিশোধ নেয় তারা চার্চিলের ওপর। ব্রিটিশ নির্বাচনের শত শত বছরের ইতিহাসে মাত্র দুবার নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি—দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ ও ১৯৪০-এ।
এখন প্রতিটি পার্লামেন্ট পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হচ্ছে। আগে ‘সিটিং’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর মর্জিমতো ব্রিটিশ রানিকে পার্লামেন্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যেকোনো সময় বাতিল করার পরামর্শ দিতে পারতেন এবং ব্রিটিশ রাজা-রানি সেই পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু ২০১১ সালে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে গৃহীত এক আইনে প্রধানমন্ত্রীর সেই ক্ষমতা রহিত করা হয়।
দুই...
৭ মের নির্বাচনটি অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কারণটি হচ্ছে নির্বাচনটি বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে যাচ্ছে। ‘হাউস অব কমন্সের’ ৬৫০টি আসনের মধ্যে পরের সরকারটি গঠনের জন্য ন্যূনতম ৩২৬টি আসন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন পাবেন, নাকি তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ডের হবে, তা নিশ্চিতভাবে কোনো জনমত
জরিপই বলতে পারছে না। ২৭০ থেকে ২৮০-এর মধ্যে তাঁদের আসনসংখ্যা থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু তাহলে তো অন্য ছোট দল দুটির একটির সঙ্গে কোয়ালিশন করতে হবে। এই ছোট দল দুটি হচ্ছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা লিব্-ডেম এবং স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এসএনপি।
পাঁচ বছর আগে ২০১০-এর সাধারণ নির্বাচনেও লেবার বা কনজারভেটিভ—কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তখন ডেভিড ক্যামেরন লিব্-ডেমের নেতা নিক ক্লেগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। ডেভিড ক্যামেরন আবার প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেষ্টা চালাবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর তিনি বিরক্ত। আবার লেবার পার্টি যদি স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে, তাহলে এই পার্টিও স্কটল্যান্ডকে যুক্তরাজ্য থেকে বের করে এনে আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বানাতে আবার চাইবে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার ওপর গণভোটে স্কটিশরা অল্প ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যে থেকে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। একবার পরাজিত হলেও এসএনপি সেই দাবি থেকে সরে আসেনি।
ডেভিড ক্যামেরন নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন, তাঁর পাঁচ বছরে যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার বাড়তে শুরু করেছে, দেশের মানুষ সুখেই আছে। সুতরাং তাঁর দল ও তাঁকেই ভোট দেওয়া উচিত। এর বিপরীতে লেবার পার্টির মিলিব্যান্ড বলছেন, গত পাঁচ বছরে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেনি, বরং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। কনজারভেটিভরা আবার ক্ষমতায় এলে মানুষজনের, বিশেষ করে গরিব জনগোষ্ঠীর অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করবে, ধনীদের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দেবে।
ডেভিড ক্যামেরনের বিরুদ্ধে একটি বড় ব্যর্থতার অভিযোগ: বিদেশি অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ প্রত্যাশিতভাবে ঠেকাতে পারেননি। অনেক ব্রিটিশের অভিযোগ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হওয়ার কারণে কোনো রকমের ভিসা বা বাধাবিঘ্ন ছাড়া পূর্ব ইউরোপের ইইউ সদস্যভুক্ত গরিব দেশগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাজ্যে ঢুকছে এবং সরকারি ভাতা নিয়ে মাসের পর মাস কাজকর্ম না পেয়ে বেকার থাকছে। তাদের ট্যাক্সের টাকায় এই লোকগুলোকে পুষতে হচ্ছে। লেবার পার্টিও এমন সব লোকের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। তবে তারা কনজারভেটিভদের মতো এত কঠোর নয়।
অভিবাসী ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে আছে ‘ইউকিপ’, মানে ‘ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্স পার্টি’। তারা বলতে গেলে কোনো বিদেশিকেই যুক্তরাজ্যে সহ্য করতে চায় না। সৌভাগ্যবশত ২০১০-এর নির্বাচনে তারা কোনো আসনই পায়নি, তবে পরে দুটো উপনির্বাচনে তারা জিতে যায় এবং ‘হাউস অব কমন্সে’ ঢুকতেও পারে। এতে অনেকেই আতঙ্কিত বোধ করতে থাকে এই নির্বাচনেও তারা কয়টি আসন পায় এবং মোট ‘কাস্ট’ ভোটের বিপরীতে কত শতাংশ ভোট পায়, ২০১০-এর তুলনায় ভোটের শতাংশে বাড়ল না কমল, তা ‘মনিটর’ করবে যুক্তরাজ্য ও তার বাইরের কোটি কোটি মানুষ। তাদের ভোটসংখ্যা বাড়লে অনেক বছর ধরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরও নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা অযৌক্তিক হবে না যে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সব নেতা-মন্ত্রী বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে এত বক্তৃতা-বিবৃতি, হুমকি-ধমকি দিলেন, কিন্তু তার পরও গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা লাখ লাখ ভোট, প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৩৫ শতাংশ পেলেন কী করে? তাহলে কি নেতা-মন্ত্রীদের এত বক্তৃতা-বিবৃতি এই ভোটাররা গ্রাহ্যই করেননি?
যুক্তরাজ্যের এই সাধারণ নির্বাচনে আমাদের বাংলাদেশিদের আরও বেশি আগ্রহী হওয়ার বড় কারণ: বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ১২ জন বড় তিনটি দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন। রুশনারা আলী ২০১০-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘হাউস অব কমন্সে’ নির্বাচিত হয়েছিলেন, লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে। এবার অন্তত আরও দুজন নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এঁদের একজন ‘সেলিব্রিটি’ টিউলিপ সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধুর নাতনি ও শেখ রেহানার মেয়ে। অনেক বছর ধরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
লেবার পার্টির আর এক সেলিব্রিটি অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ অভিনেত্রী ৮০ বছর বয়সী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। ২০১১ সালে অবসরের ঘোষণা দিলে উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবান আসনে লেবার পার্টি টিউলিপ সিদ্দিককে মনোনয়ন দেয়। ২০১০-এর নির্বাচনে গ্লেন্ডা জ্যাকসন ৪২ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।
ব্রিটিশ নির্বাচনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় যেসব মনোনয়ন পেয়ে থাকে, তা দেওয়া হয় পার্টির স্থানীয় শাখা থেকে, কেন্দ্র থেকে নয়। আমাদের দেশে পার্টিগুলোর শীর্ষ নেতা-নেত্রীরাই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। তাই, ব্রিটেনে কয়লাখনি অধ্যুষিত একটি নির্বাচনী এলাকায় পার্টির স্থানীয় শাখা মনোনয়ন দেবে হয়তো একজন কয়লাশ্রমিককেই। কারণ, এই কয়লাশ্রমিকই অনেক বেশি বুঝবেন ওই এলাকা এবং কয়লাশ্রমিকদের সমস্যা।
আর মনোনয়ন কখনো কখনো নির্বাচনের অনেক আগেই দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন দেওয়া হয়েছে টিউলিপ সিদ্দিককে। নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো বড় জনসভা বা শোডাউন ছিল না, কখনোই থাকে না। প্রচারণা চলে টিভি-রেডিওতে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাগুলো নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্দিষ্ট কোনো দলকে সাধারণত সমর্থন জানায়।
দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট চলতি সংখ্যায় প্রথম সম্পাদকীয়কে কনজারভেটিভ পার্টি ও তার নেতা ডেভিড ক্যামেরনকে সমর্থন দিয়েছে। এ জন্য প্রতিপক্ষ দল পত্রিকাটিকে শত্রু মনে করে না। আমাদের দেশে এই রীতি এখনো গড়ে ওঠেনি।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
mohiuddinahmed1944@yahoo.com
No comments