নবরূপে রাহুল, হাতিয়ার মোদির জমিনীতি by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব
অল্প দিনের ব্যবধানে ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটল। পুরোনো জনতা
পরিবারের ছয়টি দল আলাদা আলাদা করে ঘর না করে যৌথ পরিবারের শরিক হওয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সবাই একজোট হয়ে একটি দল গঠন করছে। মুলায়ম সিং যাদব
সেই দলের প্রধান নেতা। পুরোনো দল গুটিয়ে এই নতুন দলে এসেছেন লালু
প্রসাদ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও শরদ যাদব, হরিয়ানার ওম প্রকাশ
চৌটালা, কর্ণাটকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ও কমল মোরারকা।
দ্বিতীয় ঘটনাটা সিপিএমে। কট্টরপন্থী প্রকাশ কারােতর জায়গায় দলের সাধারণ
সম্পাদক নির্বাচিত হলেন নরমপন্থী সীতারাম ইয়েচুরি। ঠিক ওই সময়েই দিল্লির
শাসক দল আম আদমি পার্টি (এএপি) তাদের গৃহবিবাদের অবসানে দল থেকে বের করে
দিল যোগেন্দ্র যাদব, প্রশান্ত ভূষণসহ চার শীর্ষ নেতাকে। চতুর্থ ঘটনাটিও
পিঠোপিঠিই। প্রায় দুই মাসের অজ্ঞাতবাস শেষে কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল
গান্ধী দেশে ফিরলেন এবং দিন কয়েকের মধ্যেই যেন কংগ্রেসের মরা গাঙে বান এল।
চারটি ঘটনাই ভারতীয় রাজনীতিতে গভীর অর্থবহই শুধু নয়, এই ঘটনাগুলোর
কুশীলবেরা সবাই রাজনৈতিকভাবে ভারতের শাসক দল বিজেপির ঘোরতর বিরোধী।
যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হলো, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক রাহুলের ফিরে আসা, যা মৃতসঞ্জীবনী সুধার মতো কংগ্রেসকে আচমকাই চনমনে করে তুলেছে। বাকি ঘটনাগুলোও ক্রমেই দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের ছবি নতুনভাবে আঁকতে সাহায্য করবে। আপাতত এটুকু বলা যেতে পারে, নরেন্দ্র মোদির সরকারের মধুচন্দ্রিমার দিন এই ঘটনাগুলোর সঙ্গেই শেষ হলো।
যে ছয় দল একজোট হলো, সেগুলোর মধ্যে মুলায়মের সমাজবাদী পার্টির রমরমা উত্তর প্রদেশে, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও নীতিশ-শরদ যাদবের জনতা দলের (সংযুক্ত) শক্তি প্রধানত বিহার ও ঝাড়খন্ডে, চৌটালার লোকদলের বিক্রম হরিয়ানায় এবং দেবগৌড়ার জনতা দলের (ধর্মনিরপেক্ষ) প্রতিপত্তি কর্ণাটকে। কমল মোরারকার সমাজবাদী জনতা পার্টির দাপট অবশ্য সেই অর্থে কোথাও নেই। বিহারে এই বছরের অক্টোবর মাসে বিধানসভার ভোট। লালু-নীতিশ-শরদের সঙ্গে সেখানে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসও জোটবদ্ধ। বিজেপিকে এই জোট গত লোকসভা ভোটে ভালোমতোই বেগ দিয়েছে। এককাট্টা হয়ে লড়লে এবং মুলায়ম-চৌটালার সক্রিয় সমর্থন পেলে রাজ্য বিধানসভা নীতিশ দখলে রাখতে পারেন। এটা নতুন এই দলের (যে দলের নাম ও প্রতীক অবশ্য এই লেখার সময়েও ঠিক হয়নি) কাছে যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনই চ্যালেঞ্জ নরেন্দ্র মোদির কাছেও।
সিপিএমে সীতারামের আমল যে শুরু হতে যাচ্ছে তা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। তবু পার্টিটা যেহেতু সিপিএম, তাই না আঁচানো পর্যন্ত কোনো কিছুই সেখানে বিশ্বাস নেই। প্রকাশ কারােতর সঙ্গে সীতারামের রাজনৈতিক অমিল বহু চর্চিত। কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলের সঙ্গেই সমদূরত্ব রেখে কারাত বাম শক্তিদের ঐক্যবদ্ধ করায় বরাবর বেশি আগ্রহী ছিলেন। সীতারামও সেই নীতি অনুসরণ করতেন। তবে তিনি মনে করেন, বিজেপি ও কংগ্রেস দুটি দলই খারাপ হলেও বিজেপি বেশি খারাপ, কংগ্রেস কম। বিজেপি বেশি খারাপ কারণ, তারা সাম্প্রদায়িক। কংগ্রেস অন্তত সাম্প্রদায়িক দল নয়। ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে রুখতে তাই কংগ্রেসকে পাশে রাখা দরকার। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কারণে বামেরা যখন ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসে, সীতারাম তখন সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশদের মতো কট্টরদের গোঁয়ের সামনে তাঁর মতো নরমপন্থীদের পিছু হটতে হয়েছিল। আজ সেই সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে সীতারাম আসীন।
এই লেখাটি লেখার সময় আমার খুব মনে পড়ছে বন্ধু সৈফুদ্দিন চৌধুরীর কথা। দিল্লিতে দিনে দিনে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। লোকসভায় সিপিএমের সদস্য হিসেবে সৈফুদ্দিন ক্রমেই দাগ কাটতে লাগলেন এবং শাসক কংগ্রেসের সমীহ আদায়ে সফল হলেন। বাবরি মসজিদ আন্দোলনের সময় থেকে সৈফুদ্দিন যখন সাম্প্রদায়িকতার ঝাপটানির বিপদ অনুধাবন করতে থাকেন, তখন থেকেই তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন শুরু। দলে তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন, প্রয়োজনে বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। তাঁর কথায়, ‘বিজেপি গ্রেটার ইিভল, কংগ্রেস লেসার ইিভল। বড় বিপদকে রুখতে কম বিপদকে সঙ্গে নিতে হবে।’ সেই সময় সৈফুদ্দিনের ওই রাজনৈতিক লাইন সিপিএম গ্রহণ করেনি। তাঁর সঙ্গে ক্রমেই দলের দূরত্ব বাড়ল এবং একসময় তিনি দলত্যাগে বাধ্য হলেন। তাঁর বিতাড়নে প্রকাশ-সীতারাম হাত মিলিয়েছিলেন। সৈফুদ্দিনকে ক্যানসার হারিয়ে দিলেও সিপিএম শেষ পর্যন্ত তাঁর নীতিই যে আঁকড়ে ধরেছে, মৃত্যুর আগেই তা তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন।
সীতারামের উত্থান এবং রাহুল গান্ধীর ফিরে আসা প্রায় একই সময়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরুর ঠিক আগেই রাহুল গা-ঢাকা দিলেন। তাঁর দপ্তর থেকে বলা হলো, দুই সপ্তাহের জন্য তিনি জনজীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন রাজনৈতিক আত্মানুসন্ধানের জন্য। তখন থেকেই শুরু জল্পনার, কী হলো, রাহুল গেলেন কোথায়? কংগ্রেসের কেউই এর কোনো স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি বা চাননি। আজও কেউ জানেন না উনি কোথায় ছিলেন। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে বেশ ঢাক ঢাক গুড় গুড় রয়েছে। যেমন, অসুস্থতা। নেতাদের নাকি অসুস্থ হতে নেই। অসুখ হলেও কী অসুখ তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে চান না। তাতে নাকি দর কমে যায়। সোনিয়া গান্ধীর অসুখটা যে ঠিক কী, যার জন্য তাঁকে আমেরিকার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল এবং এখনো মাঝে মাঝে ‘চেকআপ’ করাতে যেতে হয়, তা কেউ জানে না। শরদ পাওয়ারের যে মুখে ক্যানসার হয়েছিল তা জানা যায় অস্ত্রোপচারের পরে। মুলায়ম সিং যাদবকে নাকি পারকিনসন্স রোগে ধরেছে। কিন্তু তিনি নিজে কিছু বলেন না। অটল বিহারি বাজপেয়িও যত দিন পারা যায় অসুস্থতা চেপে ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশ্যে সবকিছু জানার কোনো অধিকারই কেন জানি এ দেশের আম আদমির নেই। আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। জননেতা হলেও রাহুল কোথায় ছিলেন এই দুই মাস, তা জানার অধিকার যেন জনতার থাকতে নেই।
অবশ্য সেই আগ্রহ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে নেতা রাহুলের প্রত্যাবর্তন। দেশে ফেরার তিন দিনের মাথায় দিল্লির রামলীলা ময়দানে সরকারের কৃষিজমি অধিগ্রহণ নীতির বিরোধিতা করে কংগ্রেস যে কৃষক সমাবেশের আয়োজন করে, তা ছিল রাহুলের দ্বিতীয় ইনিংসের গোড়াপত্তন। সেদিন রাহুলের ভাষণ, মঞ্চে তাঁর আচরণ (মনমোহন সিংকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিলেন, সব বয়স্ক শীর্ষ নেতা নামার পর নিজে মঞ্চ ছেড়েছিলেন) এটুকু বুঝিয়ে দেয়, এ এক নতুন রাহুল। ঠিক পরের দিন সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়ে সরকারকে তুলাধোনা করলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে সংসদে হাজিরাই শুধু দিচ্ছেন না, বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে বিদ্ধ করছেন। এত বছর এই রাহুলকে কেউ দেখেনি। সাংসদ হিসেবে গত ১০ বছরে যাঁর কোনো ভূমিকাই প্রায় ছিল না, অজ্ঞাতবাস শেষে কোনো এক জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় তিনি এখন অন্য নেতা। ইন্টারনেটের স্বাধীনতা রক্ষায় তাঁর ভাষণ, সেই ভাষণ শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশংসার নামে ব্যজস্তুতি (মোদিকে কৃষকবিরোধী ও শিল্পপ্রিয় বুঝিয়ে দেওয়া), সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া, সেখান থেকে কৃষকের আত্মহত্যার খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়া—সবকিছুই কংগ্রেসিদের বিরাটভাবে আশ্বস্ত করছে। তাঁরা এটুকু অন্তত বুঝতে পারছেন, রাহুল আগের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। এখন তিনি আগের তুলনায় অনেক ‘প্রো-অ্যাক্টিভ’। এই বোধোদয় কদিনেই কংগ্রেসকে অদ্ভুতভাবে চনমনে করে তুলেছে। এ যেন বন্য বাইসনের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো।
ঐতিহাসিকভাবেই কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থান ‘লেফট টু দ্য সেন্টার’। জওহরলাল নেহরু সমাজবাদের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীও কমিউনিস্ট পার্টিকে কোল পেতে দিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবনা থেকেই ইন্দিরার ব্যাংক জাতীয়করণ, কয়লাখনি রাষ্ট্রীয়করণ। বিজেপিকে রুখতেও কংগ্রেস বামপন্থীদের ও বামপন্থীরা কংগ্রেসকে কোল পেতে দিয়ে আসছে। সীতারাম ইয়েচুরির উত্থান কংগ্রেস-বামপন্থীদের কাছাকাছি আসার এই প্রয়োজনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃত্ব বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে রুখতে (তাঁরা মনে করেন, মোদি-মমতা একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছে, যা সারদা কেলেঙ্কারি থেকে মমতা ও রাজ্যসভায় গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসের ক্ষেত্রে মোদিকে সাহায্য করবে) মাস কয়েক ধরেই বামপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য তদবির করে আসছেন। সীতারামের ক্ষমতায়ন সেই দাবিকে আরও জোরালো করবে। সংসদের ভেতর ও বাইরে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সমন্বয় ক্রমেই বাড়ছে। সীতারাম রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পর সব দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর দলের বোঝাপড়া অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিজেপিকে রুখতে রাহুল-সীতারাম জুটির যুগলবন্দী আগামী দিনে অন্য রাজনৈতিক অনুঘটকের কাজ করতে পারে।
কংগ্রেসের দুর্বলতাই দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জন্ম দিয়েছে। সেই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চার শীর্ষ নেতার বহিষ্কার এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একগুঁয়ে আচরণ এই দলটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। তাদের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে এক কৃষকের আত্মহত্যা সাধারণ মানুষের মনেও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল এখনো আহামরি এমন কিছু করতে পারেননি, যাতে আর পাঁচজনের চেয়ে তিনি নিজেকে আলাদা দাবি করতে পারেন। রাহুলের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা তাঁর কাছে অশনিসংকেত। রাহুলের জমি-আন্দোলনকে কেজরিওয়ালও তাই হাতিয়ার করতে উঠেপড়ে নেমেছেন।
জমি বড় বিষয়বস্তু। জমি বড়ই স্পর্শকাতর। মমতার জমি আন্দোলনেই ৩৪ বছরের বাম মৌরসি পাট্টা পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপাটিত। রাহুল গান্ধী সেই জমিকেই হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে কোমর কষে নেমেছেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আয়েশের দিনকে পেছনে ফেলে তিনি যদি রাজ্যে রাজ্যে এভাবে রাস্তায় নামেন, মোদি সরকারের জমিনীতি কংগ্রেসের হারানো জমি ফেরত দিতে তাহলে দেরি করবে না।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হলো, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক রাহুলের ফিরে আসা, যা মৃতসঞ্জীবনী সুধার মতো কংগ্রেসকে আচমকাই চনমনে করে তুলেছে। বাকি ঘটনাগুলোও ক্রমেই দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের ছবি নতুনভাবে আঁকতে সাহায্য করবে। আপাতত এটুকু বলা যেতে পারে, নরেন্দ্র মোদির সরকারের মধুচন্দ্রিমার দিন এই ঘটনাগুলোর সঙ্গেই শেষ হলো।
যে ছয় দল একজোট হলো, সেগুলোর মধ্যে মুলায়মের সমাজবাদী পার্টির রমরমা উত্তর প্রদেশে, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও নীতিশ-শরদ যাদবের জনতা দলের (সংযুক্ত) শক্তি প্রধানত বিহার ও ঝাড়খন্ডে, চৌটালার লোকদলের বিক্রম হরিয়ানায় এবং দেবগৌড়ার জনতা দলের (ধর্মনিরপেক্ষ) প্রতিপত্তি কর্ণাটকে। কমল মোরারকার সমাজবাদী জনতা পার্টির দাপট অবশ্য সেই অর্থে কোথাও নেই। বিহারে এই বছরের অক্টোবর মাসে বিধানসভার ভোট। লালু-নীতিশ-শরদের সঙ্গে সেখানে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসও জোটবদ্ধ। বিজেপিকে এই জোট গত লোকসভা ভোটে ভালোমতোই বেগ দিয়েছে। এককাট্টা হয়ে লড়লে এবং মুলায়ম-চৌটালার সক্রিয় সমর্থন পেলে রাজ্য বিধানসভা নীতিশ দখলে রাখতে পারেন। এটা নতুন এই দলের (যে দলের নাম ও প্রতীক অবশ্য এই লেখার সময়েও ঠিক হয়নি) কাছে যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনই চ্যালেঞ্জ নরেন্দ্র মোদির কাছেও।
সিপিএমে সীতারামের আমল যে শুরু হতে যাচ্ছে তা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। তবু পার্টিটা যেহেতু সিপিএম, তাই না আঁচানো পর্যন্ত কোনো কিছুই সেখানে বিশ্বাস নেই। প্রকাশ কারােতর সঙ্গে সীতারামের রাজনৈতিক অমিল বহু চর্চিত। কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলের সঙ্গেই সমদূরত্ব রেখে কারাত বাম শক্তিদের ঐক্যবদ্ধ করায় বরাবর বেশি আগ্রহী ছিলেন। সীতারামও সেই নীতি অনুসরণ করতেন। তবে তিনি মনে করেন, বিজেপি ও কংগ্রেস দুটি দলই খারাপ হলেও বিজেপি বেশি খারাপ, কংগ্রেস কম। বিজেপি বেশি খারাপ কারণ, তারা সাম্প্রদায়িক। কংগ্রেস অন্তত সাম্প্রদায়িক দল নয়। ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে রুখতে তাই কংগ্রেসকে পাশে রাখা দরকার। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কারণে বামেরা যখন ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসে, সীতারাম তখন সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশদের মতো কট্টরদের গোঁয়ের সামনে তাঁর মতো নরমপন্থীদের পিছু হটতে হয়েছিল। আজ সেই সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে সীতারাম আসীন।
এই লেখাটি লেখার সময় আমার খুব মনে পড়ছে বন্ধু সৈফুদ্দিন চৌধুরীর কথা। দিল্লিতে দিনে দিনে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। লোকসভায় সিপিএমের সদস্য হিসেবে সৈফুদ্দিন ক্রমেই দাগ কাটতে লাগলেন এবং শাসক কংগ্রেসের সমীহ আদায়ে সফল হলেন। বাবরি মসজিদ আন্দোলনের সময় থেকে সৈফুদ্দিন যখন সাম্প্রদায়িকতার ঝাপটানির বিপদ অনুধাবন করতে থাকেন, তখন থেকেই তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন শুরু। দলে তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন, প্রয়োজনে বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। তাঁর কথায়, ‘বিজেপি গ্রেটার ইিভল, কংগ্রেস লেসার ইিভল। বড় বিপদকে রুখতে কম বিপদকে সঙ্গে নিতে হবে।’ সেই সময় সৈফুদ্দিনের ওই রাজনৈতিক লাইন সিপিএম গ্রহণ করেনি। তাঁর সঙ্গে ক্রমেই দলের দূরত্ব বাড়ল এবং একসময় তিনি দলত্যাগে বাধ্য হলেন। তাঁর বিতাড়নে প্রকাশ-সীতারাম হাত মিলিয়েছিলেন। সৈফুদ্দিনকে ক্যানসার হারিয়ে দিলেও সিপিএম শেষ পর্যন্ত তাঁর নীতিই যে আঁকড়ে ধরেছে, মৃত্যুর আগেই তা তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন।
সীতারামের উত্থান এবং রাহুল গান্ধীর ফিরে আসা প্রায় একই সময়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরুর ঠিক আগেই রাহুল গা-ঢাকা দিলেন। তাঁর দপ্তর থেকে বলা হলো, দুই সপ্তাহের জন্য তিনি জনজীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন রাজনৈতিক আত্মানুসন্ধানের জন্য। তখন থেকেই শুরু জল্পনার, কী হলো, রাহুল গেলেন কোথায়? কংগ্রেসের কেউই এর কোনো স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি বা চাননি। আজও কেউ জানেন না উনি কোথায় ছিলেন। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে বেশ ঢাক ঢাক গুড় গুড় রয়েছে। যেমন, অসুস্থতা। নেতাদের নাকি অসুস্থ হতে নেই। অসুখ হলেও কী অসুখ তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে চান না। তাতে নাকি দর কমে যায়। সোনিয়া গান্ধীর অসুখটা যে ঠিক কী, যার জন্য তাঁকে আমেরিকার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল এবং এখনো মাঝে মাঝে ‘চেকআপ’ করাতে যেতে হয়, তা কেউ জানে না। শরদ পাওয়ারের যে মুখে ক্যানসার হয়েছিল তা জানা যায় অস্ত্রোপচারের পরে। মুলায়ম সিং যাদবকে নাকি পারকিনসন্স রোগে ধরেছে। কিন্তু তিনি নিজে কিছু বলেন না। অটল বিহারি বাজপেয়িও যত দিন পারা যায় অসুস্থতা চেপে ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে প্রকাশ্যে সবকিছু জানার কোনো অধিকারই কেন জানি এ দেশের আম আদমির নেই। আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। জননেতা হলেও রাহুল কোথায় ছিলেন এই দুই মাস, তা জানার অধিকার যেন জনতার থাকতে নেই।
অবশ্য সেই আগ্রহ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে নেতা রাহুলের প্রত্যাবর্তন। দেশে ফেরার তিন দিনের মাথায় দিল্লির রামলীলা ময়দানে সরকারের কৃষিজমি অধিগ্রহণ নীতির বিরোধিতা করে কংগ্রেস যে কৃষক সমাবেশের আয়োজন করে, তা ছিল রাহুলের দ্বিতীয় ইনিংসের গোড়াপত্তন। সেদিন রাহুলের ভাষণ, মঞ্চে তাঁর আচরণ (মনমোহন সিংকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিলেন, সব বয়স্ক শীর্ষ নেতা নামার পর নিজে মঞ্চ ছেড়েছিলেন) এটুকু বুঝিয়ে দেয়, এ এক নতুন রাহুল। ঠিক পরের দিন সংসদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়ে সরকারকে তুলাধোনা করলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে সংসদে হাজিরাই শুধু দিচ্ছেন না, বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে বিদ্ধ করছেন। এত বছর এই রাহুলকে কেউ দেখেনি। সাংসদ হিসেবে গত ১০ বছরে যাঁর কোনো ভূমিকাই প্রায় ছিল না, অজ্ঞাতবাস শেষে কোনো এক জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় তিনি এখন অন্য নেতা। ইন্টারনেটের স্বাধীনতা রক্ষায় তাঁর ভাষণ, সেই ভাষণ শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশংসার নামে ব্যজস্তুতি (মোদিকে কৃষকবিরোধী ও শিল্পপ্রিয় বুঝিয়ে দেওয়া), সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া, সেখান থেকে কৃষকের আত্মহত্যার খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়া—সবকিছুই কংগ্রেসিদের বিরাটভাবে আশ্বস্ত করছে। তাঁরা এটুকু অন্তত বুঝতে পারছেন, রাহুল আগের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। এখন তিনি আগের তুলনায় অনেক ‘প্রো-অ্যাক্টিভ’। এই বোধোদয় কদিনেই কংগ্রেসকে অদ্ভুতভাবে চনমনে করে তুলেছে। এ যেন বন্য বাইসনের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো।
ঐতিহাসিকভাবেই কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থান ‘লেফট টু দ্য সেন্টার’। জওহরলাল নেহরু সমাজবাদের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীও কমিউনিস্ট পার্টিকে কোল পেতে দিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবনা থেকেই ইন্দিরার ব্যাংক জাতীয়করণ, কয়লাখনি রাষ্ট্রীয়করণ। বিজেপিকে রুখতেও কংগ্রেস বামপন্থীদের ও বামপন্থীরা কংগ্রেসকে কোল পেতে দিয়ে আসছে। সীতারাম ইয়েচুরির উত্থান কংগ্রেস-বামপন্থীদের কাছাকাছি আসার এই প্রয়োজনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃত্ব বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে রুখতে (তাঁরা মনে করেন, মোদি-মমতা একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছে, যা সারদা কেলেঙ্কারি থেকে মমতা ও রাজ্যসভায় গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসের ক্ষেত্রে মোদিকে সাহায্য করবে) মাস কয়েক ধরেই বামপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধার জন্য তদবির করে আসছেন। সীতারামের ক্ষমতায়ন সেই দাবিকে আরও জোরালো করবে। সংসদের ভেতর ও বাইরে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সমন্বয় ক্রমেই বাড়ছে। সীতারাম রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পর সব দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর দলের বোঝাপড়া অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিজেপিকে রুখতে রাহুল-সীতারাম জুটির যুগলবন্দী আগামী দিনে অন্য রাজনৈতিক অনুঘটকের কাজ করতে পারে।
কংগ্রেসের দুর্বলতাই দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জন্ম দিয়েছে। সেই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চার শীর্ষ নেতার বহিষ্কার এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একগুঁয়ে আচরণ এই দলটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। তাদের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে এক কৃষকের আত্মহত্যা সাধারণ মানুষের মনেও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল এখনো আহামরি এমন কিছু করতে পারেননি, যাতে আর পাঁচজনের চেয়ে তিনি নিজেকে আলাদা দাবি করতে পারেন। রাহুলের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা তাঁর কাছে অশনিসংকেত। রাহুলের জমি-আন্দোলনকে কেজরিওয়ালও তাই হাতিয়ার করতে উঠেপড়ে নেমেছেন।
জমি বড় বিষয়বস্তু। জমি বড়ই স্পর্শকাতর। মমতার জমি আন্দোলনেই ৩৪ বছরের বাম মৌরসি পাট্টা পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপাটিত। রাহুল গান্ধী সেই জমিকেই হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে কোমর কষে নেমেছেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আয়েশের দিনকে পেছনে ফেলে তিনি যদি রাজ্যে রাজ্যে এভাবে রাস্তায় নামেন, মোদি সরকারের জমিনীতি কংগ্রেসের হারানো জমি ফেরত দিতে তাহলে দেরি করবে না।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments