রক্ষণাত্মক কৌশলে সরকার by আবদুল্লাহ আল মামুন
চলমান
সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থাকার কৌশল নিয়েছে সরকার।
১৪ দিনেও খালেদা জিয়ার নামে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল হয়নি।
একইভাবে দেশী-বিদেশী চাপ থাকার পরও সংলাপ হচ্ছে না। বিএনপির চেয়ারপারসনের
গুলশান কার্যালয় তল্লাশির ওয়ারেন্ট হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। উল্টো
ডিসিসি (ঢাকা সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ঢাকাবাসীকে
নির্বাচনমুখী করে তোলার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এ ছাড়া ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দিকেও তাকিয়ে আছে সরকার। খুব
শিগগিরই তার বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা আছে। মোদির বাংলাদেশ সফরের দিনক্ষণ
চূড়ান্ত হলেই বিএনপি তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে পারে বলে মনে করছেন
নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান অবস্থা থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি তাদের কর্মসূচি ধরে রাখতে চাইবে। কিন্তু মানুষ হয়তো ততদিন অপেক্ষা করবে না। তাদের ধারণা বিএনপির এ কর্মসূচিতে মানুষ আর বেশি দিন ঘরে বসে থাকবে না। এটা বিএনপিও অনুমান করতে পারছে। যে কারণে তাদের মধ্যেও অস্বস্তি বাড়ছে। এ পর্যায়ে এসে সরকার এখনই আরও কঠোর অবস্থানে না গিয়ে আপাতত কিছু দিন চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চায়। এরপর নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার ডিফেন্সিভ পজিশনে চলে গেছে। কারণ সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি বিদেশনির্ভর হওয়ায় কূটনীতিকদের একটা চাপ আছে। সরকারও তার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত। সবচেয়ে বড় কথা বিরোধীপক্ষ যে নাশকতা চালাচ্ছে, সরকার তা দমন বা নিরসন কেন করছে না সে ব্যাপারে জনগণ অসন্তুষ্ট। তাই সরকার কিছুটা নমনীয় অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের পরোয়ানা সত্ত্বেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করা এবং সার্চ ওয়ারেন্ট থাকার পরও গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি না চালানোর বিষয়কে সরকারের ডিফেন্সিভ পজিশনের অংশ বলে মনে করছেন সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত দুই মাসে বিএনপির অবরোধ এবং হরতালের কারণে দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এসব ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। কারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। একইভাবে যতই অস্বীকার করুক পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ খুন, যানবাহন জ্বালাও-পোড়াওসহ সব দায় বহন করতে হবে বিএনপিকেই। কারণ তারাই অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে। এই কর্মসূচি চলাবস্থাতেই প্রাণঘাতী ঘটনাগুলো ঘটছে। কাজেই এসব দায় থেকে কোনোভাবেই নিজেদেও এড়াতে পারবে না বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষেরই সম্মানজনক এক্সিট প্রয়োজন।
সেই সম্মানজনক সমাধানের পথ বের করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আলাদা চিঠিতে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। দু’পক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে দেশের মধ্যে সুশীল সমাজসহ রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপিকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। একই উদ্দেশ্যে উন্নয়ন সহযোগীরা নাশকতা বন্ধের জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপি সংলাপের কথা মুখে বললেও তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করছে না। সরকারও বারবার বলছে নাশকতাকারীদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়।
কিন্তু গত দু’দিন সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারপক্ষ সহসাই কোনো সংলাপে যাবে না। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের ব্যাপারেও আগ্রহী নয় সরকারের হাইকমান্ড। টানা অবরোধে অর্থনৈতিক ক্ষতিতে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও রাজনৈতিক উপায়ে নয়, তারা এই পরিস্থিতির শেষ দেখতে চায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর পদক্ষেপের মাধ্যমেই।
আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেছেন, বর্তমানে দেশে যা চলছে সেটা কোনো আন্দোলন নয়, জঙ্গিবাদী তৎপরতা। পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না। তাই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জঙ্গিবাদী তৎপরতা রুখতে আইনশৃংখলা বাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশেও সেভাবেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড দমন করা হবে। হানিফ মনে করেন, এ অবস্থা আর বেশি দিন চলবে না। জনগণ রাস্তায় বের হয়ে আসবে।
সরকারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলব না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান অবস্থায় সাধারণ মানুষের ভেতর সব চেয়ে বেশি যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল- এ পরিস্থিতি আর কত দিন চলবে। তাদের মতে, এর জবাবও সরকারকেই দিতে হবে । এ জন্য যেকোনোভাবে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে । অথবা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসে একটি ফয়সালা করতে হবে। অবশ্য এ জন্য বিএনপিকেও পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারা বন্ধ করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াওর মতো ধ্বংসাত্মক অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি তুলে নিয়ে সংলাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকার রক্ষণাত্মক (ডিফেন্সিভ) ভূমিকা নেয়ায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আগের চেয়ে রাস্তায় অনেক বেশি যানবাহন দেখা যায়। মানুষ ধীরে ধীরে রাস্তায় নামছে। এখন শুধু স্কুল-কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া শুরু হলে অবস্থা অনেক পাল্টে যাবে। অবস্থা আগের মতো স্বাভাবিক করার জন্য সরকার ডিসিসি নির্বাচনের কৌশল নিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মানুষকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে বের করে আনা ও বিএনপির আন্দোলন অকার্যকর করার কৌশলের অংশ হিসেবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। নির্বাচনী ডামাডোলে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও স্তিমিত হয়ে পড়বে বলেই বিশ্বাস করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাই সহসাই ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। এ নির্বাচন সফল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচনী ডামাঢোল শুরু হলে বিএনপি কোনোভাবেই চলমান আন্দোলন ধরে রাখতে পারবে না।
সরকারের রক্ষণাত্মক ভূমিকার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং নেতাকর্মীদের ওপর হামলা সত্ত্বেও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি শুরুর পর পরই পাড়া-মহল্লায় ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সংসদ সদস্যদের নিজ এলাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিটি হয়নি। কমিটির মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে গেলে সহিংসতা আরও বাড়ত। এর দায় পড়ত সরকারের ওপর। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেরা না গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীন দলটি কিছুটা হলেও প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও সরকারি মহল খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। আর এ কারণেই জেলা পর্যায়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
বিশেষ করে সংঘাতকবলিত উত্তরাঞ্চলের দুই জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশের কর্মকর্তা পর্যায়ে পরিবর্তনের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামেও কিছু পরিবর্তন আসবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। পুলিশের হেডকোয়ার্টারেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর চিন্তা করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের কৌশলী ভূমিকার অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির বিপক্ষে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক উপায়ে নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করবে তারা। বর্তমানে ১৪ দলের ব্যানারে সারা দেশে সমাবেশ কর্মসূচি চলছে। এসব সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করছেন। পাশাপাশি আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করে কার্যকর সাফল্য অর্জনের চেষ্টা চলছে।
চলমান অচলাবস্থা থেকে উত্তরণে বড় একটি উপায় হতে পারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির বাংলাদেশ সফর। তার আগেই বিএনপি কর্মসূচি প্রত্যাহারে বাধ্য হবে- এমন ধারণাও করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশটির পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থেকে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান অবস্থা থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি তাদের কর্মসূচি ধরে রাখতে চাইবে। কিন্তু মানুষ হয়তো ততদিন অপেক্ষা করবে না। তাদের ধারণা বিএনপির এ কর্মসূচিতে মানুষ আর বেশি দিন ঘরে বসে থাকবে না। এটা বিএনপিও অনুমান করতে পারছে। যে কারণে তাদের মধ্যেও অস্বস্তি বাড়ছে। এ পর্যায়ে এসে সরকার এখনই আরও কঠোর অবস্থানে না গিয়ে আপাতত কিছু দিন চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চায়। এরপর নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার ডিফেন্সিভ পজিশনে চলে গেছে। কারণ সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি বিদেশনির্ভর হওয়ায় কূটনীতিকদের একটা চাপ আছে। সরকারও তার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত। সবচেয়ে বড় কথা বিরোধীপক্ষ যে নাশকতা চালাচ্ছে, সরকার তা দমন বা নিরসন কেন করছে না সে ব্যাপারে জনগণ অসন্তুষ্ট। তাই সরকার কিছুটা নমনীয় অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের পরোয়ানা সত্ত্বেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করা এবং সার্চ ওয়ারেন্ট থাকার পরও গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি না চালানোর বিষয়কে সরকারের ডিফেন্সিভ পজিশনের অংশ বলে মনে করছেন সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত দুই মাসে বিএনপির অবরোধ এবং হরতালের কারণে দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এসব ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। কারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। একইভাবে যতই অস্বীকার করুক পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ খুন, যানবাহন জ্বালাও-পোড়াওসহ সব দায় বহন করতে হবে বিএনপিকেই। কারণ তারাই অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে। এই কর্মসূচি চলাবস্থাতেই প্রাণঘাতী ঘটনাগুলো ঘটছে। কাজেই এসব দায় থেকে কোনোভাবেই নিজেদেও এড়াতে পারবে না বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষেরই সম্মানজনক এক্সিট প্রয়োজন।
সেই সম্মানজনক সমাধানের পথ বের করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আলাদা চিঠিতে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। দু’পক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে দেশের মধ্যে সুশীল সমাজসহ রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপিকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। একই উদ্দেশ্যে উন্নয়ন সহযোগীরা নাশকতা বন্ধের জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপি সংলাপের কথা মুখে বললেও তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করছে না। সরকারও বারবার বলছে নাশকতাকারীদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়।
কিন্তু গত দু’দিন সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারপক্ষ সহসাই কোনো সংলাপে যাবে না। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের ব্যাপারেও আগ্রহী নয় সরকারের হাইকমান্ড। টানা অবরোধে অর্থনৈতিক ক্ষতিতে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও রাজনৈতিক উপায়ে নয়, তারা এই পরিস্থিতির শেষ দেখতে চায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর পদক্ষেপের মাধ্যমেই।
আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেছেন, বর্তমানে দেশে যা চলছে সেটা কোনো আন্দোলন নয়, জঙ্গিবাদী তৎপরতা। পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না। তাই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জঙ্গিবাদী তৎপরতা রুখতে আইনশৃংখলা বাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশেও সেভাবেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড দমন করা হবে। হানিফ মনে করেন, এ অবস্থা আর বেশি দিন চলবে না। জনগণ রাস্তায় বের হয়ে আসবে।
সরকারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলব না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান অবস্থায় সাধারণ মানুষের ভেতর সব চেয়ে বেশি যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল- এ পরিস্থিতি আর কত দিন চলবে। তাদের মতে, এর জবাবও সরকারকেই দিতে হবে । এ জন্য যেকোনোভাবে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে । অথবা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসে একটি ফয়সালা করতে হবে। অবশ্য এ জন্য বিএনপিকেও পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারা বন্ধ করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াওর মতো ধ্বংসাত্মক অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি তুলে নিয়ে সংলাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকার রক্ষণাত্মক (ডিফেন্সিভ) ভূমিকা নেয়ায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আগের চেয়ে রাস্তায় অনেক বেশি যানবাহন দেখা যায়। মানুষ ধীরে ধীরে রাস্তায় নামছে। এখন শুধু স্কুল-কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া শুরু হলে অবস্থা অনেক পাল্টে যাবে। অবস্থা আগের মতো স্বাভাবিক করার জন্য সরকার ডিসিসি নির্বাচনের কৌশল নিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মানুষকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে বের করে আনা ও বিএনপির আন্দোলন অকার্যকর করার কৌশলের অংশ হিসেবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। নির্বাচনী ডামাডোলে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও স্তিমিত হয়ে পড়বে বলেই বিশ্বাস করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাই সহসাই ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। এ নির্বাচন সফল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচনী ডামাঢোল শুরু হলে বিএনপি কোনোভাবেই চলমান আন্দোলন ধরে রাখতে পারবে না।
সরকারের রক্ষণাত্মক ভূমিকার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং নেতাকর্মীদের ওপর হামলা সত্ত্বেও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি শুরুর পর পরই পাড়া-মহল্লায় ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সংসদ সদস্যদের নিজ এলাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিটি হয়নি। কমিটির মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে গেলে সহিংসতা আরও বাড়ত। এর দায় পড়ত সরকারের ওপর। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেরা না গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীন দলটি কিছুটা হলেও প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও সরকারি মহল খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। আর এ কারণেই জেলা পর্যায়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
বিশেষ করে সংঘাতকবলিত উত্তরাঞ্চলের দুই জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশের কর্মকর্তা পর্যায়ে পরিবর্তনের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামেও কিছু পরিবর্তন আসবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। পুলিশের হেডকোয়ার্টারেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর চিন্তা করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের কৌশলী ভূমিকার অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির বিপক্ষে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক উপায়ে নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করবে তারা। বর্তমানে ১৪ দলের ব্যানারে সারা দেশে সমাবেশ কর্মসূচি চলছে। এসব সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করছেন। পাশাপাশি আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করে কার্যকর সাফল্য অর্জনের চেষ্টা চলছে।
চলমান অচলাবস্থা থেকে উত্তরণে বড় একটি উপায় হতে পারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির বাংলাদেশ সফর। তার আগেই বিএনপি কর্মসূচি প্রত্যাহারে বাধ্য হবে- এমন ধারণাও করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশটির পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থেকে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
No comments