লন্ডন ’৭১: মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্ট by মহিউদ্দিন আহমদ
সাহিত্যিক
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ম্যাগনাম্-ওপাস-এর একটি হচ্ছে তাঁর দুই খণ্ডের
উপন্যাস পূর্ব-পশ্চিম। এটিতে ’৪৭-এর দেশ বিভাগ-পরবর্তী ওপার বাংলা-এপার
বাংলার কথা আছে। বাংলাদেশের বিক্রমপুর থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত বিস্তৃত এই
উপন্যাসের ক্যানভাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা এবং কুশীলবের বর্ণনাও
আছে এই উপন্যাসে। দেশ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি ২৫ বছর আগে
প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রতি সপ্তাহে একটি
কিস্তি পড়া শেষে পরবর্তী কিস্তির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসটির নিচে উদ্ধৃত অংশটুকু আমার সম্পর্কে এই ছোট্ট আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক মনে করি:
‘সেখান (ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি) থেকে ওরা (উপন্যাসের দুই চরিত্র—অলি ও বিশাখা) দুজনে চলে এল ট্রাফালগার স্কয়ারে। লন্ডন শহরে যে কত বাঙালি থাকে, তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল এখানে এসে। আজ এখানে শুধু বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে। চতুর্দিকে বাঙালি মুখ। বাংলাদেশের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আজ এখানে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত। তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন।
‘ট্রাফালগার স্কয়ারে সব সময় টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। আজ সেখানে প্রায় চার-পাঁচ হাজার বাঙালি এসে জড়ো হয়েছে। প্রথমে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হলো, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। তারপর বিভিন্ন বক্তা শোনাতে লাগলেন বাংলার গ্রামগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি। একজন প্রস্তাব তুললেন, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসকে পৃথিবীর সব দেশের বয়কট করা উচিত। কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়। একজনের বক্তৃতার মাঝখানেই হঠাৎ একটা উল্লাসের কোলাহল শোনা গেল। এইমাত্র লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাতে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠল, জয় বাংলা! জয় বাংলা!’
লন্ডন তথা যুক্তরাজ্যে বাঙালিদের বৃহত্তম এই সমাবেশে যোগদান সহজতর করার জন্য সেদিন যুক্তরাজ্যে বাঙালি সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছিল, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত সব রকমের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে শত শত বাসভর্তি মানুষ এসেছিল সেদিন। সমাবেশে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ হয়েছিল বলে আমাদের বিশ্বাস।
১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি হাসান ফেরদৌসের বাসায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার সম্পর্কে তথ্যগুলো তিনি কোথা থেকে জোগাড় করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের এত দীর্ঘ এক সময়কালের ঐতিহাসিক সব ঘটনা বর্ণনা করতে তাঁকে অনেক বই ও কাগজপত্র পড়তে-ঘাঁটতে হয়েছে, অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। ওই সময়কার কাগজপত্রেই তিনি আমার কথা জেনেছিলেন। জেনেছিলেন জাহানারা ইমাম, রুমী এবং মুক্তিযুদ্ধের আরও অনেকের কথা, যাঁদের উল্লেখ তিনি করেছেন তাঁর এই উপন্যাসে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা শুরু থেকেই একটি জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। সব শ্রেণির মানুষ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শ্রমিক, কৃষক— সবাই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে যাঁর মতো সামর্থ্য অনুযায়ী অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ চলেছে তখন সীমান্তে, শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, হোটেলে, বনে-জঙ্গলে। মুক্তিযুদ্ধ তখন চলেছে রেডিওতে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, খেলার মাঠে, খোলা মাঠে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারেক মাসুদের মুক্তির গান ছবিতে এর কিছুটা বর্ণনা আছে।
মুক্তিযুদ্ধের তখন একটি ‘কূটনৈতিক ফ্রন্ট’ও ছিল। এই কূটনৈতিক ফ্রন্টেও মুক্তিযুদ্ধ চলেছে, চলেছে দুনিয়ার বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন দেশে। মুক্তিযুদ্ধের এই কূটনৈতিক ফ্রন্টটি খুলেছিলেন কে এম শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হক, নতুন দিল্লিতে, ১৯৭১-এর ৬ এপ্রিল। কে এম শিহাবউদ্দিন তখন নতুন দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের এক তরুণ কূটনীতিবিদ, সেকেন্ড সেক্রেটারি, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ১৯৬৬ ব্যাচের এক সদস্য। আর আমজাদুল হক, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস এটাচি। ’৭১-এর ডিসেম্বরে শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হকের ভাই।
এই তরুণ দুই বাঙালি কূটনীতিবিদ এমন একটি ঘটনা ঘটালেন, যেমনটি দুনিয়ার আর কোনো দেশে আগে ঘটেনি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর যে গণহত্যা শুরু করল, তার তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় এবং সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত হয়ে তাঁরা টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাঙালি সাংবাদিক দিলীপ মুখার্জির গ্রেটার কৈলাসের বাসায়, ৬ এপ্রিল মধ্যরাতে এক সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে কাঁপিয়ে দিলেন। তাঁদের অনুসরণ করলেন আরও কতগুলো দেশের পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত কিছু বাঙালি কূটনীতিবিদ।
লক্ষ করার বিষয়, কে এম শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকেরা যখন মুক্তিযুদ্ধের এই কূটনৈতিক ফ্রন্টটি খুললেন, তখনো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ’৭১-এর ১০ এপ্রিল এবং এই সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নেন ১৭ এপ্রিল, বৈদ্যনাথতলায়, এখন যার নাম মুজিবনগর। এই কূটনৈতিক ফ্রন্টে প্রবল এক ভূমিকম্পের শক্তিতে যোগ দিলেন কলকাতায় পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনে কর্মরত সব বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের পরদিন, ১৮ এপ্রিল, বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ৪৯ ব্যাচের এক সদস্য, হোসেন আলীর নেতৃত্বে। ১০৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল ৬৫। তাঁরা আগের দিন ব্যাংক থেকে সব টাকাই তুলে নিলেন আর দখল করে নিলেন ডেপুটি হাইকমিশন ভবনটিও। একাত্তরে আমরা পাকিস্তান দূতাবাসগুলোর ওই একটিই দখল করতে পেরেছিলাম। এই উপদূতাবাসের অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হলো তখন।
এর পরের ফ্রন্টটি ছিল নিউইয়র্কে। সেখানকার পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেলের ভাইস কনসাল ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ১৯৬৬ ব্যাচের এক পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা। তিনি পদত্যাগ করলেন ২৬ এপ্রিল। আজকের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত তখন ওয়াশিংটনের পাকিস্তান এম্বাসিতে ইকোনমিক কাউন্সেলর, তিনি পদত্যাগ করলেন ৩০ জুন। ওয়াশিংটনে তখন ডেপুটি চিফ অব মিশন এনায়েত করিম ও পলিটিক্যাল কাউন্সেলর এস এ এম এস কিবরিয়া পদত্যাগ করলেন ৪ আগস্ট। এই দিন পদত্যাগ করলেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের পাকিস্তান স্থায়ী মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি এস এ করিমও। কাঠমান্ডু থেকে পদত্যাগ করলেন সেকেন্ড সেক্রেটারি মুস্তাফিজুর রহমান।
একাত্তরে যে তিনজন বাঙালি রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের ‘মার্ডারার’ সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কূটনৈতিক ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ, ২১ আগস্ট; ফিলিপাইনের কে কে পন্নী, ১৪ সেপ্টেম্বর; আর্জেন্টিনায় আবদুল মোমেন, ১১ অক্টোবর। এমন আরও পদত্যাগ ঘটেছে প্যারিস, বার্ন হংকং, স্টকহোম, লাগোস, ব্রাসেলস, আফ্রিকা, বৈরুত, টোকিও, কায়রোতেও। ফলে এসব জায়গায় পাকিস্তানের অপপ্রচার প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খায়।
দেশ থেকে ২৫ মার্চের পর থেকেই গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার-নির্যাতনের খবর পাচ্ছিলাম। মার্চ-এপ্রিলে লন্ডনের আকাশ প্রায়শই মেঘলা, মাঝেমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও। প্রতিকূল আবহাওয়া। তার ওপর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমি পাকিস্তান হাইকমিশনে যাই, কিন্তু কোনো কাজ নেই। ঘরে-বাইরে, দেশে সাংঘাতিক সব খবর। ওখানকার পত্রপত্রিকায়, টিভিতে, রেডিওতে আরও বেশি বেশি খবর। এর মধ্যে খবর পাই মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্টের। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকেও তো কিছু করতে হয়।
১০ এপ্রিল, বিবিসি বাংলা বিভাগে দেখা হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে। এই দিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরাসরি কাজ করবেন। স্যারকে অনুরোধ করলাম আমাকেও সঙ্গে নিতে। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। বললেন, মুজিবনগর সরকার তখনো গঠিত হয়নি। আমাকে দিয়ে তিনি কী কাজ করাবেন, তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে আগে। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকল।
একাত্তরের ১ আগস্ট, বাংলাদেশিদের বৃহত্তম সমাবেশটি হয় সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি সকাল সাতটার দিকে টেলিফোন করে বললাম, স্যার, এত বড় একটি সমাবেশে যদি প্রকাশ্যে আমার পদত্যাগের ঘোষণাটি দিতে অনুমতি দেন, যুক্তরাজ্যের বাঙালি মহলে তো বটেই, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মিডিয়া জগৎ এবং কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস। অপরাধ বোধ করছি, স্যার।
আবু সাঈদ চৌধুরী তখনই কিছু না বলে ১০ মিনিট পর আমাকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন বললেন। ১০ মিনিট পর তিনি আমাকে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। দ্রুতই আমার গাড়িটি চালিয়ে তাঁর উত্তর লন্ডনের বাসায় চলে গেলাম। স্ত্রীকে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, কায়সার, খালেদ ও শিরিনের তত্ত্বাবধানে রেখে স্যারের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ট্রাফালগার স্কয়ারে যাই। তার পরের ঘটনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপরের উদ্ধৃতিতে আছে।
সেদিন বিকেল থেকে রেডিওতে এবং পরদিন লন্ডন টাইমস-এর ওভারসিজ নিউজ সেকশনে আমাকে নিয়ে সচিত্র প্রথম এবং গার্ডিয়ান-এর পেছনের পাতায় বড় খবর। তিন সপ্তাহ পর, ২৩ আগস্ট প্রথম সন্তান অরুর জন্ম।
লন্ডন তথা সারা ইউরোপে বাংলদেশের প্রথম কূটনৈতিক ফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হলো, যখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৭ আগস্ট লন্ডনের নটিংহিল গেটের ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনে আমাদের কূটনৈতিক মিশন উদ্বোধন করেন, অনেক বাঙালি, লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি লুৎফুল মতিন, লাগোস থেকে পদত্যাগকারী তৃতীয় সচিব মহিউদ্দিন জায়গীরদার, রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ এবং সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও এন্থনি ম্যাসকারেন হাসদের উপস্থিতিতে। ইতিমধ্যে আরও কতগুলো দেশ থেকে আরও কিছু বাঙালি স্টাফ আমাদের সঙ্গে লন্ডনে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন আরও বেশি, ২৭ আগস্টের পরে। ব্রিটিশ সরকার আমাদের এই মিশনকে স্বীকৃতি দেয়নি; তাতে কী, আমরা দমে থাকিনি।
লন্ডনে আমাদের প্রথম সেই মিশনটি এখন বাংলাদেশ সেন্টার।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
‘সেখান (ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি) থেকে ওরা (উপন্যাসের দুই চরিত্র—অলি ও বিশাখা) দুজনে চলে এল ট্রাফালগার স্কয়ারে। লন্ডন শহরে যে কত বাঙালি থাকে, তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল এখানে এসে। আজ এখানে শুধু বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে। চতুর্দিকে বাঙালি মুখ। বাংলাদেশের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আজ এখানে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত। তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন।
‘ট্রাফালগার স্কয়ারে সব সময় টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। আজ সেখানে প্রায় চার-পাঁচ হাজার বাঙালি এসে জড়ো হয়েছে। প্রথমে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হলো, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। তারপর বিভিন্ন বক্তা শোনাতে লাগলেন বাংলার গ্রামগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি। একজন প্রস্তাব তুললেন, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসকে পৃথিবীর সব দেশের বয়কট করা উচিত। কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়। একজনের বক্তৃতার মাঝখানেই হঠাৎ একটা উল্লাসের কোলাহল শোনা গেল। এইমাত্র লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাতে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠল, জয় বাংলা! জয় বাংলা!’
লন্ডন তথা যুক্তরাজ্যে বাঙালিদের বৃহত্তম এই সমাবেশে যোগদান সহজতর করার জন্য সেদিন যুক্তরাজ্যে বাঙালি সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছিল, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত সব রকমের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে শত শত বাসভর্তি মানুষ এসেছিল সেদিন। সমাবেশে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ হয়েছিল বলে আমাদের বিশ্বাস।
১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি হাসান ফেরদৌসের বাসায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার সম্পর্কে তথ্যগুলো তিনি কোথা থেকে জোগাড় করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই উপন্যাসের এত দীর্ঘ এক সময়কালের ঐতিহাসিক সব ঘটনা বর্ণনা করতে তাঁকে অনেক বই ও কাগজপত্র পড়তে-ঘাঁটতে হয়েছে, অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। ওই সময়কার কাগজপত্রেই তিনি আমার কথা জেনেছিলেন। জেনেছিলেন জাহানারা ইমাম, রুমী এবং মুক্তিযুদ্ধের আরও অনেকের কথা, যাঁদের উল্লেখ তিনি করেছেন তাঁর এই উপন্যাসে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা শুরু থেকেই একটি জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। সব শ্রেণির মানুষ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শ্রমিক, কৃষক— সবাই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে যাঁর মতো সামর্থ্য অনুযায়ী অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ চলেছে তখন সীমান্তে, শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, হোটেলে, বনে-জঙ্গলে। মুক্তিযুদ্ধ তখন চলেছে রেডিওতে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, খেলার মাঠে, খোলা মাঠে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারেক মাসুদের মুক্তির গান ছবিতে এর কিছুটা বর্ণনা আছে।
মুক্তিযুদ্ধের তখন একটি ‘কূটনৈতিক ফ্রন্ট’ও ছিল। এই কূটনৈতিক ফ্রন্টেও মুক্তিযুদ্ধ চলেছে, চলেছে দুনিয়ার বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন দেশে। মুক্তিযুদ্ধের এই কূটনৈতিক ফ্রন্টটি খুলেছিলেন কে এম শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হক, নতুন দিল্লিতে, ১৯৭১-এর ৬ এপ্রিল। কে এম শিহাবউদ্দিন তখন নতুন দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের এক তরুণ কূটনীতিবিদ, সেকেন্ড সেক্রেটারি, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ১৯৬৬ ব্যাচের এক সদস্য। আর আমজাদুল হক, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস এটাচি। ’৭১-এর ডিসেম্বরে শহীদ সাংবাদিক নাজমুল হকের ভাই।
এই তরুণ দুই বাঙালি কূটনীতিবিদ এমন একটি ঘটনা ঘটালেন, যেমনটি দুনিয়ার আর কোনো দেশে আগে ঘটেনি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর যে গণহত্যা শুরু করল, তার তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ায় এবং সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত হয়ে তাঁরা টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাঙালি সাংবাদিক দিলীপ মুখার্জির গ্রেটার কৈলাসের বাসায়, ৬ এপ্রিল মধ্যরাতে এক সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে কাঁপিয়ে দিলেন। তাঁদের অনুসরণ করলেন আরও কতগুলো দেশের পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত কিছু বাঙালি কূটনীতিবিদ।
লক্ষ করার বিষয়, কে এম শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকেরা যখন মুক্তিযুদ্ধের এই কূটনৈতিক ফ্রন্টটি খুললেন, তখনো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ’৭১-এর ১০ এপ্রিল এবং এই সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নেন ১৭ এপ্রিল, বৈদ্যনাথতলায়, এখন যার নাম মুজিবনগর। এই কূটনৈতিক ফ্রন্টে প্রবল এক ভূমিকম্পের শক্তিতে যোগ দিলেন কলকাতায় পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনে কর্মরত সব বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের পরদিন, ১৮ এপ্রিল, বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ৪৯ ব্যাচের এক সদস্য, হোসেন আলীর নেতৃত্বে। ১০৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল ৬৫। তাঁরা আগের দিন ব্যাংক থেকে সব টাকাই তুলে নিলেন আর দখল করে নিলেন ডেপুটি হাইকমিশন ভবনটিও। একাত্তরে আমরা পাকিস্তান দূতাবাসগুলোর ওই একটিই দখল করতে পেরেছিলাম। এই উপদূতাবাসের অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হলো তখন।
এর পরের ফ্রন্টটি ছিল নিউইয়র্কে। সেখানকার পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেলের ভাইস কনসাল ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ১৯৬৬ ব্যাচের এক পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা। তিনি পদত্যাগ করলেন ২৬ এপ্রিল। আজকের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত তখন ওয়াশিংটনের পাকিস্তান এম্বাসিতে ইকোনমিক কাউন্সেলর, তিনি পদত্যাগ করলেন ৩০ জুন। ওয়াশিংটনে তখন ডেপুটি চিফ অব মিশন এনায়েত করিম ও পলিটিক্যাল কাউন্সেলর এস এ এম এস কিবরিয়া পদত্যাগ করলেন ৪ আগস্ট। এই দিন পদত্যাগ করলেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের পাকিস্তান স্থায়ী মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি এস এ করিমও। কাঠমান্ডু থেকে পদত্যাগ করলেন সেকেন্ড সেক্রেটারি মুস্তাফিজুর রহমান।
একাত্তরে যে তিনজন বাঙালি রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের ‘মার্ডারার’ সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কূটনৈতিক ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ, ২১ আগস্ট; ফিলিপাইনের কে কে পন্নী, ১৪ সেপ্টেম্বর; আর্জেন্টিনায় আবদুল মোমেন, ১১ অক্টোবর। এমন আরও পদত্যাগ ঘটেছে প্যারিস, বার্ন হংকং, স্টকহোম, লাগোস, ব্রাসেলস, আফ্রিকা, বৈরুত, টোকিও, কায়রোতেও। ফলে এসব জায়গায় পাকিস্তানের অপপ্রচার প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খায়।
দেশ থেকে ২৫ মার্চের পর থেকেই গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার-নির্যাতনের খবর পাচ্ছিলাম। মার্চ-এপ্রিলে লন্ডনের আকাশ প্রায়শই মেঘলা, মাঝেমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও। প্রতিকূল আবহাওয়া। তার ওপর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমি পাকিস্তান হাইকমিশনে যাই, কিন্তু কোনো কাজ নেই। ঘরে-বাইরে, দেশে সাংঘাতিক সব খবর। ওখানকার পত্রপত্রিকায়, টিভিতে, রেডিওতে আরও বেশি বেশি খবর। এর মধ্যে খবর পাই মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্টের। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকেও তো কিছু করতে হয়।
১০ এপ্রিল, বিবিসি বাংলা বিভাগে দেখা হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে। এই দিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরাসরি কাজ করবেন। স্যারকে অনুরোধ করলাম আমাকেও সঙ্গে নিতে। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। বললেন, মুজিবনগর সরকার তখনো গঠিত হয়নি। আমাকে দিয়ে তিনি কী কাজ করাবেন, তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে আগে। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকল।
একাত্তরের ১ আগস্ট, বাংলাদেশিদের বৃহত্তম সমাবেশটি হয় সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি সকাল সাতটার দিকে টেলিফোন করে বললাম, স্যার, এত বড় একটি সমাবেশে যদি প্রকাশ্যে আমার পদত্যাগের ঘোষণাটি দিতে অনুমতি দেন, যুক্তরাজ্যের বাঙালি মহলে তো বটেই, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মিডিয়া জগৎ এবং কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস। অপরাধ বোধ করছি, স্যার।
আবু সাঈদ চৌধুরী তখনই কিছু না বলে ১০ মিনিট পর আমাকে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন বললেন। ১০ মিনিট পর তিনি আমাকে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। দ্রুতই আমার গাড়িটি চালিয়ে তাঁর উত্তর লন্ডনের বাসায় চলে গেলাম। স্ত্রীকে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, কায়সার, খালেদ ও শিরিনের তত্ত্বাবধানে রেখে স্যারের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ট্রাফালগার স্কয়ারে যাই। তার পরের ঘটনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপরের উদ্ধৃতিতে আছে।
সেদিন বিকেল থেকে রেডিওতে এবং পরদিন লন্ডন টাইমস-এর ওভারসিজ নিউজ সেকশনে আমাকে নিয়ে সচিত্র প্রথম এবং গার্ডিয়ান-এর পেছনের পাতায় বড় খবর। তিন সপ্তাহ পর, ২৩ আগস্ট প্রথম সন্তান অরুর জন্ম।
লন্ডন তথা সারা ইউরোপে বাংলদেশের প্রথম কূটনৈতিক ফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হলো, যখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৭ আগস্ট লন্ডনের নটিংহিল গেটের ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনে আমাদের কূটনৈতিক মিশন উদ্বোধন করেন, অনেক বাঙালি, লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি লুৎফুল মতিন, লাগোস থেকে পদত্যাগকারী তৃতীয় সচিব মহিউদ্দিন জায়গীরদার, রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ এবং সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও এন্থনি ম্যাসকারেন হাসদের উপস্থিতিতে। ইতিমধ্যে আরও কতগুলো দেশ থেকে আরও কিছু বাঙালি স্টাফ আমাদের সঙ্গে লন্ডনে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন আরও বেশি, ২৭ আগস্টের পরে। ব্রিটিশ সরকার আমাদের এই মিশনকে স্বীকৃতি দেয়নি; তাতে কী, আমরা দমে থাকিনি।
লন্ডনে আমাদের প্রথম সেই মিশনটি এখন বাংলাদেশ সেন্টার।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
No comments