পুলিশের আবদার! by সোহরাব হাসান
৫
মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু
(নিবারণ) আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
পাঠানো প্রস্তাবটিতে আইনের অধিকাংশ ধারার পরিবর্তন ও বাতিলের সুপারিশ করা
হয়েছে। পুলিশ বিভাগের দাবি, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের ফলে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মিথ্যা
মামলার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আইন
প্রয়োগকারী বিভিন্ন বেসামরিক সংস্থার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন এর ফলে
বাধাগ্রস্ত হবে। এ আইনের কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হরতাল,
অবরোধ, বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম থেকে
জনসাধারণের জানমাল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ
নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা
ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পুলিশ বিভাগের এই দাবি
মোটেই ঠিক নয়। বরং আইনটি বহাল থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীগুলো বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে
‘অবারিত’ মামলা করে যাচ্ছে এবং অনেককে দফায় দফায় রিমান্ডেও নিচ্ছে। এ কথাও
সত্য নয় যে, এই আইনের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জনগণের
জানমালের হেফাজত দিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সারা দেশে
বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে বেশুমার মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের
কারণেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতি
মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার কাউকে ধরে আনতে বললে তারা
বেঁধে আনে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে কানসাট কিংবা শনির আখড়ার কথা আমরা ভুলে
যাইনি। কিংবা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের
ঘটনাও।
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার’ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। জনগণ আশা করেছিল, ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের পুরোনো পথে হাঁটবে না এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যুগোপযোগী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। তারা এমন একটি আইন করবে, যাতে নিরাপত্তা হেফাজতে কেউ নির্যাতন ও হয়রানির শিকার না হন। কিন্তু সেটি যখন হয়নি, তখন সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংসদ ইউনিয়নের সভাপতি) নবম জাতীয় সংসদে একটি বেসরকারি বিল আনেন, যার লক্ষ্য ছিল নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা দেওয়া। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিলটি পাস হয়। এই বিলের প্রেক্ষাপটটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্লেট-গ্লাস চুরির মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে রিমান্ডে নেয়। সে সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এমনকি ভিন্নমতের লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের জিঘাংসার শিকার হয়েছিলেন। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলা করেছিল জঙ্গিবাদীরা। আর এই ঘটনার দায়ে সরকার গ্রেপ্তার করে ও রিমান্ডে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও লেখক শাহরিয়ার কবিরকে।
আবার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা একইভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের শিকার হয়েছিলেন (বর্তমান সরকারের আমলে সেই অপসংস্কৃতি রহিত হয়েছে ভাবার কারণ নেই)।
বিল পেশের সময় এর উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যাসংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং সংবিধানের সকল নাগরিকের এই অধিকার সংরক্ষিত আছে।…কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যারা আইনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে যায়, ফলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। জনগণকে বিভিন্ন অজুহাতে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে এবং পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়। বিভিন্ন সময়ে আইনের হেফাজতে রেখে নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এমনকি নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে অহরহই।
সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে, আইনের শাসন সুরক্ষিত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে, সাধারণ মানুষকে সরকারি প্রশাসনযন্ত্র ও পুলিশের বেআইনি আচরণ, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষাকল্পে ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের সুবিধা নিশ্চিত করতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে এ বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে।’
বর্তমান পুলিশপ্রধান অভিযোগ করেছেন, বিলটি নিয়ে সংসদে যেভাবে আলোচনা হওয়া দরকার, সেভাবে হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে যায়নি। সংসদীয় কমিটিতে না পাঠিয়ে কোনো বিল সংসদে পাস করার নজির নেই। এসব উদ্ভট কথাবার্তার মানে কী? প্রকৃত ঘটনা হলো বিলটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে সাত দফা আলোচনা হয়েছে। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এবং সদস্য আ স ম ফিরোজ, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, হাফিজ আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, মুহিবুর রহমান মানিক, আবদুল হাই ও সৈয়দা আশরাফী পাপিয়া। কমিটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আমীর-উল ইসলাম, আবদুল বাসেত মজুমদার, সুলতানা কামাল, আদিলুর রহমান প্রমুখের মতামত নিয়েছে। এরপর সেটি ভেটিং বা ছাড়পত্রের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া সরকারি–বেসরকারি কোনো বিল সংসদে অনুমোদিত হতে পারে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি নির্যাতনবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। যার শিরোনাম ছিল নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সনদ (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল ইন হিউম্যান অব ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট)। বাংলাদেশ এই সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে নির্যাতনবিরোধী ওই আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য।
এখন দেখা যাক আইনে কী আছে এবং পুলিশ বিভাগ কী কী সংশোধনী চাইছে। আইনে হেফাজতে মৃত্যু বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গ্রেপ্তারের সময়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কেবল সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতে মৃত্যু অথবা গ্রেপ্তারের সময় ফৌজদারি কার্যবিধি এবং অন্য কোনো প্রচলিত আইনের বিধানের অধীনে কৃতকাজ ব্যতিরেকে মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বলতে এ আইনের অধীনে বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাকে বোঝাবে। আইনে থাকা ‘উদ্বিগ্ন কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে’ অংশটি সংশোধনীতে বাদ দেওয়া হয়েছে। আইনে নির্যাতন বলতে শারীরিক ও মানসিক দুটোই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সংশোধনীতে মানসিক নির্যাতন বাদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনটি ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ এই কার্যবিধি প্রণয়নের পর বিভিন্ন দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে বহু আইন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারি কার্যবিধির দোহাই দিচ্ছে।
আইনে বলা হয়েছে, আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করেন যে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে আদালত ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করে সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দিতে পারবেন। পুলিশের সংশোধনীতে থানা বা ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের বিষয়টি না হয় মানা গেল। কিন্তু থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে যে তার প্রতিকার মিলবে তার ভরসা কী?
এই আইনের অধীনে সব অপরাধ অ–আপসযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের প্রস্তাবে অপরাধ জামিনযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনের ১১(৪) ধারায় আছে, কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবেন। পুলিশ এটির বিলুপ্তি চেয়েছে। আইনে আছে, কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা আছে। কিন্তু সংশোধনীতে সর্বোচ্চ পঁাচ বছর ও সর্বনিম্ন দুই বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা দণ্ড লঘু করতে তৎপর।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আইনে যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কাস্টম, ইমিগ্রেশন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা ইত্যাদির কথা বলা আছে; সেখানে সংশোধনীতে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বিশেষ শাখা ও গোয়েন্দা শাখার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। একই যাত্রায় দুই ফল হতে পারে না।
আরেকটি উদ্বেগজনক প্রস্তাব হলো পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেই মামলার শাস্তির অর্ধেক বাদীকে ভোগ করতে হবে। এটি ফরিয়াদির প্রতিকার চাওয়ার পথ অনেকটাই রুদ্ধ করবে। অন্যদিকে এই প্রস্তাবটি যদি খোদ পুলিশ বিভাগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তাহলে কতজন পুলিশ সদস্য জেলখানার বাইরে এবং কতজন ভেতরে থাকবেন, সেটি বলা কঠিন।
পুলিশের এসব প্রস্তাব কি ভীতি বা আতঙ্কেরই বহিঃপ্রকাশ নয়? আসামি ধরার সময় এবং ধরার পর যে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর যদি সেটাই না হবে, তাহলে পুলিশের বাড়তি আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন পড়ল কেন? কোনো সভ্য দেশই এই অদ্ভুত আবদার মেনে নিতে পারে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘জনজীবনে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার’ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। জনগণ আশা করেছিল, ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের পুরোনো পথে হাঁটবে না এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যুগোপযোগী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। তারা এমন একটি আইন করবে, যাতে নিরাপত্তা হেফাজতে কেউ নির্যাতন ও হয়রানির শিকার না হন। কিন্তু সেটি যখন হয়নি, তখন সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংসদ ইউনিয়নের সভাপতি) নবম জাতীয় সংসদে একটি বেসরকারি বিল আনেন, যার লক্ষ্য ছিল নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা দেওয়া। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিলটি পাস হয়। এই বিলের প্রেক্ষাপটটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্লেট-গ্লাস চুরির মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে রিমান্ডে নেয়। সে সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এমনকি ভিন্নমতের লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের জিঘাংসার শিকার হয়েছিলেন। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলা করেছিল জঙ্গিবাদীরা। আর এই ঘটনার দায়ে সরকার গ্রেপ্তার করে ও রিমান্ডে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও লেখক শাহরিয়ার কবিরকে।
আবার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা একইভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের শিকার হয়েছিলেন (বর্তমান সরকারের আমলে সেই অপসংস্কৃতি রহিত হয়েছে ভাবার কারণ নেই)।
বিল পেশের সময় এর উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যাসংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং সংবিধানের সকল নাগরিকের এই অধিকার সংরক্ষিত আছে।…কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যারা আইনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে যায়, ফলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। জনগণকে বিভিন্ন অজুহাতে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে এবং পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়। বিভিন্ন সময়ে আইনের হেফাজতে রেখে নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতন করা হয়। এমনকি নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে অহরহই।
সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে, আইনের শাসন সুরক্ষিত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে, সাধারণ মানুষকে সরকারি প্রশাসনযন্ত্র ও পুলিশের বেআইনি আচরণ, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষাকল্পে ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের সুবিধা নিশ্চিত করতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে এ বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে।’
বর্তমান পুলিশপ্রধান অভিযোগ করেছেন, বিলটি নিয়ে সংসদে যেভাবে আলোচনা হওয়া দরকার, সেভাবে হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে যায়নি। সংসদীয় কমিটিতে না পাঠিয়ে কোনো বিল সংসদে পাস করার নজির নেই। এসব উদ্ভট কথাবার্তার মানে কী? প্রকৃত ঘটনা হলো বিলটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে সাত দফা আলোচনা হয়েছে। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এবং সদস্য আ স ম ফিরোজ, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, হাফিজ আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, মুহিবুর রহমান মানিক, আবদুল হাই ও সৈয়দা আশরাফী পাপিয়া। কমিটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আমীর-উল ইসলাম, আবদুল বাসেত মজুমদার, সুলতানা কামাল, আদিলুর রহমান প্রমুখের মতামত নিয়েছে। এরপর সেটি ভেটিং বা ছাড়পত্রের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া সরকারি–বেসরকারি কোনো বিল সংসদে অনুমোদিত হতে পারে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি নির্যাতনবিরোধী সনদ গ্রহণ করে। যার শিরোনাম ছিল নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সনদ (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল ইন হিউম্যান অব ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট)। বাংলাদেশ এই সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে নির্যাতনবিরোধী ওই আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য।
এখন দেখা যাক আইনে কী আছে এবং পুলিশ বিভাগ কী কী সংশোধনী চাইছে। আইনে হেফাজতে মৃত্যু বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গ্রেপ্তারের সময়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কেবল সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতে মৃত্যু অথবা গ্রেপ্তারের সময় ফৌজদারি কার্যবিধি এবং অন্য কোনো প্রচলিত আইনের বিধানের অধীনে কৃতকাজ ব্যতিরেকে মৃত্যু বোঝানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বলতে এ আইনের অধীনে বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাকে বোঝাবে। আইনে থাকা ‘উদ্বিগ্ন কারও ওপর নির্যাতন করা হয়েছে’ অংশটি সংশোধনীতে বাদ দেওয়া হয়েছে। আইনে নির্যাতন বলতে শারীরিক ও মানসিক দুটোই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সংশোধনীতে মানসিক নির্যাতন বাদ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনটি ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ এই কার্যবিধি প্রণয়নের পর বিভিন্ন দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে বহু আইন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারি কার্যবিধির দোহাই দিচ্ছে।
আইনে বলা হয়েছে, আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করেন যে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে আদালত ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করে সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দিতে পারবেন। পুলিশের সংশোধনীতে থানা বা ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের বিষয়টি না হয় মানা গেল। কিন্তু থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে যে তার প্রতিকার মিলবে তার ভরসা কী?
এই আইনের অধীনে সব অপরাধ অ–আপসযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের প্রস্তাবে অপরাধ জামিনযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনের ১১(৪) ধারায় আছে, কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবেন। পুলিশ এটির বিলুপ্তি চেয়েছে। আইনে আছে, কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা আছে। কিন্তু সংশোধনীতে সর্বোচ্চ পঁাচ বছর ও সর্বনিম্ন দুই বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা দণ্ড লঘু করতে তৎপর।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আইনে যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কাস্টম, ইমিগ্রেশন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা ইত্যাদির কথা বলা আছে; সেখানে সংশোধনীতে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বিশেষ শাখা ও গোয়েন্দা শাখার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। একই যাত্রায় দুই ফল হতে পারে না।
আরেকটি উদ্বেগজনক প্রস্তাব হলো পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেই মামলার শাস্তির অর্ধেক বাদীকে ভোগ করতে হবে। এটি ফরিয়াদির প্রতিকার চাওয়ার পথ অনেকটাই রুদ্ধ করবে। অন্যদিকে এই প্রস্তাবটি যদি খোদ পুলিশ বিভাগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তাহলে কতজন পুলিশ সদস্য জেলখানার বাইরে এবং কতজন ভেতরে থাকবেন, সেটি বলা কঠিন।
পুলিশের এসব প্রস্তাব কি ভীতি বা আতঙ্কেরই বহিঃপ্রকাশ নয়? আসামি ধরার সময় এবং ধরার পর যে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর যদি সেটাই না হবে, তাহলে পুলিশের বাড়তি আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন পড়ল কেন? কোনো সভ্য দেশই এই অদ্ভুত আবদার মেনে নিতে পারে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments