পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’ by আলী ইমাম মজুমদার

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সত্তায় এমনভাবে বিরাজমান যে এ থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। তিনি রয়েছেন আমাদের আনন্দ, বেদনা, মিলন, বিরহ আর সংকটে। তাঁর বাণী আমাদের ভাবনাকে করে জাগ্রত। শাণিত হয় ভাষা। আর এরই জন্য বারবার আমরা ছুটে যাই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কাছে। তাঁর একটি ছোট্ট কবিতা ‘ভক্তিভাজন’। এ কবিতা থেকেই শিরোনামটির উদ্ধৃতি। প্রসঙ্গ পরে আলোচনায় আসবে।

এ নিবন্ধে মূল আলোচ্য বিষয় তিস্তা। নদীটি দেশের উত্তরাঞ্চলের বাঁকে বাঁকে চললেও ছোট নয় মোটেই। আর বৈশাখ মাসে এতে হাঁটুজল থাকত না। পার হতে পারত না গরু আর গাড়ি। খরায় কিছুটা ক্ষীণস্রোতা হলেও প্রমত্তা ছিল এ নদী। হিমালয়ের একটি হিমবাহ এর উৎস। উৎসের ঠিকানা ভারতের সিকিম রাজ্য। সে রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৩০০ কিলোমিটারের অধিক দৈর্ঘ্যের এ নদীটি সব অর্থেই আন্তর্জাতিক। বাংলাদেশে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর আর বগুড়া জেলার প্রায় আড়াই কোটি লোক এর ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘ পথযাত্রা শেষ করে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে চিলমারী বন্দরের কাছে। এ নদীটিকে কেন্দ্র করে উত্তরাঞ্চলে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি সুন্দর সেচব্যবস্থা। গত বছর সেচ দেওয়া হয়েছিল ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে। আর এবার ২৫ হাজার হেক্টরে থেমে গেছে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ। অবশ্য সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে অনুরূপ আরেকটি সেচ প্রকল্প রয়েছে। জানা যায়, সিকিমে নির্মিত হয়েছে একাধিক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু দুটো দেশ কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করতে পারবে, তা নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে উজানের দেশ ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহারের সুযোগ পাচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। আর সে বঞ্চনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা মাঝেমধ্যে লক্ষণীয় হলেও তা তিমিরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করতে সক্ষম হয়। সেবার তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। এর আগে ও পরের সরকারগুলোর এ বিষয়ে প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার আবার ক্ষমতায় এলে জনগণ বিশ্বাস করতে থাকে যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। বিশ্বাস যৌক্তিক ছিল। এ সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা বিধানে ভারত সরকারকে সার্বিক নৈতিক ও বৈষয়িক সহায়তা দিয়ে চলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের পণ্য আনা-নেওয়া করতে বাংলাদেশের স্থল ও নৌপথ ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে উদারভাবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। এর কারণও সবারই জানা। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হতে গিয়েও হয়নি। প্রস্তাবিত চুক্তি আপাতত হিমাগারে। চলমান লোকসভা নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হলে বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ উদ্যমে বিষয়টি মীমাংসার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভারতের সদিচ্ছা অপরিহার্য। ঠিক তেমনি ভারতকে এ ক্ষুদ্র প্রতিবেশীটির ভূমিকাও মূল্যায়ন করতে হবে। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় অমীমাংসিত থাকলে জনভোগান্তি বৃদ্ধি পায়। আর এর সুযোগ নিতে সচেষ্ট হয় উভয় দেশের সম্পর্ক বিনষ্টকারী মহল। দুই দেশের নেতাদের দূরদৃষ্টি আর দেওয়া-নেওয়ার মনোভাবের মাধ্যমে জোরদার হতে পারে স্বস্তির ভিত। সামান্য ছাড় ভবিষ্যতে বৃহৎ প্রাপ্তির বীজ বপন করতে পারে।
প্রসঙ্গ ছিল তিস্তা। এবারে সেচ মৌসুমে জ্বলে-পুড়ে বেশুমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এর সেচ অঞ্চল। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে এর অববাহিকায়। নৌ-চলাচলব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মূল নদীতে পানিপ্রবাহ নেই বললেই চলে। কোথাও হয়তো বা গরু আর গাড়ি পার হতেও আটকায় না। প্রয়োজন ন্যূনতম পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিউসেক পানি। গোটা সেচ মৌসুম অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চে গড়ে পেয়েছে ৪০০-৪৫০ কিউসেক পানি। ফসল আবাদ করে সেচের অপেক্ষায় হাহাকার করছেন চাষি। তাই যেটুকু পানি পাওয়া যায় তা সেচখালেই দিতে হয়। সুতরাং নদীর মূল স্রোতোধারা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরাই বা কী করবেন? তিস্তায় এ ধরনের পানিস্বল্পতা তাঁরা বোধ হয় সাম্প্রতিক কালে মোকাবিলা করেননি।
তিস্তা প্রকল্পটি হঠাৎ জাতীয় গণমাধ্যমে নতুনভাবে আলোচনায় চলে এল এর আকস্মিক পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি নিয়ে। ২২ এপ্রিল পানির প্রবাহ দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার কিউসেক। অথচ ২০ আর ২১ তারিখে ছিল যথাক্রমে ৭০০ আর ৮৫০ কিউসেক। জানা যায়, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭ তারিখে প্রবাহ দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে ১২৪৩, ১১৮৬, ১৩৬৬ আর ১৯৫৫ কিউসেকে। উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রকল্পে আলোচ্য সময়ে পাওয়া যাচ্ছিল প্রয়োজনের এক-দশমাংশ পানি। সেচ মৌসুমের শেষ প্রান্তে আকস্মিক কিছুটা পানি বৃদ্ধি সম্পর্কে স্থানীয় প্রকৌশলীরা মনে করেন উজানের গজলডোবায় মেরামত বা অন্য কোনো প্রয়োজনে গেট খোলার ফলে বেশি পানি এসেছিল। আর আমাদের মতো পশ্চিমবঙ্গেরও সেচ মৌসুম শেষ হওয়ার পথে বিধায় এমনিতে ক্রমান্বয়ে নদীতে পানি বেশি আসার কথা। যদি আমাদের প্রয়োজনে পানি ছাড়া হতো, সেখানকার কর্তৃপক্ষ আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা ছিল। স্বাভাবিক ছিল বর্ধিত পানির ধারাবাহিকতা থাকা। কিন্তু কোনোটিই হয়নি। তাই এক দিনের বাদশাহি নিয়ে এত মাতামাতির তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না।
তাও হয়েছে। তিস্তায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ২২ এপ্রিল একটি প্রধান রাজনৈতিক দল আয়োজন করে লংমার্চের। কর্মসূচিটি নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল ছিল। তাই দোষণীয় কিছু নেই। তবে আকস্মিক সাময়িক পানি বৃদ্ধি কাকতালীয়ভাবে এর সময়ের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘এটা লংমার্চের প্রাথমিক সাফল্য। আমরা সাময়িক নয়, পুরোপুরি সফলতা চাই।’ অপর দিকে একই সময়ে জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় দাবি করা হয়, অধিক পানি প্রাপ্তি সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফসল। ঠিক এর পরদিনই পানিপ্রবাহ ব্যাপক হ্রাস পাওয়ায় দাবি দুটোর অসারতাই প্রমাণিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিস্তার প্রবাহ নিয়ে উভয় পক্ষই রাজনীতি করছে। আর তিস্তা তো রাজনীতিরই শিকার। এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিস্তার পানিবণ্টন সম্পর্কে দুটো দেশকে সমাধানে আসতে হবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায়। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে এর জন্য জোরদার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষণীয় হয়নি। আর বর্তমান সরকার গত পাঁচ বছর ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েও সফল হয়নি। তাই এর দায়ভার উভয় পক্ষকেই নিতে হবে।
সে দায়ভার মেটানো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলেও আকস্মিক ভিন্ন কোনো কারণে এক দিনে পানি বৃদ্ধি নিজ নিজ সাফল্য বলে হাস্যকর দাবি করতেও তারা পিছপা হয়নি। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ভক্তিভাজন কবিতাটি অনেকটা প্রাসঙ্গিক। লোকারণ্য রথযাত্রায় মহা ধুমধাম চলছে। ভক্তেরা পথের ওপর লুটিয়ে পড়ে করছে প্রণাম। রথের ওপর অধিষ্ঠিত রয়েছে মূর্তি। ভক্তগণের এ সমর্পণকে রথ, পথ আর মূর্তি ধরে নিচ্ছে তারা নিজেই দেবতা। এ অবস্থায় অন্তর্যামী হেসেছিলেন। তিস্তার পানি নিয়ে মতভিন্নতা সীমান্তের অপর পারের দেশটির সঙ্গে। দৈবদুর্বিপাকে বা প্রযুক্তিগত কারণে শৃঙ্খলিত তিস্তায় হঠাৎ কিছু বেশি পানি এলেও আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের সাফল্য বলে দাবি করছেন জোর গলায়। অবশ্য পানি আবার নেমে গেলে চুপ মেরে গেছেন। এসব জেনে প্রতিবেশীরা নিশ্চয়ই হাসেন। আমরা কাজের কাজ তেমন করতে না পারলেও অকারণে অন্যের হাসির খোরাক হতে পেরেছি বহুবার।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.