রাশিয়া-ইউক্রেন: ঘৃণা ছড়ানোর দিন by মশিউল আলম
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি রাশিয়ার
সশস্ত্র বাহিনীর ক্রিমিয়ায় ঢুকে পড়াকে ‘অবিশ্বাস্য আগ্রাসন’ বলে অভিহিত
করেছেন। কিন্তু সারা ইউক্রেনে ও রাশিয়ার কোথাও কোথাও এখন যা ঘটছে, তার
পুরোটাকেই আসলে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের
সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিকিতা খ্রুশ্চভের পুত্র সের্গেই খ্রুশ্চভ মঙ্গলবার
সকালে বিবিসি ওয়ার্ল্ডকে যেমনটি বলছিলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষ তিন দশক
আগে কখনো কল্পনাও করেননি যে তাঁরা একদিন ভিন্ন ভিন্ন দুটি স্বাধীন দেশের
মানুষ হতে পারেন।
রুশ ভাষায় ইউক্রেনের আরেকটা নাম আছে: ‘মালোরুসিয়া’ (মালায়া রুসিয়া বা ছোট রাশিয়া)। একসময় ‘কিয়েভস্কায়া রুস’ ছিল রুশ সাম্রাজ্যের নাম, যার কেন্দ্র ছিল আজকের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। রুশ কথাসাহিত্যের জনক, যাঁর ‘ওভারকোটের’ পকেট থেকে বেরিয়েছেন উনিশ শতকের রাশিয়ার সব কথাসাহিত্যিক, সেই নিকোলাই গোগল ছিলেন ইউক্রেনের সন্তান। মোট কথা, রুশ আর ইউক্রেনীয় দুটি ভিন্ন জাতিসত্তা—এটাই যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রুশ ভাষায় ইউক্রেনের আরেকটা নাম আছে: ‘মালোরুসিয়া’ (মালায়া রুসিয়া বা ছোট রাশিয়া)। একসময় ‘কিয়েভস্কায়া রুস’ ছিল রুশ সাম্রাজ্যের নাম, যার কেন্দ্র ছিল আজকের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। রুশ কথাসাহিত্যের জনক, যাঁর ‘ওভারকোটের’ পকেট থেকে বেরিয়েছেন উনিশ শতকের রাশিয়ার সব কথাসাহিত্যিক, সেই নিকোলাই গোগল ছিলেন ইউক্রেনের সন্তান। মোট কথা, রুশ আর ইউক্রেনীয় দুটি ভিন্ন জাতিসত্তা—এটাই যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মিখাইল গর্বাচভ যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের বিশাল সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘোষণা করতে বাধ্য হন, তখন আমরা পড়াশোনার সুবাদে মস্কোর বাসিন্দা। রাশিয়া, বেলারুশিয়া ও ইউক্রেন—এই তিনটি স্লাভ-অধ্যুষিত সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে সে সময় পৃথক হওয়ার কোনো দাবি ছিল না। যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে একটা নতুন ‘ইউনিয়ন চুক্তি’ স্বাক্ষর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিল, তখনো এমন ধারণাই প্রবল ছিল যে মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোসহ অন্যরা আলাদা হয়ে গেলেও রাশিয়া, বেলারুশিয়া ও ইউক্রেন একসঙ্গেই থাকবে। আমাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের মধ্যে বেলারুশ ও ইউক্রেনীয় ছিলেন অনেক। তাঁরাও মনে করতেন রাশিয়া, বেলারুশিয়া ও ইউক্রেন একসঙ্গে থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু গর্বাচভকে ক্ষমতাহীন করার মতলবে রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন ইউক্রেন ও বেলারুশিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট ক্রাভচুক আর শুশকেভিচের সঙ্গে যোগসাজশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করে ফেললেন। শেষে এক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্টি হলো ১৫টি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, ইউক্রেন যার একটি। কিন্তু রাশিয়া আর ইউক্রেন শত শত বছর ধরে এমন মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরও রুশ ও ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের জীবনে বিচ্ছেদের কোনো প্রভাব তেমন দৃশ্যমান হয়নি।
মস্কোর কিয়েভস্কি বাকজালে (কিয়েভ স্টেশন) ট্রেনে চেপে সোজা কিয়েভ শহরে পৌঁছে যাওয়া ছিল আগের মতোই সহজ। অসাধারণ স্থাপত্যমণ্ডিত মস্কোর মেত্রো স্টেশন ‘কিয়েভস্কায়া’র নামটিও অক্ষুণ্ন রেখে দিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ। একইভাবে ইউক্রেনের কিয়েভ, খারকভ, দানিয়েৎস্কসহ বিভিন্ন শহরে অটুট-অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে সোভিয়েত আমলের স্মারক স্থাপনাগুলো। লেনিনের একেকটা গগনচুম্বী মূর্তি আজও শোভা পাচ্ছে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে।
কিন্তু বিচ্ছেদের কুফল যেন অবধারিত ব্যাপার। স্বাধীন ইউক্রেনের মানুষের মনোজগতে গত দুই দশকে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ইউক্রেন তার অতিবৃহৎ প্রতিবেশী রাশিয়ার ছায়াকে ক্রমশ প্রকাণ্ড হতে দেখেছে। রাশিয়ার ভেতরেও রুশ জাত্যভিমান বাড়তে বাড়তে জার আমলের মাত্রায় উঠেছে। ভ্লাদিমির পুতিন তাদের কাছে নব্য রাশিয়ার নতুন জার। তাই রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে তাদের মোটেও পছন্দ নয় (অপছন্দের কারণ শুধু তাঁর রুশপন্থা নয়, তাঁর সীমাহীন দুর্নীতি-দুঃশাসনও বটে)।
তারা চায় ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে। তারা কিয়েভের স্বাধীনতা চত্বরের নাম দিয়েছে ‘ইউরো ময়দান’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের সহযোগিতা চুক্তি থেকে ইয়ানুকোভিচ পিছিয়ে গেলে যারা ওই ময়দানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তাদের কেউ কেউ পশ্চিমা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা আগামী ৪০০ বছর মস্কোর সঙ্গে সংস্রব রাখতে চাই না।’
এ পর্যন্ত ততটা খারাপ ছিল না। খারাপ হতে পারেনি আরও এই কারণে যে ইউক্রেনে রুশভাষী মানুষের সংখ্যা প্রচুর, পূর্ব ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ায় তো তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অবশ্য রাশিয়ার অভিযোগ, ইউক্রেনের রুশভাষী নাগরিকেরা উগ্র জাতীয়তাবাদী ইউক্রেনীয়দের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত তাদের সুরক্ষা দেওয়ার অজুহাতেই রাশিয়া ক্রিমিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছে (প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের অনুরোধে)। অবশ্য কিয়েভে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন এমন একজন বাঙালি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ইউক্রেনে রুশবিদ্বেষ তেমন দৃশ্যমান ছিল না, ইয়ানুকোভিচ ভেগে যাওয়ার আগে-পরের কয়েক দিন পুতিনের আচরণের ফলে সেটা দেখা দিয়েছে। এটা সহজেই বোধগম্য, কারণ পুতিনের আগ্রাসী আচরণ ইউক্রেনের জনসাধারণকে অবশ্যই রুশবিদ্বেষী করে তুলবে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনে রুশভাষীরা আক্রান্ত—এমন প্রচারণায় রাশিয়ার ভেতরেও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ব্যাপক। মস্কোতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্রিমিয়ায় রুশ বাহিনীর ঢুকে পড়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে মিছিল করেছেন। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী রুশ কিছু এলাকা যেমন: ভারানিওঝ, বেলগোরদ থেকে বাসে করে প্রচুরসংখ্যক রুশ সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনের খারকভ ও অন্যান্য শহরে ঢুকে ইয়ানুকোভিচপন্থীদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন—এমন খবর পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে।
অর্থাৎ রাশিয়া ও ইউক্রেনের নতুন শাসকদের মধ্যকার বিরোধ কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। উভয় দেশের রাজনীতিকদের ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাথায় যদি এখন দুষ্টবুদ্ধির খেলা ঘনিয়ে উঠতে থাকে, তাহলে তাদের প্রধান অস্ত্রই হবে ঘৃণা।
তবে স্বস্তির কথা হলো, কোনো অঞ্চল থেকে এখনো পর্যন্ত রক্তপাতের খবর আসেনি; কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল, শ্বাসরুদ্ধকর। কোথাও একটিমাত্র গুলি ফুটলেই সহিংসতার যে দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে, তার ভয়াবহতার মাত্রা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments